এক দিন

এ বছরের নোবেলজয়ী আবদুলরাজাক গুরনাহর উপন্যাস ‘দ্য লাস্ট গিফট’ থেকে

অলংকরণ: আরাফাত করিম

ভূমিকা

২০১১ সালে বেশ কাকতালীয়ভাবেই আবদুলরাজাক গুরনাহর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তখন তাঁর নাম জানতাম না। তিনি মেলবোর্নে এসেছিলেন লেখক-পাঠক সম্মেলনে। সেদিন তাঁর সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস দ্য লাস্ট গিফট নিয়ে বলেছিলেন। বলছিলেন, চারজন মানুষকে কেন্দ্র করে এর গল্প—আব্বাস, মরিয়ম, হানা ও জামাল। তখন আব্বাস চরিত্রের সঙ্গে লেখকের নিজের জীবনের বেশ কিছু মিল নিয়েও কথা হয়েছিল।

বহু বছর ধরে যুক্তরাজ্যে থাকার পরও আব্বাস একে নিজের দেশ ভাবতে নারাজ। অন্যদিকে আবদুলরাজাকের জন্ম জানজিবারে। তিনি যুক্তরাজ্যবাসী ষাটের দশকের শেষ থেকে। তবে কথায় কথায় সেদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘যদি আমাকে হঠাৎ কেউ ঘুম থেকে তুলে জানতে চায়, তোমার দেশ কোথায়? আমি খুব সম্ভবত বলব—জানজিবার, যদিও আমার জীবনের বড় অংশ কেটেছে যুক্তরাজ্যে।’ তাঁর এই কথাটা আমার মনেও খুব দাগ কেটেছিল। কেননা, আমিও কৈশোর থেকে অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসী। তবু নিজেকে বাংলাদেশিই মনে করি।

সেদিনের কথোপকথনে আবদুলরাজাক গুরনাহর বলা আরও একটা কথা মনে আছে আমার, ‘একজন মানুষ আসলে সারা জীবন ধরে একটাই গল্প বলে।’

দ্য লাস্ট গিফট উপন্যাসে আব্বাস সারা জীবন পরিবারের কাছে কিছু একটা গোপন রাখে। তার স্ত্রী মরিয়ম এবং ছেলে ও মেয়ে জামাল ও হানা জানে না সে কোথা থেকে এসেছে বা তার পরিবারে কে কে ছিল। এ নিয়ে একটা নীরব চাপ থাকে সবার মনেই।

বইটি শুরু হয়েছে এক শীতকালের অফিস শেষে বাড়ি ফেরার মুহূর্ত থেকে। সেদিন বাসে ফিরতে ফিরতে আব্বাস অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রথম কিছু অংশের বর্ণনায় টের পাওয়া যায়, যে শহরে আব্বাস বসবাস করে, তা তার কতটা অনাত্মীয়, বন্ধুহীন। মরিয়মের সঙ্গে তার সবচেয়ে বড় মিল হলো স্বজনহীনতা।

ওদিকে জন্মের পরপরই হাসপাতালের বারান্দায় মরিয়মকে ফেলে গিয়েছিল তার মা, সঙ্গে একটা চিরকুট, ‘ওরা আমাকে বাচ্চাটা রাখতে দেবে না। ওর নাম মরিয়ম।’ এরপর বিভিন্ন পালক মা-বাবার হাতবদল হয়ে মরিয়ম আশ্রয় পায় এক্সেটার শহরে, এক দম্পতির কাছে। তার পালক বাবার নাম বিজয়, দেশ ভারতবর্ষ; আর পালক মায়ের নাম ফিরুজ, দেশ মরিশাস। এ শহরেই সতেরো বছর বয়সে মরিয়মের সঙ্গে পরিচয় হয় আব্বাসের এবং বাড়ি থেকে পালিয়ে মরিয়ম চলে আসে আব্বাসের সঙ্গে।

আব্বাসের অসুস্থতাকে কেন্দ্র করেই তার অতীতবিষয়ক প্রশ্নটি সবার মনে ছায়া ফেলে, এমনকি আব্বাসের নিজের মনেও। সে ভাবতে থাকে, তার পরিবারকে শেষ উপহার দেওয়ার সময় হয়তো এসেছে।

এখানে অনূদিত অংশটুকু ‘ওয়ান ডে’ অধ্যায় থেকে নেওয়া, যেখানে আব্বাস হাসপাতালের বিছানায় শায়িত। এখনো অচেতন। আর তার ছেলে জামাল বসে আছে বাবার পাশে।

এখন আর মনে নেই তার মায়ের পরিত্যক্ত হওয়ার কাহিনিটা সে শুরুতেই সত্যি বলে মেনে নিয়েছিল কি না। না মানারই কথা। সে সময়ে তার মনের ভেতরের পরিচিত জগতের সঙ্গে বাইরের কোনো কিছুর মিল না থাকায় অবিশ্বাস কী করে করতে হয়, সে জানত না। তবে কোনো না কোনো সময়ে নিশ্চয়ই সে টের পেয়েছিল গল্পটা সত্যি আর তখন মায়ের উন্মোচিত যেকোনো নতুন তথ্যই সে আঁকড়ে ধরতে চাইত। সে কৈশোরে পৌঁছালে, যখন আরেকটু খোলাখুলিভাবে তার সঙ্গে কথা বলা যেত, তার মা কথাগুলো বলার জন্য নিজস্ব একটা ধরন বেছে নিয়েছিল। এসব সময়ে জামাল খুব সাবধান থাকত, কিছুতেই চাইত না মা মাঝপথে বাধা পেয়ে থেমে যাক।

হানা অনেক কম বাধ্য ছিল, সে তার চাওয়াগুলো মায়ের কাছ থেকে আদায় করে নিতে জানত। সে বিভিন্ন ঘটনার আরও বিস্তারিত বর্ণনা দিতে বলত, বিভিন্ন মানুষের নাম অথবা তাদের পরিণতি জানতে চাইত, এক্সেটার এখান থেকে কত দূর? তোমার বাবা আর মা এখন কোথায় থাকে? মরিশাসের নামটা কোথা থেকে এল? এই সব প্রশ্ন তাদের মাকে নানা রকম ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য করত। যার ফলে বয়ানের অন্তরঙ্গ ভঙ্গিটা হারিয়ে যেত।

মা একা থাকলে জামাল তাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে কথা বলতে দিত। সে নিবিড় একাগ্রতায় খেয়াল করত, কেমন করে তার মা সতর্কভাবে একেকটা ছবিতে গভীরতা মেশাচ্ছে—কখনো থেমে থেমে ভুলে যাওয়া কোনো বর্ণনাকে ফিরে আসার সময় দিয়ে, কখনো হঠাৎ মনে পড়া কোনো ঘটনায় অবাক হয়ে। বিবরণে কোনো অসংগতি দেখলেও জামাল পারতপক্ষে কিছু বলত না। যদিও তখনো তার জানা ছিল না যে গল্পেরা স্থির থাকে না, প্রতিটা নতুন অনুসরণের সঙ্গে সঙ্গে তারা সূক্ষ্মভাবে রূপ বদলায়, নতুন করে নিজেদের সাজায়, আর যা কিছুই অসংগতি বলে মনে হয়, হয়তো সেসবই বস্তুত কী হতে পারত আর অনিবার্য পুনর্বিবেচনা। সে সহজাতভাবেই একজন ভালো শ্রোতা ছিল এ সমস্ত কিছু না জেনেই।

একবার, তখনো সে মা-বাবার সঙ্গেই থাকত, মা এক্সেটারের এক প্রচণ্ড শীতকালের কথা বলছিল, যেবার সবকিছু জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল। এক কথা থেকে আরেক কথায় যেতে যেতে তার মা স্মৃতিচারণা করছিল আর তারপর বিভিন্ন কথা ভেবে মন খারাপ করছিল—সেই ১৯৭৪-এর পর সেখানে আর যাওয়া হয়নি, কত বন্ধুর সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই, ফিরুজের কথাও বলছিল। বাবা তখন ঘরে ছিল, একটা ক্রসওয়ার্ড মেলাচ্ছিল, মরিয়মের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে হঠাৎ বিকট জোরে বলে উঠল, ‘আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুব আনন্দিত হয়েছি, মিস্টার বুটস!’ তাদের প্রথম সাক্ষাৎ নিয়ে এটা ছিল একটা পুরোনো তামাশা।

মা হেসে বাবার দিকে চেয়ে বলেছিল, ‘তারপরও মনে হয় যদি ফিরুজকে খুঁজে পেতাম।’

জামাল জানত মা তার পালক মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে কিন্তু খুঁজে পায়নি। এ বিষয়ে তারা সবাই জানত, হানা জন্মানোর পর মরিয়ম কত আকুলভাবে পালক মা-বাবাকে খুঁজেছে, ফিরুজের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলার পর আফসোসের কথা তার মা বহুবার বলেছে। তবে এভাবে বাবার সামনে কখনোই বলেনি, অন্তত জামাল কখনো শোনেনি। যখন বলল, বাবা নাখোশ চোখে তাকাল তার দিকে।

‘ওই সব লোককে নিয়ে এত চিন্তা কিসের তোমার?’ হঠাৎ রাগত গলায় বলল বাবা। নিজের গলার রাগটা হয়তো নিজের কানেই বেজেছিল, তাই আবার বলার সময় তার কণ্ঠস্বর ছিল স্থির ও আপসমূলক, ‘তারা তো তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি। তুমি অন্তত তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছ—আমি নিশ্চিন্তভাবে বলতে পারি, তারা তোমার জন্য এইটুকু কখনোই করত না। তুমি চেষ্টা করেছ, ব্যর্থ হয়েছ, আর তো কিছু করার নেই, তাই না? ওদের ভুলে যাও।’

খুব টান টান মুহূর্ত ছিল সেটা, জামাল দেখেছিল তার বাবা আবার তার ক্রসওয়ার্ডে চোখ ফেলার আগপর্যন্ত মা অপলক বাবার চোখে চোখ রেখেছিল। সে বুঝেছিল, বাবার দিকে মায়ের ওই চাহনিটা ছিল একটা চ্যালেঞ্জ—আমি তাদের ভুলতে চাই না। আমি তোমার মতো হতে চাই না। কী এমন হয়েছিল, যা এতই খারাপ যে তার পালিয়ে আসতে হয়েছে, আবার নিশ্চয়ই এত খারাপ কিছুও না, নয়তো মা কেন আবার পালক মা-বাবাকে খুঁজতে আকুল হবে? হয়তো সে রকম নির্দিষ্ট কোনো ঘটনাই ঘটেনি। সতেরো বছরের একটা মেয়ে খুব আবেগপ্রবণ কিছু একটা করে ফেলেছিল, তারপর ভুল স্বীকার করতে দেরি হয়ে গেছে। এই সময়গুলোতেই নিজেদের একটা অদ্ভুত পরিবার বলে বোধ হতো, এই সব মুহূর্ত—যাদের দিকে অগ্রসর হয়েও আবার তারা ফিরে আসত—এই সব গল্প আর ঘটনা, যা খুব সংক্ষিপ্ত আর অপ্রত্যাশিতভাবে আবির্ভূত হয়েই বিলম্বিত নীরবতা ও নিষ্পলক চাহনির মধ্যে হারিয়ে যেত।

বাবা কেন তার অতীত নিয়ে সব সময় এত নীরব? হাসপাতালের বিছানায় শায়িত তার বাবার ঊরুতে আলতো হাত বোলায় জামাল। ‘কী এমন করেছিলে তুমি, বলো তো? আমাকে শুনতে পাচ্ছ? নিশ্চয়ই তোমার অবস্থা অত খারাপ না, নইলে তো এতক্ষণে ওরা তোমার শরীরে কয়েক রকম ফুটো করে, সেখানে টিউব লাগিয়ে তোমাকে মেশিনের সঙ্গে গেঁথে ফেলত,’ সে বলে ওঠে।

হঠাৎই আব্বাস চোখ মেলে, শূন্য দৃষ্টিতে একপলক চেয়েই চোখ বোজে। সেই আচমকা রক্তাভ চাহনিতে কেঁপে ওঠে জামাল, যেন মৃত কেউ কথা বলে উঠেছে, সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে তার নিষ্ঠুর মনে হয়। মৃদু স্বরে সে বলে, ‘তোমার মোটেই তেমন অসুখ করেনি, এই তো কেমন হ্যামকে দোল খাওয়া রাজার মতো রাগী চোখে তাকাচ্ছ।’ তারপরই খেয়াল করল বাবার নিশ্বাস বদলে গেছে, একটা কাঁপা কাঁপা ভাব। সে কি কাউকে ডাকবে? বিছানা ঘিরে থাকা পর্দার ওপাশে সে হাসপাতাল কর্মীদের নড়াচড়া শুনছিল। খানিকক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাসের পর বাবার শ্বাসপ্রশ্বাস আবার স্বাভাবিক হয়ে এল। ঘুমন্ত বাবার পাশে বসে থাকতে অদ্ভুত লাগছিল, এ রকম অসহায়ের মতো শুয়ে থাকতে বাবাকে কখনো দেখেনি সে। সাধারণত বাবার ঘুম এতটাই মৃদু যে কখনো যদি অসম্ভাব্য সুযোগে তাকে ঘুমন্ত দেখাও যায়, এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাবা নড়ে উঠবে। হয়তো তার টান টান স্নায়ু এখনো কাজ করে যাচ্ছে আর জামালের কণ্ঠস্বর সমস্ত ওষুধ ভেদ করে তার চোখ খুলে দিয়েছে।

জামাল তার বাবার পায়ে আবার হাত বোলায়, আর ও রকম আমাকে ভয় দেখিয়ো না। এখন বিশ্রাম নাও। তুমি কেন কখনো তোমার ফেলে আসা পরিবারের কথা বলো না? কারণ, সে কখনোই বলেনি, এক কৃপণ বাবা আর অত্যাচারিত মায়ের ঝাপসা একটা ধারণার বেশি কিছুই না। মাঝেমধ্যে, প্রায়ই, সে তার নাবিকজীবনের—বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের গল্প বলত অথবা ইলেকট্রনিক কারখানায় ইঞ্জিনিয়ারের কাজটা পাওয়ার আগে আরও কত বছর ধরে কত রকম অকথ্য কাজ তাকে করতে হয়েছে জীবন ধারণের জন্য, সে গল্প বলত। কিন্তু তার পরিবার অথবা সে কোত্থেকে এসেছে, সে সম্পর্কে কিছুই বলত না কখনো।

যখন ছোট ছিল, শিশুতোষ সারল্যে হানা আর জামাল জানতে চাইত তাদের দাদা-দাদির কথা, তারা কোথায়, তারা কেমন এবং এ রকম আরও অনেক প্রশ্ন, বেশির ভাগ সময় তাদের বাবা এসব প্রশ্ন এড়িয়ে যেত—কখনো হাসিমুখে, কখনো হাসি ছাড়া। ওই সব তোমাদের শুনতে ভালো লাগবে না, সে বলত। মাঝেমধ্যে, অল্পস্বল্প কিছু সে বলত, জামালের মনে হতো খুব দামি কিছু কথা, তবে সুনির্দিষ্ট দানা বাঁধার মতো কিছু না। যেন সে একটা ঘোরের মধ্যে বলে ফেলত কথাগুলো, যেন তার কল্পনার ছোট একটা টুকরো সে তুলে ধরেই অন্ধ করা আলোর ঝলকানিতে তা ভাসিয়ে দিত।

জামালের মনে আছে, এক বড়দিনে বাবা তাদের গোলাপজলের কথা বলেছিল, উৎসবের সময় এভাবেই আমরা অতিথিদের স্বাগত জানাতাম। ঈদের প্রথম দিনে লোকে একে অপরের বাড়ি যেত ঈদ মোবারক জানাতে আর একসঙ্গে কফি পান করতে, আর যথেষ্ট সচ্ছল হলে সঙ্গে হালুয়াও থাকত। কোনো কোনো বাড়িতে মেহমানদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য তাদের হাতে অথবা মাথার চুলে হালকা করে গোলাপজল ছিটানো হতো রুপালি গোলাপদানি থেকে।

যখন হানা আরও প্রশ্ন করত, কারণ, সে সেই সব মানুষ সম্পর্কে, তারা যে বাড়িতে বেড়াতে যেত, সেই সবকিছু সম্পর্কে জানতে চাইত—জামালও জানতে চাইত, কিন্তু প্রশ্ন করার বিষয়ে সে হানার মতো নির্ভীক ছিল না—বাবা তাদের জানাত কী করে গোলাপের পাপড়ি থেকে গোলাপজল পতিত হতো আর কীভাবে তা বিভিন্ন খাবার এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হতো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে—চীন থেকে আর্জেন্টিনা। বাবা তাদের ঈদ সম্পর্কে বলত এবং সে সম্পর্কে ভ্রমণবৃত্তান্ত হাজির করত—একেক দেশে ঈদ একেক রকম করে পালন করা হয়, চান্দ্রবর্ষের কোন মাসে ঈদ পালিত হয়, চান্দ্রবর্ষ কাকে বলা হয়। যখন তারা তাদের বাবার জন্মভূমির কথা জানতে চাইত, বাবা বলত, সে হলো আফ্রিকার এক বাঁদর।