দস্তয়েভস্কির শহরে

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

১৮৮০ সালে বিশাল জনসমক্ষে ভাষণ দেওয়ার পর উল্লসিত জনতা চিৎকার করে তাঁর উদ্দেশে বলে উঠেছিল, ‘প্রোফেট, প্রোফেট’। তাঁর মৃত্যুর পর তুর্গেনেভ বলেছিলেন, ‘দা সাদ অফ রাশিয়া’ বা ‘রাশিয়ার শয়তান’। একই সঙ্গে সাধু এবং শয়তানের মুকুট পরে তিনি এখনো রাজ করছেন সাহিত্যজগতে। লেখার মাধ্যমে ব্যক্তির মনোজাগতিক যে রূপ তিনি তুলে ধরেছিলেন, তা অনন্য। অবশ্য অনেকেই সেই কঠিন বাস্তবতা মেনে নিতে পারেননি। দস্তয়েভস্কি হয়তো এ কারণেই বলেছিলেন, ‘যত আমি মনুষ্যত্বকে ভালোবাসতে থাকি, তত আমি মানুষকে কম ভালোবাসতে থাকি।’

এই ‘সাধু এবং শয়তান’কে দেখার ইচ্ছা আমার বহুদিনের।

সেন্ট পিটার্সবার্গে আমার হোটেলের আশপাশেই দর্শনীয় সব জায়গা। এই বিদেশ–বিভুঁইয়ে ইংরেজি না জানা লোকালয়ে এখন অবধি কোনো অসুবিধা হয়নি। এ শহরে বাস, ট্রামে চেপে কোথাও যাওয়ার প্রয়োজনও পড়েনি, এখন পড়বে। ম্যাপে দেখে নিলাম, মেট্রো ধরে কত দূরে সাধু এবং শয়তান লেখক ফিওদর দস্তয়েভস্কির বাড়ি। বইয়ে পড়ে, ছবি দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গিয়েছে তাঁর বাড়ির ছবি। এবার শুধু যাওয়া বাকি রয়েছে। আমার হোটেল থেকে তিনটা স্টেশন পরই বইয়ে পড়া, স্বপ্নে দেখা বাড়ি। ম্যাপে এ–ও দেখাচ্ছে যে এখান থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরত্ব সেই বাড়ির। হেঁটেই চলে যাওয়া যায়। তবে এ দেশে গুগল ম্যাপ কাজ করে না আর এ দেশের ম্যাপে আকছার আমি পথ হারিয়ে উল্টো পথে হাঁটা ধরি। মেট্রো ধরেই চললাম। তিনটা স্টেশনই তো। মেট্রো থেকে নেমে খেই হারিয়ে ফেললাম৷ এ শহরে সব পথ সব বাড়ি একই রকম দেখতে। স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি ইংরেজি জানেন না। আরেকজনকে জিজ্ঞেস করে দিক ঠিক করলাম যে পুবে যাব না পশ্চিমে। এরপর রাজকীয় পথ ধরে হাঁটতে থাকলাম কিছুক্ষণ। আশপাশের ভবনগুলো দেখে মনে হয়, একেকটা বিস্তৃত প্রাসাদ যেন। প্রতিটি বাড়ির দেয়ালে ভাস্কর্য বা ফুল–লতা–পাতা খোদাই করা। পথে নিঃশব্দে গাড়ি চলছে। পথের রূপ দেখতে দেখতে হাঁটতে হাঁটতে আমি অনেকখানি চলে এসেছি। ফিওদর দস্তয়েভস্কির বাড়ি ফেলে এলাম নাকি! ছিমছাম পথ, পথের ধারের বাড়িঘর আর বাড়ির নিচের কফি শপ দেখতে দেখতে এখানেই হারিয়ে গিয়েছিলাম। সামনে চওড়া রাস্তা, রাস্তা পার হওয়ার আগে একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, এই পথ ধরে ডানে গেলে মিলবে তাঁর বাড়ি। আমি রাশিয়ান ভাষা পড়তে জানি না, বাড়ির নম্বর দেখে চেনার উপায় নেই। তিনি যে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে থাকতেন, তা ছবি দেখে চিনি। খুঁজে না পেলে যে কী হবে! অবশ্য তাঁর মিউজিয়ামে যোগাযোগ করে জেনে নিয়েছি কীভাবে যেতে হবে। তা–ও তো হারিয়েই যাচ্ছি মনে হয়।

দস্তয়েভস্কির অ্যাপার্টমেন্ট ভবন
ছবি: লেখক
ম্যাপে দেখে নিলাম, মেট্রো ধরে কত দূরে সাধু এবং শয়তান লেখক ফিওদর দস্তয়েভস্কির বাড়ি। বইয়ে পড়ে, ছবি দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গিয়েছে তাঁর বাড়ির ছবি। এবার শুধু যাওয়া বাকি রয়েছে। আমার হোটেল থেকে তিনটা স্টেশন পরই বইয়ে পড়া, স্বপ্নে দেখা বাড়ি। ম্যাপে এ–ও দেখাচ্ছে যে এখান থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরত্ব সেই বাড়ির।

আমার সামনে একটা ফুলের দোকান, সেখানে জিজ্ঞেস করতেই বলল, ‘মুসিয়াম?’ আমি হ্যাঁ বলতেই পাশের ভবনটি দেখিয়ে দিলেন।

আমার মনে হলো, ঝপ করে এক জাদুর দুয়ার খুলে গিয়েছে। বাড়ির এত কাছে আমি! বইয়ে পড়ে যে বাড়ির অস্থিসন্ধি মুখস্থ হয়ে গেছে।

রাস্তা পার হয়ে দূর থেকে আবার পাঁচতলা বাড়িটি দেখলাম। তারপর বেজমেন্ট দিয়ে চলে গেলাম বাড়ির ভেতরে। ভেতরে ঢুকে আমি উদ্‌ভ্রান্তের মতো হয়ে গেলাম৷ রবীন্দ্রনাথের পর এই প্রথম কোনো কিংবদন্তিতুল্য লেখকের বাড়ি দেখছি৷ এতটাই নার্ভাস হয়ে গিয়েছি যে মাথা কাজ করছে না। সামনের কাচের ঘরে বোধ হয় টিকিট নিতে হবে। টিকিট নেওয়ার পর টিকিটঘরের নারীটি কি যে বললেন, কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি সম্মোহিতের মতো সামনের দিকে এগোলাম। সামনে কাঠের সিঁড়ি। এই সিঁড়ি দিয়ে দস্তয়েভস্কি ওঠানামা করেছেন। আমি কি এই সিঁড়িতে পা ফেলতে পারব?

এই সিঁড়ি দিয়ে দস্তয়েভস্কি ওঠানামা করেছেন
ছবি: লেখক

ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কি ১৮২১ সালে মস্কোয় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। অল্প বয়সে লেখকের মা মারা যান। এরপর দস্তয়েভস্কি ও তাঁর ভাইকে মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে পাঠানো হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে তিনি কিছুদিন কাজ করেন, সেই সঙ্গে সাহিত্যচর্চাও করতে থাকেন। ২৪ বছর বয়সে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘পুওর ফোক’ বা ‘দরিদ্র ব্যক্তি’ প্রকাশিত হয়।

জার শাসকদের সমালোচনা করার জন্য গ্রেপ্তার হন ২৮ বছর বয়সে এবং তখনই তাঁকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। তখন সাইবেরিয়া ছিল এক বিভীষিকার নাম। দুর্গম দূরদেশে বরফের মধ্যে নির্বাসন ছিল এক অভিশাপ ও আতঙ্ক। এমনকি ফায়ার স্কোয়াডে তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে শেষ মুহূর্তে আদেশটি তুলে নেওয়া হয় এবং কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় অন্যান্য কয়েদির মতো তাঁর পায়ে লোহার বেড়ি পরিয়ে রাখা হতো।

চার বছর সশ্রম কারাদণ্ডের পর আরও ছয় বছর তাঁকে সাইবেরিয়ায় বাধ্যতামূলক মিলিটারিতে সেবা দিতে হয়। ১০ বছরের সাজা শেষ করে আবার তিনি রাশিয়ায় ফিরে আসেন। এর পরপরই লেখেন অমর উপন্যাস ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’। দেনার দায় না থাকলে তিনি এ উপন্যাস লিখে শেষ করতে পারতেন না। এ কারণেই তিনি হয়তোবা লিখেছিলেন, ‘কোনো প্রাণী এত নিষ্ঠুর হতে পারে না, যত নিষ্ঠুর মানুষ।’

এর মধ্যে বিয়ে করেন মারিয়াকে। মারিয়ার সঙ্গে বেশি দিন সংসার করতে পারেননি। রোগে ভুগে বিয়ের সাত বছর পর মারিয়া মৃত্যুবরণ করেন।

রাশিয়ায় বিখ্যাত প্রত্যেক লেখকের বাড়ি মিউজিয়াম করে রাখা হয়েছে
ছবি: লেখক
দস্তয়েভস্কিকে নিজ জীবদ্দশায় চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এর অন্যতম কারণ ছিল তাঁর জুয়া খেলার নেশা। ‘জুয়াড়ি’ উপন্যাস লেখার সময় স্টেনোগ্রাফার হিসেবে নিযুক্ত করেন আনাকে। পরে আনা আর তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আনাই হয়ে ওঠে তাঁর চিরজীবনের সাথি, তাঁর ভালোমন্দের সারথি। মৃত্যুর আগপর্যন্ত আনার সঙ্গে সংসার করেন প্রায় ১৭ বছর।

দস্তয়েভস্কিকে নিজ জীবদ্দশায় চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এর অন্যতম কারণ ছিল তাঁর জুয়া খেলার নেশা। ‘জুয়াড়ি’ উপন্যাস লেখার সময় স্টেনোগ্রাফার হিসেবে নিযুক্ত করেন আনাকে। পরে আনা আর তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আনাই হয়ে ওঠে তাঁর চিরজীবনের সাথি, তাঁর ভালোমন্দের সারথি। মৃত্যুর আগপর্যন্ত আনার সঙ্গে সংসার করেন প্রায় ১৭ বছর। দস্তয়েভস্কির ছোটবেলা থেকেই মৃগীরোগ ছিল। খেয়ালি আর মেজাজিও ছিলেন। ১৮৮১ সালে মাত্র ৫৯ বছর বয়সে ফুসফুসে রক্তক্ষরণের কারণে তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাই কি তিনি বলে গিয়েছিলেন, ‘তোমার নিকৃষ্ট পাপ হলো কারণ ছাড়াই তুমি নিজেকে ধ্বংস করেছ এবং নিজের সঙ্গে প্রতারণা করেছ।’

আমি এখনো সিঁড়ির মুখেই দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে পেছনে ফেলে দুজন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেলেন। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। একসময় সাহস সঞ্চয় করে সিঁড়ি বেয়ে ডান দিকের কক্ষে প্রবেশ করলাম। এই কক্ষের সারি সারি কাচের শোকেসে রাখা আছে বিভিন্ন সময়ে লেখকের লেখা চিঠি। চিঠির মর্ম উদ্ধার করতে পারব না। কারণ, তা রুশ ভাষায় লেখা। তবে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম দস্তয়েভস্কির হাতের লেখা দেখে। মনে হচ্ছে যেন ছাপাখানা থেকে এইমাত্র এসেছে। গোটা গোটা অক্ষরে ডান দিকে বাঁকা করে লেখা অক্ষরগুলো যেন আকাশের তারার মতো জ্বলজ্বল করছে। একটা শোকেসে চিঠির সঙ্গে রাখা আছে তাঁর ব্যবহৃত দোয়াত ও কলম। পাশের শোকেসে তাঁর লেখা ডায়েরি।

দস্তয়েভস্কির হাতের লেখা, তাঁর ব্যবহৃত দোয়াত ও কলম
ছবি: লেখক

এর পাশের শোকেসে শোভা পাচ্ছে উপন্যাস ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাযোভ’–এর খসড়ার দুটি পাতা। চিঠিগুলো পরিপাটি হলেও লেখার খাতায় অনেক আঁকিবুঁকি করেছেন। কোথাও লেখার মধ্যে ছবিও আঁকা। দুই পাশের দেয়ালজুড়ে লেখকের বিভিন্ন সময়ের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। একটা শোকেসে দস্তয়েভস্কির কয়েকটা বই খুলে রাখা আছে। এর মধ্যে একটি ‘দ্য ইডিয়ট’, যা তিনি আরেক মহান লেখক আলেকসান্দার পুশকিনকে স্মরণ করে লিখেছিলেন। মাত্র ১৩টি উপন্যাস, ৩টি নভেলা ও ১৭টি ছোটগল্প লিখে তিনি কালজয়ী হয়ে রয়ে গেছেন।

এই শোকেসগুলো পার হলে দেয়ালের কাচের বাক্সে রাখা আছে সাইবেরিয়ায় কারাবাসের সময়কার পায়ের বেড়ি। তখনকার দিনে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলে কয়েদিদের হাতকড়া ও বেড়ি পরিয়ে রাখা হতো।

যখন প্রায় সব লেখার খাতা, চিঠি আর ছবি দেখা শেষ, তখন একটা ছবিতে চোখ স্থির হয়ে গেল। দস্তয়েভস্কির শেষশয্যা, যেখানে দস্তয়েভস্কি চোখ মুদে শুয়ে আছেন। ছবিটি এঁকেছেন আইভান ক্রামস্কোই। মৃত্যুর কাছাকাছি মানুষ বোধ হয় এমনই হয়।

এই কক্ষের সবদিকের দেয়ালে দস্তয়েভস্কির হাতের লেখা, বইয়ের পাতা বা ছোট ছোট কোটেশন ওয়ালপেপার করে রাখা হয়েছে। এ পাশের কক্ষটি দেখা হয়ে গেলে আমি চললাম সিঁড়ির অপর পাশের কক্ষগুলো দেখতে।

সাইবেরিয়ায় দস্তয়েভস্কির কারাবাসের সময়কার পায়ের বেড়ি
ছবি: লেখক

এপাশে প্রবেশের অংশে প্রথমেই একটি ছোট প্যাসেজ। সেখানে একটি কাচের বাক্সে ফিওদর দস্তয়েভস্কির হ্যাট রাখা। প্যাসেজ পার হলে দস্তয়েভস্কির বসার ঘর। সেখানে ছোট একটি টেবিল, চারটা চেয়ার, উঁচু স্ট্যান্ডসহ ঘড়ি ও এক সেট সোফা শোভা পাচ্ছে। টেবিলে ছোট একটা কাচের বাক্সে লেখকের কয়েকটি সিগারেট রাখা। ১৪৫ বছরের পুরোনো সিগারেট এই প্রথম দেখলাম। খাবার ঘরের দেয়াল ডিজাইন করা সবুজ রঙের ওয়ালপেপারে ঢাকা। বসার ঘরে পথের দিকে মুখ করা দেয়ালজোড়া জানালা। জানালায় ডবল লেয়ারের পর্দা ঝুলছে।

দস্তয়েভস্কির বসার ঘর
ছবি: লেখক
প্রবেশের অংশে প্রথমেই একটি ছোট প্যাসেজ। সেখানে একটি কাচের বাক্সে ফিওদর দস্তয়েভস্কির হ্যাট রাখা। প্যাসেজ পার হলে দস্তয়েভস্কির বসার ঘর। সেখানে ছোট একটি টেবিল, চারটা চেয়ার, উঁচু স্ট্যান্ডসহ ঘড়ি ও এক সেট সোফা শোভা পাচ্ছে। টেবিলে ছোট একটা কাচের বাক্সে লেখকের কয়েকটি সিগারেট রাখা। ১৪৫ বছরের পুরোনো সিগারেট এই প্রথম দেখলাম।

বসার ঘরের বাঁ পাশের ঘরটি হলো দস্তয়েভস্কির পড়া ও লেখার ঘর। লেখকের বাড়িতে প্রচুর বই থাকার কথা, কিন্তু এই কক্ষে খুব বেশি বইয়ের দেখা পেলাম না। ছোট একটা কাচের আলমারিতে কিছু বই রাখা। তাঁর লেখার টেবিলটি বেশ বড় ও মজবুত কাঠের তৈরি। টেবিলের দুই পাশে ড্রয়ার আছে। টেবিলের ওপর রাখা আছে তাঁর বই, কফির মগ, মোমবাতিদানি, কিছু কাগজ। লেখার কক্ষে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ, তাই দরজা থেকেই যতটুকু দেখা যায়, দেখে নিতে হলো। বাংলার বাইরে আমি এই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখকের টেবিল দেখলাম। আমার ইচ্ছা করছে আরেকটু কাছ থেকে লেখার টেবিল দেখি; কিন্তু তা সম্ভব নয়। লেখার কক্ষের দেয়ালে ঝুলছে দস্তয়েভস্কির ছবি। এ কক্ষের ওয়ালপেপার অফ হোয়াইট রঙের। তাতে ছোট ছোট ফুলেল ইংলিশ ডিজাইন করা। চেয়ার, টেবিল, বইয়ের আলমারি ছাড়াও এ কক্ষে একটা কর্নার টেবিল আর একটা সোফা আছে। এ কক্ষের জানালাও বাইরের পথমুখী।

দস্তয়েভস্কির পড়া ও লেখার ঘর
ছবি: লেখক

বসার ঘরে ডান পাশে আরেকটি কক্ষ। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন দর্শনার্থী এই কক্ষের প্রতিটা জিনিস খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। আর কেউ জোরে কথা বলছেন না, ফিসফিস করে কথা বলছেন। এঁদের সিভিক সেন্স দেখে চমৎকৃত হলাম।

পরের কক্ষটি লেখকের খাবার ঘর। খাবার ঘরে ছোট একটি খাবার টেবিল, চারটি চেয়ার, একটি শোকেস, একটি কাবার্ড রয়েছে। টেবিলে সাদা টেবিল ক্লথ বিছানো আর কয়েকটি প্লেট সাজানো। লেখক যে মোটেও সচ্ছল ছিলেন না, তা এই কক্ষের আসবাব দেখলেই বোঝা যায়। আর ব্যক্তি হিসেবেও ভীষণ খামখেয়ালি ছিলেন। ‘জুয়াড়ি’ উপন্যাসটি লেখার জন্য আগেই প্রকাশকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বসেছিলেন। আর লেখা এগোচ্ছিলও না। প্রকাশকের শর্ত ছিল, যদি সময়মতো উপন্যাসটি তিনি শেষ করতে না পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে সব উপন্যাসের স্বত্ব প্রকাশক নিয়ে নেবেন এবং এর জন্য কোনো অর্থ প্রদান করা হবে না। প্রকাশকের এই সাবধানবাণীতেও কাজ হয়নি। তখন স্টেনোগ্রাফার হিসেবে আনা যোগদান করেন এবং বলতে গেলে একপ্রকার জোর করেই দস্তয়েভস্কিকে দিয়ে উপন্যাসটি লিখিয়ে নেন। এই উপন্যাস শেষ করার পরই তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

দস্তয়েভস্কির খাবার ঘর
ছবি: লেখক
বিকেল হয়েছে অনেক্ষণ। এ শহরে গ্রীষ্মের বিকেলগুলো প্রলম্বিত। আমাকে যেতে হবে তিখভিন সেমিট্রিতে। আমি কি সন্ধ্যা হওয়ার আগে যেতে পারব? বাঙালির অবচেতন মন বলছে, সন্ধ্যার কাঁটা টিকটিক করছে, অথচ এ শহরে সন্ধ্যা নামে ১০টার সময়। তারপর কিছুক্ষণ আড়মোড়া দেয়। রাতের নিকষ আঁধার নেমে আসে ১১টায়। আমি যাব লেখক ফিওদর দস্তয়েভস্কির সমাধি দেখতে।

খাবার ঘরের পরের কক্ষে দস্তয়েভস্কির বাচ্চাদের খেলনা ও চেয়ার, টেবিল রাখা আছে। কক্ষটি লেখকের শোবার ঘর ছিল। বেশ কয়েক বছর আগে এখানে বিছানা থাকলেও এখন সেটি আর নেই। দস্তয়েভস্কি ও আনার চার সন্তান ছিল। তবে তাঁদের কোনো ছবি বা তথ্য এ কক্ষে নেই।

লেখকমাত্রই দরিদ্র, তা ফিওদর দস্তয়েভস্কির এই অ্যাপার্টমেন্ট দেখলেই বোঝা যায়। কক্ষটির পর ঘুরে এসে প্রবেশমুখের প্যাসেজ। এই অ্যাপার্টমেন্টের চারটি কক্ষই খুব সাধারণ, আসবাবও সাধারণ। দস্তয়েভস্কির পোশাক বা ব্যবহৃত অন্যান্য জিনিসপত্রের চিহ্ন কোথাও নেই। সব কক্ষ ঘুরে দেখার পর আমার মনে কোথায় যেন হাহাকার করে উঠল। কোথায় যেন বেজে উঠল বিষাদের বীণা। এত খ্যাতিমান লেখকের ব্যবহৃত খুব অল্প জিনিসই সংগ্রহে আছে। তবে রাশিয়ায় এসে সবচেয়ে ভালো লেগেছে যা তা হলো, প্রত্যেক লেখকের বাড়ি মিউজিয়াম করে রাখা হয়েছে। বিখ্যাত সব লেখকের বই স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত এবং প্রতিদিন প্রচুর দর্শনার্থী এই মিউজিয়ামগুলোতে ভিড় করেন।

১৪৫ বছরের পুরোনো দস্তয়েভস্কির সিগারেট
ছবি: লেখক

তবু ফিওদর দস্তয়েভস্কির বাড়ি দেখে আমার কেন জানি না মন খারাপ হলো। মন খারাপ নিয়েই পথে নামলাম। এই পথ ধরে অগণিতবার লেখক হেঁটে যাওয়া–আসা করেছেন। কখনো কখনো ঘোড়ার গাড়ি করেও চলাফেরা করেছেন৷ এ শহরবাসীর কি কিছুই এসে যায় না এতে!

আমি হেঁটে হেঁটে চললাম মেট্রোস্টেশনের দিকে।

বিকেল হয়েছে অনেক্ষণ। এ শহরে গ্রীষ্মের বিকেলগুলো প্রলম্বিত। আমাকে যেতে হবে তিখভিন সেমিট্রিতে। আমি কি সন্ধ্যা হওয়ার আগে যেতে পারব? বাঙালির অবচেতন মন বলছে, সন্ধ্যার কাঁটা টিকটিক করছে, অথচ এ শহরে সন্ধ্যা নামে ১০টার সময়। তারপর কিছুক্ষণ আড়মোড়া দেয়। রাতের নিকষ আঁধার নেমে আসে ১১টায়। এর আগে পুরো দিন আমার, পুরো শহর আমার।

আমি যাব লেখক ফিওদর দস্তয়েভস্কির সমাধি দেখতে। ম্যাপ দেখে কাঁহাতক পথঘাট খুঁজে পাওয়া যায়? কিন্তু এবার আমাকে ম্যাপ দেখেই পৌঁছাতে হবে। এ দেশে আসার পর আজ অবধি ম্যাপ ছাড়া, মোবাইল নেটওয়ার্ক ছাড়াই যেসব অভিযান করেছি, তাতে লোকে পাগল বলবে। পাগল বলুক আর যা–ই বলুক, এ দেশের মানুষ আমাকে ভালোবেসে পথ দেখিয়ে দিয়েছে, ভাষা জানুক বা না জানুক, যে পথের দিশা জানতে চেয়েছি, তা–ই দেখিয়ে দিয়েছে৷

মেট্রোতে চেপে দুটি স্টেশন পার হয়ে যেখানে পৌঁছালাম, সে জায়গার পথঘাট আমার চেনা নয়। স্টেশনের সামনে কয়েকজন দাঁড়িয়ে ছিলেন। জিজ্ঞেস করতে বললেন, সামনে যেতে হবে। কিন্তু ম্যাপ বলছে, কোথায় কোথায় ঘুরে পাঁচ মিনিট হেঁটে ইউটার্ন নিয়ে তারপর পাব তিখভিন সেমিট্রি। আমি অন্য সবার সঙ্গে রাস্তা পার হলাম এবং রাস্তা পার হওয়ার পর দেখি, ফুটপাত ঘেঁষে উঁচু দেয়াল আর দেয়ালের ভেতরে বড় বড় গাছ ছায়া দিচ্ছে। এটা অবশ্যই সেমিট্রি হবে। আমি নিশ্চিত। পথের বাঁক চলে গেছে ডান দিকের একটা কবলস্টোন পথ ধরে। আমিও চললাম সেই পথে। খানিকদূর যাওয়ার পর সামনে বাঁ পাশে দেখি সুন্দর একটি গির্জা আর ডান পাশে বাগানে প্রবেশের ছোট একটা গেট। গেটের ভেতরে এক ঘন সবুজ বাগান। আর গেটের সামনে ফিওদর দস্তয়েভস্কির বড় একটা ছবি ঝোলানো। আমার বুঝতে বাকি রইল না যে এ–ই সেই জায়গা।

দস্তয়েভস্কির সমাধিতে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

গেটের মুখে ছোট একটা ঘরে জিজ্ঞেস করলাম টিকিট লাগবে কি? ভদ্রমহিলা আমার হাতে টিকিট ধরিয়ে দিলেন এবং একটা ম্যাপ দিলেন। রুশ ভাষায় লেখা সে ম্যাপের কিছুই আমার বোধগম্য নয়। তিনিই কলম দিয়ে গোল করে এঁকে দিলেন লেখকের সমাধির ঠিকানা। আর বললেন, গেট দিয়ে ঢুকতেই হাতের বাঁ দিকের কয়েকটি সমাধি পর তা খুঁজে পাওয়া যাবে।

আমি সেমিট্রিতে প্রবেশ করে দেখি, উঁচু উঁচু গাছের পাতা ভেদ করে সূর্যের রশ্মি কোমল, তির্যক রেখা ফেলছে।

ঐতিহাসিক, সুসজ্জিত পার্কের মতো এই সেমিট্রির কোথাও না তাকিয়ে আমি সোজা চলে গেলাম ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কির কাছে। সব সমাধির মধ্যে সবচেয়ে আলাদা তিনি। কালো পাথরের সমাধিফলকে দস্তয়েভস্কির আবক্ষ ভাস্কর্য খোদাই করা। আর ফলকে লেখা আছে পবিত্র বাইবেল থেকে নেওয়া কয়েকটি লাইন।

সমাধিফলকে দস্তয়েভস্কির আবক্ষ ভাস্কর্য
ছবি: লেখক

সমাধির চারপাশে ছোট ছোট গাছ লাগানো। সমাধিফলকের পায়ের কাছে লেখকের ভাস্কর্যের নিচে ভক্তদের রেখে যাওয়া শ্রদ্ধার নিবেদন কয়েকটি ফুল।

লেখকের সমাধির সামনে একটি বেঞ্চ পাতা, সেখানে বসে আছেন তিন তরুণ ভক্ত। রাশিয়ান হলেও ইংরেজি জানেন। বললেন, লেখককে ভালোবেসে তাঁরা এসেছেন শ্রদ্ধা জানাতে। পাঠ্যপুস্তকে পড়েছেন দস্তয়েভস্কির লেখা। আমাকে বেঞ্চে বসার জায়গা করে দিয়ে চলে গেলেন তাঁরা। এর মধ্যে একজন মাঝবয়সী নারী এসেছেন ফুল হাতে। সমাধির চারদিকে কালো রঙের অনুচ্চ গ্রিল দিয়ে ঘেরা থাকলেও সামনের দিকে একটা ছোট গেট আছে। গেট খুলে নারীটি হাতের ফুল সমাধিতে রেখে আবার গেট বন্ধ করে চলে গেলেন। আমি বসে থাকতে থাকতেই ১০–১২ জন ভক্ত এসে শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে গেলেন৷

যুগ যুগ ধরে মানুষের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা ছাড়া পৃথিবীতে আসলে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়।

আরও পড়ুন