নদীর ওপার পাখির বাসা

আমার মা যে এমন একটা কথা আমাকে বলে ফেলতে পারেন ধারণা ছিল না। কেন যেন মনে হচ্ছে তৃণই বলিয়েছে মাকে দিয়ে। ও নিজে বলার সাহস পাচ্ছিল না। আমার এ রকম মনে হওয়ার কারণটা হলো বাসাবদলের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছিল, ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলোতে ও বেশ কদিন মুখ ফসকে বলে ফেলেছে, ‘ইশ্​! তোমার অত বড় বুকশেলফটা যে নতুন বাসায় কোথায় রাখব!’

আমি ওর কথা ঝেড়ে ফেলার মতোই বলেছি, ‘চিন্তা কোরো না। ব্যবস্থা একটা হবেই।’

কিন্তু মা আর তৃণ দুজনের কেউ আমার মতো স্বপ্নে ভাসা মানুষ নন। নতুন বাসার ঘরদোর, আয়তন, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন, ছেলেমেয়ে, নাতি–নাতনিদের ভবিষ্যৎ—সবকিছু নিয়ে চুলচেরা ভেবে চলেছেন। কোনো রকম আবেগকেই যেন প্রশ্রয় দিতে রাজি নন। আজ নাশতা খাওয়া শেষ হতেই মা তুললেন কথাটা, ‘তোর বইয়ের বড় বুকশেলফটা নতুন বাসায় না নিলে হয় না?’

এমন একটা প্রশ্নের জন্য সত্যিই প্রস্তুত ছিলাম না। চট করে কী উত্তর দেব! হতভম্ব হয়ে জানতে চাইলাম, ‘কী করব ওটা?’

‘বেচে দে কারও কাছে।’

‘বইগুলা?’

‘রেখে কী করবি? তুইও তো পড়স না।’

চমকে উঠলাম মায়ের কথা শুনে। অজান্তেই মনের চোখ দিয়ে নিজের দিকে তাকালাম। সত্যিই তো আজকাল আমি তেমন পড়ি না। আগে যেমন অফিসে যাওয়ার সময় ব্যাগে একটা বই নিয়ে যেতাম, বাসায় ফিরে বিশ্রাম নিয়ে এক ঘণ্টা হলেও পড়তাম, সেসব অভ্যাস বুঝি হারিয়েই ফেলেছি!

না না। হারাইনি তো। একদমই হারাইনি। আজও আমি বইয়ের প্রতি সমান ভালোবাসা অনুভব করি। ভালো কোনো বইয়ের সন্ধান পেলে রকমারিতে অর্ডার দিই। আমি জানি, এই অনলাইন-আসক্তি আমার বেশি দিন থাকবে না। পাখিরা একদিন আমাদের শহরে ফিরে আসবেই আসবে! বইয়ের ঘ্রাণে আবার আমি বিমনা হব! মা কীভাবে বলতে পারলেন বুকশেলফটা সরাতে? চা না খেয়েই নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়লাম।

মা সত্যি আমার ভেতরটাকে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছেন! যতটা না বুকশেলফটাকে সরাতে বলে, তার চেয়ে আমি যে সমুদ্রের সিংহাসন হারিয়ে ফেলেছি, সে ব্যাপারটা ধরিয়ে দিয়ে! মেঘসাম্রাজ্যেরও বুঝি পতন হবে!

কতক্ষণ পর কিচেন থেকে তৃণ আসে। চায়ের কাপ হাতে। আমাকে গাট্টা মেরে শুয়ে থাকতে দেখে জানতে চায়, ‘অফিসে যাবে না? কটা বাজে, দেখেছ?’

আমি শুয়ে শুয়ে পা নাড়াই। প্রথম বৃষ্টি নামার পর মাটির যে সোঁদা গন্ধ আসে, তা মনে আনার চেষ্টা করি। একধরনের অক্ষমতা আমাকে কুরে কুরে খায়। তৃণ চায়ের কাপটা সাইড টেবিলে রেখে মাথার কাছে বসতেই পাখি হত্যার বিচার জানাই, ‘মা কীভাবে বলল বুকশেলফটা বিক্রি করে দিতে!’

তৃণ চুপ হয়ে যায়। অনেকক্ষণ কী ভাবে। তারপর একটা ঘাসফড়িংয়ের আর্তনাদ ছড়িয়ে বলে, ‘আচ্ছা, নতুন বাসায় ওটা কোথায় রাখবা? চিন্তা করছ?’

আমি তৃণর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাই। কিন্তু আমার সব মনোযোগ আফতাবনগর আমাদের নতুন বাসার ওপর স্থির হয়ে থাকে। চার বেডরুমের বাসা। মাস্টার বেডরুমে থাকবেন মা–বাবা। তার পরের রুমে ছেলে। সিফাত। ও মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ার। তৃতীয় বেডরুমে মেয়ে। সারা। অনার্সে অ্যাডমিশন নিল। তার পরেরটায় আমরা দুজন। ওটা মূলত গেস্টরুম। আঁটাআঁটি করে দুজন থাকা যাবে।

নতুন বাসা নেওয়াটা জরুরি হয়েছিল। কিন্তু সবখানেই তো আর বাসা নেওয়ার সামর্থ্য থাকে না। করোনার পর বদলে গেছে জীবনধারা। আমার রিটায়ার্ড শিক্ষক বাবা এখন আর ছাত্র পড়াতে পারেন না। চোখ দুটো প্রায় গেছে। অনেক ছাত্র ছিল বাবার। এখন আমার একার বেতনেই চলছে সংসার। সে জন্য শান্তিনগরের বহুদিনের বাসা ছেড়ে বেছে নিয়েছি শহরের প্রায় বাইরের কোনো এলাকাকে। ওদিকে ভাড়াটা এখনো সাধ্যের মধ্যে আছে। ছেলেমেয়ের ভার্সিটিও কাছে।

কী, কোথায় রাখবা বললা না?

আমি কোনো উত্তর দিতে পারি না। এত দিন বড় বুকশেলফটা ড্রয়িংরুমেই ছিল। সবার অমতেই ছিল। একদিন হুট করেই রঙিন প্রজাপতির মতো অনাহুতই ঘরে এসে জুটেছিল ওটা। করোনা আসার চার বছর আগেই হবে, বৈবাহিক সূত্রে আমার এক আত্মীয় মাকসুদুল বারী ঢাউস সাইজের বুকশেলফটা তাবৎ বইসহ আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। সারা জীবনের জন্য তিনি কানাডায় সেটেল হবেন। প্রিয় সংগ্রহগুলোকে বুঝি সের দরে ছাড়তে চাইছিলেন না। বারবার বলছিলেন, দেশে এলে তোমার বাসায় দেখতে যাব! তিনি আমার বইপ্রীতিকে সম্মান দিয়েছেন। বুকশেলফটা যতই বড় হোক আর বই হোক যতই অপছন্দের, তবু তখন আমার বাসার সবার কাছে ছিল প্রাপ্তি! রঙিন প্রজাপতিকে কি কেউ ঘর থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে পারে?

কিন্তু বাসাবদলের ঝঞ্ঝাটে সে প্রাপ্তিই এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটার সঙ্গে তো অর্থনৈতিক জটাঝুটও রয়েছে! ট্রাকে আলমারি, টিভি, ফ্রিজ, ওভেন, খাট–পালঙ্ক, এমনকি ঝাড়ু বা বদনা নিলেও ক্ষতি নেই কিন্তু এই যে এত বই, বিপুলসংখ্যক বই, সংখ্যাহীন অগণিত বই—এসব কার কাজে লাগবে? কী হবে এসব দিয়ে?

সত্যিই তো! আমি ছাড়া আর কে পড়ে বই? পড়ে তো পড়েই না, তাকিয়েও দেখে না একবার বইয়ের দিকে! কারও সামান্য আবেগও নেই এসব বইকে ঘিরে! অথচ একসময় ছিল, ভালোভাবেই ছিল, হাসনাহেনার ঘ্রাণে ভুর ভুর করত আমাদের গোপীবাগের বাসাটা। মার মুখে আমি রবীন্দ্রনাথের ‘কুমু’র গল্প শুনেছি! নৌকাডুবি, যোগাযোগ, শেষের কবিতারও। শরৎচন্দ্রের এমন কোনো বই বাকি নেই, যা পড়েননি। কবে কবে যে বুকের ভেতর চর পড়ল! ছানিপড়া চোখে মা এখন স্মার্টফোনে ফেসবুক দেখেন। ইউটিউবে রান্নার রেসিপি ঘাঁটেন। মজার কিছু পেলে আমাদের সঙ্গেও শেয়ার করেন।

আব্বারও যৌবনস্মৃতিময় অনেকগুলো বই রয়েছে এখানে। যত না আব্বার, তার চেয়ে দাদোর। দাদো সেই পঞ্চাশে বর্ধমান থেকে চলে আসার সময়ই অনেক বই বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। সেখানে মানিক-তারাশঙ্কর-বিভূতিসহ কে না উপস্থিত ছিলেন! রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকান্ত থেকে শরৎ-বঙ্কিম, নীহাররঞ্জন, ফাল্গুনী, আকবর হোসেন, বিষাদ–সিন্ধু, সালেহা! সেসব বই পড়ে পড়েই তো আমি বই পড়ায় নেশাগ্রস্ত হয়েছি। সেই বইপ্রিয় বাবা কীভাবে কীভাবে ব্যর্থ হাহাকার হয়ে গেলেন! তাঁর ধারণা, বই পড়তে পড়তেই আমরা তাঁর ছেলেমেয়েরা উচ্ছন্নে গিয়েছি! সারাক্ষণ কেবল বিবেকতাড়িত থাকি, যা এ যুগে মানায় না!

তৃণ তো ব্যস্ত রান্নাবান্না সাংসারিক ঝুটঝামেলা নিয়ে। এরপর ফেসবুক আর ইউটিউবে ঘুরপাক। ছেলেমেয়ে দুটো তো পুরোই ডিজিটাল। শুধু আমিই পড়ে আছি বই নিয়ে। বই ঘিরেই পড়িমরি! তাই আমার বইগুলো আর সবার কাছে কাগজের পিণ্ড ছাড়া যে অন্য কিছু মনে হবে না, সেটাই স্বাভাবিক।

না, আমি আমার মা–বাবা, স্ত্রী–সন্তানকে দোষ দিচ্ছি না। ওদের কী দোষ? আসলে সময়ই বোধ হয় বদলে দিয়েছে সবাইকে।

আমাকে বিছানায় ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত দেখে তৃণ মাথা ঝুঁকিয়ে নিচে নেমে আসে। চুমু খায়। তারপর ফিসফিসিয়ে বলে, চলো একদিন নদীর ওপার যাই।

কেন?

তুমি তো বিয়ের আগে থাকতা? তোমার কত স্মৃতি!

হুম।

ওপারে দেখো সস্তা একটা রুম পাও কি না, তোমার বুকশেলফ আর বইগুলা রেখে আসব। মাঝেমধ্যে গিয়ে যত্ন নেব।

তৃণর কথা শুনে আমার ভালো লাগে, মনটা ভালো হয়ে যায়। ‘নদীর ওপার পাখির বাসা’ গানটার কথা মনে পড়ে! আমি গুনগুনিয়ে উঠি। আমি জানি, তৃণর বাপের বাড়িটা কাছাকাছি হলে ওখানেই বুকশেলফটা রাখতে বলত। সেটা যে অনেক দূর। সেই কয়া! কুষ্টিয়া! আর আমার তো দেশের বাড়িই নেই, নেই সামান্য একটু ভিটার ঠাঁই! আমার দাদো সব সম্পত্তি ফেলে এসেছেন বর্ধমানে। পানির দরে বিক্রি করে এসেছেন। রাগে-দুঃখে-অভিমানে আর কখনো যাননি। স্কুলমাস্টার বাবাও এ দেশে কিছু করতে পারলেন না। আমরা শূন্যের ওপর ভাসমান। তৃণকেই আমার দেশের বাড়ি মনে হয়, মনে হয় আমার এক টুকরো ভিটে। অফিসে যাওয়ার জন্য আমি উঠে বসি। চা মুখে দিই। ঠান্ডা। বিস্বাদ।

দুই

এক কাকভোরে আমরা দুজন ঠিকই পৌঁছে যাই বুড়িগঙ্গার ওপার। মা–বাবার সঙ্গে রাগ করে দুই বছর জিনজিরার এক বাড়ির চিলেকোঠায় ছিলাম যৌবনে, বিয়ের আগে। সে বাড়িটাই আর নেই। চিলেকোঠা তো চিলেকোঠা, একটা চড়ুই পাখির ভেন্টিলেটরেরও খোঁজ মিলল না দুপুরতক। শেষে আমি তৃণকে নিয়ে কলাকোপা-বান্দুরার বাসে উঠে বসি।

তৃণ বলে ‘কই যাও’। উত্তর দিই না!

বাস থেকে নেমেও আমি তৃণর সঙ্গে কথা বলি না। ইছামতী নদীর দিকে হাঁটি। হেঁটে যাই। হাঁটতেই থাকি। তৃণ বলে ‘কই যাও’। উত্তর দিই না। একটা খোলা ছইহীন নৌকার মধ্যে উঠে বসি। মাঝিকে জিজ্ঞেস করি, পাল নাই?

মাঝি হাসে। উল্টো জানতে চায়, কোন যুগে আছেন?

আমি আকাশের সাদা পাল নীল জমিন আর ইছামতীর টলটলে জলের দিকে তাকিয়ে দিশা পাই না, এ আমি কোন যুগে আছি! আমার খালি মনে পড়ে দাদো সাইকেল চালাচ্ছেন বর্ধমানে! সাইকেল চালাতে চালাতে কোথায় যে হারিয়ে যাচ্ছেন, চারদিকে শুধু মাঠ আর মাঠ, খোলা প্রান্তর, দাদো আর সেখান থেকে ফিরতে পারছেন না, ভয়ে, একা! আমি কেমন ঘামতে থাকি!