বিদায় এলিস মানরো
১৩ মে মারা গেছেন নোবেলজয়ী ছোটগল্পকার এলিস মানরো। ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে ছোটগল্প লেখা কানাডার এই লেখক মনে করতেন, গল্পই তাঁর আরাধ্য। ১৯৬৮ সালে বেরোনো মানরোর প্রথম দিককার বই ড্যান্স অব দ্য হ্যাপি শেডস থেকে নেওয়া ‘বয়েজ অ্যান্ড গার্লস’ নামের এই গল্পের পরতে পরতে আছে এক কিশোরীর মনোবেদনার বিষণ্ন দুনিয়া। এই লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা।
আমার বাবা ছিলেন শিয়ালচাষি। মানে খোঁয়াড়ে রুপালি শিয়াল পালতেন পুরো শরৎ আর শীতের শুরু অবধি। তারপর ওদের লোমগুলো উপযুক্ত হলে ওদের মেরে ছাল ছাড়িয়ে বিক্রি করতেন হাডসন বে কোম্পানি কিংবা মন্ট্রিয়ল ফার ট্রেডার্সের কাছে।
বড়দিনের আগের কয়েক সপ্তাহ ধরে রাতের খাবারের পর বাবা কাজ করতেন বাড়ির ভাঁড়ারঘরে। ঘরটা চুনকাম করা, কাজের টেবিলের ওপর ১০০ ওয়াটের বাতি জ্বালানো। আমি আর আমার ভাই লাইর্ড ওপরের সিঁড়িতে বসে দেখতাম। বাবা শিয়ালের শরীর থেকে পুরো চামড়াটা উল্টে বের করতেন, তখন ওটাকে আশ্চর্য রকম ছোট দেখাত, ইঁদুরের মতো, তুচ্ছ, তার নিজের অনেক গরিমার ফার থেকে বিমুক্ত। সেসব নগ্ন, পিচ্ছিল মৃতদেহ একটি বস্তায় ভরে গর্তে পুঁতে ফেলা হতো। আমার মা এই পেল্টিং, মানে পশু মারা, ছাল ছাড়ানো এবং ফার তৈরির প্রক্রিয়ার সবটাই অপছন্দ করতেন। মা চাইতেন এসব কাজ যেন বাড়িতে না হয়। ছাড়ানো চামড়াগুলো একটা লম্বা বোর্ডের ওপরে উল্টেপাল্টে টান টান করে রেখে বাবা নিপুণভাবে সেগুলোয় লেগে থাকা জমাট বাঁধা শুকনো রক্তকণা, চর্বির টুকরো তুলে ফেলতেন। সেই রক্ত আর চর্বির গন্ধের সঙ্গে শিয়ালের তীব্র নিজস্ব আদিম গন্ধ ছড়িয়ে থাকত বাড়িময়।
অন্ধকারে আমরা শুয়ে থাকতাম পানিতে ভাসা সরু ভেলার মতো বিছানায়। স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম সিঁড়ির ওই গর্ত থেকে আসা আবছা আলোর দিকে। ক্রিসমাস হোক বা না হোক, লাইর্ড সব সময়ই ‘জিঙ্গেল বেলস’ গাইত। আর আমি গাইতাম ‘ড্যানি বয়’। গান গাইতে গাইতেই ঘুমিয়ে যেত লাইর্ড; আমি তার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেতাম। তারপরের সময়টুকু একান্তই আমার নিজের; এবং সম্ভবত দিনের শ্রেষ্ঠ সময়। আমি তখন নিজেকে কম্বলের ভেতরে পুরোপুরি মুড়ে দিনের পর দিন শোনানো গল্পগুলো আওড়ানোর প্রস্তুতি নিতাম। আমার গল্পগুলোয় থাকত সাহস, দৃঢ়তা আর আত্মত্যাগ; যদিও আমার নিজের বাস্তবিক জগতে এগুলোর কোনোই ভূমিকা ছিল না। গল্পে আমি লোকজনকে বোমাবিধ্বস্ত ভবন থেকে উদ্ধার করতাম, স্কুলের আঙিনা তছনছ করা দুটি ভয়ানক নেকড়েকে গুলি করে মেরেছিলাম। জুবিলির মূল সড়ক দিয়ে একটা চমৎকার ঘোড়ায় চেপে আমার নাম না-জানা বীরত্বের জন্য নগরবাসীর কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করতে করতে এগোতাম।
জীবন্ত শিয়ালগুলো থাকত বাবার বানানো মধ্যযুগীয় শহরের মতো উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা তালা আটকানো জায়গায়। সেখানে খাবার আর পানির পাত্র তারের সঙ্গে এমনভাবে বাঁধা থাকত, যাতে বাইরে থেকেও সেগুলো খালি করা বা পরিষ্কার করা সম্ভব হতো। এই পাত্রগুলো টিনের পুরোনো ক্যান দিয়ে তৈরি। আর সিঁড়ি ও খোঁয়াড়টা ফেলে দেওয়া কাঠের বিভিন্ন টুকরা দিয়ে বানানো। বাবা একটি এক চাকার ঠেলাগাড়ির সঙ্গে টিনের ড্রাম লাগিয়ে ঘাসের জমিতে পানি আনার ব্যবস্থা করেছিলেন। গরমের সময় শিয়ালগুলোর প্রতিদিন দুবার করে পানি দরকার হতো, কাজটি আমিই করতাম। সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে একবার, আরেকবার রাতের খাবারের পরে। আমি পাম্প থেকে ড্রামগুলোয় পানি ভরে সেগুলো খামার থেকে ঘাসের জমিতে নিয়ে ঢালতাম। লাইর্ডও সঙ্গে আসত। তার সবুজ ক্যানটিতে এত পানি ভরত যে পায়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে পানি ছলকে ওর ক্যানভাসের জুতা ভিজে যেত।
আমার দাদিমা বেড়াতে এসে কয়েক সপ্তাহ ছিলেন। তখন তাঁর কাছে শুনতাম, ‘মেয়েরা দরজা এভাবে জোরে লাগায় না’, ‘মেয়েরা বসার সময় দুই হাঁটু মিশিয়ে বসে।’
পানি বয়ে নেওয়া ছাড়াও বাবাকে আমি লম্বা হয়ে যাওয়া ঘাসসহ ঘাসের জমিতে অন্যান্য আগাছা পরিষ্কার করার সময়ও সাহায্য করতাম। কাজের কথা ছাড়া তখন বাবা আমার সঙ্গে আর কিছুই বলতেন না। এ ক্ষেত্রে তিনি আমার মায়ের একদমই বিপরীত। মা আনন্দে থাকলে আমার সঙ্গে সব ধরনের গল্প করতেন, তাঁর ছোটবেলায় কী নামের কুকুর ছিল, বড় হওয়ার পর যেই ছেলেদের সঙ্গে তিনি ঘুরতে বেরোতেন, সেসব গল্পও করতেন। আমার বাবার যা কিছুই গল্প বা ভাবনা, সেগুলোর সবই ছিল একান্ত ব্যক্তিগত। আর আমিও তাঁর কাছে লজ্জা পেতাম বলে কখনো কোনো প্রশ্ন করতাম না। তবে যত যা-ই হোক, আমি বাবার চোখের সামনে কাজ করতাম খুব আন্তরিকভাবে আর গর্ব নিয়ে। একবার এক পশুখাদ্য বিক্রেতা বাবার সঙ্গে কথা বলতে এলে তিনি বললেন, ‘আমার নতুন কাজের লোকের সঙ্গে পরিচিত হোন।’ এটা শুনেই আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে সরে গিয়েছিলাম, খুশিতে আমার মুখ লালচে হয়ে গিয়েছিল।
মাকে খামারে দেখা বেশ বিরল আর অদ্ভুত ঘটনাই ছিল। কাপড় শুকাতে দেওয়া অথবা বাগানে আলু রোপণ করা—এ ধরনের কোনো কাজের দরকার না হলে মা কখনো বাড়ির বাইরে আসতেন না। তাঁকে কেমন যেন ঘরহারা মনে হচ্ছিল, সূর্যালোকের স্পর্শ না পাওয়া তাঁর খালি পা, সদ্য বাসন মেজে আসার ফলে ভেজা হাতের ছাপসহ অ্যাপ্রোন পরনে ছিল তখনো। একটা রুমাল দিয়ে বাঁধা চুলগুলোর একাংশ বের হয়ে ছিল। সকালে মা নিজের চুলগুলো এভাবেই বেঁধে রাখতেন। আর বলতেন সুন্দর করে চুল বাঁধার মতো সময় তাঁর কাছে নেই। তাই এভাবেই সারা দিন তাঁর চুল বাঁধা থাকত। তবে আসলেই তাঁর সময় ছিল না। এই দিনগুলোয় আমাদের বাড়ির পেছনের বারান্দায় শহর থেকে কেনা পিচ, নাশপাতি আর আঙুরভর্তি ঝুড়ির স্তূপ জমে থাকত। সঙ্গে থাকত বাগানের পেঁয়াজ, টমেটো আর শসা। এসব দিয়ে বানানো হতো জেলি, জ্যাম, আচার ও চিলি সস। রান্নাঘরে একটা চুলা সারা দিনই জ্বালানো থাকত। সেখানে সেদ্ধ পানিতে ডোবানো কাচের বয়ামের শব্দ হতে থাকত টুংটাং। কখনো দুই চেয়ারের মাঝখানে একটা খুঁটিতে ঝোলানো কাপড়ের ভেতরে থাকত জেলি বানানোর জন্য রাখা কালচে-নীল আঙুরের মণ্ড। আমাকে দেওয়া হয়েছিল টেবিলে বসে গরম পানিতে সেদ্ধ করা পিচগুলোর খোসা ছাড়ানো বা পেঁয়াজ কাটার কাজ, যেগুলো করতে করতে আমার চোখ দিয়ে পানি গড়াত। কাজ শেষ হতেই দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতাম আমি। যেন কাজ শেষ হয়েছে টের পেয়ে মা আমাকে পরবর্তী কাজের জন্য ডাকলে আমি শুনতে না পাই। গরমের সময়ের অন্ধকার রান্নাঘর ঘেন্না লাগত আমার, ঘেন্না লাগত সবুজ পর্দা, পুরোনো তেল চিটচিটে টেবিল, অমসৃণ আয়না আর উঁচু-নিচু ফ্লোরম্যাটে মোড়ানো মেঝে। মা তখন খুবই পরিশ্রান্ত থাকতেন, কথা বলার মতো কোনো সুযোগই তাঁর থাকত না। তখন তাঁর পড়ে আসা নরমাল স্কুল গ্র্যাজুয়েশন ড্যান্সের গল্প বলার মতো কোনো মানসিকতাই আর অবশিষ্ট থাকত না। মায়ের ঘর্মাক্ত মুখে শুধু বয়ামের হিসাব আর কত কাপ চিনি লাগল—সেগুলোর হিসাব থাকত। আমার মনে হতো, বাড়ির এসব কাজের কোনো শেষ নেই, ব্যাপারটা হতাশাজনক।
পানির ট্যাংকটি ঠেলে খামারঘরের কাছে নিয়ে রাখার সময় মাকে বলতে শুনলাম, ‘লাইর্ড আরেকটু বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো। তারপর তুমি সত্যিকারের সাহায্য পাবে।’ বাবা কী বলেছিলেন, আমি শুনিনি।
আমার মনে হচ্ছিল, এই খামারে মায়ের কোনো কাজ নেই এবং আমি চাইছিলাম বাবাও এটা বুঝুক। আমার মা লাইর্ডের ব্যাপারে কী ভাবেন? সে তো কোনো কাজেরই না। মা বলছিলেন, ‘তারপর আমি ওকে আরও বেশি করে বাসার কাজে লাগাতে পারব। যেই না আমি ওর থেকে পেছনে ঘুরলাম, ওমনি সে দৌড়ে চলে যায়। মনে হয় আমার কোনো মেয়েই নেই।’
আমার কখনো মনে হয়নি যে মায়ের কথা বাবা আমলে নেবেন। কে-ইবা ভাবতে পারে লাইর্ড আমার কাজগুলো করছে? তালার কম্বিনেশন মনে রাখা থেকে শুরু করে কাঠির মাথায় পাতা লাগিয়ে পানির পাত্রগুলোকে ধুয়ে পরিষ্কার করা কিংবা পানি না ফেলে ট্যাংক বয়ে নেওয়া—কোনো কাজই সে পারবে না। এতেই বোঝা যায়, আমার মায়ের বাস্তবতা জ্ঞান কত কম।
যে শীতে আমার বয়স ১১, তখন আমাদের আস্তাবলে দুটি ঘোড়া ছিল। এদের নাম আমরা দিয়েছিলাম ম্যাক ও ফ্লোরা। ম্যাক কালো রঙের নির্লিপ্ত একটা কাজের ঘোড়া। আর ফ্লোরা ছিল সোরেল মেয়ার প্রজাতির। ম্যাককে চালানো বেশ সহজ ছিল। কারণ, ও অনেক ধীর হয়ে গিয়েছিল। ফ্লোরা ছিল বেশ হিংস্র, প্রায়ই গাড়ি অথবা এমনকি অন্য ঘোড়ার দিকেও তেড়েফুঁড়ে যেত।
মা আমাকে যেসব কথা বলেন, এই শীতে সে কথাগুলোর মতো কথা প্রচুর শুনতে লাগলাম আশপাশে। ‘মেয়ে’ শব্দটি আগে ‘শিশু’র মতোই একটি নিষ্পাপ, বোঝাহীন শব্দ মনে হতো; কিন্তু এখন সেটা আর তেমনটি থাকল না। আমার দাদিমা বেড়াতে এসে কয়েক সপ্তাহ ছিলেন। তখন তাঁর কাছে শুনতাম, ‘মেয়েরা দরজা এভাবে জোরে লাগায় না’, ‘মেয়েরা বসার সময় দুই হাঁটু মিশিয়ে বসে।’ এর চেয়ে আরও খারাপ ব্যাপার হলো যখন তাঁকে কোনো প্রশ্ন করতাম, উত্তর আসত, ‘এগুলো মেয়েদের জানার দরকার নেই।’
বসন্ত এলে ঘোড়াগুলোকে গোলাঘরের উঠানে ছেড়ে দেওয়া হলো। এক শনিবার আমরা আস্তাবলে গিয়ে দেখি সব কটি দরজা খোলা, সেখানে হেনরিকে দেখলাম স্টলের পেছনে আটকে রাখা তার ক্যালেন্ডারের সংগ্রহ গোছাচ্ছে। আমাদের বলল, ‘তোমাদের বুড়ো বন্ধু ম্যাককে বিদায় জানাতে এসেছ নাকি?’
আমি হেনরিকে জিজ্ঞেস করলাম, আজই কি ম্যাককে গুলি করা হবে? ম্যাক আর ফ্লোরা এত দীর্ঘদিন ধরে আস্তাবলে ছিল যে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম এদের গুলি করে মেরে ফেলা হবে। বাবা বাড়ি থেকে একটা বন্দুক হাতে নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা এখানে কী করছ?’ আমরা বললাম, ‘কিছুই না।’ বাবা আমাদের বাড়িতে গিয়ে খেলতে বললেন। আমি লাইর্ডকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি ম্যাককে গুলি করা দেখতে চাও?’ উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে সাবধানে গোলাঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে বাবা আর হেনরির আলাপের মধ্যেই স্টল থেকে বের হওয়া ম্যাকের পায়ের আওয়াজ পেলাম। দুটি বোর্ডের মাঝখানের চওড়া একটা ফাটল দেখিয়ে লাইর্ডকে আমি বললাম, ‘চুপ থেকে অপেক্ষা করো। তারা তোমার আওয়াজ শুনতে পেলে আমরা দুজনেই বিপদে পড়ব।’
বাবাকে দেখলাম বন্দুক হাতে। ম্যাক বেড়ার পাশে বিবর্ণ মরা ঘাসে নাক ঘষছিল। তারপর আমার বাবা গেট খুললে ম্যাককে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। সোজা হেঁটে সামান্য দূরে সরে এসে নিজের জন্য সুবিধাজনক একটা জায়গায় দাঁড়ালেন বাবা। হেনরিও আড়াআড়িভাবে কিছুটা দূরে সরে গেলেও আলতো করে লাগামটি ধরেই রেখেছিল। বাবা বন্দুক ওঠালে ম্যাকও মুখ তুলে এমনভাবে তাকাল, যেন সে কিছু একটা আঁচ করেছে। আর তখনই বাবা ম্যাককে গুলি করলেন।
ম্যাক ধপাস করে পড়ে না গিয়ে দুলতে দুলতে নিজের একপাশে ফিরে পড়ে গিয়ে পরে আবার পিঠের ওপর ভর দিয়ে উল্টে আশ্চর্যজনকভাবে বাতাসে তার পাগুলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য নাচাল। লাইর্ড একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জোরে বলে উঠল, ‘সে এখনো মরেনি।’ আমি বললাম, ‘এখন শুধু চামড়া ছিলে কেটে টুকরা করবে, চলো, চলে যাই। এখন তাহলে তুমি দেখলে কীভাবে গুলি করে মারা হয়’, কথাগুলো এমনভাবে বলেছিলাম যেন আমি নিজে আগে বহুবার এসব দেখেছি! বললাম, ‘শোনো, তুমি কাউকে নিশ্চয়ই বলতে যাবে না, তাই না?’ সে নির্বিকারভাবে না–বোধক উত্তর দিল।
দুই সপ্তাহ পরে রাতে মা-বাবার আলাপ শুনে জানলাম, তাঁরা ফ্লোরাকে মেরে ফেলবেন। পরদিন আমরা উঠানে শীতের ঝড়ে ভেঙে যাওয়া গাছের ডালপালা কুড়াচ্ছিলাম। তখন ফ্লোরার ডাকের শব্দের সঙ্গে বাবার গলা আর হেনরির চিৎকারও শোনা গেল। কী হয়েছে দেখার জন্য গোলাঘরের মাঠের দিকে দৌড়ে গেলাম আমরা।
আস্তাবলের দরজা খোলা ছিল। হেনরি ফ্লোরাকে বের করে আনতেই ফ্লোরা ওর হাত থেকে ছুটে গিয়ে মাঠে দৌড় দিল। আমরা বেড়ার ওপর উঠে বসলাম। ফ্লোরাকে ঠিক ওয়েস্টার্ন সিনেমার কোনো র্যাঞ্চের ঘোড়ার মতো দেখাচ্ছিল। বাবা আর হেনরি ছুটছিল ফ্লোরার পেছনে, চেষ্টা করছিল তার ঝুলন্ত লাগামটি ধরতে। অনেক পরিশ্রম করে তাকে প্রায় আটকানোর মুহূর্তেই তাঁদের দুজনের মাঝখান দিয়ে বাঁক নিয়ে পেরিয়ে গোলাঘরের পাশ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল ফ্লোরা। লম্বা এল আকৃতির মাঠের দিকে চলে গিয়েছিল সে, ও যদি মাঝবরাবর লেনের দিকে যেত, তাহলে খোলা গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারত। বাবা আমাকে চিৎকার করে গেটটা বন্ধ করতে বলছিলেন।
আমি খুবই দ্রুত দৌড়াতে পারতাম। বাগানের মাঝখান দিয়ে দৌড়ে নিচু হয়ে থাকা গাছগুলো পেরিয়ে লাফ দিয়ে একটি নালা পেরিয়ে খোলা গেটে পৌঁছেছিলাম আমি। গেট লাগানোর বদলে যদ্দুর সম্ভব আরও খুলে দিয়েছিলাম। কাজটা কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে করিনি, স্রেফ ঝোঁকের বশে করে ফেলেছিলাম। ফ্লোরা বিন্দুমাত্রও থামেনি। আমার পাশ দিয়ে সে ছুটে চলে গেল।
আমি ধরে নিয়েছিলাম লাইর্ড বলে দেবে। ভাবছিলাম আমার কী হতে পারে। আগে কখনো আমি বাবার অবাধ্য হইনি।
এখানে ফ্লোরার যাওয়ার মতো কোনো বুনো ঝোঁপওয়ালা জায়গা নেই। আর শিয়ালগুলোকে খাওয়ানোর জন্য ওর মাংস আমাদের দরকার ছিল। আমি শুধু বাবা ও হেনরির পরিশ্রমই আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আর যখন বাবা বুঝে গেলেন, আমাকে আর বিশ্বাস করা যায় না, তখন তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে আমি তার পক্ষে পুরোপুরিভাবে নেই। আমি ছিলাম ফ্লোরার পক্ষে, কিন্তু এতে তারও কোনো উপকার হয়নি। কারোরই কোনো কাজে আসলাম না আমি।
বাড়ি ফিরে গেলে মা বললেন, ‘কিসের এত চেঁচামেচি?’ জানালাম যে ফ্লোরা বেড়া ভেঙে পালিয়ে গেছে। মা ইস্তিরিটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, ‘আহা, তোমার বেচারা বাবা! এখন সে সারা তল্লাটে ফ্লোরাকে খুঁজে বেড়াবে।’ মাকে আমি সবকিছু বলতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু না বলে আমার ঘরে গিয়ে বসে রইলাম।
রাত একটার পরে ট্রাক ফিরে এল। লাইর্ড হাত তুলে রক্তের দাগ দেখিয়ে বলল, ‘আমরা ফ্লোরাকে গুলি করে, ওকে কেটে ৫০ টুকরা করেছি।’ মা বললেন, ‘এসব নিয়ে আমি কিছু শুনতে চাই না। আর এভাবে নোংরা হয়ে টেবিলে আসবে না।’
আমরা বসে ছিলাম। বাবা স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন আর হেনরি তামাক চিবোচ্ছিল বরাবরের মতোই। আমাকে দেখিয়ে লাইর্ড টেবিলের এক প্রান্ত থেকে গর্বের সঙ্গে বলে উঠল, ‘ফ্লোরা পালিয়ে যাওয়ার জন্য সে-ই দোষী।’
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী?’
লাইর্ড বলল, ‘সে চাইলে গেটটা বন্ধ করে দিতে পারত, কিন্তু করেনি; বরং গেট খুলে দিয়েছিল আর ফ্লোরা পালিয়ে গেল।’
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, এটি ঠিক কি না।
টেবিলের সবাই তখন আমার দিকে তাকিয়েছিল। আমি মাথাটা হ্যাঁ–বোধকভাবে নাড়িয়ে খুব কষ্ট করে খাবার গেলার চেষ্টা করলাম। আমাকে লজ্জায় ডুবিয়ে দিয়ে আমার চোখও তখন ভিজে যাচ্ছিল কান্নায়।
বাবা নিতান্ত বিরক্তির শব্দ করে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কেন তেমনটা করেছিলাম।
আমি কোনো উত্তর দিইনি। মাথাটা নিচু করেই চামচ রেখে দিয়ে টেবিল থেকে উঠে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু কেউ আমাকে উঠে যেতে বলেনি। লাইর্ড নির্বিকারভাবে বলে উঠল, ‘সে তো কাঁদছে।’
বাবা বললেন, ‘বাদ দাও, ও একটা বাচ্চা মেয়েই তো।’ তাঁর এই কথার মধ্য দিয়ে চিরতরে এ ঘটনার সমাপ্তি ঘটে গেল।
নিজের অন্তর থেকে আমি তাঁর কথার প্রতিবাদ করিনি। হয়তো সেটাই সত্যি।
ঈষৎ সংক্ষেপিত