ধ্বংসস্তূপের নিচে মানবতা কাঁদছে

১৩ দিন ধরে চলছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলে হামলা করার পর পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলও। এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত দুই পক্ষের পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ লাশ হয়েছে। আর গাজার হাজারো নিরস্ত্র মানুষ মুখোমুখি হয়েছে অবিশ্বাস্য এক মানবেতর অভিজ্ঞতার। তেমনই এক কবি মোসাব আবু তোহা। গাজায় শরণার্থীশিবির আল শাতিতে ১৯৯২ সালে জন্ম নেওয়া এই তরুণ কবি তাঁর অবরুদ্ধ দিনগুলোর কথা লিখেছেন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায়। অনুবাদ করেছেন মারুফ ইসলাম

ফিলিস্তিনের গাজা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, কাঁদছে মানবতা
ছবি: এএফপি

আমাদের বাড়িটা তিনতলা। সেদিন রাতে নিচতলায় বসার ঘরে বসে ছিলাম আমরা। আমরা মানে আমার পরিবারের সদস্যরা। এর মধ্যে টের পেলাম, আমার এক ভাই ঢুকল ঘরে।

টের পেলাম বলছি এ কারণে যে ঘরটি ছিল পুরোপুরি অন্ধকার। বিদ্যুৎ ছিল না ২০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমি আমার ভাইকে দেখতে পাইনি, ভাইও দেখেনি আমাকে।

আমি বসে ছিলাম একটি চেয়ারে। টের পেলাম, আমার ভাই পাশের সোফায় বসল। হঠাৎ কয়েক কিলোমিটার দূরে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল আলোর ঝলকানি। সেই ঝলকানিতে আমাদের বসার ঘরটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য আলোকিত হয়ে উঠল। আর আমরা একমুহূর্তের জন্য দেখতে পেলাম পরস্পরকে।

‘ও আচ্ছা! তুমি এখানে!’ আমার ভাই বিস্মিত হয়ে বলল।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী হামলা শুরু করার পর আমাদের জীবনটা এমনই হয়ে গেছে। আমি শেষ গোসল করেছি পাঁচ দিন আগে। আর শেষবার সেলুনে গিয়েছি চার দিন আগে। কোথায় কোথায় যে লুকিয়ে থাকছি, তার ঠিকঠিকানা নেই। আমাদের চারপাশে কারও জীবন এখন নিরাপদ নয়। আমরা কেউ আর আগের মতো নেই।

আমার প্রতিবেশীরা কেউ এখন নিজের বাড়িতে নেই। বিশেষত নারী ও তরুণীরা—সবাই চলে গেছে জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলে। স্কুলটি এখন আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আমি চেষ্টা করেছিলাম, কাছাকাছি একটা স্কুলে আশ্রয় পাওয়া যায় কি না। সেখানকার এক কর্মী বললেন, ‘অন্য কোথাও চেষ্টা করুন। এখানে ধারণক্ষমতার তিন গুণ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। তিলঠাঁই নেই অবস্থা।’

তারপর বাধ্য হয়ে আমরা নিজের বাড়িতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিই। যা আছে কপালে! আমার মা, বাবা, এক ভাই আর আমি বাড়িতেই থাকতে শুরু করলাম।

পরদিন সকাল ১০টার দিকে দেখি, আমার বিবাহিত দুই বোন সান্দোজ ও সাজা তাঁদের স্বামী ও সন্তানসহ আমাদের বাড়ির দরজায় হাজির! সান্দোজের তিনটি ছোট ছেলেমেয়ে রয়েছে। সবচেয়ে বড়টির বয়স ছয় বছর আর সবচেয়ে ছোটটির দুই মাস। তাদের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি, পায়ের তলা কালো হয়ে ফোসকা পড়ে গেছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, দীর্ঘ পথ হেঁটে এসেছে তারা।

আমি গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলি, যাও, আগে গোসল করো।

দুই মাস বয়সী ছোট্ট ভাগনি জেইনা খুক খুক করে কাশছিল। আর আমার বোন সাজা নিঃশব্দে কাঁদছিল। আমি বললাম, কাঁদছ কেন? সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘আমরা ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ কালো ধোঁয়ায় আমাদের বাড়ির চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়। আর আমাদের গায়ের ওপর ঝুরঝুর করে জানালার কাচ ভেঙে পড়ে।’

আমাদের বাড়িটা এখন ১০টি ছোট ছেলেমেয়ে দিয়ে ভরা। সবচেয়ে বড় শিশুটির বয়স আট। সে আমারই ছেলে। আর সবচেয়ে ছোটটি জেইনা।

আমাদের ঘরে খাবারের রসদ ফুরিয়ে আসছে। মা বাধ্য হয়ে রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করলেন। আমরা এখন দিনে তিনবেলার পরিবর্তে দুইবেলা খাই।

আমাদের বাড়ির তৃতীয় তলায় আমার একটা লাইব্রেরি আছে। লাইব্রেরিটায় ঢুকতে এখন খুব খারাপ লাগে। অনেক বই অপঠিত রয়ে গেছে। হিসাব করে দেখলাম, এখানে যত বই আছে, বছরে যদি ৮০টি করে বইও পড়ি, তবু সব শেষ করতে ৫৬ বছর সময় লাগবে। হঠাৎ হাসি পেল। ৫৬ বছর তো দূরের কথা, ৫৬ মিনিট বেঁচে থাকতে পারব কি না, সে নিশ্চয়তা নেই। এখানে প্রতিদিন শত শত মানুষ বোমার আঘাতে প্রাণ দিচ্ছে।

এর আগে ২০০৮-২০০৯ সালের দিকে ইসরায়েল যখন গাজায় হামলা চালিয়েছিল, তখন আমি বেশ খানিকটা আহত হয়েছিলাম। বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। সেই ভয়ংকর স্মৃতি আজও ভুলতে পারি না। সেই স্মৃতি নিয়ে ২০২১ সালে একটি কবিতাও লিখেছি। সেই ইসরায়েল আবার হামলা শুরু করেছে। সব সময় আতঙ্কে থাকি, আবার হয়তো ২০০৮-০৯–এর মতো দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হব।

অনেক দেশ ইসরায়েল থেকে তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নিচ্ছে। আবার অনেক দেশ অস্ত্র দিয়ে, কখনো কখনো চিকিৎসাসামগ্রী দিয়ে ইসরায়েলকে সাহায্য করছে। এসব দেখে আমার বুকটা গভীর বেদনায় ভরে উঠেছে। যেন ইসরায়েলিদের জীবন মহামূল্যবান আর ফিলিস্তিনিদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। তারা সম্ভবত ভুলে গেছে যে আমাদেরও তাদের মতোই দুটো চোখ আছে, দুটো কান আছে এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গও একই। আমরাও ভয় পাই, কাঁদি।

আমি আশা করি, পশ্চিমারা ইসরায়েলকে আরও বেশি অস্ত্র দেওয়ার পরিবর্তে এবং গাজায় মানবিক সাহায্য বন্ধ করার পরিবর্তে ফিলিস্তিনের তরুণেরা কেন সীমান্ত পাড়ি দেন, তা নিয়ে ভাববে। তারা যদি বিশ্বাস করে, আমরাও মানুষ এবং আমাদের কোনো আশ্রয় নেই, প্রতিরক্ষা বাহিনী নেই, বিমানবন্দর নেই, সমুদ্রবন্দর নেই, তাহলে তারা আমাদের বাড়িগুলোর ওপর বোমা বর্ষণ করবে না।

আমার জন্ম হয়েছিল একটি শরণার্থীশিবিরে। কারণ, আমার মা–বাবা তখন উদ্বাস্তু হয়ে ওই শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আর এখন আমরা নিজ বাড়িতে থাকলেও সেটি যেন একটি কারাগার। কোনো জানালা নেই, দরজা নেই, কেবল আমন্ত্রণহীন অতিথির মতো বোমার ধোঁয়া আছে।

ধ্বংসস্তূপের নিচে মানবতা কাঁদছে!

মোসাব আবু তোহার কবিতা

রাস্তার ওপর দরজা

শরণার্থীশিবিরে

বিস্ফোরণে ছিটকে পড়ে দরজাটা,

ধুলোর মেঘের নিচে কাশছে বাড়িগুলো

ঝলসানো বাতাসে নাক ফুলেছে তাদের।

রক্তাক্ত দরজার নিচে মৃতদেহটা পেল মেয়েটা।

মাটির গুমরানো কান্না শোনা যায়।

যদিও আঙুলগুলো

গেছে কাটা মৃত যুবকের, তবু মুঠো তার

ছাড়েনি পুরোনো চাবির গোছা—বাবার রেখে যাওয়া

একমাত্র উত্তরাধিকার।

নিশ্চিত ইয়াফার ওই ঘর টিকে নেই আর, তবু চাবিটাই

পাসপোর্ট তার ইয়াফায় ফেরার।

ইয়াফা শিবিরে সে আর তার

ধসে যাওয়া ঘরসহ দাঁড়াবে না।

মেয়েটা বন্ধ করে দরজা। হৃদয়ে

খোলে অশ্রুর জানালা।

ফিলিস্তিনে ঘটে যাওয়া ধ্বংসযজ্ঞের পটভূমিতে লেখা কবিতাটি ডন: (ডেমোক্রেসি ফর অ্যারাব ওয়ার্ল্ড নাউ) থেকে অনুবাদ করেছেন তানভীর মাহমুদ