একাত্তরে রংতুলি দিয়ে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন চারুশিল্পীরা

মুক্তিযুদ্ধের সময় চারুশিল্পের লড়াই ছিল অন্য ধরনের। ক্যানভাস আর রং–তুলির মাধ্যমে সেদিন তাঁরা ছিলেন অভূতপূর্ব এক যুদ্ধে। একাত্তরে কেমন ছিল সেসব চারুশিল্পীর যুদ্ধ!

১৯৭১ সালের অবরুদ্ধ বাস্তবতায় জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম ‘মুক্তিযোদ্ধা’
ছবি: সংগৃহীত

৯৪৭ সালে বাংলায় যে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটল, তার পটভূমিতে পরের বছরই ঢাকায় চারুশিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল। সূচনাকাল থেকে এই শিক্ষালয়ে চারুশিল্পীদের স্বদেশলগ্ন করে তোলার সচেতন প্রয়াস ছিল। এর ফল হলো, পরবর্তী সব প্রগতির সংগ্রাম ও স্বাধিকার আন্দোলনে বাংলাদেশের চারুশিল্পীদের ভূমিকা ছিল ইতিবাচকভাবে সক্রিয়। এরই পরিণতিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই অংশগ্রহণ করুন না কেন, তাঁদের অবদান ছিল সর্বতোভাবে গৌরবজনক। চারুকলা এমন একটি বিস্ময়কর অঙ্গন হয়ে উঠেছিল, যেখানে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি লোকেরও অস্তিত্ব ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই চারুশিল্পীদের সৃষ্টিকর্মে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব ছিল সর্বাত্মক। স্বাধিকারের সংগ্রামসহ মুক্তিযুদ্ধে চারুশিল্পীরা যে গভীরভাবে একাত্ম ছিলেন, সবার আগে তার পটভূমি ব্যাখ্যা করা দরকার।

১.

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে যে দেশাত্মবোধক জাগরণের সৃষ্টি হয়, চারুশিল্পীরা ছিলেন তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শহীদ মিনার নির্মাণ, শহীদ দিবস পালন ও এর প্রকাশনা, বিভিন্ন সাহিত্য সম্মেলনে অংশগ্রহণ প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের পুরো সময় অব্যাহত ছিল তাঁদের এই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৫৬ সালে শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা গৃহীত হলে শিল্পী হামিদুর রহমান ও ভাস্কর নভেরা আহমেদের নকশা অনুমোদিত হয় এবং সে অনুযায়ী ১৯৫৭ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ষাটের দশকের শেষ দিক থেকে, বিশেষত ১৯৬৮ সাল থেকে শহীদ দিবসকে কেন্দ্র করে শহীদ মিনারভিত্তিক প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠেন চারুশিল্পীরা। ১৯৬৮ সাল থেকে শহীদ মিনারে অঙ্কন ও লিখনের সমন্বয়ে রাজনৈতিক বার্তা বহনকারী ব্যানার প্রদর্শনী ছিল শিল্পীদের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ উপস্থাপনা। এই বছর থেকেই রাজপথে আলপনা আঁকার রীতি প্রবর্তিত হয়। প্রথম বছরই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে আজিমপুর কবরস্থান পর্যন্ত রাস্তাজুড়ে বাঙালি সংস্কৃতির নিদর্শন হিসেবে যে আলপনা আঁকা হয়, তা বাঙালি চেতনায় ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করে।

১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থানের পটভূমিতে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে স্বরবর্ণের ব্যানার প্রদর্শনীর মাধ্যমে উপস্থাপিত হয় বাঙালির সংগ্রাম, প্রতিবাদ ও বেদনার ভাষ্য। প্রতিবাদী ভাষার একটি নতুন রূপ পরিস্ফুটিত হয় এই প্রদর্শনীতে। মুস্তাফা মনোয়ার, রফিকুন নবী, হাশেম খানসহ প্রধান শিল্পীরা এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৯ সালে শিল্পীদের আঁকা প্রতিবাদী চিত্রও শহীদ মিনারে টানানো হয়েছিল। তাতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চিত্রও ছিল। একালে রাজনৈতিক পোস্টার ও ফেস্টুন লেখার কেন্দ্রভূমি ছিল চারুকলার হোস্টেল। শিল্পী রফিকুন নবীর উদ্যোগ ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ঊনসত্তুরের ছড়া নামে একটি প্রতিবাদী সংকলন। তিনিই পুরো সংকলনটির অলংকরণ করেন। লেখকতালিকায় ছিলেন শওকত ওসমান, সরদার জয়েনউদ্দীন, শওকত আলী, ফররুখ আহমদ, আল মাহমুদ, এখলাসউদ্দিন, রফিকুন নবী, সফিকুন নবী প্রমুখ।

১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ নবাগত সংবর্ধনা উপলক্ষে বাংলা একাডেমিতে দুই দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক উৎসবের যে আয়োজন করে, তার সঙ্গে চারুশিল্পীরা যুক্ত ছিলেন। মঞ্চসজ্জা, মঞ্চ পরিকল্পনা, প্যান্ডেলের ডিজাইন করা প্রভৃতি কাজে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, নিতুন কুন্ডু প্রমুখ সক্রিয় ছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে ১৯৭০ সালেও একুশকে কেন্দ্র করে শহীদ মিনারে ব্যানার প্রদর্শনী ও আলপনা আঁকার কাজ অব্যাহত ছিল। সেই সঙ্গে ওই বছর জয়নুলের পরিকল্পনায় বাঙালির ঐতিহ্যকে চিত্রায়িত করার অভিপ্রায়ে শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজন করা হয়েছিল ‘নবান্ন’ শীর্ষক এক প্রদর্শনীর (১৩-২২ ফেব্রুয়ারি)। প্রদর্শনীর জন্য আঁকা ‘নবান্ন’ শীর্ষক স্ক্রোলচিত্রটি জয়নুলের বিখ্যাত এক সৃষ্টি হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে। ১৯৭০ সালের বাংলা নববর্ষে আয়োজিত হয়েছিল ‘কালবৈশাখী’ নামে আরেক প্রতীকী প্রদর্শনীর। সেইকালে বাংলার বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে যথাযথভাবে উপস্থাপনের জন্য এই নাম ছিল যথাযথ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় শিল্পীদের আঁকা কয়েকটি অবিস্মরণীয় পোস্টার—প্রথমে শিল্পী কামরুল হাসানের আঁকা সেই বিখ্যাত কার্টুনচিত্র। এরপর ‘সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী’, ‘বাংলার মায়েরা মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’ ও ‘বাংলার হিন্দু বাংলার খৃষ্টান বাংলার বৌদ্ধ বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালী’
ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে শহীদ মিনারে শিল্পীদের প্রতিবাদী উপস্থাপনা পূর্ববর্তী বছরের মতো শুধু অব্যাহতই ছিল না, আরও ব্যাপক রূপ ধারণ করেছিল। একটি প্রাসঙ্গিক তথ্য হলো, ১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের একুশের সংকলন–এর প্রচ্ছদ অঙ্কন, ভেতরের অলংকরণ, এমনকি লেখার পরিকল্পনা প্রভৃতির সঙ্গে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীসহ অন্য শিল্পীরা সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এটি বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ, ষাটের দশকে স্বাধিকার আন্দোলনে ব্যাপকভাবে সক্রিয় প্রগতিশীল এই ছাত্রসংগঠন শিক্ষার্থীদের উন্নত রুচিস্নিগ্ধ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ফলে তারা তাদের কাজকে সার্থক করে তোলার অভিপ্রায়ে চারুশিল্পীদের যুক্ত করেছে। শিল্পীরাও দেশাত্মবোধ থেকে আন্তরিকভাবে তাদের কাজের সঙ্গে একাত্ম থেকেছেন।

১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ময়মনসিংহে মাওলানা ভাসানী আহূত এক জনসভায় জয়নুল আবেদিন বক্তৃতা দেন এবং পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত খেতাব ‘হিলাল-ই-ইমতিয়াজ’ প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেন। তারপর এল ১৯৭১–এর উত্তাল মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের ঘটনা। গঠিত হলো ‘বাংলা চারু ও কারু শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ’। এর যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ও মুর্তজা বশীর। এই পরিষদের উদ্যোগে ১৬ মার্চ তারিখে ‘স্বা ধী ন তা’ শীর্ষক এক মিছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বের হয়ে বাহাদুর শাহ পার্কে গিয়ে শেষ হয়। জয়নুল আবেদিন ছিলেন এই মিছিলের পুরোভাগে। মিছিল শেষে তিনি বক্তৃতাও দেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতার পরিপ্রেক্ষিতে এমন একটি মিছিলের আয়োজন করতে চারুশিল্পী সমাজ উদ্বুদ্ধ হয়েছে, এ কথা ঠিক। কিন্তু তখনকার উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে এটি ছিল নিঃসন্দেহে দুঃসাহসী কর্মসূচি। শিল্পী কামরুল হাসান মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় ঢাকার হাতিরপুল এলাকার সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছেন। সরকারি কর্মকর্তা হয়েও অফিসে যাওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। শিল্পী ইমদাদ হোসেনও সরকারি চাকরিজীবী হয়েও ছিলেন ষাটের দশকের স্বাধিকার আন্দোলনসহ অসহযোগ আন্দোলনে সর্বতোভাবে সক্রিয়। কামরুল হাসানের আঁকা ইয়াহিয়ার দানবমূর্তি শীর্ষক কার্টুনসংবলিত অন্তত ১০টি পোস্টার ২৩ মার্চ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রথম প্রদর্শিত হয়। ২৫ মার্চ কালরাতে তাঁকে আমরা দেখি হাতিরপুল এলাকায় নিজ বাসার কাছে ট্রেঞ্চ খোঁড়ার কাজে তরুণদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মধ্যরাতে অপারেশন সার্চলাইটে নেমে পড়লে তিনি বিরত হন। ৪ এপ্রিল কলকাতার উদ্দেশে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। জয়নুল আবেদিন ২৯ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত কেরানীগঞ্জে আত্মগোপনে ছিলেন; বাকি সময় শত্রুমুক্ত দেশের প্রতীক্ষায় অবরুদ্ধ ঢাকায় নিজের বাসায় থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেন।

১২ এপ্রিল কলকাতায় পৌঁছানোর পর প্রবাসী সরকারের কাজে যুক্ত হন কামরুল হাসান। কামরুল হাসানের নেতৃত্বে প্রবাসী সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের অধীনে গড়ে ওঠে আর্ট ও ডিজাইন বিভাগ। এ বিভাগে তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুন্ডু, প্রাণেশ মণ্ডল, জহির আহমদ, হাসান, বীরেন সোম প্রমুখ। তাঁদের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কতগুলো পোস্টার তৈরি করে তা প্রচার করা হয়। এর মধ্যে বিখ্যাত হয়ে আছে কামরুল হাসানের আঁকা ইয়াহিয়ার দানবীয় মুখাকৃতির কার্টুনসংবলিত পোস্টারটি। ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ বাংলা ও ইংরেজি ক্যাপশনে এর দুটি রঙিন ভাষ্য প্রকাশ করা হয়। বাংলা ভাষ্যটি আবার এক রঙে লক্ষাধিক কপি ছাপিয়ে মুক্তাঞ্চলে বিলি করা হয়। একটি শিল্পকর্ম কীভাবে শত-সহস্র মুক্তিযোদ্ধাসহ লক্ষ-কোটি মানুষের অনুপ্রেরণা ও উজ্জীবনের কারণ হতে পারে, হয়ে উঠতে পারে যুদ্ধেরই হাতিয়ার, এই পোস্টার হয়ে আছে তার উত্তম দৃষ্টান্ত। অন্যান্য পোস্টারের কয়েকটির ভাষা এ রকম: ‘সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী’, ‘বাংলার মায়েরা মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’, ‘বাংলার হিন্দু বাংলার খৃষ্টান বাংলার বৌদ্ধ বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালী’। অন্যদিকে বাংলাদেশের শিল্পীদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি নিয়ে কলকাতার বিড়লা একাডেমিতে আয়োজিত হয় এক প্রদর্শনী। কামরুল হাসান, দেবদাস চক্রবর্তী, মুস্তাফা মনোয়ার, নিতুন কুন্ডু, প্রাণেশ মণ্ডল, নাসির বিশ্বাস, বীরেন সোম, স্বপন চৌধুরী, কাজী গিয়াস, চন্দ্রশেখর দে, রণজিৎ নিয়োগী, হাসি চক্রবর্তীসহ ১৭ জন শিল্পীর ৬৬টি শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে স্থান পায়।

প্রবাসী সরকারের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একদল শিল্পীর এসব কার্যক্রমের পাশাপাশি অনেক শিল্পী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। গেরিলা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সৈয়দ আবুল বারক আলভী। তিনি ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন। শাহাবুদ্দিনের মতো শিল্পীরা সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আর অনেকে ঢাকায় অবস্থান করে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে নানাভাবে তাঁদের সহযোগিতা করে গেছেন। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ নাম শিল্পী রফিকুন নবীর। ২৫ মার্চ কালরাতে চারুকলার হোস্টেলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন শিল্পী শাহনেওয়াজ।

১৯৭১ সালে জয়নুল আবেদিন দেশের অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতেই আঁকেন লড়াকু ‘মুক্তিযোদ্ধা’র গতিময় প্রাণবন্ত চিত্র। কামরুল হাসান কলকাতায় কালো কালিতে আঁকেন ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ও ‘নারী মুক্তিযোদ্ধা’ শীর্ষক চিত্রদ্বয়। সফিউদ্দীন আহমেদ অবরুদ্ধ ঢাকার আতঙ্কজনক পরিস্থিতিকে নিজের যে ভীতিবিহ্বল চোখ দিয়ে প্রত্যক্ষ করেন, সেই চোখকেই প্রতীক করে পরবর্তীকালে এঁকেছেন একাধিক চিত্র। এস এম সুলতান, মোহাম্মদ কিবরিয়া, রশীদ চৌধুরীসহ সব শিল্পীর কাজেই মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষণীয়।

২.

ষাটের দশকে বাংলাদেশের চিত্রশিল্পে সংঘটিত বিমূর্ততার প্রসারকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাধাগ্রস্ত করে চিত্রের জমিনে নতুন করে অবয়বের উজ্জীবন ঘটিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় জীবনে যে স্বপ্নপূরণের নতুন আনন্দঘন পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছিল, তা বাংলাদেশের চারুশিল্পের ক্ষেত্রকেও করেছিল উর্বর ও আশাবাদী চেতনায় ভাস্বর। হতাশা, বিমর্ষতা, নেতিবাচকতা, জীবন থেকে পলায়নপরতা প্রভৃতি চিত্রের জমিনে যে ধূসরতা ও অন্ধকারের গহ্বর সৃষ্টি করেছিল, মুক্তিযুদ্ধ সেখানে নিয়ে এসেছিল উজ্জ্বল আলোর ব্যাপ্তি, আবেগের প্রচণ্ড গতি। জয়নুলের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ চিত্রটির দিকে তাকালেই চোখে পড়বে আবেগের এই দুরন্ত বেগময়তা। অস্ত্র হাতে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যে উদ্দাম গতিতে বীরদর্পে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছেন, তা বিজয়ী বাহিনীর সাফল্যময় পদবিক্ষেপের এক দ্যোতনার সৃষ্টি করছে। তাঁরা গ্রামের অশিক্ষিত তরুণ হতে পারেন, তাঁরা উত্তম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না হতে পারেন, কিন্তু মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তাঁরা যে অকুতোভয়, প্রাণ বিসর্জনে নির্ভীক সংকল্পবদ্ধ, তা তাঁদের পেশি সঞ্চালনসহ দুর্বার গতিময়তার মধ্য দিয়েই সুপরিস্ফুট। অন্যদিকে কামরুল হাসান প্রকৃতির পটভূমিতে এঁকেছেন ‘নারী মুক্তিযোদ্ধা’র যে চিত্র, তার প্রতীকী মূল্য অসামান্য।

মুক্তিযুদ্ধ বদলে দিয়েছে চিত্রশিল্পীদের ভাবনার জগৎ, বিরচন কৌশল, রং ব্যবহারের টেকনিক, চিত্রতলের মেজাজ, ইমেজ ও মোটিফ ব্যবহারের পরিকল্পনা। নতুন উদ্দীপনা, প্রাণবন্ততা ও আশাবাদ তাঁদের চিত্রে এনেছে ইতিবাচক জীবনবোধ আর স্বাদেশিকতার সীমাহীন বিস্তার। মানবীয় শক্তির প্রতি বিপুল আস্থা তাঁদের চিত্রতলকে অবয়বের নান্দনিক উৎসারণে উদ্দীপ্ত করেছে। চিত্রতলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানুষের আধিপত্য। সেই সঙ্গে বিস্তারিত হয়েছে শিল্পীদের সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমও। স্বাধীন দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ মুক্তাঙ্গনে ভাস্কর্য সৃষ্টিতে তাঁদের করেছে অনুপ্রাণিত, সাহসী ও শক্তিশালী। সুতরাং চারুশিল্পের জগতে মুক্তিযুদ্ধের এই প্রভাবকে ঐতিহাসিকভাবে অনন্য অর্জন হিসেবেই চিহ্নিত করতে হবে।

Cap: