‘আমার মানসিক যন্ত্রণার সময় তোদের কাছ থেকে যেটা চেয়েছিলাম, তা হলো চিঠি’

শহীদজননী জাহানারা ইমামের কর্মময় জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন চিত্রশিল্পী মাসুক হেলাল। আরও অনেকের মতো তিনিও তাঁকে ডাকতেন ‘আম্মা’ বলে। ১৯৮১ সালে শহীদজননীর ক্যানসার ধরা পড়ে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৪২ বছর। ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ছোট ছেলে জামীর কাছে প্রায়ই যেতে হতো। সে সময় জাহানারা ইমামের সঙ্গে নিয়মিত চিঠি বিনিময় হতো এই শিল্পীর। এ রকমই একটি চিঠির স্মৃতি ‘প্রথম আলো’র পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন চিত্রশিল্পী।

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম

‘প্রিয় মাসুক,
ওরে হতচ্ছাড়া, বাঁদর, মুখপোড়া হনুমান, দু–দুটো  চিঠি দিলাম বেবীর (প্রয়াত সাংবাদিক বেবী মওদুদ) ঠিকানায়, একটারও জবাব দিলি না? মানলাম তুই রাত দেড়টা–দুটো পর্যন্ত “বিচিত্রা”র স্বাধীনতা, ফ্যাশন, ঈদ—এই সব সংখ্যার কাজ করিস। এর মধ্যেই কি রাত দেড়টার সময় তোর মোটা তুলি দিয়ে দু–চার কথা লিখে, নিদেনপক্ষে একটা স্কেচ এঁকেও কি পোস্ট করা যেত না? আমার অমন মানসিক যন্ত্রণার সময় সবচেয়ে যেটা তোদের কাছ থেকে চেয়েছিলাম, তা হলো তোদের কাছ থেকে চিঠি। না বেবী, না তুই—সেটুকুও দিতে পারলি না! যা, তোর মুখে ছাই।
 আম্মা’

আম্মাকে নিয়ে আমার কথা

আমরা, সাপ্ত‌াহিক ‘বিচিত্রা’র কর্মীরা শহীদজননী জাহানারা ইমামকে ‘আম্মা’ বলে ডাকতাম। ‘বিচিত্রা’র সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী ছিলেন জাহানারা ইমামের ছেলে ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম সদস্য শহীদ শাফী ইমাম রুমীর সহযোদ্ধা। রুমী শহীদ হলে তাঁর সহযোদ্ধারা সবাই জাহানারা ইমামকে ‘আম্মা’ বলে ডাকতেন। তিনিও তাঁদের ঠিক সন্তানের মতোই দেখতেন। মা সন্তানের জন্য যা যা করেন, তিনিও তা–ই করতেন। আমাদের সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরীসহ আমরা ‘বিচিত্রা’র সবাই তাঁকে ‘আম্মা’ বলে ডাকতাম।

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, সাংবাদিক বেবী মওদুদের সঙ্গে শিল্পী মাসুক হেলাল
ছবি: পাভেল রহমান

১৯৯০ সালে, দ্বিতীয়বার ক্যানসার চিকিৎসার জন্য তাঁকে আমেরিকার মিশিগানে নিয়ে গেলেন (জাহানারা ইমামের ছোট ছেলে) জামী ভাই। সেখানে আম্মার অপারেশন হলো মুখে, মাড়িতে। সেই সময় এই চিঠি তিনি আমাকে লেখেন। আমি, আলোকচিত্রী পাভেল রহমান ও সাংবাদিক বেবী মওদুদ—আমরা আম্মাকে নিয়মিত চিঠি লিখতাম। সে সময় কোনো কারণে আমাদের চিঠিগুলো আম্মার হাতে পৌঁছায়নি। আম্মার এই চিঠি পাওয়ার দু–এক দিন পরই তিনি আমার অনেকগুলো চিঠি পান।

একনজরে শহীদজননী জাহানারা ইমাম

শহীদজননী জাহানারা ইমাম। ১৯২৯ সালের ৩ মে ভারতের মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাকনাম ছিল জুডু। জুডু নামের এই কিশোরী কুড়িগ্রাম শহরজুড়ে সাইকেল চালাতেন। বাম রাজনীতিতে যোগ দিয়ে মুকুল ফৌজ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট বাবার সংগ্রহে রাখা দেশি-বিদেশি বই, পত্রপত্রিকা পড়তেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই পরিচিত হয়েছিলেন তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি, শেক্‌সপিয়ারের লেখার সঙ্গে। রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ পাস করে কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে স্নাতক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবন শুরু করেন ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুলে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। ১৯৪৮ সালে স্বামী শরীফ ইমামের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫২ সালে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব নেন।

মাসুক হেলালকে লেখা জাহানারা ইমামের চিঠি

১৯৫১ সালে তাঁর প্রথম সন্তান রুমির জন্ম হয়। ষাটের দশক থেকে জাহানারা ইমাম একটু একটু করে লেখালেখির সঙ্গে জড়িয়ে যান। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বড় ছেলে শাফী ইমামকে হারান। কয়েক মাসের মধ্যে স্বামী শরীফ ইমামকেও পাকিস্তানি হানাদাররা নির্মম নির্যাতন করে আহত অবস্থায় মুক্তি দেয়। বিজয়ের দুই দিন আগে শরীফ ইমাম মারা যান। বিজয়ের পর রুমীর সব বন্ধুসহ সব মুক্তিযোদ্ধা তাঁকে তাঁদের জননী হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। এক শহীদের জননী, হাজার মুক্তিযোদ্ধার জননী হয়ে ওঠা এই নারী পরিচিতি পান সবার ‘শহীদজননী’ হিসেবে। জাহানার ইমাম রচিত ‘একাত্তরের দিনগুলি’ এক মহৎ রচনা। বাংলাদেশের জন্মকথার এক আঁকর গ্রন্থ। তাঁর লেখা আর প্রকাশিত বইয়ের তালিকায় আছে ‘অন্য জীবন’ (১৯৮৫), ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ (১৯৮৫), ‘জীবন মৃত্যু’ (১৯৮৮), ‘চিরায়ত সাহিত্য: শেক্‌সপিয়ার ট্র্যাজেডি’ (১৯৮৯), ‘বুকের ভিতরে আগুন’ (১৯৯০), ‘নাটকের অবসানে’ (১৯৯০), ‘দুই মেরু’ (১৯৯০), ‘নিঃসঙ্গ পাইন’ (১৯৯০), ‘নয় এ মধুর খেলা’ (১৯৯০), ‘ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস’ (১৯৯১), ‘প্রবাসের দিনলিপি’ (১৯৯২)।