অলংকরণ: আরাফাত করিম

আর্জেন্টাইন গল্পকার হোর্হে লুইস বোর্হেসের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তত একটি সম্পর্কের কথা জানা ছিল আমার। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এ জনপদে ১৯৭১ সালে যে গণহত্যা চালায়, জানতাম, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর মতো আরও কিছু লেখকসহ বোর্হেস সেটার বিপক্ষে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনা সরকারকে। তবে সম্প্রতি বোর্হেসের সঙ্গে বাংলাদেশের আরও একটি সংশ্লিষ্টতা আমি খুঁজে পেয়েছি। জেনেছি, পুরোনো পুঁথির খোঁজে সত্তরের দশকে বাংলাদেশে এসেছিলেন বোর্হেস।

আবিষ্কারটা ঘটেছে নিছক ঘটনাক্রমে। ১৯৬৩ সাল থেকে ঢাকা নিউমার্কেটে বইপ্রেমীদের বিচরণক্ষেত্র হয়ে থাকা জিনাত বুক সাপ্লাই যে চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল মাস কয়েক আগে, প্রচুর পুরোনো বই তারা তখন কম দামে ছেড়ে দিয়েছে। জনৈক সারোয়ার ইকবালের পুঁথি-সংগ্রাহকের তিন দশকের অভিজ্ঞতা নামের পুরোনো বইটা আমি সেখানেই খুঁজে পাই। দেখি, হলদে পাতার বইটার মাঝের অংশে আর্ট পেপারে ডজন দুয়েক সাদাকালো ফটোগ্রাফও বসানো। লেখকের সংগৃহীত কিছু পুঁথির ছবি, বিভিন্ন সভায় বক্তব্যরত লেখক—এমন সব ফটোর মাঝে আলাদা করে চোখ গেল যে ছবিটায়, সেখানে হাতে কোনো পুঁথি নিয়ে পুরোনো দিনের সোফায় বসে আছেন তিনজন হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। মাঝের মানুষটি লেখক, বাঁ দিকের ব্যক্তি অচেনা। তবে তৃতীয় মানুষটির চোখে কালো চশমা থাকলেও তাঁকে চিনতে আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না, মাঝবয়সের অন্ধত্ব বরণ করা বোর্হেসের অজস্র ফটো আমি দেখেছি।

ছবিটা দেখে যথেষ্ট অবাক হয়েছিলাম আমি। সময় নষ্ট না করে তাই জিনাত থেকে কেবল ওই বই নিয়েই চলে গেলাম নর্থ এন্ডে। আর সেই কফিশপে বসেই পরের তিন ঘণ্টায় যখন শেষ করলাম বইটা, চমকপ্রদ এক ঘটনা তখন আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। জানা গেল, ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামে এসেছিলেন বোর্হেস, সেই সফরে সারোয়ার ইকবালের কাছ থেকে সপ্তসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা নামের দ্বাদশ শতাব্দীর একটি দুষ্প্রাপ্য পুঁথি কিনেছিলেন তিনি। রাজা হরিবর্ম দেবের পৃষ্ঠপোষকতায় সেই পুঁথি রচনা করেছিলেন শিলাদিত্য। পুঁথিটা কিনতে ইকবাল সাহেবের সঙ্গে বোর্হেস সাক্ষাৎ করেন হোটেল আগ্রাবাদের অষ্টম তলায়, ছবিটা সেখানেই তোলা।

ঐতিহাসিক এ তথ্যের আবিষ্কারে এত উত্তেজিত বোধ করলাম যে সেই সন্ধ্যায় পরিচিত বোর্হেসপ্রেমীদের নিয়ে একটা আড্ডা পর্যন্ত ডেকে ফেললাম আমি। গল্পকার শিবব্রত বর্মন, কবি হাসনাত শোয়েব, অনুবাদক মিম আরাফাত মানব আর স্প্যানিশ ভাষার শিক্ষক প্রিতম পালকে সেখানেই খুলে বললাম ব্যাপারটা। বইয়ের ছবি দেখে আর বর্ণনা পড়ে সবাই আমার মতোই অবাক। ছবির তৃতীয় মানুষটিকে অবশ্য আমার মতোই কেউ চিনতে পারল না। সারোয়ার ইকবালও তাঁর লেখায় ওই ভিনদেশি তরুণের নাম উল্লেখ করেননি, শুধু বলেছেন, বোর্হেস তাঁকে ডাকছিলেন ‘মারিও’ বলে।

বেঙ্গল বইয়ের চত্বরে সেই সন্ধ্যায় লম্বা আলাপের পর ঠিক হলো, সারোয়ার ইকবাল আর বোর্হেসের ওই বাংলাদেশ সফর প্রসঙ্গে খানিক ঘেঁটে দেখা উচিত আমাদের।

আমি তাই কয়েকটা দিন খুব খোঁজাখুঁজি করলাম ইন্টারনেটে। কোথাও বোর্হেসের বাংলাদেশ সফর বিষয়ে কিছু লেখা নেই। কেবল ব্রুকলিন ইনস্টিটিউট অব ক্রিয়েটিভ লিটারেচারের একটা পাতায় পাওয়া গেল একটা অদ্ভুত তথ্য। ১৯৮৩ সালে নিজের শেষ গল্পগ্রন্থ শেক্​সপিয়ার’স মেমোরির খসড়া করার সময় নাকি সেখানে ‘শিলাদিত্যজ উইজডম’ নামে একটা গল্প রেখেছিলেন বোর্হেস, প্রকাশিত সংকলনে যেটা বাদ দেওয়া হয়। যেহেতু ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’কে ইংরেজি অনুবাদে একভাবে ‘উইজডম’ বলা যায়, আমি তাই ভাবতে থাকি, তবে কি সারোয়ার ইকবালের ওই পুঁথি থেকেই গল্পটার আইডিয়া পেয়েছিলেন বোর্হেস? ১৯৭৪ সালে একটা পুঁথি আবিষ্কার করে সেটাকে কেন্দ্র করে ১৯৮৩ সালের মাঝখানে একটা গল্প লেখা, বোর্হেসের মতো খুঁতখুঁতে লেখকের পক্ষেও ব্যাপারটা খুবই সম্ভব!

তবে পুরো ব্যাপারটা আমার কল্পনাও হতে পারে। বাদ দেওয়া ওই গল্প থেকেই প্রমাণিত হয় না যে বোর্হেস চট্টগ্রামে এসেছিলেন। আমি তাই অনুসন্ধানের চেষ্টা করি, অন্যদিক থেকে সারোয়ার ইকবাল সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা যায় কি না। পুঁথি-সংগ্রাহকের তিন দশকের অভিজ্ঞতা বইয়ের প্রকাশক আহমদ পাবলিশিং হাউজের সঙ্গে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করি। দুঃখের ব্যাপার, প্রকাশক জানান, ১৯৮১ সালে প্রকাশিত ওই বইয়ের কোনো কপি তাঁদের কাছে অবশিষ্ট নেই। লেখক সারোয়ার ইকবাল সম্পর্কেও কোনো তথ্য দিতে তিনি তাই অপারগ।

তারপর যথারীতি অন্য কাজের ব্যস্ততায় ধীরে ধীরে ঢিল পড়ে বোর্হেসসংক্রান্ত অনুসন্ধানে।

সপ্তাহ দুয়েকের মাঝে ব্যাপারটা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, কিন্তু ফেসবুকের মেসেঞ্জারে আমাকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলেন গল্পকার শিবব্রত বর্মন। শিবুদা জানান, বোর্হেসের বাংলাদেশ সফর নিয়ে নিজের মতো করে খোঁজ করছিলেন তিনিও। সেই খোঁজ করতে গিয়েই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কোনো এক পরিচিতের মাধ্যমে তিনি পেয়েছেন মজার এক তথ্য। না, ১৯৭৪ সালে বোর্হেস ও মারিও নামের কোনো আর্জেন্টাইনের বাংলাদেশে আসার ব্যাপারে কোনো তথ্য তিনি পাননি। তবে বিমানবন্দরের পুরোনো রেকর্ড জানাচ্ছে, ওই বছরের জুলাই মাসের মাঝামাঝি ভারত থেকে বিমানযোগে চট্টগ্রামে ঢুকেছেন এমন দুই যাত্রী, যাঁদের নাম পিয়েরে মেনার্দ ও মার্টিন ফিয়েরো।

মেসেঞ্জারে ওদিক থেকে তথ্যটা আমাকে জানিয়ে মুচকি হাসেন শিবুদা।

শিবুদার ওই হাসির অর্থ বুঝতে কষ্ট হয় না আমার। বোর্হেসের মনোযোগী পাঠকমাত্রই জানেন, মার্টিন ফিয়েরো আর পিয়েরে মেনার্দের পরিচয়। বাঙালির কাছে জীবনানন্দের বনলতা সেন যা, আর্জেন্টাইন পাঠকের কাছে তেমনই সুপরিচিত নাম হোসে হার্নান্দেজের কবিতার চরিত্র ফিয়েরো—বুনো পম্পাসের যে নাইফ-ফাইটার খুন করেছিল এক কৃষ্ণাঙ্গকে। বোর্হেস, নিজের লেখাতেও চরিত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন সেই ফিয়েরোকে।

অন্যদিকে বোর্হেসের লেখকজীবনের বাঁক বদলে দেওয়া গল্পটির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে পিয়েরে মেনার্দের নাম। ১৯৩৮ সালে তীব্র জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে বোর্হেস যখন নিজেকে নিয়ে সংশয়ে আছেন, লিখতে পারবেন কি না, তখন তিনি চেষ্টা করলেন একেবারে নতুন ঘরানার একটা গল্প লিখতে। প্রবন্ধের আদলে লেখা সেই গল্পের নাম ‘পিয়েরে মেনার্দ, দ্য অথর অব ডন কিহোতে’। অনেকটুকু সত্যের জায়গামতো কল্পনা মিশিয়ে দিয়ে বিভিন্ন কাল্পনিক বই আর মানুষকে নিয়ে গল্প লেখার যে বোর্হেসীয় ঘরানা, পিয়েরে মেনার্দকে দিয়েই শুরু সেই ধারাটার।

আলাদা করে চোখ গেল যে ছবিটায়, সেখানে হাতে কোনো পুঁথি নিয়ে পুরোনো দিনের সোফায় বসে আছেন তিনজন হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। তবে তৃতীয় মানুষটির চোখে কালো চশমা থাকলেও তাঁকে চিনতে আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না, মাঝবয়সের অন্ধত্ব বরণ করা বোর্হেসের অজস্র ফটো আমি দেখেছি।

১৯৭৪ সালে বিমানপথে চট্টগ্রামে প্রবেশ করা যাত্রীদের তালিকায় মার্টিন ফিয়েরো আর পিয়েরে মেনার্দের নাম থাকার ঘটনায় তাই বাংলাদেশে বোর্হেসের বেড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি আরেকটু দৃঢ় হয় আমার মনে। তবু ঘটনাটা নিয়ে একেবারে নিঃসংশয় হতে সপ্তাহ কয়েক পর আমি চলে যাই চট্টগ্রামে। পুঁথিসংগ্রাহক সারোয়ার ইকবালকে অনুসন্ধানের সেই যাত্রায় আমার সঙ্গী হিসেবে থাকেন কবি হাসনাত শোয়েব।

হাসনাত নিজে চট্টগ্রামের মানুষ, স্থানীয় এক পুঁথি-সংগ্রাহকের খোঁজ তিনি আগেই নিয়ে রেখেছিলেন। ভদ্রলোকের বাসায় ঘুরতে গিয়ে তাঁর সংগ্রহটি দেখে মুগ্ধ হই, তবে সাক্ষাতের প্রকৃত উদ্দেশ্যটা পূর্ণ হয় না। সারোয়ার ইকবাল নামের কোনো সংগ্রাহককে এই ভদ্রলোক চেনেন না (স্বাভাবিক। প্রকাশিত বইতে সারোয়ার ইকবাল নিজের বয়স উল্লেখ করেছেন ৬৫। এত দিনে তাঁর মরে ভূত হয়ে যাওয়ার কথা।)। আর সত্তরের দশকে চট্টগ্রাম শহরে পুঁথি-সংগ্রাহক কারা ছিলেন, সেই বিষয়েও তাঁর একেবারে ধারণা নেই। তবে ভদ্রলোক একটা উপকার করলেন। চট্টগ্রাম শহরের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন, হারুনুর রশিদ নামের এমন এক লোকের ফোন নম্বর দিলেন তিনি। বললেন, পুঁথি-সংগ্রাহকদের সম্পর্কেও ভালো ধারণা রাখেন ওই গবেষক।

পরদিন দুপুরে আমি আর হাসনাত ভাই দেখা করি হারুনুর রশিদের সঙ্গে। ভদ্রলোক অফিসের ব্যস্ত সময়ের মধ্যে আমাদের কথা মন দিয়ে শোনেন, বেশ আগ্রহীও মনে হলো তাঁকে। তারপর তিনি আমাদের বললেন সন্ধ্যা সাতটার দিকে তাঁর বাসায় দেখা করতে, সংগ্রহের পুরোনো পত্রিকাগুলো তিনি নাকি ওখানেই রাখেন।

আর সেই সন্ধ্যায়, ছাদ ছুঁই ছুঁই অনেকগুলো বেতের বুকশেলফে ঠাসাঠাসি করে রাখা বইয়ের মধ্যে এনার্জি বাল্বের আলোয় আলোকিত ঘরটায় ঢুকতেই ভদ্রলোকের মুখে চওড়া একটা হাসি দেখলাম।

হারুনুর রশিদ জানান, অফিস থেকে এসে আমাদের ছাড়াই তিনি ঘাঁটা শুরু করেছেন ১৯৭৪ সালের পত্রিকা। সেখান থেকেই জেনেছেন, সত্যিই সে বছরের জুলাই মাসের শেষ দিকে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের আয়োজনে পুঁথি-সংগ্রাহকদের একটা দুই দিনব্যাপী সম্মেলন হয়েছিল জামালখানের ওদিকে। দৈনিক আজাদী সেই সম্মেলন নিয়ে কয়েক শ শব্দের যে প্রতিবেদনটি করেছিল, হারুনুর রশিদ আমাদের সেটারই লেমিনেট করা একটা কপি দেখালেন। বিশেষভাবে তিনি আঙুল দিয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন একটা বাক্যের ওপর, ‘...ভারত, নেপাল, ভুটান ছাড়াও দুষ্পাপ্য পুঁথির সংগ্রহ করিতে সুদূর জাপান, এমনকি আর্জেন্টিনা হইতে কতিপয় নাগরিক এই আয়োজন উপলক্ষে চট্টগ্রামে উপস্থিত হইয়াছেন।’

আমি, হাসনাত শোয়েব ও হারুনুর রশিদ—প্রত্যেকেই একে অন্যের দিকে চেয়ে হাসি। সুদূর একটি দেশের নাম আমাদের মুখে সেই হাসি ফুটিয়ে তুলেছে।

তবে সেই সন্ধ্যায় রিয়াজুদ্দিন বাজারসংশ্লিষ্ট এলাকায় ঘোরাঘুরির পর অবশ্য আমি আর হাসনাত শোয়েবের মুখে সেই হাসিটি আর থাকে না। কারণ, সারোয়ার ইকবালের স্মৃতিকথায় উল্লেখিত তাঁর বাড়িটির অবস্থান আমরা সেখানে খুঁজে পাই না। নির্দিষ্ট ঠিকানার চারপাশে এখন কেবল দানবীয় সব হাইরাইজ, একেকটা দালানের ভূতপূর্ব মালিকের সন্তানেরা নিজেদের মধ্যে সেখানে ফ্ল্যাট ভাগাভাগি করে আবাস করছেন। দু-একটা বাড়িতে ইতস্তত জিজ্ঞাসা করে লাভ হয় না, সারোয়ার ইকবালকে কেউই চিনতে পারে না। রাতের বাসে ঢাকায় ফেরার পথে তাই কেন যেন খানিক বিষণ্ন লাগে আমাদের।

এসব কথা আগের। বোর্হেসের বাংলাদেশ সফর নিয়ে যেটুকু দ্বিধা আমার ছিল, সেটাও মুছে গেছে গত পরশু, আলবার্তো ম্যাঙ্গুয়েলের মাধ্যমে। অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বোর্হেসকে দীর্ঘদিন বই পড়িয়ে শুনিয়েছিলেন যে তরুণ, তিনিই আলবার্তো ম্যাঙ্গুয়েল। প্রাবন্ধিক ম্যাঙ্গুয়েল বাংলাদেশে তেমন সুপরিচিত নন অবশ্য, নেট ঘেঁটে কেবল এটুকু পেলাম যে সুহান রিয়াসাত নামের একজন নিজের ওয়েবসাইটে ম্যাঙ্গুয়েলের লেখার অল্প কিছু অনুবাদ করে রেখেছে।

যাহোক, গত পরশু সেই আলবার্তো ম্যাঙ্গুয়েল রচিত আ রিডার অন রিডিং বইটা পড়তে পড়তেই দারুণ একটা লেখায় চোখ পড়ে আমার। অনুবাদ করলে সেই লেখাটা দাঁড়ায় এমন:

‘...১৯৭৬-এর এপ্রিলে ওয়াশিংটন ডিসির সেই সাহিত্য সম্মেলনে অতিথিদের মূল আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায় বোর্হেসের একটা বক্তৃতা, যার শিরোনাম ছিল “সংস্কৃত পুঁথির ধাঁধার জগৎ”। 

‘হিলটন হোটেলের সবচেয়ে বড় হলঘরটায় সেই বিকেলে একটা আসন পাওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে গেল দুনিয়ার বাঘা-বাঘা পণ্ডিতের মাঝেও। নিউইয়র্ক থিয়েটারের পরিচালক জ্যান কিটিংও সংস্কৃত পুঁথির ধাঁধার জগতের সন্ধান পেতে কনুই মারামারি করে ঢুকলেন সেই সভাকক্ষে। তারপর কী হয়েছিল, কিটিং সেটা লিখে গেছেন তাঁর বই এসেন্স অব থিয়েটার-এ, “দুজন লোক বোর্হেসকে বক্তৃতামঞ্চে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল মাইক্রোফোনের সামনে, হাততালি চলল দীর্ঘক্ষণ ধরে। বোর্হেস তখন অনড়, হাততালি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল একসময়। তারপর বোর্হেস শুরু করলেন তাঁর ঠোঁট নাড়ানো। স্পিকারে কেবল ফিসফিসের মতো কিছু আওয়াজ শোনা গেল। যেন দূরের কোনো ডুবন্ত জাহাজ থেকে চিৎকার করছে কোনো মানুষ, আর তাদের স্বর ঢেকে যাচ্ছে সমুদ্রের শব্দে। বিচ্ছিন্নভাবে বোঝা গেল কয়েকটা শব্দ কেবল—সংস্কৃত পুঁথি... ভারতবর্ষ... বাংলাদেশ...পুঁথি...সংস্কৃত...বাংলাদেশ...

“মাইক্রোফোনটা একটু উঁচু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, উপস্থিত কারোরই যেন সাহস হলো না ওই অন্ধ, বৃদ্ধ গল্পকারের মুখের সামনে গিয়ে মাইকটা ঠিক করে দেয়। বোর্হেস বক্তৃতা দিলেন এক  ঘণ্টা, আর ওই একটা ঘণ্টায় ঘরের কোনো শ্রোতাই—মাইকে যদিও ফিসফিস ছাড়া আর কিছুই নেই—জায়গা ছেড়ে সামান্য নড়ল না। এবং বোর্হেস যখন শেষ করলেন তাঁর বক্তব্য, সবাই উঠে দাঁড়াল নীরবে, আর শুরু হলো এমন হাততালি, যেন সেটা কখনো থামবে না।”’