স্লিপিং মিউজিক

অলংকরণ: আরাফাত করিম

স্লিপিং মিউজিক ছাড়া ঘুম একেবারেই হয় না। প্রথম প্রথম যখন আমি ঘুমাতে না পেরে স্লিপিং বড়ি হজম করা শুরু করলাম, তখন এক বন্ধু আমাকে বলল এই মিউজিকের কথা। ওর কথায় প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না, কিন্তু কয়েক দিন বাদেই পুরোদমে বিশ্বাস করা শুরু করলাম। ও নিজেও শোনে এই মিউজিক। মিউজিকটা কার, আমি জানি না। তবে রাষ্ট্র থেকেও বলা হয়েছে, ঘুম না এলে এই মিউজিক শুনতে। কম্পোজিশনটা নাকি বিখ্যাত কোনো মিউজিশিয়ানের।

ব্যাপারটা প্রথম প্রথমে এতটাই ভালো লাগল যে বলে বোঝাতে পারব না। মিউজিক ছাড়ার দুই মিনিটের মাথায় এখন ঘুমিয়ে যাই। অথচ কয়েক বছর আগেও রাতে ঘুমাতেই পারতাম না। ইনসমনিয়ার মতো হয়ে গিয়েছিল।

আমি একটা করপোরেট হাউসে চাকরি করি। সারা দিন শুয়ে থাকাই আমার কাজ। অদ্ভুত মনে হলেও এটাই সত্যি। মাসিক বেতনও অনেক। এই টাকা দিয়ে পাঁচটা সংসার চালানো সম্ভব। হাউস আমাদের নিয়ে কোনো একটা পরীক্ষা চালাচ্ছে। সেটা সম্পর্কে অবশ্য জানা যায়নি। তবে লোকমুখে শুনি, ভবিষ্যতে মানুষকে আরও আরামে রাখার পরিকল্পনা হচ্ছে। আশপাশে মানুষদের দেখে অবশ্য বোঝাই যায়, তারা এখনো আরামেই আছে। খাদ্যের অভাব নেই। কারণ, ফুড ক্যাপসুল আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। একটা ক্যাপসুলেই সারা সপ্তাহ চলে যায়। হাগা-মুতার ব্যাপার নেই বললেই চলে। কারণ, কেউ পানিও পান করে না। দরকার হয় না আসলে। ওহ...গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা, পৃথিবীর ষন্ডামার্কা মানুষেরা চেয়েছিল জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করতে, সেটা করতে গিয়ে দেখা গেল, এখন জন্মহার এত কম যে ভবিষ্যতে মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে, এটা ভেবে সবাই–ই উদ্বিগ্ন। আমার কথাই ধরুন না। যখন আমার জন্ম হলো, সে বছর মাত্র সাত শিশু ভূমিষ্ঠ হয়। এতে সবাই নাকি খুব আনন্দ করেছিল। কোটি কোটি টাকা খরচ করে আমাকে দেখতেও এসেছিল দুনিয়ার অন্য প্রান্তের মানুষেরা। আর সেই আমি এখন ঘুমের অভাবে হাভাতে।

আমার মা ছিলেন শিক্ষক। বাবাও। তবে এখন আর শিক্ষকের প্রয়োজন নেই। এ আই-ই সব করে। মানুষেরও তেমন কোনো কাজ নেই। সবাই ঘোরে, ফেরে আর খায়। তবে আরেকটা গোষ্ঠী আছে, যারা গবেষণা করে। তারা ওপর মহলের। তাদের সঙ্গে আমাদের দেখা নেই বললেই চলে। আমি যেখানে কাজ করি, সেখানে গবেষণা তারাই করে। কিন্তু আমাদের আশপাশে কেউ আসে না। জানি না কী হচ্ছে সেসব জায়গায়।

স্লিপিং মিউজিক নিয়ে অনেক দিন গবেষণা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, নির্দিষ্ট সময়ে এই স্লিপিং মিউজিক আপনা-আপনি বেজে উঠবে। আর আমাদের ঘুমিয়ে যেতে হবে তখন। এটাও হবে, আমি নিশ্চিত। ২০২২/২৩ সালের দিকেও এসব মিউজিক মানুষ শুনত। তখন ইউটিউব নামে একটা অনলাইন প্লাটফর্ম ছিল। সেখানেই বেশির ভাগ মানুষ শুনত এই মিউজিক। তবে গবেষণা বলে, সেটা ছিল খুবই অল্প মানুষ। তখন পৃথিবীতে প্রায় ৭০০ কোটি মানুষ ছিল, সেই তুলনায় কিছুই না। বর্তমানে মানুষের সংখ্যা ১০০ কোটি। এদের প্রত্যেকেই এই মিউজিকের কথা জানে। কিছুদিন পর হয়তো সবাই-ই শুনবে।

রাতে স্লিপিং মিউজিক ছেড়ে শুয়ে পড়লাম। কী আশ্চর্য! শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীর কেমন যেন করে উঠল। আসলে সেক্স করতে মনে চাচ্ছিল। কিন্তু মিউজিকটা এমনভাবে বাজতে শুরু করল, আমি আর উঠে সেক্সডলটা আনতে পারলাম না। ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলাম।

সকালে ঘুম ভাঙল ঠিক দশটায়। ফ্রেশ হয়ে অফিসের দিকে যাওয়ার জন্য গ্রাউন্ড ফ্লোরে গেলাম। আমি থাকি টপ ফ্লোরে। ব্লিডিংটা ১০৩ তলা। ছাদের ওপর এক দিনই দাঁড়াতে পেরেছিলাম। দেখে মনে হচ্ছিল, সারা পৃথিবীই দেখছি। কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়। পরে রাষ্ট্রীয় নির্দেশ মোতাবেক ছাদে আর দাঁড়াইনি। তারা বলে, আপনারা ছাদে দাঁড়াবেন না। এটা বিপজ্জনক। অবশ্য কীভাবে বিপজ্জনক, তা আমি বুঝিনি। একদিন অফিসে গিয়ে শুয়ে শুয়ে জাফর ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম ছাদের ব্যাপারটা। তিনি উত্তরে বললেন, ‘তুমি যাতে সুন্দর দৃশ্য দেখতে না পাও, তোমার ভেতর যাতে সৌন্দর্যের ধারণা জন্ম না নেয়, সে জন্যই তোমাকে ছাদে দাঁড়াতে দিচ্ছে না।’

জাফর ভাই আগে কী এক পার্টি করতেন। সেখান থেকেই বোধ হয় শিখেছেন এসব। তাঁর কাছে আরও অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করে, কিন্তু তিনি কথা বাড়ান না। জিজ্ঞেস করলেই চুপ হয়ে যান। যেদিন আমাকে ওই সব কথা বলেছিলেন, তার পরদিনই তাঁকে প্রশাসন ধরে কী যেন একটা অপারেশন করে দিয়েছে। তাঁদের দলের আরও অনেককে ধরে এই কাজ করেছে। এখন তাঁরা কেউই ঠিকঠাক কথা বলতে পারেন না। আগে মাঝেমধ্যে মিছিল দেখতে পেতাম। তা এখন এতই কমেছে যে বছরে একটা কি দুটো দেখি। হয়তো ভবিষ্যতে আর দেখব না।

অফিস থেকে দেওয়া গাড়িতে উঠে পড়লাম। আমাকে চালাতে হয় না। রোবট আছে। সে-ই চালায় এবং এটিও জানে, কোথায় কোথায় যাব আমি।

আমার একই রুটিং—প্রতিদিন অফিস। অফিস শেষে কার্টুন শো। একই রকম শো হয় প্রতিদিন। আর শোতে দেখানো হয়, আমাদের কী কী করতে হবে এবং কী কী করা যাবে না। দেখতে দেখতে মুখস্থ হয়ে গেছে। গোপন একটা বই পড়েছিলাম। জাফর ভাই–ই দিয়েছিলেন একদিন। সেখানে সিনেমা নিয়ে কথা আছে। সিনেমা কী, আমি জানতাম না। তবে আমরা যেভাবে থিয়েটারে শো দেখি, লোকজন আগে সিনেমা দেখত এইভাবে—শুনে থ হয়ে গিয়েছিলাম। এ–ও সম্ভব! সিনেমাতে কী দেখানো হতো, সেটিও জেনেছিলাম। গল্প দেখানো হতো। গল্প কী? জানতাম না। এখন জানি। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার ওই বই পড়ার স্মৃতি লোপ পাচ্ছে। জানি না কেন!

অফিসে পৌঁছে লিফটে উঠলাম। ৭৮ নম্বর ফ্লোরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা মেসেজ দেখতে পেলাম পিসিতে। আগামীকালই আমার চাকরির শেষ দিন। জানতাম, এ রকম হবেই। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি, তা বুঝিনি। সারা দিন অফিস করে বাসায় চলে এলাম।

আজ আমার মন খারাপ। পিসি মনে করিয়ে দিল সেক্সডলের কথা। দুই মিনিট সেক্স শেষে ফ্রেশ হয়ে শুতে যাব, এমন সময় হুংকার দিল কলিংবেল। ভেতর থেকে দেখলাম, বাইরে প্রশাসনের লোকজন। খুলে দিলাম দরজা। অবশ্য আমি দরজা না খুললে তারা এখানে দাঁড়িয়েই থাকত। সকালে যখন খুলতাম, তখন ভেতরে ঢুকত। ওরা কাউকে ডিস্টার্ব করতে চায় না। এটাই বলে আরকি!

‘আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে। রাষ্ট্রীয় নির্দেশ।’ হাসিমুখে বলল।

আমি বললাম, ‘এখন তো আমার ঘুমের সময়।’

‘আচ্ছা। ঘুমিয়ে নিন। ঘুম থেকে উঠলেই আমাদের সাথে যাবেন। আমরা অপেক্ষা করছি।’

মনে মনে ভাবলাম, কত ভালো এরা। এদের প্রশিক্ষণ নিশ্চয়ই খুব ভালো হয়েছে। মুগ্ধ হলাম। মানুষ আগে যেমন কবিতা পড়ে, গান শুনে মুগ্ধ হতো, তেমন।

মিউজিক ছেড়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম ভেঙে ফ্রেশ হওয়ার পর তাদের দেখলাম, যেখানে তাদের রেখে ঘুমাতে গিয়েছি, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয়, এরা রোবট নয়তো? হতেও পারে!

‘চলুন তাহলে যাওয়া যাক।’

তারা খুশি হলো আমার কথায়। সম্মানের সঙ্গে রওনা হলো আমাকে নিয়ে।

একটা ফাঁকা জায়গায় এসে গাড়িটা থামল। রিমোট টিপতেই একটা জায়গা খুলে গেল। আলিবাবার গল্পের মতো। ভেতর থেকে বের হয়ে এল একটা স্বয়ংক্রিয় খাঁচা। সেটার দরজা খুলতেই আমাকে নিয়ে খাঁচার মধ্যে ঢুকে পড়ল তারা। নিঃশব্দে লক হয়ে গেল দরজা। আমরা নামতে লাগলাম। নামতে লাগলাম। নামতেই লাগলাম। মনে হচ্ছে সারা জীবন ধরে নেমে যাচ্ছি। শেষ হচ্ছে না।

কতক্ষণ পরে পৌঁছলাম, জানি না। খাঁচাটা থেকেও নেমে গেলাম।

আমাকে এবার একটা ঘরে বসানো হলো। তারা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এক হাস্যোজ্জ্বল মানুষ—কখনো মনে হয় পুরুষ, কখনো নারী—আমার সামনে এল। আমার ভালো–মন্দের খবর জিজ্ঞেস করার পর বলল, ‘আমরা দেখছি স্লিপিং মিউজিকে আপনার খুব দ্রুতই ঘুম চলে আসে। সে জন্যই আপনার আগের চাকরিটা থেকে আপনাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে আপনার নতুন কাজ হবে এখানে।’

‘কী কাজ?’ জিজ্ঞেস করলাম তাকে।

‘আপনাকে ঘুমাতে হবে; এবং তা অবশ্যই স্লিপিং মিউজিক শুনে। আপনাকে নিয়ে গবেষণা করব আমরা। এই স্লিপিং মিউজিককে আমরা আরও উন্নত করতে চাই। আশা করি, আপনি এই কাজে আমাদের সাহায্য করবেন।’

‘জি, অবশ্যই।’

সঙ্গে সঙ্গে মিউজিক বেজে উঠল। সেই চেনা সুর। আর আমি তলিয়ে গেলাম ঘুমের দেশে।

আসলেই কি তলিয়ে গেলাম, নাকি তীব্র এক ঘুম ডানা ঝাপটে এসে ছিনতাই করে নিয়ে গেল আমাকে!