তেমুজিনের দেশে
মঙ্গোল যাযাবর পরিবারের সঙ্গে এক রাত
মঙ্গোলিয়ার পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটে চেঙ্গিস খানের নাম অথবা উল্টোটি বললেও ভুল হবে না। মধ্যযুগে মঙ্গোল সাম্রাজ্য ছিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ। ভ্রমণকারী এলিজা বিনতে এলাহী একবিংশ শতাব্দীতে কেমন দেখলেন আজকের মঙ্গোলিয়া? সেই অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করছেন ধারাবাহিকভাবে।
সকাল ৭টা। উলনবাটোরের হোটেল নাইন–এর রেস্তোরাঁয় জানালার কাচ গলে সকালের রোদ এসে পড়েছে আমাদের খাবার টেবিলে। সড়কের দিকে তাকিয়ে দেখি একেবারে জনশূন্য। বেলা বাড়তেই সড়কের চেহারা পাল্টে যাবে। রেস্তোরাঁও খালি। আমরা দুজন প্রথম অতিথি। সকাল ৮টায় আমাদের যাত্রা শুরু হবে।
গন্তব্য গুরভানবুলাগ। উলনবাটোর থেকে ২৮০ কিলোমিটার। একটি যাযাবর পরিবারের সঙ্গে কাটাব। ছেলেবেলা থেকে মঙ্গোলিয়াকে জেনেছি চেঙ্গিস খানের মাধ্যমে। এই ভূখণ্ডবাসী সম্পর্কে একটি বিষয় সমাদৃত, তা হলো মঙ্গোলরা যাযাবরের জাতি। সেই যাযাবরদের সঙ্গে, তাদের আবাসনে রাত্রিযাপন করব। অবশ্যই রোমাঞ্চ অনুভব করছি। গুরভানবুলাগ উত্তর মঙ্গোলিয়ার বুলগান প্রদেশের একটি জেলা। মঙ্গোলিয়াতে প্রদেশ রয়েছে ২১টি। ২১টি প্রদেশে মোট জেলার সংখ্যা ৩৩০। জেলাকে মঙ্গোলরা বলে ‘সাম’।
আমরা সকালের নাশতা করছি, ৮টা বাজার ১০ মিনিট আগেই তুসিনতুর এসে হাজির রেস্তোরাঁয়। আমরা আগেই হোটেল চেক আউট করেছি। বাক্সপেটরা জমা করেছি রিসিপশনে। ৮টা ১০ মিনিটে রওনা হলাম। আজই প্রথম উলনবাটোরের বাইরে যাচ্ছি।
ধীরে ধীরে শহর পেরোচ্ছি আর লোকালয় কমছে। শুরু হলো মঙ্গোলিয়া রোড ট্রিপ...! উলনবাটোর শহর থেকে রোড ট্রিপে বের হলাম। আবার ৫ দিন পর উলনবাটোর শহরে ফেরত আসব। এই রোড ট্রিপে উত্তর-মধ্য-পশ্চিম মঙ্গোলিয়া দেখার সুযোগ হবে। আর অল্প অংশ গোবি মরুভূমির।
উলনবাটোর থেকে এই সড়ক সোজা কোথায় চলে গেছে কে জানে! ঘণ্টা দেড়েক পার হবার পর একটি গ্রামের দেখা পেলাম। পুরো স্তেপ অঞ্চলজুড়ে মাঝে মাঝে দু–একটা যাযাবরদের বাড়ি দেখা যায়।
আমার গাইড তুসিনতুরের ভাষ্যমতে, এই ভূখণ্ডের ৫০ শতাংশ লোক বাস করে রাজধানী শহরে। শহর থেকে বের হবার পর ঘোড়া আর গরু ছাড়া লোকালয় তেমন চোখে পড়েনি। দু–তিনটে বাড়ি মিলে একটা গ্রাম। আচমকা কোনো বাজার বা মার্কেট চোখে পড়ে। এখানকার ঘনবসতিপূর্ণ গ্রামের লোকসংখ্যা তিন হাজার।
বাদামি রঙা পাহাড়, ততোধিক বাদামি রঙা প্রকৃতি, আচমকা সবুজ দেখলে ছবি তুলে রাখছি, নানা রকমের ঘোড়া, গরু, ভেড়া, আকাশে চিল আর জিপের মধ্যে ফাইয়াজ, ড্রাইভার আর গাইডসহ আমরা চারজন—মোটামুটি এরাই পথসঙ্গী।
পথের দুইধার দেখছি আর ভাবছি এই অঞ্চলে তো ঘাস ছাড়া উদ্ভিদ নেই। প্রাণীগুলো আপনমনে মাথা নিচু করে কী চিবিয়ে যাচ্ছে। ঝাঁকে ঝাঁকে গরু, ঘোড়া আর ভেড়া। কোনো মানুষ নেই এদের সঙ্গে। এদের বাড়িঘর কোথায়। মানে এই প্রাণীগুলোর মালিক কোথায়। আমি খুব খেয়াল করে দেখেছি আশপাশে কোনো বাড়ি নেই, পাহারাদার নেই। মাঝে ছোটখাটো বাজার ও মার্কেট পার হচ্ছে; কিন্তু সাইনবোর্ডে কিছু পড়তে পারছি না। কারণ, রাশান সিরিলিক অক্ষরে লেখা সবকিছু।
দুপুর ১২টার দিকে আমাদের ফোর–হুইলার এসে থামল একটি মার্কেটের সামনে। এখানে লাঞ্চ করব। তুসিনতুর বলল, পথে আর ভালো কোনো মার্কেট নেই, যেখানে খাবার পাওয়া যাবে। রেস্টুরেন্টের নাম পড়তে পারলাম না। তবে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে ‘রোড সাইড স্টেশন’ ও স্থাপনকাল ১৯৯৮ সাল। মার্কেটের সামনে অনেক গাড়ি রয়েছে। বুঝলাম পর্যটকেরা এখানেই পথে বিশ্রাম নেয়। মার্কেটের পাশেই একটি ব্রিজ দেখলাম। একটি সরু নদী। এত পথ এলাম, এখানেই কিছুটা জলাধার দেখতে পেলাম। নদীর ধারে অনেক ঘোড়া।
ভেতরে গেলাম। খাবার মেন্যু দেখছি তখন তুসিনতুর বলল, মঙ্গোলিয়ান গোলাস খেতে পারো। গোলাস কি মঙ্গোলিয়ান খাবার? অবাক হলাম। বিফ গোলাস আমি খেয়েছি হাঙ্গেরি আর চেক রিপাবলিক ভ্রমণে। রাজি হলাম। খেয়ে দেখা দরকার। বলা হয়, গোলাস হাঙ্গেরিয়ান খাবার।
গোলাসের প্রতি দুর্বলতা তৈরি হয়েছে কিশোর বয়সে টেলিভিশনে সুবর্ণা মুস্তফার একটি নাটক দেখে। তারিক আনাম ও সুবর্ণা মুস্তফা অভিনীত ‘হাঙ্গেরিয়ান গোলাস’–এর মাধ্যমে জানা হয় গোলাস হাঙ্গেরির খাবার। পূর্ব ইউরোপের দুপুর ও রাতের প্রধান খাবারই বিগ গোলাস। চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগ ভ্রমণেই প্রথম খেয়েছি। খাদ্য, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান, স্থাপত্যরীতি বহমান। এক অঞ্চল থেকে অনায়াসেই অন্য ভূখণ্ডে পৌঁছে যায়।
মঙ্গোলিয়ান গোলাস যখন সামনে এল, দেখলাম একটি প্লেটে ভাত (চায়নিজ চিকচিকে ভাত), ঝোল ঝোল গরুর মাংস, সঙ্গে আলুর ভর্তা আর সালাদ। হাঙ্গেরিয়ান গোলাস কিংবা চেক রিপাবলিক গোলাসের সঙ্গে মঙ্গোলিয়ান গোলাসের একদমই কোনো মিল নেই স্বাদে কিংবা গন্ধে।
আবার পথ ধরলাম। যেতে যেতেই চোখে পড়ল ব্যাকট্রিয়ান ক্যামেলের একটি দল। দুই কুঁজবিশিষ্ট উট। আমি বললাম এত দূর থেকে দেখব না। কাছে গিয়ে দেখব। আর্থ গাড়ি থামাল। সড়কের দুই প্রান্ত দেখা যাচ্ছে। গোটা সড়কে কোনো গাড়ি নেই। পথের মাঝে বসে ছবিও তোলা যাবে। উটের কাছাকাছি যাচ্ছি আর দলটি অদ্ভুত শব্দ করছে। হয়তো ভয় পাচ্ছে নতুন আগন্তুক দেখে। তুসিনতুর আমাদের থামতে বলল একটু। উটগুলো পলকহীন দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
দুই কুঁজবিশিষ্ট উট প্রথম দেখেছিলাম উজবেকিস্তানের খিভা শহরে। শহরে একটি স্থানে একটি উট। এখানে তো দেখেছি ব্যাকট্রিয়ান উটের রাজ্য। একসময়ের মঙ্গোলিয়ার বিশেষ বাহন দুই কুঁজবিশিষ্ট এই ব্যাকট্রিয়ান উট! চেঙ্গিস খানের সৈন্যরা এবং মঙ্গোলিয়ান সৈন্যরা তাদের বাহন হিসেবে ব্যবহার করত এই উটগুলো। এই জাতের উট প্রধানত মধ্য এশিয়ার মরুভূমি অঞ্চল, বিশেষ করে গোবি মরুভূমি এবং তুর্কমেনিস্তান, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া ও চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায়। খিভা শহরে যে ব্যাকট্রিয়ান ক্যামেলটি দেখেছিলাম সেটি বেশ রোমশ ছিল। এদের গায়ে দেখি লোম নেই। তুসিনতুর বলল, গ্রীষ্মে এদের গায়ের লোম ঝরে যায়। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম কিছু কিছু উটের গায়ে অল্প অল্প লোম এখনো রয়েছে। যত দূর চোখ যায় ধু ধু প্রান্তর। উটের দল আর আমরা তিনজন ছাড়া পুরো তল্লাটে কেউ নেই। গাড়িতে চড়ে বসার আগে সবাই মিলে পথের মাঝে বসে ছবি তুললাম।
সড়কপথ থেকে আচমকা আমাদের আর্থ ভিন্ন এক পথ ধরল। এক ঘণ্টা এ রকম পথ চলতে থাকবে তারপর আসবে যাযাবর পরিবারের গের।
গাড়ি কখনো মাটির পথ দিয়ে যাচ্ছে, কখনো পাথুরে, কখনো ঘাস মাড়িয়ে। গাড়িতে বসে থাকা দায়। এত ঝাঁকুনি। কোথাও কোনো বসতি দেখছি না। ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার পরপর একটি–দুটি গের। প্রতিটি গেরের সামনে একটি বা দুটি গাড়ি।
পথ কী করে চিনছে সে! কোনো জিপিএস নেই, পথে কোনো মাইলফলক নেই। এ রকম অবাক লেগেছিল সাহারাতে তাঁবুবাসের সময়। চলতে চলতে গাড়ি আচমকা বালি-কাঁকরের পথ ধরল। এখানেও একদমই সে রকম। সাহারাতে কেবল বালির ঢিবি ছিল। এখানে তো নানা জাতের পথ।
এ রকম দেড় ঘণ্টা চলার পর এল আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য। যাযাবর গের। একজন নারী ও পুরুষ এসে আমাদের অভিবাদন জানালেন। চেনেতদর্জ আর তাঁর স্ত্রী। দুজনই মঙ্গোল পোশাক পরে আছেন। বিশাল প্রান্তর। চারদিকে পাহাড় মাঝে কয়েক শ একর জায়গা। সেই স্থানে তিনটি গের। গেরগুলোর সামনে কয়েকটি ঘোড়া বাঁধা রয়েছে। আর একটি গরু ও বাছুর রাখবার স্থান।
একটি গেরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। বাটিতে দুধ–চা, হাতে বানানো গোল গোল রুটি কিংবা পাউরুটি হবে, আর বড় একটি গামলাতে চিজ পরিবেশন করা হলো। লবণ দেওয়া চা, পামির হাইওয়েতে আমার ভালোই অভিজ্ঞতা হয়েছে। ড্রাইভার, গাইড কয়েক বাটি পান করলেন। আমি আর ফাইয়াজ এক বাটি চা শেষ করতে করতে পারিনি। নোমাড পরিবারের অনেক কায়দা–কানুন রয়েছে। অতিথিকে সুগন্ধিসহ অভ্যর্থনা জানানো হয়। গেরে প্রবেশেরও নিয়মকানুন আছে। একটি পাথরের ছোট বোতল আমাদের হাতে দেওয়া হলো। সেখান থেকে কাঠিতে করে অল্প সুগন্ধি আমাদের গায়ে দেওয়া হলো।
গেরের দরজাটি বেশ ছোট। আমার মতো কম উচ্চতার মানুষকেও মাথা নিচু করে প্রবেশ করতে হলো। দরজা দিয়ে প্রবেশ করার পর বাঁ দিক দিয়ে গেরে প্রবেশ করতে হবে। গেরের ভেতরটি বেশ রঙিন। মঙ্গোল যাযাবরদের গের বা গোল তাঁবু যে নামেই ডাকি না কেন—দেয়াল আর ছাদ ভেড়ার উল দিয়ে ঠাসা, শীতের সময় তাঁবু গরম রাখে। মেঝেতেও উলের কার্পেট। মেঝে, খাট সব জায়গাতেই উলের কার্পেট বিছানো। গেরের ঠিক মাঝখানে একটা উনুন বা ফায়ারপ্লেস, তার লম্বা চিমনিটা ছাদের মাথা ফুঁড়ে বাইরে বেরিয়ে থাকে, যাতে ধোঁয়াটা একেবারে বাইরে বেরিয়ে যায়। উনুনের আশপাশে রান্না, খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি আর দেয়াল ঘেঁষে দু–তিনটে খাট—মোটা উলের লেপ–তোশকসমেত।
একসঙ্গে বসে গল্প করলাম অনেকক্ষণ। আমাদের মাঝে দোভাষীর কাজ করছেন তুসিনতুর। জানলাম এই পরিবারের ঘোড়া রয়েছে ১০০টি আর গরু-ছাগল রয়েছে এক হাজারের বেশি। সব বাইরে খাবার খেতে গেছে। ভোরে ফিরে আসবে। এই যাযাবর পরিবারের গ্রীষ্মকালীন আবাস এটি। শীতের সময় তারা অন্যত্র চলে যায়। পরিবারগুলো বছরে চারবার বসত পরিবর্তন করে। এই অস্থায়ী গেরগুলো বানাতে দুই ঘণ্টা সময় লাগে এবং উঠিয়ে নিতে সময় লাগে আধা ঘণ্টা। জীবন ও অবস্থার প্রয়োজনে কত কিছুই করতে হয়।
রেস্টরুম আর বাথরুম নেই। জঙ্গলে কাজ সারতে হবে। খাওয়ার পানিরও সংকট আছে। গাইড আমাদের জন্য খাবার পানি নিয়ে এসেছেন। আমরা যেখানে লাঞ্চ করেছি সেখান থেকে তুসিনতুর পাঁচ লিটারের অনেকগুলো খাবার পানির বোতল কিনেছে। এখন বুঝতে পারছি কেন।
আমাদের হর্স রাইড রয়েছে নোমাড পরিবারের সঙ্গে। কিন্তু আমরা দুজনের কেউই আগ্রহ দেখালাম না। ঘড়িতে ৫টা বাজে কিন্তু দুপুর ১২টার মতো রোদের তাপ। এই পরিবারটির সঙ্গে দুটি শিশুও রয়েছে। চেনেতদর্জের নাতি। গ্রীষ্মের ছুটিতে দাদা-দাদির কাছে বেড়াতে এসেছে।
সন্ধ্যার কিছু আগে চেনেতদর্জের স্ত্রী গরুর দুধ সংগ্রহ করতে গেলেন। উট ও ঘোড়ার জন্য তাদের শেল্টার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু গরু, ছাগল আর ভেড়ার জন্য প্রয়োজন হয়। মাঠের মাঝে একটি ছাদখোলা শেল্টার দেখলাম। গেরের ছাদে দেখলাম গোল গোল গামলায় কী যেন রয়েছে। তুসিনতুর বলল, শুকনা দই। রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছিল।
সন্ধ্যে ৭টায় রাতের খাবার দেওয়া হলো। গরুর মাংসের মোমো, একটি চাটনি আর দুধ–চা (লবণ দেওয়া)। ঘরের চারদিকে দুধ আর দই। বিভিন্ন ধরনের চিজ বানিয়েও রাখা হয়েছে। যতটুকু বুঝলাম দুধজাতীয় খাবারের ওপরই নোমাড পরিবারগুলোকে নির্ভর করতে হয়। বাইরে এখনো আলো রয়েছে। আমি চারপাশটা ঘুরে দেখছি দিনের আলো থাকতে থাকতে। এখানে তিনটি গের রয়েছে। একটিতে আমাদের খাবার পরিবেশন করা হলো, একটি দেওয়া হলো গাইড ও ড্রাইভারকে থাকতে। আর তৃতীয় গেরটি আমাদের জন্য।
সূর্য অস্ত গেল রাত ৯টায়। চারদিক অন্ধকার হয়ে এল রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে। এবার আমাদের একটি পানীয় বানিয়ে দেখানো হলো দই থেকে। ফায়ারপ্লেসই তাদের উনুন। সেখানেই দই থেকে বাষ্প তৈরি হলো, সেই বাষ্পই তরল পানীয়। ১২ কেজি দই থেকে ২০০ লিটার তরল তৈরি হতে ৪০ মিনিটের মতো সময় লাগল। এই পানীয়টি তাদের শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচায়। গ্রীষ্মে অল্প অল্প করে বানিয়ে রাখে। আমাদের অল্প করে স্বাদ গ্রহণ করতে দেওয়া হলো। সঙ্গে একটি বাটার মিশিয়ে দেওয়া হলো। সেটিও গরুর দুধ থেকে তৈরি করা। তারা নাকি চা–ও পান করে বাটার দিয়ে। হয়তো শীতের সময়। কিন্তু আমাদের চায়ের সঙ্গে বাটার মেশানো হয়নি। আরও একটি কারণ হয়তো রয়েছে, অনেক অভ্যাস, অনেক নিয়ম বদল হয়েছে পরিবেশ-পরিস্থিতি ও বাস্তবতার কারণে।
আমি আর ফাইয়াজ নিজেদের গেরে এলাম। রাতে বাতির একমাত্র উৎস সোলার প্যানেল। একবিংশ শতাব্দীর সব আধুনিকতা থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। আমাদের গেরের আশপাশে ৫০/৬০ কিলোমিটার অবধি কোনো বসতি চোখে পড়েনি। প্রাণীর দল, নোমাড পরিবার আর আমরা ছাড়া গোটা অঞ্চলে কেউ নেই। রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম বিশ্বরাজনীতি, অর্থনীতি, মহাকাশ, পারমাণবিক বোমা, ক্ষমতার লড়াই কোনো কিছুই এদের স্পর্শ করে না। নিজের সব কাজ করেই ফুরসত নেই। দিনাতিপাত করাই মুখ্য উদ্দেশ্য। খাদ্য সংস্থান আর বছরে চারবার বসত বদল করাই কাজ। কোন রাজ্যে কী হলো কিছুই যায়–আসে না তাদের। প্রাণী আর মানুষের সহাবস্থান এই ভূখণ্ডে। প্রাণীরা তাদের পরম বন্ধু। ঘোড়া ও উটকে ভীষণ শ্রদ্ধার চোখে দেখে মঙ্গোলরা। এখনো শহরের বাইরে মূল বাহন ঘোড়া ও উট।
রাতে ভালোই ঘুমিয়েছি। আবহাওয়া কিছুটা ঠান্ডা ছিল। শীত অনুভূত হয়েছে। আমাদের গেরে ছোট একটি কাঠের টুলের ওপর একটি বেসিন আছে। বেসিনের ওপরে আধা লিটার পানি ধরবে এ রকম একটি জলাধার। সেখানে একটি আয়নাও আছে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সেখানে দাঁত ব্রাশ করলাম। প্রতিটি গেরে একটি করে প্রার্থনার স্থান রয়েছে। কাঠের একটি ছোট আলমারির মতো স্থানে বিভিন্ন দেবতার মুখশ্রীর অবয়ব তৈরি করা হয়েছে। ছোট ছোট বাটিতে পাথর রাখা হয়েছে। এই পরিবার ঠিক কোন ধর্মের অনুসারী বুঝিনি। মঙ্গোলিয়ার কিছু অংশে তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম অনুসরণ করা হয়। তুসিনতুরের ভাষ্যমতে, ৬০ শতাংশ মঙ্গোলবাসী নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম অনুসরণ করে না। মঙ্গোলরা যেহেতু ছোট ছোট আদি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত, তাই তাদের দেবতাও ভিন্ন ভিন্ন। গেরের এক কোনায় কিছু পারিবারিক ছবি রয়েছে। চেনেতদর্জের ছেলে-মেয়ে সবাই শহরে থাকে। তারা কেউই নোমাড জীবন বেছে নেয়নি। তুসিনতুর বলছিল, মঙ্গোলিয়ায় নোমাড পরিবারের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। সবাই আধুনিক জীবনযাপনে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হচ্ছে। কিছুসংখ্যক পর্যটক আগ্রহী হয় নোমাড পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতে, তাই হয়তো কিছু কিছু পরিবার এখনো টিকে রয়েছে।
সকালের নাশতার জন্য চেনেতদর্জের গেরে গেলাম আমরা। ভিন্ন ধরনের হাতে বানানো রুটি, চিজ, একধরনের স্যুপ (নুডলস ও শুকনা মাংস দেওয়া) দুধের সরের পিঠা আর অবশ্যই সঙ্গে লবণ দেওয়া দুধ–চা। মাংস শুঁটকির মতো তৈরি করে তারা। সংরক্ষণের একটি ভিন্ন ধরন। দুধের সরের পিঠা বলছিলাম যে খাবারটিকে, সেটির নাম উরুম।
বিদায়ের সময় হলো। মঙ্গোল ভূখণ্ডে ভিন্ন কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে রওনা হলাম। পরের গন্তব্য সিল্করোডের বিখ্যাত শহর কারাকোরাম।