তেমুজিনের দেশে
মঙ্গোল সাম্রাজ্যের প্রাচীন রাজধানী কারাকোরামে
মঙ্গোলিয়ার পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটে চেঙ্গিস খানের নাম অথবা উল্টোটি বললেও ভুল হবে না। মধ্যযুগে মঙ্গোল সাম্রাজ্য ছিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ। ভ্রমণকারী এলিজা বিনতে এলাহী একবিংশ শতাব্দীতে কেমন দেখলেন আজকের মঙ্গোলিয়া? সেই অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করছেন ধারাবাহিকভাবে।
মঙ্গোল যাযাবর পরিবারকে বিদায় জানিয়ে পথ ধরলাম নতুন গন্তব্যের দিকে। একই রকম পথ। প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে ঘাস মাড়িয়ে ড্রাইভার আর্থ কোথায় ছুটছে কে জানে! সামনে পাহাড়, মাঝেমধ্যে প্রাণীর মেলা আর ছোট ছোট ঘাস। কেবল পথের ধরন বদলায়, এই যেমন মিনিট দশেক সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে যাচ্ছি, আবার খানিক বাদেই কাঁকড়যুক্ত মাটির পথ। ভাবি, এই বুঝি স্বাভাবিক রাস্তায় এলাম। আমরা তথাকথিত শহুরে মানুষজন যাকে সড়ক মনে করি। মঙ্গোল রাজ্যে এই রকম আঁকাবাঁকা প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে গাড়ির চাকায় তৈরি পথই তাদের জন্য সড়ক।
গাইড তুসিনতুর বলছে, এলিজা, আজ সড়ক পুরোটাই এ রকম। তবে যে বলল, শহরে যাচ্ছি, শহরের কাছাকাছি গিয়ে পেভরোড পাব! রোড ট্রিপ শুরুর সময় থেকেই একটি কথা মাথায় ঘুরছে, আর্থ পথ কী করে খুঁজে পায়। বিশাল প্রান্তর তো দশমুখো। তুসিনতুরের ব্যাখ্যা হলো, অসংখ্যবার পর্যটক নিয়ে এসেছে আর্থ। এই পুরো অঞ্চল আর পথগুলো ওর চোখের কোণে স্ক্যান করা আছে।
যেতে যেতে আজকের পরিকল্পনা জেনে নিলাম তুসিনতুরের কাছ থেকে। এই পথ আমাদের নিয়ে যাবে একটি জাদুঘরের সামনে। গুরভানবুলাগ গ্রাম থেকে আমাদের গন্তব্য ১২০ কিলোমিটার দূরে। রাজধানী উলনবাটোর থেকে কারাকোরামের দূরত্ব প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। আমরা যে শহরে যাচ্ছি, সেটি ত্রয়োদশ শতাব্দীর, বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। মঙ্গোল সাম্রাজ্যের প্রাচীন রাজধানী কারাকোরাম। আমাদের গাইড বেশ গর্ব করে বলছিল কারাকোরামের কথা।
ঘণ্টা তিনেক পর আমাদের গাড়ি এসে থামল কারাকোরাম জাদুঘরের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে জাদুঘর চত্বরে প্রবেশ করলাম। তুসিনতুর বলল, খুব বেশি বড় নয় জাদুঘরটি তবে এটি কারাকোরাম শহরের একটি উল্লেখযোগ্য স্থান। জাদুঘরটিতে মূলত মঙ্গোলিয়ার প্রাচীন ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রাসম্পর্কিত বিভিন্ন বস্তু প্রদর্শন করা হয়েছে। প্রাচীন কারাকোরাম শহরের ধ্বংসাবশেষ, মঙ্গোলিয়ান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন সময়ের নিদর্শন এবং স্থানীয় কারুশিল্প ও শিল্পকলার বিভিন্ন সংগ্রহ রয়েছে।
চত্বরে ঢুকলেই প্রথমে চোখ যায় সামনে থাকা একটি সাদা মার্বেল পাথরের ভাস্কর্যের ওপর। অবয়ব দেখে মনে হচ্ছে, প্রাণীটি কচ্ছপ। কচ্ছপের পিঠে স্থাপন করা হয়েছে একটি মনোলিথিক স্টোন। স্টোনের শীর্ষে অল্প কারুকাজ করা। জিজ্ঞেস করার আগেই তুসিনতুর বলল, টারটেল রক। মঙ্গোল দেবতা। তবে এটি পুরোনো নয়, নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। কারাকোরাম শহরে তিনটি স্থানে টারটেল স্টোন রয়েছে যা এই শহরের প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য দেয়।
আমি আরও কিছুটা ব্যাখ্যা চাইলাম। আসলে এটি চীনা দেবতার প্রতিকৃতি। চীনা পুরাণের একটি চরিত্র বিক্সি। ড্রাগন রাজার ৯ পুত্রের একজন বিক্সি। তাকে কচ্ছপের খোলসওয়ালা ড্রাগন হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। আগের পর্বগুলোয় বলেছি, মঙ্গোল রাজ্যে তিব্বতীয় বৌদ্ধ ও রাশান সংস্কৃতির প্রভাব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে চীনা সংস্কৃতির প্রভাব। ধীরে ধীরে চীনা দেবতা হয়ে ওঠেন মঙ্গোল দেবতা।
জাদুঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই স্যুভেনির শপ। তার পাশেই টিকিট কাউন্টার। স্যুভেনির শপে এখনই যাব না। আগে জাদুঘর উপভোগ করি, তারপর।
প্রাচীন মঙ্গোলীয়রা বৃহৎ পরিসরে সভ্যতা তৈরি করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও, তাদের সৃষ্টির ইতিহাস সম্পর্কে খুব কম দলিল ও প্রমাণ পাওয়া যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই, বিদেশি ভ্রমণকারীদের লেখা নোট এবং প্রতিবেশী রাজ্য ও সাম্রাজ্যের ইতিহাস বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা দলিল হিসেবে কাজ করে। এর মূল কারণ হয়তো মঙ্গোলীয়দের যাযাবর সংস্কৃতি, যারা দীর্ঘ সময় এক অঞ্চলে অবস্থান করে না। ফলে তাদের পূর্বপুরুষদের দ্বারা বিভিন্ন পাথর এবং পাহাড়ের ওপর লেখা শিলালিপিগুলো কয়েক শ বছর ধরে আজও টিকে আছে। তা ছাড়া বৃহৎ শহরের ধ্বংসাবশেষ ও প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে আবিষ্কৃত নিদর্শনগুলোও মঙ্গোলিয়ার প্রাচীন ইতিহাস ও সভ্যতার প্রকৃত ‘সাক্ষী’ হিসেবে কাজ করে চলেছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনগুলোর একটি হলো রাজধানী কারাকোরামের ধ্বংসাবশেষ—মঙ্গোল সাম্রাজ্যের রাজধানী যাকে মধ্যযুগে বিশ্বের বৃহত্তম শহর বলে মনে করা হতো।
বছরের পর বছর ধরে পণ্ডিত ও গবেষকদের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা ও খনন কাজ প্রমাণ করেছে যে ওরখোন উপত্যকায় কারাকোরাম শহরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে।
সুতরাং বিশ্ব ঐতিহ্য ওরখোন উপত্যকার সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্য এবং কারাকোরামের প্রাচীন রাজধানীর সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক নিদর্শন সংরক্ষণ ও প্রচারের লক্ষ্যে, কারাকোরাম জাদুঘরটি ২০১০ সালে জাপান সরকারের অফেরতযোগ্য সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার পরপরই মঙ্গোলিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেসের প্রত্নতত্ত্ব ইনস্টিটিউট থেকে ৯৯টি নিদর্শন গৃহীত হয় এবং জাদুঘরে প্রদর্শন করা হয়।
আজ অবধি কারাকোরাম জাদুঘরের সংগ্রহে মোট ৩ হাজার ১২৮টি নিদর্শন নিবন্ধিত হয়েছে, যার মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান থেকে নেওয়া হয়েছে। জাদুঘরের ৬৩টি প্রদর্শনী মঙ্গোলিয়ার অমূল্য ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায়ও নিবন্ধিত হয়েছে।
মঙ্গোলিয়ার প্রথম সাম্রাজ্য হুন্নুর সময় থেকে শুরু করে প্রথম তুর্কি খাগানাতে, উইঘুর খাগানাতে, লিয়াও রাজবংশ, রৌরান খাগানাতে এবং মঙ্গোল সাম্রাজ্যের নিদর্শনগুলো জাদুঘরে রাখা হয়েছে। সব তথ্যই আসলে জাদুঘরের বিভিন্ন বোর্ডে লেখা রয়েছে।
জাদুঘরের সংগ্রহে প্যালিওলিথিক যুগ থেকে শুরু করে ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত কিছু আকর্ষণীয় নিদর্শন রয়েছে। জাদুঘরের সংগ্রহ থেকে মঙ্গোল সাম্রাজ্যের রাজধানী কারাকোরামের সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিদর্শনের কথা বলছি। বাইরে যেমন টারটেল স্টোন দেখে এলাম। জাদুঘরে আরও একটি মনোলিথিক স্টোন দেখলাম; নাম ডিয়ার স্টোন।
ডিয়ার স্টোন! এগুলো নাকি ব্রোঞ্জ যুগের। কী সাংঘাতিক! ব্রোঞ্জ যুগের কয়েকটি পাথর আমার চোখের সামনে। এগুলো দেখতে মেগালিথ স্তম্ভের মতো। কোনো কোনো পাথরের গায়ে কারুকাজ রয়েছে, কোনোটির নেই, আবার কোনোটির গায়ে কিছু লিখিত রয়েছে। ডিয়ার স্টোনগুলোর বয়স খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৬০০। শবদেহ মাটি চাপা দেওয়ার পর পাশে এই সব স্টোন স্থাপন করা হতো। সহজ করে বলতে গেলে, ব্রোঞ্জ যুগের এপিটাফ এগুলো। পুরো মঙ্গোলিয়ায় প্রায় দেড় হাজার ডিয়ার স্টোনের সন্ধান পাওয়া গেছে। দেশের বিভিন্ন জাদুঘরে সেগুলো সংরক্ষিত আছে।
গুয়ুগ খানের চিঠি! ১২৪৫ সালে মঙ্গোলিয়া সফরকারী প্লানো কার্পিনির নোটে বলা হয়েছে, কোজমা নামের এক রাশিয়ান কারিগর মহান মঙ্গোলিয়ান খান গুয়ুগের জন্য একটি সিল তৈরি করেছিলেন। রোমান পোপ ইনোসেন্ট চতুর্থকে পাঠানো গুয়ুগ খানের চিঠিতে সিলমোহরের ছাপ পাওয়া যায়। চিঠিটি বর্তমানে ভ্যাটিকান সিটিতে সংরক্ষিত আছে। মঙ্গোলিয়া ও ইতালির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কাঠামোর মধ্যে চিঠির একটি সরকারি অনুলিপি হস্তান্তর করা হয়েছে, যা এখন কারাকোরাম জাদুঘরে একটি প্রদর্শনী হিসেবে রাখা হয়েছে। চিঠিটির কোনো ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। কারণ, জাদুঘরে ছবি তোলা নিষেধ। আমি আলাদা করে অনুমতি নিয়ে অল্প কিছু ছবি তুলেছি। সিলমোহরের রেপলিকার একটি ছবি তুলেছি কেবল। তুসিনতুর সাহায্য করেছে এ বিষয়ে জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে। চিঠিটি ১২০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ২০ সেন্টিমিটার প্রস্থের একটি স্টার্চ কাগজে লেখা ছিল। পোপ ইনোসেন্ট চতুর্থ, যাঁকে তৎকালীন পশ্চিমা বিশ্বের ‘প্রভু’ বলা হতো। চিঠিটির মাঝখানে এবং নিচের ডান কোণে মহান খানের সিলমোহর স্থাপন করে এটি যাচাই করা হয়েছিল। এই সিলমোহরই মঙ্গোল সাম্রাজ্যের একমাত্র অবশিষ্ট খাসবু সিলমোহর যা তার আসল আকারে সংরক্ষিত আছে। কারাকোরামের শিলালিপি স্মৃতিস্তম্ভ! ১৩৪৭ সালে টোগুনতুমুর খানের রাজত্বকালে একটি নির্দিষ্ট শিলালিপি স্মারক তৈরি করা হয়েছিল এবং তারপর একটি বৃহৎ কচ্ছপের মূর্তির পেছনে স্থাপন করা হয়েছিল। স্মৃতিস্তম্ভটির একদিকে মঙ্গোলীয় লিপির শিলালিপি এবং অন্যদিকে চীনা লিপির শিলালিপি রয়েছে। গবেষকেরা পরে আবিষ্কার করেন যে দুটি ভিন্ন ভাষায় লেখা হলেও শিলালিপিগুলোর অর্থ একই ছিল।
১৩৮০ সালে মিং রাজবংশের সৈন্যদের আক্রমণের সময় স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙে ফেলা হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। স্মৃতিস্তম্ভের ভাঙা টুকরোগুলো পরে এরদেন জুউ মনেস্ট্রির ভেতর স্থানান্তর করা হয়। শিলালিপিটি বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার কথা বলে, যেমন ওরখোন উপত্যকায় চেঙ্গিস খানের রাজধানী প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত, ওগেদাই খানের রাজত্বকালে ‘দশ হাজার প্রশান্তি’ প্রাসাদ নির্মাণ, পাঁচতলা বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ।
এই স্মৃতিস্তম্ভ আবিষ্কারের মাধ্যমে এরদেন জুউ মনেস্ট্রির চত্বরে থাকা ধ্বংসাবশেষ মঙ্গোল সাম্রাজ্যের রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ হিসেবে প্রমাণিত হয়। এটিকে ১২২০ সালে ‘ইয়ুয়ানের ইতিহাস’–এ চেঙ্গিস খানের কারাকোরামকে রাজধানী করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে একটি দালিলিক প্রমাণ বলা যায়।
‘ফ্যাগস-পি’ স্ক্রিপ্টসহ সিলমোহর! বিলেগট খান আয়ুশিদারার অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা। তিনি ‘ফ্যাগস-পা’ লিপি (প্রাচীন মঙ্গোলীয় বর্গাকার লিপি) ব্যবহার করতেন। ১৩৭১ সালে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। এটি কারাকোরাম জাদুঘরের মূল্যবান নিদর্শনগুলোর একটি।
যদিও সিলমোহরটির কারুকাজ ও আকার ইউয়ান রাজবংশের সময় ব্যবহৃত অন্যান্য সিলমোহরের মতো ছিল, তবু এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল যা আবিষ্কৃত অন্য সিলমোহরগুলোয় পাওয়া যায়নি। তৎকালীন ঐতিহ্য অনুসারে, সিলমোহরটি কোথায় তৈরি হয়েছিল, তার তারিখ ও অবস্থান এর শীর্ষে চীনা লিপিতে লেখা আছে। গবেষকেরা মনে করেন যে সিলমোহরটি ১৩৭২ সালের দিকে তৈরি করা হয়েছিল এবং ইউয়ান রাজবংশের সিংহাসনের শেষ উত্তরসূরি বিলেগট খান আয়ুশিরিদারার রাজত্বের সঙ্গে এর সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। ২০০১ সালে মঙ্গোলিয়ান-জার্মান যৌথ গবেষণা অভিযান দল পরিচালিত কারাকোরাম শহরের ধ্বংসাবশেষে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় এই সিল আবিষ্কৃত হয়েছিল।
পোরসেলিনের জিনিসপত্র। ২০০৩ সালে মঙ্গোলিয়ান-জার্মান যৌথ গবেষণা অভিযান দল একটি জটিলভাবে তৈরি চীনামাটির বাসন আবিষ্কার করে যা সূক্ষ্ম দানাদার সাদা কাদামাটি ও নীল আভাযুক্ত আধা স্বচ্ছ এনামেল দিয়ে তৈরি। প্রথমে শিল্পকর্মটিকে মাটির সিংহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। তবে পরে এটি ভুল প্রমাণিত হয় এবং এটি আসলে একটি পৌরাণিক প্রাণীর ভাস্কর্য।
কালভিঙ্কা ভাস্কর্য! কালভিঙ্কা সম্পর্কে আমি প্রথম জানলাম। অসংখ্য চীনামাটি ও মাটির ভাস্কর্য এবং ব্রোঞ্জের আয়না যা কেবল কারাকোরাম শহরেই তৈরি করা হয়নি, বরং বিদেশ থেকে বাণিজ্যের মাধ্যমে আমদানি করা হয়েছে। এসব নিদর্শন জাদুঘরের সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এই সব আকর্ষণীয় নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে একজন মিশরীয় ফারাওয়ের চিত্র, পৌরাণিক প্রাণী ও কালাভিঙ্কা পাখির ভাস্কর্য।
সোয়ম্বো শিলালিপিসহ স্মৃতিস্তম্ভ! সোয়ম্বো শিলালিপিসংবলিত এই স্মৃতিস্তম্ভ কারাকোরাম শহরে বসবাসকারী ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর গবেষণার জন্য এবং মসজিদের ইতিহাসের জন্য একটি মূল্যবান নিদর্শন। গবেষকেরা বিশ্বাস করেন যে ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইউয়ান রাজবংশের সময় কারাকোরামে বসবাসকারী স্থানীয় মুসলমানরা এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন।
মঙ্গোলিয়ায় বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত মুদ্রার সংগ্রহগুলো ভালো লেগেছে। জাদুঘরে প্রাচীন একটি মানচিত্র চিত্রকলা ও প্রতীকীর মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে প্রাচীন কারাকোরাম শহরের। সেখানে দেখানো হয়েছে যে বৌদ্ধ মন্দির, খ্রিষ্টান চার্চ, মসজিদ, স্তূপসহ সব জাতি-ধর্ম-বণের মানুষের বসবাস ছিল এই শহরে। সঙ্গে সিল্ক রোডের বণিকদের আসা-যাওয়া তো ছিলই। সিল্ক রোডের বণিকদের বসবাস ছিল শহরের কেন্দ্রে।
বর্তমানে এই শহরে বাস করে মাত্র দশ হাজার মানুষ। শান্ত একটা শহর। শহরের একপাশে সবুজ প্রান্তর, অন্যপাশে স্তেপ অঞ্চল। পথের ধারে ঘোড়া, ভেড়া, গরু, উটের সংখ্যা অগণিত। অযথা আধুনিকতার কোনো ভাব নেই শহরজুড়ে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর বিশ্বে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল কারাকোরাম। একসময় শহরটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং পরবর্তী বহু শতকে এর প্রকৃত অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু অবশেষে কারাকোরামের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা প্রত্নতাত্ত্বিক ও সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে এই শহর তার জীবদ্দশায় কেমন ছিল, সেই কাল্পনিক চিত্র আঁকতে সক্ষম হয়েছেন।
অজানা সমাধি! মানচিত্র দেখে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। তুসিনতুর বলল, আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কক্ষ রয়েছে। ২০১৩ সালে বুলগান প্রদেশের নিকটবর্তী এলাকায় উৎখননের ফলে একটি সমাধি পাওয়া গেছে। তবে সমাধিটি কার, সে বিষয়ে প্রত্নত্বত্তবিদেরা নিশ্চিত হতে পারেননি। সমাধি থেকে ২৭০টি প্রত্নবস্তু উদ্ধার করা হয়েছে। সেই প্রত্নবস্তুগুলো দিয়েই সাজানো হয়েছে কক্ষটি।
এটি ছিল মঙ্গোলিয়ায় আবিষ্কৃত প্রথম চিত্রিত সমাধি, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ স্থানটির সংরক্ষণের জন্য ইউনেস্কোর কাছে সহায়তার আবেদন করলে ইউনেস্কো সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে।
খনন করার পর দেখা যায়, সেখানে একটি দীর্ঘ, ঢালু ঢালু পথ রয়েছে যা ভূগর্ভস্থ সমাধিস্থলে নিয়ে যায়। খননকাজ থেকে আবিষ্কৃত নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে পোড়ামাটির মূর্তি, সোনার জিনিসপত্র ও বাইজেন্টাইন মুদ্রা, যা সংস্কৃতি ও সমাধির অবস্থান সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।
সমাধিতে ৪২ মিটার দীর্ঘ একটি ঢালু পথ রয়েছে যা মাটির ৭ মিটার নিচে নেমে আসে এবং একটি সমাধিস্থলে পৌঁছায়। সমাধির ঢালু দেয়াল এবং সম্ভবত অন্যান্য অংশ চিত্রকর্ম দিয়ে সজ্জিত ছিল।
ঘোড়ায় চড়ে থাকা যোদ্ধাদের ১১৭টির বেশি পোড়ামাটির মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে, যা সামরিক সংযোগ বা মৃত ব্যক্তির পরিচর্যার প্রতিনিধিত্বের ইঙ্গিত দেয়। সমাধিতে ১৫০টির বেশি সোনার জিনিসপত্র ছিল, যার মধ্যে ছিল একটি সোনার মুকুট, একটি সোনার প্লেট, সোনার আংটি ও প্রাচীন সোনার মুদ্রা (সম্ভবত বাইজেন্টাইন ও সোগদিয়ান)।
সমাধির স্থাপত্যের সঙ্গে বাইজেন্টাইন ও সোগদিয়ান মুদ্রার উপস্থিতি পশ্চিমা এবং মধ্য এশীয় উভয় সংস্কৃতির সঙ্গে সংযোগের ইঙ্গিত দেয়। সমাধির নকশাটি তাং রাজবংশের চীনা সমাধির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, যা সেই সময়কালে এই অঞ্চলের তুর্কি সংস্কৃতিতে চীনা প্রভাব প্রকাশ করে। শৈলীগত তারিখের ওপর ভিত্তি করে, সমাধিটি খ্রিষ্টীয় ৭ম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের বলে মনে করা হয়। প্রবেশদ্বারের কাছে একজন ব্যক্তির কঙ্কাল, সম্ভবত সমাধি ডাকাত, একটি কুকুরের কঙ্কালসহ পাওয়া গেছে।
চেঙ্গিস খান এই শহরের স্থাপনা করলেও এই শহরের উন্নতি তাঁর আমলে হয়নি। চেঙ্গিস খানের উত্তরাধিকারী ওগেদেই খানের শাসনকালে এর উন্নতি শুরু হয়। তাঁর আমলেই কারাকোরাম মঙ্গোল রাজত্বের যথার্থ রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
উত্তর-মধ্য মঙ্গোলিয়ার ওরখন উপত্যকায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক শহর ছিল কারাকোরাম। খারাখোরিন, হরহোরিন, খারাখোরাম, কোরা কোরাম ইত্যাদি নামেও এর পরিচিতি ছিল। মঙ্গোলরা আসার আগেই এখানে বসতি স্থাপিত হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য অনুসারে, এই শহরে প্রথমে যাযাবররা তাঁবু খাটিয়ে থাকত। অষ্টম থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যে, ব্রোঞ্জ যুগের উইঘুর বংশধরেরা এই শহরের প্রথম পত্তন করে। আমি অবাক হয়েছি এই তথ্য জেনে। মঙ্গোলিয়া দিয়ে যাওয়া বিখ্যাত সিল্ক রোডের উত্তর–দক্ষিণ ও পূর্ব–পশ্চিমের সংযোগ কেন্দ্রে এই শহর অবস্থিত ছিল।
মধ্যযুগের পর্যটকদের সত্যিই ধন্যবাদ প্রাপ্য। কারণ, তাঁদের লেখা ছাড়া রাজধানী কারাকোরামের জমজমাট অবস্থার বিবরণ পাওয়া সম্ভব ছিল না। এমনই এক উল্লেখযোগ্য লেখক হলেন মঙ্গোল রাজসভায় আসা ফ্রান্সের রাজা নবম লুইয়ের দূত উইলিয়াম অব রুব্রুক। উইলিয়াম তাঁর লেখায় জানিয়েছিলেন যে এই শহরে ১২টি মন্দির, ২টি মসজিদ ও ১টি চার্চ ছিল। কারাকোরাম শহরের ধর্মীয় বৈচিত্র্যের উল্লেখ এই লেখায় পাওয়া যায়।
কারাকোরাম শহর ধ্বংসের পর, মঙ্গোলদের এই রাজধানীর কথা মানুষের স্মৃতি থেকে ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়। ১৮৮৯ সালে এই অঞ্চলে কর্মরত দুই রাশিয়ান প্রাচ্যবিদ এই শহরের অবস্থান আবার খুঁজে পান। পরবর্তী শতাব্দীতে এই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা খনন কার্য শুরু করেছিলেন।
জাদুঘর পরিদর্শন শেষ করে স্যুভেনির শপে ঘুরতে ঘুরতে আমি আর তুসিনতুর কারাকোরামের সুপ্রাচীন ইতিহাস ঝালাই করে নিচ্ছিলাম। স্যুভেনির শপের প্রতিটি প্রতিকৃতি দারুণ মনোগ্রাহী। পশুর চামড়ায় আঁকা শিল্পকর্মগুলো খুব সুন্দর। একবিংশ শতাব্দীতে কোনো দেশের স্যুভেনির শপে পোস্টকার্ড দেখলে ভালো লাগে। আমি পোস্টকার্ড সংগ্রহ করি। ছোটবেলার অভ্যাসটা এখনো রয়ে গেছে।
হায়! সঙ্গে তো ফাইয়াজ রয়েছে। সে কোথায়! জাদুঘরে এলে আমি হারিয়ে যাই ইতিহাসের ভেতর। চোখের সামনে কারাকোরাম দেখতে পাচ্ছিলাম। বিশেষ করে মানচিত্রে কারাকোরাম শহরকে দারুণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
জাদুঘরের চারপাশে কিছু স্টোন রাখা রয়েছে। তুসিনতুর বলল, জাদুঘরের ছাদে গিয়ে কারাকোরামের চারপাশ দেখা যায়। ত্রিতল ছাদে উঠে কারাকোরাম দেখলাম। আচমকা দেখলাম, কিছু পাথর ছড়িয়ে রাখা হয়েছে ছাদের মেঝেতে। তুসিনতুর ব্যাখ্যা দিল, এগুলো কয়লা। পুড়িয়ে এ রকম বাদামি করা হয়েছে। এগুলো বিছিয়ে রাখলে শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
পৃথিবীর অন্য অনেক সমৃদ্ধ নগরের মতোই ছিল কারাকোরাম। সেই সমৃদ্ধির ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না একবিংশ শতাব্দীর কারাকোরাম শহরে। কিন্তু কারাকোরাম জাদুঘর চোখের সামনে মেলে ধরেছে সেই সুপ্রাচীন কারাকোরামকে!
আমরা আমাদের নতুন গের–এ এখনো চেক-ইন করিনি। এটি নোমাডদের গের নয়। আধুনিক সব নাগরিক সুবিধাসংবলিত গের। এখনকার কাজ গের চেক-ইন, দুপুরের আহার। তারপর আবার ইতিহাসের পথে পথে। কারাকোরাম শহরের আরও গল্প নিয়ে অল্প সময় পরেই ফিরছি!