কোন দেশে রোজার কী সংস্কৃতি

বিভিন্ন দেশে রোজার মাস ঘিরে গড়ে উঠেছে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি। বিভিন্ন বই ঘেঁটে এশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলোর রমজান মাসের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানাচ্ছেন মারুফ ইসলাম

তুরস্কে সাহ্‌রির সময় গান গেয়ে, ঢোল পিটিয়ে মানুষের ঘুম ভাঙানো হচ্ছেছবি: সংগৃহীত

আমাদের দেশে রোজার ঐতিহ্য মানেই যেমন কাফেলার হাঁকডাকে বিছানা ছেড়ে উঠে ঘুম ঘুম চোখে সাহ্‌রি খাওয়া আর সন্ধ্যায় ছোলা–মুড়ি–খেজুর–শরবত দিয়ে ইফতার করা, মিসরে কিন্তু তেমন নয়। দেশটিতে খেজুর, ডুমুর ও অন্যান্য ফল দিয়ে তৈরি ‘খাচাফ’ নামের একধরনের ফলের জ্যাম দিয়ে সাহ্‌রি করাই প্রধান ঐতিহ্য।

 ইফতারের রকমফের

দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে যেমন ভিন্নতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে সংস্কৃতিতেও ভিন্নতা। সেই ভিন্নতার কারণেই এশিয়ার দেশগুলোয় ইফতারের সময় খাবারের পাতে শোভা পায় সামুচা, পাকোড়া, পেঁয়াজু, বেগুনি। আর একই কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় ইফতারের সময় শোভা পায় ভিন্ন কিছু।

মিসরীয়রা ইফতারের সময় ‘কাতায়েফ’ নামের একধরনের মিষ্টি খায়। দেখতে কিছুটা প্যানকেকের মতো। এটি বাদাম দিয়ে ভরা অত্যন্ত সুস্বাদু একটি খাবার। তুর্কিদের মিষ্টান্নের নাম আবার ‘বাকলাভা’। এই মিষ্টিও তাঁরা প্রতিদিন ইফতারে ও ঈদের দিন খেতে পছন্দ করেন।

উজবেকিস্তানের মুসলমানরা রোজার সময় তাদের ঐতিহ্যবাহী তন্দুর চুলায় একধরনের মাখনের রুটি তৈরি করেন। এটাই তাঁদের ইফতারের ঐতিহ্যবাহী খাবার। মরক্কোর মানুষেরা আবার ইফতারে ‘হারিরা’ নামের একধরনের অতি উপাদেয় ও সুস্বাদু স্যুপ খায়। অনেকটা আমাদের দেশের হালিমের মতো। আবার আমাদের পুরান ঢাকার ‘বড় বাপের পোলায় খায়’–এর মতো একধরনের রুটি খেতে পছন্দ করে সিরিয়ার মানুষেরা। সেই রুটির নাম ‘মারুক’।

পবিত্র রমজান মাসে টানা তিন দিন ধরে কুয়েতে চলে কারকিয়ানআন উৎসব। এখানে ছোট ছেলেমেয়েরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ঐতিহ্যবাহী গান গায়
ছবি: সংগৃহীত

সাহ্‌রির তোড়জোড়

সাহ্‌রি সময় ঘুম থেকে ডেকে তোলাও রমজান মাসের এক সুমহান ঐতিহ্য। পাকিস্তানে অল্পবয়সী কিশোরেরা দল বেঁধে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে গজল গেয়ে মুসল্লিদের ঘুম ভাঙায়। তুরস্কেও এ ধরনের সংস্কৃতি রয়েছে। তারা ঐতিহ্যবাহী অটোমান পাঞ্জাবি ও টুপি পরে ঢোল পিটিয়ে প্রার্থনা সংগীত গায়। আমাদের দেশেও একসময় এ ধরনের সংস্কৃতি ছিল, তাদের বলা হতো ‘কাফেলা’। বর্তমানে সাহ্‌রির সময় পাড়ার মসজিদের মাইক থেকে ডেকে দেওয়া হয়। পাশাপাশি উৎসাহী ছেলেরা ইসলামি সংগীত গাইতে গাইতে ঘুম থেকে ওঠার জন্য মানুষকে আহ্বান জানায় বটে, কিন্তু আগের সেই অবস্থা আর নেই।

এই কাফেলার মতো মরক্কোয় যাঁরা ঘুম ভাঙান, তাঁদের ‘নাফর’ বলা হয়। নাফরেরা ঐতিহ্যবাহী গেন্ডোরা, টুপি ও সাধারণ চপ্পল পরে ঘুরে ঘুরে ঢোল বাজিয়ে সাহ্‌রির সময় ঘুম ভাঙান। সপ্তম শতক থেকে মরক্কোয় এই ঐতিহ্য চলে আসছে।

ইফতারের সময় হয়েছে কি না, সেটি জানান দেওয়ারও রয়েছে নানা ধরনের ঐতিহ্য। যেমন সিরিয়ায় ইফতারের সময় জানানো হয় কামানের গোলার মাধ্যমে। বসনিয়া-হার্জেগোভিনায়ও কামানের গোলার মাধ্যমে রোজা ভাঙার সংকেত দেওয়া হয়।

তবে পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু দেশে সাইরেন বাজিয়ে ইফতারের সময় জানানো হয়। এই সাইরেন বাজানোর সংস্কৃতি একসময় আমাদের দেশেও ছিল। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, বিশ–ত্রিশ বছর আগেও সাইরেন বাজানো হতো শহরে শহরে। এখন এই ঐতিহ্য পুরোপুরি বিলুপ্ত। এখন মসজিদের মাইকে মাগরিবের আজানের মাধ্যমেই ইফতারের সময় ঘোষণা করা হয়।

আলবেনিয়ার মানুষেরা আবার সাহ্‌রি ও ইফতার—উভয় সময়ই রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ঢোল বাজিয়ে প্রার্থনা সংগীত গান। সাধারণত তাঁদের ড্রাম বা ঢোলগুলো তৈরি করা হয় ভেড়া অথবা ছাগলের চামড়া দিয়ে।

রোজার সময় ইরাকে ইফতার সেরে মাগরিবের নামাজ আদায় করে মেহিবেস নামে একধরনের খেলা খেলেন পুরুষেরা
ছবি: সংগৃহীত

আরও কিছু রেওয়াজ

সাহ্‌রি ও ইফতারের বাইরে রোজাকে ঘিরে আরও কিছু রেওয়াজ দেখা যায় দেশে দেশে। যেমন মিসরীয়রা তাদের রাস্তাগুলো সুন্দর সুন্দর কাচের লণ্ঠন দিয়ে সাজিয়ে রোজাকে স্বাগত জানায়। এসব লণ্ঠনের নাম ‘ফানুস’। সেগুলো দেখতে আমাদের দেশের আকাশে ওড়ানো ফানুসের মতো নয়।

এ ছাড়া মুসলিম–অধ্যুষিত দেশগুলোর প্রায় প্রতিটি বাজার এই রমজানে আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়ে ওঠে। ঘরে ঘরেও অনেকে চাঁদ–তারার অলংকার সাজিয়ে ঝুলিয়ে দেন। ঈদের আগে সবাই ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে ঝকঝকে তকতকে করে ফেলেন। ঈদ উপলক্ষে প্রায় সবাই সাধ্যমতো জামাকাপড় কেনা থেকে শুরু করে নানা ধরনের উপহারসামগ্রী ও কার্ড কেনেন এবং উপহার দেন।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘হক আল লায়লা’ নামে বিখ্যাত এক উৎসব রয়েছে। এটাই তাদের রোজার ঐতিহ্য। তবে এটি শুরু হয় রমজান মাস শুরু হওয়ার ১৫ দিন আগে। উৎসবটিতে শিশুরা উজ্জ্বল পোশাক পরে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায় এবং ঐতিহ্যবাহী আরবীয় গান গায়। তখন পাড়ার বাসিন্দারা তাদের ‘খরিতা’ নামের একধরনের মিষ্টি খাবার উপহার দেন।

সারা বিশ্বে যখন সামাজিক বন্ধনগুলো শিথিল হয়ে আসছে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বাড়ছে, তখন আমিরাতের এই ঐতিহ্য সামাজিক বন্ধন ও পারিবারিক মূল্যবোধ আরও দৃঢ় করছে বলেই মনে করছেন সমাজ বিশ্লেষকেরা।

প্রথম ছবিতে মিসরে রাস্তার পাশের দোকানে বিক্রি হচ্ছে ফানুস। কায়রোর রাস্তায় এই ‘ফানুস’ নামের সড়কবাতি দিয়েই রোজাকে স্বাগত জানান তাঁরা

কুয়েতেও প্রায় কাছাকাছি ধরনের একটি উৎসব রয়েছে, যার নাম ‘কারকিয়ানআন’। পার্থক্য শুধু এটুকুই যে তারা এই উৎসব পালন করে রমজান মাস শুরু হলেই টানা তিন দিন ধরে। ছোট ছেলেমেয়েরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ঐতিহ্যবাহী গান গায়। পাড়াপড়শিরা শিশুদের বিভিন্ন উপহার দিয়ে খুশি করেন।

ইরাকে রোজার সময় একধরনের খেলা খেলেন মুসলমানরা। খেলাটির নাম ‘মেহিবেস’। ইফতার সেরে মাগরিবের নামাজ আদায় করে এই খেলা খেলতে মাঠে নামেন পুরুষেরা। মেহিবেস হচ্ছে একটি ছোট রিং। এটি কম্বলে লুকিয়ে রেখে খেলতে হয়। অন্যরা সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। ইরাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই খেলা চলছে।

আপনি যদি ইন্দোনেশিয়ায় যান, দেখবেন রোজার সময় সব মুসলমান প্রতিদিন তাঁদের মৃত আত্মীয়স্বজনের কবর জিয়ারত করছেন। এটাই তাঁদের রমজানের ঐতিহ্য। তাঁরা প্রতি রমজানে তাঁদের পরিবারের মৃত সদস্যদের বিশেষভাবে স্মরণ করেন। এই প্রথার নাম ‘নাইকার’। যুগ যুগ ধরে ইন্দোনেশিয়ায় এই প্রথা চলে আসছে।

মিসরের হারিরা স্যুপ, তুর্কিদের বাকলাভা ও উজবেকিস্তানের মারুক রুটি—নিজ নিজ দেশের ইফতারে এগুলো খুবই জনপ্রিয়
ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষেরা রোজার শুরুর চাঁদ দেখাকেই উৎসবে পরিণত করেছেন। তাঁরা রমজানের একচিলতে চাঁদ দেখার জন্য সমুদ্রসৈকত ও পাহাড়ের চূড়ায় জড়ো হন।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও প্রচুর মুসলমান রয়েছেন। সেখানে সাহ্‌রির সময় যাঁরা ঘুম ভাঙান, তাঁদের ‘সাহ্‌রিওয়ালা’ বলে ডাকা হয়। তাঁরাও পাড়া ও মহল্লার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ইসলামি সংগীত গান। ভারতে এই সংস্কৃতি ক্রমে কমে এলেও পুরোনো দিল্লিতে এখনো টিকে আছে।

সূত্র: মুসলিম এইড, কারাম ফাউন্ডেশন ও মিডিয়াম