ইথিওপিয়া ভ্রমণ
আফ্রিকার ‘মক্কা’—হারার
ইসলাম প্রচারের শুরুর দিকে একদল সাহাবি সমুদ্রপথে আফ্রিকার যে অঞ্চলে এসে নোঙর ফেলেন, সে জায়গাটির নামই হারার। সাহাবিরা এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ইসলাম প্রচারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন এবং পাকাপাকিভাবে বসবাসও শুরু করেন। আর এ জন্যই হারারকে আফ্রিকার ‘মক্কা’ বলা হয়ে থাকে।
আফ্রিকার ‘মক্কা’। কেমন অদ্ভুত যেন শোনাল যখন ইথিওপিয়া ভ্রমণ নিয়ে বিভিন্ন ব্লগ পড়ছিলাম। আসল মক্কায়ই যাওয়া হয়নি, আফ্রিকার মক্কায় যাওয়ার পথ পাওয়া যাবে তো! তার ওপর ইথিওপিয়ায় পা দিয়েই বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। বেশির ভাগ জায়গায়ই একা চলাফেরা করা নিষেধ। স্থানীয় গাইড নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। কোনো কোনো প্রদেশে তো একা এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে ট্যুরিস্টদের চলাফেরায় পাবন্দী এসে গেছে। ইথিওপিয়ার ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলো আগেই দেখে ফেলেছি। সবশেষ স্থান হিসেবে রেখেছি হারার বা আফ্রিকার মক্কাকে।
চলাচলে নিষেধাজ্ঞার কারণে ইথিওপিয়ার ভেতরে এক শহর থেকে অন্য শহরে আমাকে বাসে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়নি। সব শহরে আমাকে প্লেনে করে যেতে হয়েছে। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো বেশির ভাগ শহরের সঙ্গে অন্য শহরে যাওয়ার জন্য ডাইরেক্ট ফ্লাইট নেই। রাজধানী আদ্দিস আবাবা এসে তারপর অন্য ফ্লাইটে যেতে হবে। আমি এসেছি মরুভূমির শহর সেমেরা থেকে। আদ্দিস আবাবায় এসে শুনি যে ফ্লাইটে ডিরে ডাওয়া শহরে যাওয়ার কথা, সে ফ্লাইট বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। আমি একটুও ঘাবড়ালাম না। কারণ, ইথিওপিয়ায় এক মাসের বেশি সময় ভ্রমণ করে নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে। অন্য শহরে যাওয়ার ফ্লাইটও আগে বাতিল হয়েছিল। আর পরে যাওয়ার ফ্লাইট ছিল দুদিন পর। যা–ই হোক, এবার বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। আমার জায়গা হয়েছে পরের ফ্লাইটে।
বিকেল পাঁচটায় ফ্লাইট টেক অফ করল। এক ঘণ্টার মধ্যেই আমাকে ডিরে ডাওয়া এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিল। ইথিওপিয়ার যেকোনো শহরে আগে থেকে হোটেল বুক করে রাখতে হয় এবং বিদেশি ট্যুরিস্টদের নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরে অবশ্যই ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করা হোটেলে বুঝেশুনে রুম বুক করতে হয়। আমার মতো বাজেট ট্রাভেলারের পকেটের বারোটা এখানেই বেজে গেছে। ডিরে ডাওয়া শহরের সবচেয়ে ভালো হোটেলে রুম বুকিং দিয়েছি আমি। ইথিওপিয়ার সব শহরেই এয়ারপোর্ট থেকে ট্যুরিস্টদের পিকআপের ব্যবস্থা আছে। আমি পৌঁছে পার্কিংয়ে যেতেই হোটেলের নাম লেখা মাইক্রোবাস আর আমার নাম লেখা প্ল্যাকার্ড খুঁজে পেলাম।
প্লেন থেকে নামার আগেই সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। তাই পথে শহরের কিছুই দেখতে পাইনি। মনে হলো এ শহরটা বেশ উন্নত আর পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন। অবশ্য গোটা আফ্রিকা মহাদেশ আমার কাছে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন বলেই মনে হয়েছে। তবে ডিরে ডাওয়া শহরকে দেখে মনে হলো, এ শহরে প্রাণ আছে।
পরদিন সকালে হোটেলে নাশতা করেই রওনা দিলাম হারার শহরের দিকে। দিনে গিয়ে হারার শহর দেখে দিনেই ফিরে আসার পরামর্শ দিয়েছে ইথিওপিয়ায় জুটে যাওয়া বন্ধুরা। কারণ, হারারে কোনো ভালো হোটেল নেই। হোটেল যা আছে, তা সব ডিরে ডাওয়া শহরেই। আরও মজার ব্যাপার হলো, স্থানীয়রা আমাকে হোয়াইট গার্ল ভেবে ভুল করে। বাড়তি খাতির করে, বন্ধুত্ব করতে চায়। কিন্তু এসবের আমার সময় নেই। এবং প্রতিটি শহরের গাইড আমাকে স্থানীয়দের সঙ্গে মেলামেশা করতে নিষেধ করে দিয়েছে। উত্তর ইথিওপিয়ায় তো পুরো জুজু বুড়ির ভয় দেখানো হয়েছিল যে একা ঘুরলে বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলো আমাকে কিডন্যাপ করে মুক্তিপণ দাবি করবে। অবশ্য সে রকম কিছু ঘটেনি।
আমার ইথিওপিয়া ভ্রমণের সবশেষ শহর হলো হারার। বেশ সাহস করেই গাইড ছাড়া এই প্রথম একা হোটেল থেকে বেরিয়ে পাবলিক মিনিবাসে রওনা দিলাম হারারের উদ্দেশে। একমাত্র ইথিওপিয়া ছাড়া আমি কোথাও গাইড নিয়ে ঘুরি না, নিজের মতো ঘুরি। কিন্তু ইথিওপিয়ায় সরকার থেকেই নিয়ম করে দেওয়া আছে যে বিদেশি ট্যুরিস্টদের অবশ্যই গাইড নিয়ে বেড়াতে হবে। অগত্যা আমাকেও গাইড নিতে হয়েছিল।
মিনিবাসে আমার সহযাত্রী ছেলেটিও বলল, হারার পৌঁছে গাইড নিয়ে নিতে। বাইরে তখন ডিরে ডাওয়া ছেড়ে পাহাড় এসে গেছে। পথের দুপাশে উঁচু উঁচু সবুজ পাহাড়। আফ্রিকার জনসংখ্যা কম হওয়ায় পথে কোনো মানুষ চোখে পড়ল না। পাহাড়ি পথ পার হয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে হারার পৌঁছে গেলাম।
ইথিওপিয়ায় এসে হারার সম্পর্কে আমার একধরনের ফ্যান্টাসি কাজ করছিল। একে তো অনেক জায়গায় যাওয়া নিষেধ তার ওপর অনেক ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছিল তাই আদৌ হারার পর্যন্ত আমার পা জোড়া পৌঁছাতে পারবে কি না, নিশ্চিত ছিলাম না। এখন মনে হচ্ছে সত্যি সত্যিই আমি পৌঁছাতে পেরেছি।
মিনিবাসের সহযাত্রী আমাকে একটা সিএনজি অটোরিকশা ঠিক করে দিল সারা দিনের জন্য, যাতে পরে ঝামেলায় পড়তে না হয়। এটা অনস্বীকার্য যে সাধারণ মানুষ এখানে যথেষ্ট সহায়তা করে।
এখানে অটোরিকশাকে বলা হয় বাজাজ। ভারতের বাজাজ কোম্পানির অটোরিকশা তাই সাদা আর নীলরঙা এই বাহনের নাম এখানে বাজাজ। বাজাজে চড়ে আমি রওনা দিলাম হারার ওল্ড সিটি বা ওয়ালড সিটির দিকে। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন ছোট শহর হারার। প্রায় সব বাড়িই একতলা বা দোতলা এবং সব বাড়ি বা অফিসের রং সাদা। এমন সমন্বয় আমি ইথিওপিয়ার আর কোথাও দেখিনি।
বাজাজচালক আমাকে একটা গলির মুখে নামিয়ে দিল। বলল যে সে এখানেই আছে। যেহেতু ওয়ালড সিটি বা দেয়ালে ঘেরা পুরোনো শহর দেখতে আমার সময় লাগবে, তাই আমার জন্য সে এখানেই অপেক্ষা করবে।
ওয়ালড সিটি বা দেয়ালঘেরা পুরোনো শহরের গলিতে পা রেখে মোহিত হয়ে গেলাম। গলির দুপাশে সাদা দেয়াল পরিচ্ছন্ন গলি ধরে চলে গেছে আর দেয়ালে আঁকা আছে নানা নকশা। কাছে গিয়ে খেয়াল করে দেখলাম সে যেমন তেমন নকশা নয়। মেয়েদের গলার হার আর টায়রা বিশাল আকারে দেয়ালে আঁকা। আসলে আঁকা নয়, সিমেন্ট দিয়ে আকার তৈরি করে তাতে রং করে দেওয়া হয়েছে। একটু পেছনের দিকে কফি রাখার পাত্র আঁকা আর এর ওপরে লেখা আছে—হারার সিটি অব পিস, আ লিভিং মিউজিয়াম। আসলেই হারারকে লিভিং মিউজিয়াম বা জীবন্ত জাদুঘর বলা যায়।
এক গলি থেকে নানা গলি চলে গেছে। গলির দুপাশে দেয়াল আর দেয়ালের ওপাশে মানুষের ঘরবাড়ি। সবই একতলা। কোনো দেয়ালের সামনে লম্বা জায়গায় ছোট ছোট গাছ লাগানো। যত দূর চোখ যায় আকাশ ছুঁয়ে আছে সবুজ গাছপালা। এসব যখন দেখছি তখন একজন এসে আমাকে ইশারায় কী যে জিজ্ঞেস করল। আমি এক মাসের বেশি সময় ধরে ইথিওপিয়ায় ভ্রমণ করছি। আমার সঙ্গে যেচে কেউ কথা বলতে এলেই আমার গাইড হই হই করে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে এত দিন। এখন আমি জানি না এই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলব, না এড়িয়ে যাব? কারণ, আমাকে সব জায়গায় বারবার স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ দেখি ব্যক্তিটি নিজের মোবাইল আমাকে দেখাচ্ছে। মোবাইলে লেখা—আমি বাকশক্তিহীন একজন গাইড। আমি তোমাকে ওল্ড সিটি ঘুরে দেখাব। তুমি কি আমাকে গাইড হিসেবে নেবে?
আমার খুব মায়া হলো। আহা বেচারার সংসার চলে গাইডের কাজ করে। আর বাকশক্তিহীন কোনো ব্যক্তিকে কেউ গাইড হিসেবে নেবে কি না, জানি না, তবে আমি নিলাম। আমি ছাড়া কোনো ট্যুরিস্টও চোখে পড়ছে না। তার নাম ইসমাইল। শুধু বাকশক্তিহীনই নয়, সে বধির। আমারও অপরিসীম ধৈর্য। সে কথা না বুঝলে মোবাইলে লিখে জিজ্ঞেস করি, শুনতে পায় না বলে ইশারায় কাজ চালাই।
সাদা দেয়ালের পথ ধরে এগোতে এগোতে সামনে একটা মাদ্রাসা পড়ল। আমি অতিসাহসী হয়ে ছেলেদের মাদ্রাসায় ঢুকে গেলাম দেখতে, কীভাবে পড়াশোনা করে তারা। ভেতরে উঠান, উঠান পেরিয়ে একতলা মূল মাদ্রাসা ভবন। উঠানে ১২–১৪ বছরের বাচ্চারা ঘুরছে। ওরা এখন পড়ছে না। পড়াশোনা আজকের মতো শেষ।
হারার শহরে জনসংখ্যার অধিকাংশই মুসলমান। ইসলাম প্রচারের শুরুর দিকে একদল সাহাবি সমুদ্রপথে আফ্রিকার যে অঞ্চলে এসে নোঙর ফেলেন, সে জায়গাটির নামই হারার। সাহাবিরা এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ইসলাম প্রচারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন এবং পাকাপাকিভাবে বসবাসও শুরু করেন। আর এ জন্যই হারারকে আফ্রিকার ‘মক্কা’ বলা হয়ে থাকে। একসময় সমুদ্রবন্দর হারার শহরের কাছে ছিল। এখন বেশ দূরে সরে গেছে।
মাদ্রাসা দেখে আমি নিজের মতো হাঁটছি। হঠাৎ ইসমাইলের চিৎকার। হাত দিয়ে একটা ভবন দেখাল। বুঝলাম, এখানে দেখার মতো কিছু আছে। প্রাচীর পেরিয়ে ভেতরে গিয়ে দেখি সেটা হারারের আমির শেরিফ আদবেল্লাহর বাসভবন, বর্তমানে এটি মিউজিয়াম। দোতলা ভবনের স্তম্ভ কাঠের, দরজায় কাঠের ওপর কারুকাজ। দোতলার ঝুলবারান্দাও কাঠের তৈরি। আর জানালায় রঙিন কাচ বসানো। কয়েকটা সিঁড়ি পেরিয়ে সদর দরজা। তবে কাঠের সদর দরজার শীর্ষে গণেশ ঠাকুরের মূর্তি আর এর নিচে তিনটি পরি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। এর নিচে অবশ্য ফুল লতাপাতা খোদাই করা। বিবরণ পড়ে জানতে পারলাম, আঠারো শতকে নির্মিত আমিরের এই ভবনের কাঠের কারুকাজ করে দিয়েছিলেন ভারতীয় শিল্পীরা।
মিউজিয়ামের ভেতরের প্রথম কক্ষে নানা বইপুস্তক রাখা। এর মধ্যে বেশির ভাগই আরবি ও হারারি ভাষায় হাতে লেখা পুরোনো সব বই। উল্লেখ্য, হারারে একসময় আরবি ও স্থানীয় গি সিনান ভাষার প্রচলন ছিল। অবশ্য এখন ইথিওপিয়ার প্রধান ভাষা আহমারিক। স্থানীয় লোকজন এখন আরবি উচ্চারণে এই তিন ভাষার মিশেল একটি ভাষায় কথা বলে। হাতে লেখা বেশ কয়েকটি কোরআন শরিফ শোকেসে শোভা পাচ্ছে।
এখানকার পুরুষদের পোশাক আরবদের মতোই, আর নারীরা ম্যাক্সির সঙ্গে একটা বড় ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে রাখেন। পরের কক্ষে আমির বা রাজাদের পোশাক রাখা। আরবের রোবের ওপর এঁরা মাথায় রঙিন নকশাদার টুপি পরেন। আর নারীরা ম্যাক্সির ওপর বড় ওড়না পরেন। অভিজাত ঘরের নারীরা অবশ্য সিল্কের ম্যাক্সি পরেন। আর অনুষ্ঠানে গলার হার, হাতের বালার সঙ্গে মাথায় টায়রাও পরেন, যার নকশা আলাদা। হারারের টায়রা অন্যান্য অঞ্চলের টায়রার মতো নয়। ত্রিভুজাকৃতির তিনটি চাকতি কপালে ঝুলিয়ে টায়রা পরা হয়। টায়রা আসলে ইথিওপিয়ার নারীদের গয়নার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সব এলাকার নারীরা আর কিছু না পরলেও টায়রা ঠিকই পরতেন। ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের নারী কেবিন ক্রুরা এখনো মাথায় পুতির চিকন একটা টায়রা পরেন।
নারী ও পুরুষের পোশাক আর গয়নার জন্য আলাদা কক্ষ। সেখানে বিভিন্ন রঙের পোশাক পরা ম্যানিকুইন নারী-পুরুষ শোভা পাচ্ছে কাচের শোকেসের ভেতরে। আরও কয়েকটি শোকেসে রাজাদের পোশাক ও গয়না শোভা পাচ্ছে। পোশাকগুলো সিল্কের তৈরি আর তাতে করা আছে জারদৌসি নকশা। গয়নাগুলো দেখে আসল সোনার গয়না বলে মনে হলো না। এ ছাড়া নানা ডিজাইনের রুপা, পাথরের গয়না রাখা আছে শোকেসে। রুপার গয়নায় বৈচিত্র্য প্রচুর। দেখতে দেখতে অনেক সময় চলে গেল।
রাজাদের জুতা তেমন জাঁকালো নয়। খুব সাধারণ চামড়ার স্যান্ডেল পরতেন তাঁরা। তবে আশ্চর্য হলাম এখানে কাঠের তৈরি খড়ম দেখে। খড়ম যে শুধু এশিয়ায় ব্যবহৃত হতো, তা নয়। আফ্রিকায়ও এর কদর ছিল। পরের কক্ষে রাজা ও অন্যদের তরবারি, ছোরা, ড্যাগার ইত্যাদি সাজিয়ে রাখা আছে। এরপরের কক্ষে হারার রাজ্যের মুদ্রা সংরক্ষিত আছে। এই কক্ষটিতে সংরক্ষিত নানা সময়ের হারারি মুদ্রা দেখে আমার সবচেয়ে বেশি সময় কেটেছে।
বলা হয়ে থাকে, নবীজি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সময়ই একদল সাহাবি সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আফ্রিকার হারার শহরে এসে পৌঁছেছিলেন। তবে এই জাদুঘরে সংরক্ষিত সবচেয়ে পুরোনো মুদ্রাটি হিজরি ২৫৮ সনের বা ৮৭১ সালের। তখন থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মুদ্রা এখানে সংরক্ষিত আছে।
তবে পাশের কক্ষে আরও অনেক প্রাচীন মুদ্রা সংরক্ষিত আছে, যেগুলো মাটি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছিল, যা হিজরি সন গণনার আগে চালু ছিল। এর মানে হলো হারার শহরের অস্তিত্ব আমাদের নবীজির জন্মের আগেও ছিল। ইথিওপিয়ার নিজস্ব কোন্দল, দারিদ্র্য ইত্যাদি কারণে হারার সম্পর্কে গবেষণা করেনি কেউ।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে হারার স্বয়ংসম্পূর্ণ মুসলিম শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫২০ সালে সুলতান আবু বকর ইবনে মুহাম্মদ হারারকে আদাল সালতানাতের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেন। হারার হয়ে যায় আশপাশের রাজ্যের বাণিজ্যের মধ্যমণি। ১৬৪৭ সালে হারার রাজ্য খ্রিস্টান শাসকদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত দাউদ রাজবংশের স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। এরপর হারারকে দখল করে নেয় মিসরের রাজা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইথিওপিয়া রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারার ইথিওপিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তবে মজার ব্যাপার হলো, আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশ বহু বছর ব্রিটিশ বা ইউরোপের কলোনি হয়ে থাকলেও ইথিওপিয়াকে কখনোই বিদেশিরা কলোনি বানাতে পারেনি।
ভবনের দোতলায় আরও বেশ কয়েকটি কক্ষ থাকলেও সংস্কারের জন্য তা খালি আছে। আমি দোতলায় কাঠের ঝুলবারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। এখান থেকে হারার ওয়ালড সিটি ছাড়িয়েও অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। হারার শহরটি বেশ সবুজ। দূরে পাহাড় আর এর মধ্যে উনুচ্চ ভবনের বসবাস।
পাশের আরেকটি ভবনে জাদুঘরের সম্প্রসারিত অংশ। সেখানে রাজাদের খাট-পালং, প্রয়োজনীয় আসবাব, তৈজসপত্র ইত্যাদি রাখা আছে। প্রথম কক্ষেই বড় একটা পালঙ্ক রাখা। মশারি টানানোর জন্য দেখি স্ট্যান্ডও আছে! উল্লেখ্য, আজও ইথিওপিয়ায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব প্রচুর। যেকোনো শহরে বা গ্রামে এখনো ম্যালেরিয়া একটি আতঙ্কের নাম।
রান্নার জিনিসপত্র সবই মাটির তৈরি। পানি, কফি রাখা হয় আজও মাটির সুরাহিতে। কফির সুরাহির মুখ বন্ধ থাকে। থালাবাসন কিছু রুপা ও কিছু সাধারণ ধাতুর। খাবার রাখার জন্য আলাদা ঢাকনাসহ ধামার মতো দেখতে ঝুড়ি হলো ইথিওপিয়ার বৈশিষ্ট্য। খাবারের পাত্র এর ভেতরে রেখে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়, যাতে মাছি বা অন্যান্য পোকা বসতে না পারে। ইথিওপিয়ায় আর কিছুর অভাব থাকলেও মাছির অভাব নেই।
আরেক রুমে কয়লা দিয়ে চালিত ইস্ত্রি শোকেসে রাখা। রাজাদের নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র দেখে মনে হলো এরা খুবই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। দামি কিছুই দেখলাম না। মূল আফ্রিকা ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলের রাজাদের বিলাসবহুল জীবনযাপন একেবারে রূপকথার গল্পের মতো। এখানে সে চিত্র বিরল। জাদুঘর দেখতে অনেকটা সময় লাগল। বাইরে ইসমাইল আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
ওয়ালড সিটিকে জুগল বলা হয়। তবে এই পুরোনো শহরের অলিগলি দেখে আফ্রিকা বলে বিলক্ষণ মনে হবে না। মনে হবে ইউরোপের কোনো এক মফস্সল শহরে চলে এসেছি। সাদা দেয়াল আর দেয়ালের ওপর ও নিচের অংশে নীল বর্ডার দেয়াল। কোনো কোনো দেয়ালে হারার শহরকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন সব চিত্র আঁকা।
এই গলি যেখানে শেষ হচ্ছে সেখানে সরু পথের এক কোনায় একটি মেয়ে লাল রঙের নানা ঝুড়ি ও ওয়াল হ্যাংগিং নিয়ে বসে ছিল। দূর থেকে মনে হচ্ছিল, সাদার মধ্যে ফুটে আছে লাল দুষ্প্রাপ্য অ্যালামন্ডা ফুল। অবশ্য অ্যালামন্ডা এ দেশে মোটেও দুষ্প্রাপ্য নয়। বরং বনজঙ্গল আলো করে শত শত ফোটে। মেয়েটির কাছে গিয়ে দেখি সে লাল সুতা দিয়ে ধামার ঝুড়ির ওপর চিকন করে কাটা কাপড় বেঁধে বেঁধে রঙিন করে তুলছে। দেখতে খুব আকর্ষণীয় লাগছে। আর ডান দিকে যে পথটি সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে ওপরে উঠে গেছে সে পথকে কিছুতেই আফ্রিকা বলে মনে হচ্ছে না। অনেকখানি গ্রিসের সান্তোরিনির মতো লাগছে। পাহাড়ি এলাকা তাই পথে পথে চড়াই-উতরাই তো থাকবেই। আর এই পথের দুই পাশের স্বভাবতই বাড়িগুলোয় সাদা রং করা তবে বাড়ির মাঝখানের সদর দরজার ওপর কাঠের দোচালা নকশা করা। এই নকশা, এই গলির শোভা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই পথ দিয়ে নারী-পুরুষ নিজেদের মতো হেঁটে যাচ্ছে। এই গলির সব বাড়ির বাইরের দেয়ালে আয়তাকার নকশা আঁকা। আর এর ভেতরে আছে নানা লতাপাতার নকশা।
সেলাই মেশিন হলো হারার শহরের অনেকগুলো প্রতীকের মধ্যে একটি। গলির বাড়িগুলোর মাঝে দু-একটা দোকান দেখা যায়। বেশির ভাগই ছিট কাপড়ের দোকান। পাশাপাশি সারি সারি ছিট কাপড় সাজানো আছে দোকানে। পছন্দমতো কাপড় নিয়ে দোকানের সামনে সেলাই মেশিন নিয়ে বসে থাকা দরজি সাহেবকে বললেই তিনি সেলাই করে দেবেন ম্যাক্সি বা পুরুষদের থোয়াব।
পরের গলি আরও সুন্দর রূপ ধারণ করে আছে। গলির মধ্যে ইথিওপিয়ার প্রতীকস্বরূপ কফি রাখার লম্বা সুরাহি আর ছোট ছোট কাপ সাজানো আছে। অবশ্য গলির মাঝখানে খাঁ খাঁ রোদে এসবই সিমেন্টের তৈরি। প্রতিটি গলিতেই এমন কিছু না কিছু প্রতীক রাখা আছে। কোথাও সেলাই মেশিন, কোথাও ধামার মতো ঢাকনা দেওয়া ঝুড়ি ইত্যাদি। আর প্রতিটি গলির দেয়ালে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে তথ্য দেওয়া আছে। কোথাও সুলতানদের বংশতালিকা, কোথাও হারারের পুরোনো সিল, কোথাও নারী-পুরুষের পোশাক আঁকা, কোথাও গয়না।
একটা গলিতে কলকল করে কয়েকজন ফেরেশতা দেখি উড়ে যাচ্ছে। সবে তাদের স্কুল ছুটি হয়েছে। স্কুল শেষে তারাও বাড়ি ফিরছে। কেউ কেউ আবার অপার বিস্ময়ে আমাকে দেখছে। ট্যুরিস্ট আসে না তেমন আগের মতো হারারে। আর আমাকে কিছুতেই আফ্রিকান বলে মনে হচ্ছে না। তাই দেখার বস্তু তো বটেই। আমার সঙ্গে সঙ্গে ইসমাইল হাঁটছে। বলতে না পারলেও মোবাইলে লিখে লিখে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
এই পুরোনো শহর বা জুগোলে নাকি ৮২টি মসজিদ আছে। জেনে একটুও আশ্চর্য হইনি। কারণ, কয়েকটা গলি পার হলেই একটা মসজিদ চোখে পড়ছে। অন্যান্য বাড়ি থেকে মসজিদকে আলাদা করার উপায় হলো এর দরজার রং। মসজিদের দরজার রং সবুজ। প্রতিটিই ক্ষুদ্রাকৃতির মসজিদ। জোহরের আজান পড়বে বলে মনে হলো এমন সময় আমি একটা মসজিদে ঢুকে গেলাম। খুব সাধারণ মসজিদের ভেতরের অংশ। ছোট ও সাধারণ মিহরাব। মসজিদের কোথাও কোনো চাকচিক্য নেই। মসজিদের খাদিম দাঁড়িয়ে ছিল। যদিও এই মসজিদে নারীদের নামাজের জন্য আলাদা জায়গা নেই। তবু অতি ভদ্রলোক খাদিম আমাকে তাড়িয়ে দেননি। বরং কথা বলতে চাইছিলেন। কিন্তু তিনি ইংরেজি জানেন না এবং আমি হারারি ভাষা জানি না। আমাদের মধ্যে ইসমাইল মনুষ্য ভাষায় কথা বলতে অপারগ। তাই আর কথা এগোয় না।
ইসমাইল আমাকে নিয়ে জুগলের মূল গেট দেখাতে নিয়ে এল। জুগলের গেট মোট পাঁচটি। মূল গেট উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে এটি কাবা শরিফের আদলে গড়া। রং অবশ্য সাদা। জুগলের মূল গেটের সামনে এবং ভেতরে প্রচুর মানুষ দেখলাম। এটি জুগলের মূল বাজার। কাঁচাবাজার, মুদিদোকান ইত্যাদি পথের দুই পাশে পশরা সাজিয়ে বসেছে। বাজার তো বসেছে ঠিকই, তবে কোথাও কোনো চিৎকার–চেঁচামেচি নেই। কোথাও ময়লা–আবর্জনা নেই। কোথাও হইচই নেই। যেন সবাই গাইড ইসমাইলকে অনুসরণ করছে, একটুও আওয়াজ না করে নিজের কাজ করে যাচ্ছে। আসলে আফ্রিকা মহাদেশের যত দেশে বেড়িয়েছি, কোথাও চিৎকার–চেঁচামেচি শুনিনি। সবাই ধীরস্থির, পরিচ্ছন্ন। এ ব্যাপারটা আসলেই প্রশংসনীয়।
জুগল গেট আর বাজার দেখে আমি চললাম জুগলের মূল জুমা মসজিদ দেখতে। দোতলা জুমা মসজিদটি হালকা বাদামি রঙের। পেছনে ছোট একটা মিনার দেখা যাচ্ছে। বাইরের দেয়ালও হালকা বাদামি রঙের, তবে এর ওপর টারকয়েজ রঙের রেখা টানা। জোহরের আজান পড়ে গেছে আর ভেতরে মুসল্লিরা নামাজ পড়ছেন। নামাজ পড়তে আসা একটি ছেলের সঙ্গে কথা হলো। ছেলেটির নাম আবদেল, সে ইংরেজি জানে। তার ধারণা মসজিদটি প্রথম ইসলাম প্রচারের সময়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এবং সে তার জন্য গর্বিত। আবদেল সবে হাইস্কুল পাস করেছে। অদূর ভবিষ্যতে কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছে আছে, কারণ অন্যান্য অনেকের মতো তার পরিবারেরও তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর মতো টাকা নেই।
নামাজ শেষ হতেই আবদেল আমাকে ধরে ইমাম সাহেবের কাছে নিয়ে গেল। আমি সংকোচ বোধ করছিলাম। কারণ, আমাদের দেশে উন্মুক্ত শিরে কেউ মসজিদে প্রবেশ করতে পারে না। এখানে দেখি সবাই খুব স্বাভাবিক আচরণ করছে। ইমাম সাহেব ইংরেজি জানেন না কিন্তু তাতে খুব একটা অসুবিধা হলো না। তিনি আরবি ভাষা জানেন এবং আমার টুটাফাটা আরবি দিয়েই আলাপ চালালাম। ইমাম সাহেবের নাম আহমেদ। তিনি কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে এ মসজিদে ইমাম হিসেবে নিয়োজিত আছেন। তাঁর সরলতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। মসজিদের ভেতরটা সাধারণ মসজিদের মতোই। মেঝেতে লাল কার্পেট বিছানো। মুসল্লিরা নামাজ সেরে চলে যাচ্ছেন, আমি ইমাম সাহেবের সুমধুর কণ্ঠের আরবিতে বাতচিত শুনছি। আর চারপাশে বয়ে যাচ্ছে শান্তির হাওয়া।