আমি এখন যে গ্রামে এসেছি, সেই গ্রামে ১৮২৮ সালে লেখক লিও তলস্তয় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রাশিয়ার ইয়াস্নায়া পলিয়ানা নাম গ্রামটির। এটি আসলে তাঁদের পারিবারিক জমিদারির একটি অংশ। এখানে তিনি জীবনের অনেকখানি সময় কাটিয়েছেন। এখানেই লিখেছেন অমর উপন্যাস ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, ‘আনা কারেনিনা’ এবং অসংখ্য গল্প।
তলস্তয়কে আইন পড়তে কাজান শহরে পাঠানো হয়েছিল কিন্তু পড়তে তাঁর ভালো লাগেনি। জমিদারি ছিল, তাই রোজগারের চিন্তাও করতে হয়নি। মাঝখানে সন্তানদের পড়ালেখার জন্য আট বছর মস্কোতে একটি বাড়ি কিনে বসবাস করেছিলেন।
লিও তলস্তয় শেষ জীবনে আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকেছিলেন এবং খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। একসময় গৃহত্যাগ করেছিলেন। ১৯১০ সালে ৮২ বছর বয়সে আস্তাপোভো রেলস্টেশনে প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে একাকী, আত্মীয়, বন্ধু থেকে দূরে, নীরবে তিনি দেহত্যাগ করেন। এরপর তাঁকে ইয়াস্নায়া পলিয়ানায় এনে সমাহিত করা হয়।
ইয়াস্নায়া পলিয়ানা গ্রামে আমি যখন পৌঁছালাম, তখন রোদ ঝলমল করছে। গত কয়েক দিন খুব বৃষ্টি পড়েছে মস্কো শহরে। মস্কো থেকে আমাকে পাড়ি দিতে হয়েছে ২২০ কিলোমিটার। সরাসরি মস্কো থেকে তলস্তয়ের গ্রামে আসার কোনো ট্রেন বা বাস নেই। আমাকে ট্রেনে করে আসতে হয়েছে প্রথমে তুলা শহরে৷
ট্রেনে করে আসার পথে রাশিয়ার সবুজ গ্রামের যে রূপ আমি দেখেছি, তার তুলনা হয় না। পথের পাশে ফুটে আছে হলুদ বুনো ফুল আর হঠাৎ হঠাৎ করে একটা বা দুটো দোচালা বাড়ি। মাঝে পড়ে গেল একটা নদী, আবার এসে গেল ঘন সবুজ জঙ্গল। এমন অসামান্য প্রকৃতি যে দেশের আছে, সে দেশের প্রতি এমনিতেই মায়া জন্মে যায়।
রাশিয়ার ইয়াস্নায়া পলিয়ানা গ্রামে ১৮২৮ সালে লেখক লিও তলস্তয় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এটি তাঁদের পারিবারিক জমিদারির একটি অংশ। এখানে তলস্তয় জীবনের অনেকখানি সময় কাটিয়েছেন। এখানেই লিখেছেন অমর উপন্যাস ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, ‘আনা কারেনিনা’।
তুলা থেকে বাসে করে ইয়াস্নায়া পলিয়ানা গ্রামে যাওয়া যায়। কিন্তু রেলস্টেশনের বাইরে বেরিয়ে ইয়াস্নায়া পলিয়ানা যাওয়ার বাসস্টেশন খুঁজে পেলাম না। ভাষা জানি না বলে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে কোথায় যাব। রাশিয়ার অন্যান্য শহরের তুলনায় তুলা ছোট হলেও দক্ষিণ এশিয়ার তুলনায় বেশ বড় ও অত্যাধুনিক শহর। স্টেশন থেকে বের হতেই ট্যাক্সিচালকদের মাঝে একজন আমার কাছে এসে জানতে চাইল কোথায় যেতে চাই। আমি ভাবছিলাম বাস না পেলে ট্যাক্সি ডেকে নেব। ট্যাক্সি ডাকার আগেই দেখি ট্যাক্সি হাজির। ইশারায় এবং ট্রান্সলেটর দিয়ে দরদাম করে ট্যাক্সিতে চেপে বসলাম।
ট্যাক্সি শহর ছেড়ে গ্রামের পথ যখন ধরল, তখন একে আর এ জগতের গ্রাম বলে মনে হচ্ছিল না। মাঝখানে ধূসর লম্বা পথ আর দুপাশে ঘন বনানী। পথ কখনো চড়াই, কখনো উতরাইয়ের দিকে যাচ্ছে। তাতে পাশের বনের সৌন্দর্য হাজার গুণ বাড়িয়ে তুলছে। আর এদের মাথার ওপর নীল আকাশ যেন পথের মুকুট হয়ে আছে। এমন পথের দেখা মিললে পথই যেন এক রূপকথার ডালা খুলে বসে৷
বেশিক্ষণ পথের রাজ্যে থাকা গেল না। আমাকে ইয়াস্নায়া পলিয়ানা গ্রামে নামিয়ে ট্যাক্সিচালক চলে গেলেন।
আমি সকাল সকাল পৌঁছে গেছি। মনের মাঝে এক বিশাল সমুদ্র আছড়ে পড়ছে। কেমন দেখতে লিও তলস্তয়ের বাড়ি, তাঁর গ্রাম? এখানে আসার পর দেখি শুধু বাড়ি নয়, এক বিশাল রাজত্ব। তাঁর নিজের এস্টেটকে মিউজিয়াম করে রাখা হয়েছে।
এস্টেট মিউজিয়ামের টিকিট কাটার লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। কয়েক মিনিট পর টিকিট ঘরে কাচের ওপাশে থাকা নারীটি কী বললেন কিছুই বুঝতে পারলাম না। শুধু বললাম, ‘লিও তলস্তয়’। এরপর তিনি টিকিট দিলেন।
টিকিট হাতে গেটে টিকিট দেখাতেই টিকিট চেক করা নারীটি আমাকে সামনের একটা বেঞ্চে বসতে বললেন। কিন্তু আমার অবুঝ মনকে কে বোঝায়! আমি এখন লিও তলস্তয়ের এস্টেটে, যেখানে আদৌ পৌঁছাতে পারব কি না, সন্দেহ ছিল। কারণ, এই গহিন বনের মাঝে এক দুর্গম গ্রামে ভাষাজ্ঞান ছাড়া আসা একটা বড় ধরনের সাফল্য আমার কাছে।
মনের মাঝে এক বিশাল সমুদ্র আছড়ে পড়ছে। কেমন দেখতে লিও তলস্তয়ের বাড়ি, তাঁর গ্রাম? এখানে আসার পর দেখি শুধু বাড়ি নয়, এক বিশাল রাজত্ব। তাঁর নিজের এস্টেটকে মিউজিয়াম করে রাখা হয়েছে। এস্টেট মিউজিয়ামের টিকিট কাটার লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম।
আমি গ্রামের নুড়ি বিছানো পথ ধরে এগোতে থাকলাম। খানিক এগিয়ে দেখি বিশাল একটা লেক। আমাদের দেশের দিঘির চেয়ে বড়। লেকের পাড় ধরে ইউক্যালিপটাসগাছের সারি আর স্বচ্ছ নীল আকাশ যেন নেমে গেছে লেকের স্বচ্ছ জলে। আকাশ নিজের ছায়া ফেলে লেকের জলকে নীল করে তুলেছে। আর নীল সেই জল তিরতির করে কেঁপে কেঁপে উঠছে বাতাসের ঘায়ে। লেকে হলুদ রঙের শাপলা ফুল ফুটেছে আর জলের গভীরে সাঁতার কাটছে নানা জাতের মাছ। এদের সঙ্গে সাঁতার কাটছে অনেকগুলো হাঁস। হাঁস, হলুদ শাপলা, নীল দিঘি পেছনে ফেলে আমি সামনে এগোই।
এখন পথের দুপাশে জঙ্গল আরও ঘন হয়ে এসেছে। সূর্যের আলো এই ঘন ডালপালা ভেদ করে আসতে পারছে না। যতই এগোচ্ছি, ততই এই বনানী গাঢ় সবুজ রং ধারণ করছে। বেশ অনেকটা হেঁটে আসার পর সামনে মিলল ইয়াস্নায়া পলিয়ানা এস্টেটের নার্সারি। নার্সারি আলো করে ফুটে আছে গোলাপি রঙের ফ্লক্স আর ফন লিলি। অন্যান্য ফুলও আছে, তবে গোলাপি রঙে ছেয়ে গেছে বাগান। আর পেছনের নীপবিথীকা ছেয়ে আছে উঁচু উঁচু অ্যাশ আর ওকগাছে। এই বাগানে কয়েকজন ট্যুরিস্ট বেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবাই রাশিয়ান ট্যুরিস্ট।
আমাকে এই ফুলবাগান আকৃষ্ট করতে পারছে না। মন পড়ে আছে লিও তলস্তয়ের বাড়িতে। আর কত দূর গেলে দেখতে পাব তাঁর বাড়ি?
বাগান থেকে বেরিয়ে আরও ঘন নীপবন পেলাম। মাঝ দিয়ে নুড়ি আর মাটির পথ চলে গেছে। সে পথ ধরে খানিক এগোনোর পর ডান দিকে একটা উদ্যান আর বাঁ দিকে একটা বাড়ি। এদিকটা বাড়ির পেছন দিক। ঘুরে সামনের দিকে যেতেই আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। আমি সত্যিই এসে দাঁড়িয়েছি মহান লেখক লিও তলস্তয়ের বাড়ির সামনে।
বাড়িটি দোতলা। বাড়ির একতলার বারান্দার পুরোটাই গুল্মলতার আচ্ছাদন দেখে মনে হচ্ছে, বনের সবুজ পর্দা এখানে নেমে এসেছে। বাড়ির সামনে দুপাশে বাগান। সেখানে গোলাপ, ডালিয়া আরও অনেক ফুল ফুটেছে। বাগানের সামনে বেশ কিছু ট্যুরিস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি কিছুক্ষণ ঘুরে চলে গেলাম সদর দরজার দিকে। সদর দরজাটি আসলে পথের উল্টো দিকে ঘোরানো। দরজায় দাঁড়িয়ে অতি স্মার্ট স্ট্রেইট কাট স্কার্ট আর টপ পরা দ্বাররক্ষী।
আমার টিকিট দেখে দ্বাররক্ষী বললেন, ‘তোমার গ্রুপ কোথায়?’ আমি তো একা এসেছি। শুনে সঙ্গে সঙ্গে দ্বাররক্ষী একটি মেয়েকে ডেকে আনলেন। মেয়েটির নাম পলিনা। ইংরেজি জানে, এখানকার লাইব্রেরিতে কাজ করে। রাশিয়ার ট্র্যাডিশনাল গাউন ধরনের লম্বা জামা পরে আছে। পলিনা আমার টিকিট দেখে দূরে একটা জটলা দেখিয়ে বলল, ‘ওই যে তোমার গ্রুপ। তুমি দল ছাড়া হয়ে গিয়েছ। আসলে টিকিট কাটার সময় মিউজিয়াম থেকেই দশজনের একটা দল করে দেওয়া হয়। কেউ একজন বা দুজন এলেও অন্যদের সঙ্গে মিলিয়ে দল করা হয়। আমি তোমাকে মিউজিয়াম ঘুরিয়ে দেখাব। তাই দলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।’ বলেই পলিনা গাইডের দিকে এগোল। গাইডকে দেখে আমার চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। মেয়েটি এত স্মার্ট যে এখানে আসা সব ট্যুরিস্টকে হার মানাবে। সাদা শার্ট ইন করে ডেনিমের সঙ্গে পরা, চোখে এভিয়েটর সানগ্লাস। আর তার ব্যক্তিত্ব আরও স্মার্টনেস বাড়িয়ে দিয়েছে। পলিনা গাইড মেয়েটিকে বলল, তার দল থেকে যে হারিয়ে গেছে, তার দায়িত্ব পলিনা নিয়েছে।
বসার ঘর পার হলে এ বাড়ির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কক্ষ তলস্তয়ের লেখার ঘর। সেখানে তলস্তয়ের লেখার টেবিল রাখা। লিও তলস্তয়ের লেখার টেবিল দেখা এক বিশাল ভাগ্যের বিষয়, আমি সে সৌভাগ্যের অংশীদার হতে পেরেছি। এর চেয়ে আনন্দের, গর্বের আর কিছু হতে পারে না।
পলিনা আমাকে এখন মিউজিয়াম ঘুরিয়ে দেখাবে। কারণ, এখানে অডিও গাইড বা ইংরেজিতে ব্রোশার নেই, সবকিছু রাশিয়ান ভাষায় লেখা। আমি বাড়ির ভেতরের ছবি তুলতে চাই। পলিনা বলল, ‘আমাদের অফিস থেকে অনুমতি নিতে হবে।’ আমি আর পলিনা অফিসে গিয়ে অনুমতি নিয়ে এলাম। সাধারণত ভেতরে কাউকে ছবি তুলতে দেওয়া হয় না। আমি একমাত্র বিদেশি ট্যুরিস্ট বলে আমাকে অনুমতি দিয়ে দিল।
আমি আর পলিনা চললাম মহান লেখক লিও তলস্তয়ের বাড়ি দেখতে।
বাড়িতে প্রবেশ করতেই বড় একটা হলরুম। এই কক্ষে কাঠের ভারী ভারী শোকেসে লিও তলস্তয়ের সংগ্রহের বই রাখা আছে। লিও তলস্তয়ের সংগ্রহে ১৪টি ভাষার প্রায় ২৩ হাজার বই ছিল।
আর কিছু দেখার আগেই আমরা চললাম দোতলায়।
কাঠের সিঁড়ি পেরিয়ে প্রথমেই লিও তলস্তয়ের খাবার ঘর। কক্ষটি বেশ বড়। তলস্তয়ের বিশাল খাবার টেবিল দেখলেই বোঝা যায় এটি তাঁদের পরিবার ও বাইরের অতিথি আপ্যায়নের জন্য আদর্শ। দেয়ালে তলস্তয় ও স্ত্রী সোফিয়ার বিভিন্ন সময়ের বেশ কয়েকটি পোর্ট্রেট ঝুলছে। খাবার টেবিলে তলস্তয়ের ব্যবহৃত সামোভার, ক্রোকারিজ সাজানো আছে। এক কোনায় কর্নার টেবিলে লন্ঠন রাখা। আরেক পাশের কর্নার টেবিলে রাখা তলস্তয়ের ব্যবহৃত জিনিসপত্র।
টেবিলের উল্টো পাশে রাখা একটি পিয়ানো ও গ্রামোফোন। লিও তলস্তয় নিজে কিছু সুর তুলেছিলেন পিয়ানোয়। এত বড় পিয়ানো আমি খুব কম দেখেছি। ঘরে পর্যাপ্ত আলো আসার জন্য দুই পাশে বিশালাকৃতির দুটো জানালা দাঁড়িয়ে।
পরের কক্ষটি লিও তলস্তয়ের বসার ঘর। তুলনামূলকভাবে এ কক্ষটি বেশ ছোট। কক্ষে ছোট একটা সোফা, চেয়ার আর কাউচ রাখা। দেয়ালে ঝুলছে তলস্তয় ও তাঁর পরিবারের বিভিন্ন সময়ের পোর্ট্রেট। এ ছাড়া এ কক্ষের এক কোনায় স্ত্রী সোফিয়ার হাতে গড়া তলস্তয়ের ছোট একটি ভাস্কর্য শোভা পাচ্ছে। আর ছোট ছোট শোকেসে রাখা আছে তাঁদের পরিবারের ব্যবহার্য জিনিসপত্র।
বসার ঘর পার হলে এ বাড়ির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কক্ষ তলস্তয়ের লেখার ঘর। সেখানে তলস্তয়ের লেখার টেবিল রাখা। লিও তলস্তয়ের লেখার টেবিল দেখা এক বিশাল ভাগ্যের বিষয়, আমি সে সৌভাগ্যের অংশীদার হতে পেরেছি। এর চেয়ে আনন্দের, গর্বের আর কিছু হতে পারে না।
এই কক্ষের শেলফে তাঁর সংগ্রহের বই রাখা আছে সারি সারি। দেয়ালে ঝুলছে তাঁদের পারিবারিক ছবি। এক পাশে একটা বড় সোফা রাখা আর কক্ষের মাঝখানে লিও তলস্তয়ের লেখার টেবিল। পলিন যখন এই টেবিল আর চেয়ার সম্পর্কে বলছিল, তখন কোনো কথাই আমি যেন শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমার সামনে তলস্তয় বসে লিখছেন, উষ্কখুষ্ক চুল আর লম্বা দাড়ি, পরনে অতি সাধারণ পোশাক। নিবিষ্ট মনে লিখেই যাচ্ছেন, জগৎ সংসারের সঙ্গে তাঁর এখন কোনো যোগাযোগ নেই। তিনি চলে গেছেন উপন্যাসের পাতায়। এখান থেকে তাঁকে কেউ সরাতে পারবে না। এদিকে পলিনা বলেই চলেছে আর আমি কিছুই শুনছি না।
হঠাৎ সংবিৎ পেয়ে উঠতেই খুব লজ্জা পেলাম। সামনে লিও তলস্তয়ের টেবিল। টেবিলের সঙ্গে লাগোয়া চেয়ারটি খুব ছোট। এটি নাকি তাঁর মেয়ের চেয়ার ছিল। এই চেয়ারে বসেই তিনি লিখেছিলেন অমর সব উপন্যাস আর গল্প। টেবিলের পাশে একটা এক সিটের সোফা রাখা। লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে গেলে তিনি সেই সোফায় বসে বিশ্রাম নিতেন।
টেবিলে তলস্তয়ের হাতে লেখা কিছু কাগজ, তাঁর নামাঙ্কিত স্ট্যাম্প ইত্যাদি আছে। কক্ষের আরেক কোনার টেবিলে তাঁর ব্যবহৃত ল্যাম্প, দোয়াত, বই রাখা।
বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন নিজের আবিষ্কৃত ফোনোগ্রাম যন্ত্র উপহার দিয়েছিলেন তলস্তয়কে। সেই ফোনোগ্রামে তলস্তয়ের ভয়েস রেকর্ড করা আছে। সেই কক্ষেই আমাকে লিও তলস্তয়ের কণ্ঠস্বর শোনানো হলো। তার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে আমি ১৮৭৭ সালে চলে গিয়েছি।
তলস্তয়ের পড়ার ও লেখার ঘরেই একটা আশ্চর্যজনক বাক্স দেখলাম। বিখ্যাত ব্যক্তিরা তলস্তয়ের বন্ধু ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন। নিজের আবিষ্কৃত ফোনোগ্রাম যন্ত্র উপহার দিয়েছিলেন তলস্তয়কে। সেই ফোনোগ্রামে তলস্তয়ের ভয়েস রেকর্ড করা আছে। সেই কক্ষেই আমাকে লিও তলস্তয়ের কণ্ঠস্বর শোনানো হলো। লিও তলস্তয়ের পড়ালেখার ঘরে দাঁড়িয়ে এই একটু আগেই আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন তলস্তয়কে দেখতে পাচ্ছি। এখন তার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে আমি ১৮৭৭ সালে চলে গিয়েছি। ফোনোগ্রামের বাক্সটি দেখতে আগেকার দিনের সেলাই মেশিনের বাক্সের মতো।
ফোনোগ্রাম মেশিনের পেছনে আরেকটি টেবিলে বিভিন্ন ধরনের লেখার কালির দোয়াত রাখা। এদের মাঝে একটি দোয়াত নিউইয়র্কে তৈরি।
পরের কক্ষটি তলস্তয়ের শোবার ঘর। খুব সাধারণ একটি সিঙ্গেল বেড কক্ষের এক কোনায় রাখা। বিছানায় সাদা চাদরের ওপর কুরুশ-কাঁটায় বোনা রঙিন চাদর পাতা। বেড সাইড টেবিলে লেখকের ব্যবহৃত টেবিল ঘড়ি, বিস্কুটের বাক্স, ডায়েরি, বই, মোমবাতিদানি রাখা আছে। বিছানার আরেক পাশে কাঠের অতি সাধারণ একটি আলমারি। আলমারির এক পাশে ঝুলছে লেখকের সাদা রঙের শার্ট। লিও তলস্তয় জমিদার হয়েও অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তার প্রমাণ মেলে তাঁর পোশাক ও আসবাবে।
ছোট কক্ষটির আরেক পাশে একটি টেবিলে রাখা আছে ভদকার কয়েকটি কাচের বোতল। এর পাশে কয়েকটি ছোট টিনের বাক্স। বাক্স দেখে মনে হচ্ছে স্ন্যাকস বা সেই জাতীয় কিছুর বাক্স হবে। আরেক পাশে তাঁর ব্যবহৃত ছড়ি ও হাউস কোট ঝোলানো। বিছানার পাশের চেয়ারে ঝুলছে লেখকের ব্যবহৃত সোয়েটার। এই কক্ষটিও বেশ ছোট।
এরপর পলিনা কাঠের সিঁড়ি পেরিয়ে আমায় নিয়ে চলল নিচের বেজমেন্টের কক্ষে। আমি ভেবেছি হয়তোবা ভাড়ার ঘর হবে বা স্টোর রুমজাতীয় কিছু। নিচতলার প্রায় পুরোটাই তলস্তয়ের সংগ্রহের বই রাখা। এ বাড়িতে ঢোকার মুখেই দেখেছি এই কক্ষগুলো।
পলিনা বলল, ‘এখন এ বাড়ির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কক্ষে যাব আমরা।’ বলে বেজমেন্টে নিয়ে গেল। সেখানে ভেতরের বাঁ দিকের প্রায় অন্ধকার একটি কক্ষ দেখিয়ে বলল, এই ঘরে বসে তিনি লিখেছিলেন ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইলাম, এই সেই ঘর, যেখানে নিরিবিলিতে লেখা যায় বলে ওপরতলা থেকে নিচের বেজমেন্টে এসে লেখক থাকা শুরু করেছিলেন। লম্বাটে ঘরে সাধারণ এক সেট সোফা, সেন্টার টেবিল আর একটা সিঙ্গেল বেড আছে। লেখার টেবিলটি ওপরতলা থেকে নিচে আনা হয়েছিল তখন। ১৮৬৯ সালে ওয়ার অ্যান্ড পিস বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। লেখার সময়কাল ছিল ১৮৬৫ সাল। ফ্রান্সের রাশিয়া আক্রমণের পটভূমি নিয়ে লেখা এই উপন্যাসকে তলস্তয় সাহিত্য, ইতিহাস বা কবিতায় বেঁধে ফেলতে চাননি, বরং দর্শনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন।
বেজমেন্টের এই কক্ষে আলো–বাতাস তেমন প্রবেশ করতে পারছে না। কিন্তু লেখার জন্য তিনি এসবকে তুচ্ছ ভেবেছিলেন।
এর উল্টো দিকের কক্ষে বসে তিনি লিখেছিলেন আরেক বিখ্যাত উপন্যাস ‘আনা কারেনিনা’। মানব সম্পর্কের আশ্চর্য এক রূপ তিনি যেন নিজ চোখে দেখতে পেয়েছিলেন। আনা কারেনিনা লিখেছিলেন ১৮৬৮ সালে।
এই কক্ষটি আগের কক্ষের তুলনায় বদ্ধ নয়। বেশ খোলামেলা, বড় একটা জানালা আর বাইরে যাবার জন্য কাচের দরজাও আছে।
লিও তলস্তয়ের বাড়ির পুরোটাই ঘুরে দেখা হয়ে গেছে। পলিনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব, বুঝে উঠতে পারছি না। বললাম, ‘চলো এস্টেটের কফি শপে গিয়ে খানিকক্ষণ আড্ডা দিই আর কফি খাই।’ কিন্তু পলিনার ফিরে যেতে হবে অফিসে। আমি ঠিকমতো কৃতজ্ঞতা জানানোর আগেই পলিনা হাসি ছড়িয়ে দিতে দিতে চলে গেল। এই দেশের সবাই খুব কর্মঠ, কাজ ছাড়া আড্ডা ইত্যাদিতে এদের আগ্রহ নেই। আর নিজের কাজ ফেলে বিদেশিকে সহায়তা করার মানসিকতা আর কোনো জাতির আছে বলে আমার জানা নেই।
আমি এস্টেটের বাকি অংশ দেখার জন্য পা বাড়ালাম। ঘন গাছপালার মাঝে অনেক দূরে দূরে একেকটা বাড়ি। লিও তলস্তয়ের বাড়ি পার হয়ে খানিক এগোলেই একটা রাজকীয় বাড়ি। সাদা রঙের বিশাল এ বাড়িতে তলস্তয় থাকেননি। পরিবার নিয়ে বসবাস করেছেন অতি সাধারণ ছোট একটি বাড়িতে। এস্টেটে বেশ কয়েকটি রাজকীয় জমিদারবাড়ি থাকলেও তলস্তয় নিজে বেছে নিয়েছিলেন সাধারণ বাড়ি।
জঙ্গলের পথে নুড়ি বিছানো মেঠোপথ ধরে বেশ খানিকটা হেঁটে একটা খোলা জায়গায় পৌঁছালাম। এখান থেকে দূরে যত দূর চোখ যায়, শুধুই সবুজ বনভূমি আর এর ওপরে গাঢ় নীল আকাশ ছেয়ে আছে। পুরোটাই ইয়াস্নায়া পলিয়ানা গ্রাম, লিও তলস্তয়ের জমিদারির অংশ।
আরও খানিকটা সবুজের মাঝে, ঘন গাছপালার ভেতর দিয়ে হেঁটে আমি অবশেষে পৌঁছালাম লিও তলস্তয়ের সমাধিতে।
ঘন জঙ্গলের মাঝে পাখির ডাক আর এর মাঝে আগাগোড়া ঘাসে ঢাকা নামফলক, সৌধবিহীন একটা সাধারণ সমাধি। সমাধিটি বাঁধানোও নেই। এ রকম সাধারণ সমাধির নির্দেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং তলস্তয়। গাছের ছায়ায়, পাখির ডাকে, নীরবে একমাত্র এই মহান লেখকই বসবাস করতে পারেন।