অভিবাসী বন

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

আমাদের বন আমাদের ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছে! 

মং শোর কথা শুনে চমকে উঠেছিল গাঁওবুড়া। বন কীভাবে দূরে চলে যায়? বনের কি পা আছে? 

দূরে রানীখং পাহাড়ের পাশে সূর্য ডুবছিল তখন। সবুজে-নীলে-কমলায় পাহাড়-নদী-মাঠ একেবারে মাখামাখি। পাহাড়ের পাদদেশেই তাদের বন। বনটার কোনো ভালো নাম নেই। পূর্বপুরুষেরা বলত রানীর জঙ্গল। কেন বলত, তা কেউ জানে না। তাদের সমাজে কোনো রাজা-রানির কথা শোনা যায় না। তারা, এই গ্রামের অধিবাসীরা, পাহাড়ি নদীর স্রোত বেয়ে আসা নুড়িপাথর কুড়িয়ে, তা বিক্রি করে সংসার চালায়। কেউ কেউ অবশ্য কৃষিকাজও করে। আগের দিনে তাদের সমাজের সাহসী লোকেরা যেত শিকার করতে। নীলগাই, খরগোশ, শজারু, শূকর ধরে আনত বন থেকে। আজকাল বেশির ভাগ শিকার করা ভুলেই গেছে। শিকার করবে কি, বনেও আর তেমন পশুপাখি নেই। তাই তারা জমি আবাদ করা শিখছে। আলু বুনছে, কোথাও লাল মরিচ, কখনো রসুন। তা ছাড়া রানীর জঙ্গলে অনেকেই মৌচাক ভাঙতে যায়। মধু সংগ্রহ করে বছরের একটা সময়। এ এলাকার মধু খুব বিখ্যাত। শহরের লোকদের খুব পছন্দ এই খাঁটি মধু। শীতকালে যখন এ অঞ্চলে তীব্র শীত পড়ে, তখন খুব ভালো মধু পাওয়া যায়। কুয়াশামাখা ভোরে অন্ধকারে আগুন জ্বেলে ধোঁয়া দিয়ে মধু সংগ্রহ করতে হয়। হ্যাঁ, বনকে তারা প্রায়ই বিরক্ত করে বৈকি। রুটিরুজির জন্য করতেই হয়। কিন্তু তাই বলে বন অভিমান করবে? চলে যাবে তাদের ছেড়ে? এ কেমন কথা?

কিন্তু মং শো একজন বিজ্ঞানী। তার কথা তো আর ফেলনা নয়। সন্ধ্যাবেলা সে এলাকার মুরব্বিদের নিয়ে গাঁওবুড়ার বাড়িতে মিটিংয়ে বসল। 

‘গাছেরাও অভিবাসী হতে পারে!’ বলে মং শো, তাদের অবাক করে দিয়ে। ‘এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে অনেক বনজঙ্গল তার নিজস্ব এলাকা ছেড়ে দূরে চলে গেছে। এর প্রধান কারণ ক্লাইমেট চেঞ্জ। মানে জলবায়ুর পরিবর্তন। তো কীভাবে তারা করে কাজটা? মূলত সিড ডিসপার্সাল বা বীজ পাচার পদ্ধতিতে। মা গাছ বীজগুলোকে অনেক দূরে পাঠিয়ে দেয়। তারপর মা গাছেরা যখন একসময় মারা যায়, নতুন সন্তান গাছেরা বেড়ে ওঠে দূরে কোথাও। পুরোনো বন খালি হয়ে যায়। এভাবেই গোটা একটা বন এলাকা বদল করে। শেষ গ্লাসিয়াল পিরিয়ডের সময় এমন ফরেস্ট মাইগ্রেশন ঘটেছিল বেশি হারে। পৃথিবীর বনজঙ্গল তখন এদিক-ওদিক সরে গিয়েছিল নিজেদের সুবিধামতো। এই পদ্ধতি ঘটে খুব ধীরে, ধরা যাক কয়েক শ বছর ধরে। কিন্তু আমাদের রানীর জঙ্গল খুব দ্রুতই সরে যাচ্ছে। এটা আশ্চর্যের ব্যাপার। মানচিত্র বদলাচ্ছে প্রতিদিন। এমনটা আগে কোথাও কখনো দেখা যায়নি। এই দেখুন, আমি ছবি এঁকে দিচ্ছি।’

তারপর মং শো যে ম্যাপ আঁকে, তা দেখে সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। সত্যি তাদের গাঁয়ের সীমানার একেবারে কাছাকাছি চলে গেছে বনটা। সরে যাচ্ছে পুব দিকে, রানীখং পাহাড়ের নিচে যে খরস্রোতা হ্রদ, তা ছাড়িয়ে, বিশাল মাদারগাছটা পেরিয়ে আরও পুবে, যেদিকে মানুষের বসবাস নেই। রানীর জঙ্গল কি তবে তাদের ওপর অভিমান করেছে? একি দেবতাদের অভিশাপ? তারা ভয় পেয়ে যায়। কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করে। এটা কিসের আলামত? 

মং শো বলে, ‘এটা হতে দেওয়া যায় না। বনকে ফিরিয়ে আনতে হবে। বন ছাড়া আমরা অচল।’

‘ঠিক ঠিক। এ হতে দেওয়া যায় না। বনকে ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু কীভাবে?’ তারা সমস্বরে বলে ওঠে। কিন্তু কেউ কোনো বুদ্ধি খুঁজে পায় না। 

মং শো বলে, ‘আগে আমাদের বুঝতে হবে কোন কোন ফ্যাক্টর বনকে বাধ্য করছে দূরে চলে যেতে। ঠিক কোন সময়টাতে বন স্থান বদল করে। কীভাবে করে। আমরা একটা দল করব গ্রামের তরুণ-তরুণীদের নিয়ে। সবাই মিলে বনকে রোজ পাহারা দেব। কোনো অস্বাভাবিকতা, কোনো অদ্ভুত ঘটনা, নড়াচড়া—যা-ই চোখে পড়ুক, তা লক্ষ করব। তারপর সেটা পর্যালোচনা করব। তাহলেই বনকে আটকানো যাবে।’

রাতে গাঁওবুড়ার বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা হয় মং শোর। এ গাঁয়েরই ছেলে মং শো। বড় হয়ে পড়াশোনা করতে চলে গিয়েছিল বিদেশে। প্ল্যান্ট বায়োলজি আর পরিবেশবিজ্ঞান নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা তার। এ গাঁয়ের গর্ব মং শো। ভাগ্যিস, ছেলেটা গ্রামে ফিরে এসেছিল। নইলে এত বড় ঘটনা যে তাদের চোখের আড়ালে ঘটছিল, কেউ বুঝতেই পারেনি! মং শো-ই না ব্যাপারটা ধরতে পারল।

গাঁওবুড়া বলল, ‘তোমার কি মনে হয় মং? বনে কি অশুভ কোনো ঘটনা ঘটছে?’

মং চোখ তুলে তাকাল। গাঁওবুড়া তার বাবার বন্ধু। বাবা নেই আজ চার বছর। তিনি ছিলেন এই এলাকার কলেজের একমাত্র ইংরেজি শিক্ষক। মংয়েরও শিক্ষক ছিলেন তিনি। বাবার কলেজেই পড়েছে মং। বাবা তাদের শেক্​সপিয়ারের ম্যাকবেথ পড়াতেন।

একমাত্র সেদিনই ম্যাকবেথ পরাজিত হবে, যেদিন বার্নাম বন ডানসিনান পাহাড়ের অনেক উঁচুতে চলে যাবে, আর তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসবে। শুনে ম্যাকবেথ হেসে বলেছিল যে তা অসম্ভব। কারণ, বৃক্ষেরা ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না, তাই বনের পক্ষেও সম্ভব নয় অন্য কোথাও চলে যাওয়া। 

অথচ ম্যাকবেথ-এও বার্নাম বন সত্যি চলতে শুরু করেছিল। ঠিক তাদের এই রানীর জঙ্গলের মতো। মং ভাবে, তাদের গ্রামের লোকেরা বুঝি ভীষণ এক বিপদে পড়তে যাচ্ছে। গোটা একটা বনের হেঁটে চলে যাওয়া কি কোনো অশুভ লক্ষণ? কিন্তু আপাতদৃষ্টে রানীর জঙ্গলে কোনো নড়াচড়া বা চলন তাদের চোখে পড়ে না। মনে হয় সবকিছু তো স্বাভাবিক। তবে কি বনটা রাতের বেলা হাঁটে? গোপনে পালায়? 

পরদিন থেকে মং গ্রামের ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজে লেগে গেল। বনের মাটি পরীক্ষা করল তারা, হ্রদের জল, গাছের পাতা। মৌমাছি আর পাখিদের পর্যবেক্ষণ করল মনোযোগ দিয়ে। তেমন অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ল না। এ অঞ্চলে দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে বটে। এ বছর অসহনীয় গরম পড়েছে পাহাড়ে। গত বর্ষায় রানীখং পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলে বন্যা হয়েছিল খুব। ভেসে গিয়েছিল সব। তার আগেরবার অসময়ে বৃষ্টি হয়েছিল দুই মাসজুড়ে। মং জানে, জলবায়ু পরিবর্তন ফরেস্ট মাইগ্রেশনের অন্যতম কারণ। বনেরা টের পায় যে এই জায়গা তাদের জন্য আর উপযুক্ত নয়। তাই তারা শিকড়ের টান উপেক্ষা করে চলে যায়। চলে যায় বেঁচে থাকা, টিকে থাকার জন্য। ঠিক যেমন মানুষও পাড়ি জমায় অন্য কোনো দেশে, অন্য কোনো জায়গায়। কিন্তু কী এমন হলো যে রানীর জঙ্গল এত দ্রুত স্থান বদল করছে? প্রতিদিন ইঞ্চি দশেক করে? কী আশ্চর্য ঘটনা! 

বাতাস, পাখি, পতঙ্গ, হ্রদের জল আর প্রাণীদের শরীরে ভর করে টিকে থাকে বনের প্রাণ। এদের মাধ্যমেই তারা নতুন প্রজন্মকে সৃষ্টি করে। প্রাণবাহিত হয় বীজ দ্বারা। কিন্তু যত দূরে গাছেদের বীজ রোপিত হয়, তত কমে আসে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা। তাই বেশির ভাগ গাছ চায়, তাদের বীজেরা থাকুক কাছাকাছি। কিন্তু যখন তা চায় না, তখনই তারা তাদের পাঠিয়ে দেয় দূরদূরান্তে। আর আশ্চর্যজনক উপায়ে সেই বিশেষ বীজগুলো দূরে কোথাও প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার যোগ্যতা অর্জন করে। এই কাজে তাদের সাহায্য করে প্রকৃতি। কিন্তু ঠিক কীভাবে কখন তারা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে এখানে আর থাকবে না? কেন তারা খুঁজে নিতে চায় নতুন ঠিকানা? মং অনেক ভাবে, গবেষণা করে। স্লেটে আঁকিবুঁকি করে। 

তার যাওয়ার দিনও ঘনিয়ে আসে। কিন্তু রহস্যের কূলকিনারা হয় না। গ্রামবাসীর মধ্যে ভয়, অপরাধবোধ আর হতাশা বাড়ে। এরই মধ্যে তাদের বন আরও কয়েক হাত পুব দিকে সরে গেছে। তারা কিছুতেই বুঝতে পারে না কী করলে বন তাদের কাছে ফিরে আসবে। একদিন তারা প্রিয় বনকে ফিরে পাওয়ার জন্য পুজোও দেয়। 

একদিন সন্ধ্যাবেলা একটি মৌয়াল পরিবারের কিশোর ছেলে চাম্পাক ছুটতে ছুটতে এসে মং শোকে বলে যে জঙ্গলে সে নতুন কিছুর সন্ধান পেয়েছে। একটা নতুন গন্ধ, নতুন ধরনের সৌরভ, যা এর আগে সে কখনো পায়নি। আর তা পাওয়া গেছে জঙ্গলের গভীরে অবস্থিত মৌচাকগুলো ঘিরে। মনে হয়, মৌমাছিদের শরীর থেকে আসছে সেই গন্ধ। ভারি আশ্চর্য, ভারি মনমাতানো গন্ধ। 

‘ফেরোমন!’ মং শো যেন একটা ক্লু পেয়ে যায়। চাম্পাকের কথা শুনে লাফিয়ে ওঠে সে। পাওয়া গেছে। ফেরোমন হচ্ছে পতঙ্গ বা প্রাণীর শরীর থেকে আসা সেই বিশেষ গন্ধ, যা অন্য জীবকে উদ্দীপ্ত করে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে। মং শো চাম্পাককে নিয়ে তখনই রওনা হয়। সঙ্গে নেয় আরও দুজনকে। জঙ্গলের একেবারে গভীরে যে অংশে অনেক মৌচাক, সেখানে গিয়ে ডেরা পাতে তারা। দেখতে চায় কীভাবে মৌমাছির মতো এক ক্ষুদ্র পতঙ্গ এই বিশাল বিশাল বৃক্ষকে প্রভাবিত করছে।

মং শোর দল জঙ্গলের ভেতর দিন কাটায়, রাত কাটায়। প্রথম দিন কিছুই ঘটে না, অনেকগুলো মশার কামড় খাওয়া ছাড়া। জোনাকির আলো দেখে রাত পার হয়। দ্বিতীয় দিনটাও বিফলে যায়। কিন্তু তৃতীয় দিন আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। হঠাৎই মাঝরাতে গোটা বন যেন একসঙ্গে জেগে ওঠে। সরসর করে শব্দ করে ওঠে গাছের পাতাগুলো। মৌমাছিরা অকারণে ওড়াউড়ি শুরু করে। কয়েকটা কাঠবিড়ালি লাফাতে লাফাতে চলে যায় পুব দিকে। দূরে হ্রদের জল ফুঁসে উঠতে শুরু করে ক্রমাগত। আর এই রাত্তিরেও কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসে ছোট ছোট পাখি। গোল হয়ে ওড়ে তারা গাছেদের মাথার ওপর। মং শো আর তার সাথিরা অবাক বিস্ময়ে দেখে এসব কাণ্ডকারখানা। যেন রূপকথার চিত্রায়ণ ঘটছে! একটা বন কীভাবে আপাদমস্তক বদলে যাচ্ছে কয়েক মুহূর্তে! 

চনমন করে উঠল মং শোর শরীর। চোখ খুলে গেল তার। পরে তারাও টের পেল সেই তীব্র গন্ধ—মৌমাছি, না পাখি? নাকি উঁচু গজারি আর কাঠবাদামগাছ? কার শরীর থেকে এই সৌরভ আসছে? বোঝা মুশকিল। কিন্তু মাতাল করা ওই গন্ধ যেন সবকিছুকে ক্রমেই উন্মূল করে দিচ্ছে। সবাইকে উদাসী আর ঘরছাড়া করে তুলছে। বনের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। পাতাদের শব্দ এত বেড়ে গেল যেন ঝড় এসেছে। পাখিরাও উড়তে লাগল পাগলের মতো। মৌমাছিরা ভনভন করতে লাগল। কোটর আর ডেরা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে লাগল খরগোশ, শজারু, কাঠবিড়ালি, দাঁতাল শুয়োর ও বাগডাশ। আর তারপরই শুরু হলো গ্রেট মাইগ্রেশন। গাছেরা হঠাৎ হেলতে-দুলতে চলতে শুরু করল, ম্যাকবেথ নাটকের সেই বার্নাম বনের মতো। যেন হাজারো সৈনিক মাথায় নিয়ে চলেছে বনের গাছগুলোকে। মং শো আর তার সাথিরা অভিভূত বিস্ময়ে দেখল সবকিছু। তারপর কী যে হলো তাদের, সম্মোহিতের মতো তারা নিজেরাও শামিল হলো সেই অভিবাসনে। সৈন্যদলের মতো তারাও এগিয়ে যেতে থাকল পুব দিকে—হ্রদের পাশ দিয়ে পাহাড়ের ওপাশে, যেখানে এখনো কোনো লোকালয় নেই।