প্রায় ৯-১০ ফুট উঁচু বেজায় বৃহৎ একটি রকের ফাটল থেকে গজিয়েছে, চিরল চিরল পাতায় সমাচ্ছন্ন একটি বৃক্ষ। গাছটির দুদিকে প্রসারিত হয়েছে সরল-সোজা দুটি ডাল। তাতে রোদ পড়ে তৈরি হয়েছে খ্রিষ্টধর্মের প্রতীক ক্রুশের আকৃতি। গোসলখানার তালাশে ফার্মহাউসের দিকে যাওয়ার মেঠোপথের নির্দেশনা দিতে গিয়ে এল-নোরা ঠিক এই গাছেরই উল্লেখ করেছিল। এ মুহূর্তে আমার প্রয়োজন, ওয়ারি গোত্রের পিরামিড থেকে স্মৃতিপ্রবণ মনকে ইনকা ট্রেইলের বাস্তবতায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা। জোরকদমে হেঁটে আসায় একটু ক্লান্তও লাগছে, তাই বসে পড়ি পা ছড়িয়ে।
বৃক্ষটির প্রজাতি শনাক্ত করতে ব্যর্থ হলেও, তার গোড়ার খোঁড়লে ডিমে তা দেওয়ার ভঙ্গিতে বসে থাকা গোটা ছয়েক বনঘুঘুকে দেখতে পেয়ে ভীষণ অবাক লাগে! গাছটির কাণ্ড থেকে অর্কিডের মতো বেরিয়ে এসেছে কয়েকটি সাদাটে ধূসর কলি। তার গোড়া থেকে পালা করে ফেসো ছিঁড়ে নিচ্ছে, আগ্রাসী গোছের দুটি নাম না জানা পাখি।
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে প্রান্তরের ওপারে ঘন হয়ে ওঠা ঝোপঝাড়ের দিকে নজর দিই। কাঠের বেড়া দেওয়া একটি ফার্মহাউসের আদলও স্পষ্ট ওঠে। ওখান থেকে বেরিয়ে, আস্তেধীরে এদিকে এগিয়ে আসছে ট্রেইলের চেনা মুখ—কারমাইকেল কারামুচি। দূরত্বের জন্য তার চোখমুখের অভিব্যক্তি স্পষ্ট হয় না কিছু, তবে রোদে সুঠাম দীর্ঘ দেহের ছায়া ফেলে পাতা–লতা, পাথর ও পতঙ্গ নিরিখ করে করে, অতি ধীরে হাঁটার ভঙ্গি থেকে ‘ক্রাম’ ডাকনামে পরিচিত কারামুচিকে চিনতে আমার ভুল হয় না।
সোনালি চুল ও বাহারি দাড়িতে তারুণ্যদীপ্ত ক্রাম মজার মজার মেসেজ উৎকীর্ণ টি-শার্ট পরতে ভালোবাসে। দিন তিনেক আগে তাকে দেখি, এল-নোরার হাত ধরে মৃদুস্বরে কিছু বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছে। তখন তার টি–শার্টের পেছনে লেখা ছিল, ‘সরি গার্লস্, আই ডেট ওনলি মডেলস’।
আমাদের দেখতে পেয়ে ক্রাম হাতও নেড়েছিল। তখন খেয়াল করেছিলাম, অত্যন্ত সুদর্শন এই যুবকের পিঠে দুটো ডানা জুড়ে দিলে, তাকে মডেল করে আঁকা যায় দেবদূতের চিত্র। মানুষটি খুব নিচু গলায় মাঝেমধ্যে ব্যাঞ্জো বাজিয়ে কান্ট্রি ওয়েস্টার্ন ধাঁচের গান গেয়ে ক্যাম্পসাইটের কারও কারও মন মাতিয়েছে। ট্র্যাকার নারীদের মধ্যে তার স্তাবকও জুটেছে, তবে সাড়া দানে সে এখন অব্দি বিরত আছে।
ক্রাম আমার কাছাকাছি এগিয়ে এলে আমি উঠে দাঁড়িয়ে তাকে ইশারায় গাছটির ছায়ায় সৃষ্ট ক্রুশচিহ্নটি দেখাই। গোসল সেরে এসেছে, তাই ট্রাউজারের এখানে-ওখানে ফুটে উঠেছে জলের ছোপ ছোপ আর্দ্রতা। আঙুলে স্যাঁতসেঁতে টি–শার্টে ক্রুশের প্রতীক এঁকে সে বলে, দিস শ্যাডো কুড কোয়ালিফাই ফর অ্যান এক্সাম্পল অব আ ট্রেইল ম্যাজিক।
সহমত প্রকাশে আমি মাথা হেলাই, যুবকটি ঠোঁটে–মুখে বশীকরণ হাসি ফুটিয়ে বলে, ‘ওয়াটার ইজ ওয়ার্ম, এনজয় আ ফাইন শাওয়ার।’
চলে যায় সে। গমনপথের দিকে তাকিয়ে দেখি, তার টি–শার্টের পিঠে আজ লেখা, ‘হোয়াট কালার ইজ ইয়োর প্যারাস্যুট?’ এই মেসেজের মর্মার্থ কী হতে পারে, তা ভাবতে ভাবতে ফার্মহাউসের দিকে মেলা দিই। কিন্তু মাথা থেকে ক্রামকে সরাতে পারি না; কারণ তাকে দেখলেই মনে হয় যে চাইলে এই বান্দাকে চরিত্র করে গোয়েন্দা গল্প লেখা যায়।
কুয়াশাচ্ছন্ন এক সকালে ক্রামকে তাঁবুর সামনে কারও মাথার খুলি হাতে বসে থাকতে দেখলে, রহস্য গল্পের ধাঁচে কিছু একটা লেখার প্লট আমার মাথায় আসে; আর আমি যে ধরনের ভ্রমণ রচনা মুসাবিদা করে থাকি, তাতে চরিত্রহীন হওয়ার অবকাশ কম, রসদের তাগিদে সদাসর্বদা আমাকে তালাশ করতে হয় কোনো না কোনো চরিত্রের, তো সে প্রেষণায় জানতে চাই, ‘খুলিটি কার, বলা যায় আমাকে, ক্রাম?’
সম্মোহন ছড়ানো হাসি ফুটিয়ে সে করোটিকে সম্বোধন করে তার ‘সুইটহার্ট’ বা ‘প্রয়াত প্রেমিকা’ বলে। মন্তব্য করি, এ ধরনের বস্তু নিয়ে ট্রেইলে ঘোরাফেরা করাটা রেওয়াজ হিসেবে শুধু অপ্রচলই নয়, অপরাধও বটে।
সহমত পোষণ করে কারামুচি ওরফে ক্রাম বলে, ইয়েস, সত্যিকারের খুলি নিয়ে খোলা আসমানের তলায় হাঁটাহাঁটি করলে, আঙিনায় রঙ্গন ফুটলে যেমন মধু চাখতে হাজির হয় ক্রিমসন সানবার্ড বা সিঁদুরে মৌটুসি পাখি, ঠিক তেমনি পরওয়ানা নিয়ে ছদ্মবেশী গোয়েন্দা এসে উদয় হবে তৎক্ষণাৎ।
কথাবার্তায় জানতে পারি যে প্লাস্টিকের কয়েকটি টুকরাটাকরা জড়ো করে ক্রাম তার তথাকথিত সুইটহার্টের খুলি নির্মাণ করেছে। পেশা হিসেবে বছরজুড়ে প্লাস্টিকের করোটি ও কঙ্কাল তৈরি করে এবং যুক্তরাষ্ট্রে হ্যালোউইন পরবের সময় সেগুলো চড়া মূল্যে বিক্রি করে দিন গুজরান করে সে। প্রসঙ্গত উল্লখ্য যে হ্যালোউইন উদ্যাপনের সময় আঙিনায় মুখ ব্যাদান করা কৃত্রিম কঙ্কাল দাঁড় করিয়ে রাখাটা যুক্তরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক রীতি-রেওয়াজেরই অংশ বিশেষ।
ফার্মহাউসের কাছাকাছি আসতেই প্রান্তরে গা–ঘেঁষাঘেঁষি করে ফুটে ওঠা হলুদ ও নীল রঙের বুনো ফুলের কনট্রাস্ট খুব করে চোখে পড়ে। ফটক খুলে আঙিনায় ঢুকি, কিছু স্থানীয় ফুলের ঝোপঝাড় ছাড়া অন্য কোনো অর্থকরি ফসল চোখে পড়ে না। একদিকে ফার্মের মালিকের ইটে গড়া একটি সাদামাটা ঘর; তার দেয়াল ঘেঁষে লাগানো তিনটি ইয়াকা ফুলের গাছ।
সূর্যপ্রিয় এই তরু লাতিন আমেরিকার একাধিক দেশে বিবেচিত হয় নেটিভ প্ল্যান্ট হিসেবে। সুতরাং ইনকা ট্রেইলের কাছাকাছি ইয়াকাগাছ দেখতে পেয়ে তেমন একটা অবাক হই না, তবে যা আমাকে বিপুলভাবে বিস্মিত করে, তা হচ্ছে তরুটির আচরণ! এই মৌসুমে এতে সাদা রঙের সুদীর্ঘ গর্জিয়াস ডাঁটিওয়ালা সব ফুল ফুটে ওঠার কথা। কিন্তু তা না ফুটিয়ে গাছটি তার পত্রালিতে ঝাঁপির মতো আকৃতি তৈরি করে যেন কিছু একটা থেকে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করছে।
আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সংযুক্ত এই আচরণ নিয়ে আমি দিন কয়েক আগে পেরুর গাছপালা শনাক্তকরণবিষয়ক একটি পুস্তকে পড়েছি। তো ঘটনাটি চাক্ষুষ করে ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে নোটবুকে লিখি, ‘জাস্ট উইটনেসড্ আ প্ল্যান্টস্ ন্যাচারাল ডিবেড়া মেকানিজম’।
ঘরটির সামনের দিকে যেতে পারলে কোথায় কড়িপাতির বিনিময়ে গোসলের বন্দোবস্ত, তা খুঁজে বের করা যায়। তো এদিক-ওদিক তাকিয়ে ডিঙাই দুটি ঝোপ। ‘আর ইউ ইন্টারেস্টেড ইন বাটারফ্লাইজ,’ বলে আড়াল থেকে প্রশ্ন করে কে যেন আমাকে চমকে দেয়!
ঘুরে তাকাই। দেখি, বেঞ্চে বসে ৮-৯ বছর বয়সের একটি মেয়ে। তার পাশে রাখা বাটারফ্লাই নেট। জানতে চাই, ‘আর ইউ ক্যাচিং এনি বাটারফ্লাই?’
বালিকাটি জবাব দেয়, ‘ওয়েল, আই অ্যাম স্টাডিং বাটারফ্লাইজ, আই অ্যাম আ রিসার্চার।’ টুকটাক কথা বলি আমরা।
ফার্মমালিকের কন্যাটির নাম কান্তো কারম্যান। স্কুলে যায় না সে, আর এদিকে স্কুলই বা কোথায়, ঘরে হোম স্কুল পদ্ধতিতে মায়ের কাছে পড়াশুনা করছে। কান্তো আমাকে নিয়ে এসে দাঁড়ায় তার বাটারফ্লাই বার্ন বা প্রজাপতির গোলাঘরের কাছে।
জালি তারে ঘেরা বেশ বিরাট একটি খাঁচার ভেতর ঝোপে–ঝাড়ে উড়ছে বেশ কয়েকটি প্রজাপতি। ধূসর বাদামি মসলিনে বোনা শরীরের বড়সড় একটি মথ উড়ে এসে বসে সবুজ পাতায়। তার পাখায় সাদা ফোঁটার ভেতর কাজল পরানো দুটি চোখের দিকে নির্দেশ করে কান্তো বলে, ‘দিস ওয়ান ইজ মাই ফেভারিট, কল্ড সমারসেট।’
নোটবুকে কিছু একটা টুকে পৃষ্টা উলটিয়ে সমারসেট মথের একাধিক স্কেচ দেখিয়ে অত্যন্ত পরিণত নারীর মতো বলে কান্তো, ‘আমার বাটারফ্লাই বার্নে আছে দুটি সমারসেট মথ। আমি তাদের যোগাযোগ করার ধরন গবেষণা করছি।’
খানিক বিস্ময় নিয়ে বালিকাটিকে আমি অবলোকন করি। কেচোয়া মেয়ের মতো গড়নপিটন হলেও তার গাত্রবর্ণ প্রায় শ্বেতকায়। আর কথাবার্তায় ফুটে উঠছে পাশ্চাত্য নারীর সোজাসাপটা আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি।
ঘাস–পাতা মাড়িয়ে একটি ধেড়ে কচ্ছপকে হাঁটাচলা করতে দেখে আমার আবার অবাক হওয়ার পালা আসে! বলেই ফেলি, ‘দিস ইজ আ বক্স টার্টল, ইনকা ট্রেইলের কাছেপিঠে তো বক্স টার্টেল থাকার কথা নয়।’
দ্রুত উত্তর দেয় কান্তো, ‘ইউ আর রাইট। এটির নাম হচ্ছে জুলিয়েট। এর সাথি রোমিও আশপাশেই আছে। যুক্তরাষ্ট্রে আমার জন্মদিনে গ্র্যান্ডমা আমাকে দুটি বক্স টার্টলের বাচ্চা উপহার দিয়েছিলেন। এরা বড় হয়েছে। নাউ রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট আর ইন লাভ। একদিন এদের সংসারে সন্তানও আসবে।’
কান্তোর কাছে জানতে চাই, ‘গোসলখানা কোন দিকে?’
ফিক করে হেসে সে জবাব দেয়, ‘দিস ইজ আওয়ার প্রাইভেট হোম। এখানে তোমার ঢুকে পড়াটা ঠিক হয়নি। গেট দিয়ে বেরিয়ে ডান দিকে সোজা হেঁটে যাও। দেখতে পাবে মায়ের ব্যাকপ্যাকার্স ফ্যাসিলিটি। মাই মাম লাভস্ মানি। সে পয়সা চাইবে, হ্যাভ আ নাইস শাওয়ার।’
দুটি ঘর ও প্রশস্ত আঙিনা নিয়ে ব্যাকপ্যাকার্স ফ্যাসিলিটিটি খুঁজে পেতে সমস্যা হয় না। একটি ঘরের ছাদে বাসানো বেশ কতগুলো সোলার প্যানেলে ঝলসাচ্ছে অপরাহ্ণের ঝলমলে রোদ। আঙিনায় সাক্ষাৎ পাওয়া যায় কান্তোর জননী ট্রেইসি কারম্যানের। ভীষণ মিষ্টি ছোট্টমোট্ট একটি বিড়াল কাঁধে নিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন বাঁধানো উঠানে। হল কামরায় নিয়ে গিয়ে তিনি দেখিয়ে দেন, কীভাবে সেলফোনে চার্জ দেওয়া যায়।
ওখানে জনা তিনেক পর্যটককে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ঘাঁটতে দেখি। একজন উঠে ফ্রিজ থেকে বের করে নেন কোল্ড ড্রিংকসের শিশি। দেয়ালে সাঁটা হোয়াইট বোর্ডে প্রতিটি পণ্যের দাম ডলার ও ইউরোতে লেখা আছে। বুঝতে পারি, তাঁবু বাসে শরীর টাটিয়ে উঠলে, এই ফ্যাসিলিটিতে দড়ির হ্যামক, শেয়ারে ব্যাঙ্ক বেড বা পুরো একটি কামরা ভাড়া করা যায়। আমি চড়া মূল্যে সৌরবিদ্যুতে চালিত শাওয়ারের বন্দোবস্ত খরিদ করে বেরিয়ে আসি উঠানে।
আমাকে লেমোনেডের একটি গ্লাস অফার করে ট্রেইসি অভয় দেন, শাওয়ারের মূল্যের সঙ্গে প্যাকেজ হিসেবে কোল্ড ড্রিংকস, আইফোনের চার্জ ইত্যাদি ইনক্লুড করা আছে। অতঃপর তিনি জানতে চান, ‘এনিথিং এলস?’
সরাসরি বলেই ফেলি, ‘আই অ্যাম ডিপলি ইন্টারেস্টেড অ্যাবাউট ইয়োর স্টোরি। কীভাবে এখানে আসা হলো, কী সমাচার...! আই অ্যাম ফাইন্ডিং মাইসেল্ফ রিয়েলি ইন্টারেস্টেড অ্যাবাউট ইয়োর লাইফ হিয়ার। অ্যাম আই আস্কিং ঠু মাচ?’
‘নট অ্যাট অল,’ বলে ভরসা দিয়ে ট্রেইসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। তারপর আমার চোখে চোখ রেখে বলেন, ‘নো ওয়ান এভার আস্কড মি, হোয়াই আই অ্যাম হিয়ার।’
আমি নোটবুক দেখিয়ে ইশারায় তথ্য টুকে নেওয়ার অনুমতি চাইলে, ‘ইয়েস, ইউ মে টেক নোট, আই ডোন্ট রিয়েলি কেয়ার,’ বলে ট্রেইসি কেচোয়া গ্রামের প্রান্তে ফার্মহাউস গড়ে তোলার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন।
শাইনিং পাথখ্যাত গুপ্ত গেরিলা দলের সঙ্গে পেরুর সিকিউরিটি ফোর্সের ক্রসফায়ারে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল কেচোয়া গোত্রের কিশোর চিনবো। প্রচুর বাড়িঘর পুড়ে বাস্তুহারা হওয়া শরণার্থীদের সঙ্গে মিলেঝুলে পায়ে হেঁটে, অ্যামাজন রেইনফরেস্টের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা নদীতে জেলেদের নৌকায় চড়ে, মাস ছয়েক পর, আহত চিনবো সীমান্ত অতিক্রম করে হাজির হয়েছিল ভিন্নদেশ ইকুয়েডরে। ওখানে শরণার্থীদের সেবা দেওয়া আমেরিকান মিশনারির নার্সরা চেষ্টা করে আহত চিনবোর চিকিৎসা করতে। কিন্তু দিন দিন ছেলেটির স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকলে, অবশেষে তাকে মেডিকেল ভিসার আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে পাঠাতে সমর্থ হয়।
ছোট্ট একটি দোকানের মালিক ট্রেইসি ওই হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে রোগীদের সেবা করতেন। ওখানেই তাঁর পরিচয় হয় বয়সে ছোট চিনবোর সঙ্গে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায় সে, কিন্তু তার শরীর সেরে উঠতে সময় লাগছিল। আর ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও সে গৃহযুদ্ধ–উপদ্রুত পেরুতে ফিরে যেতে চাইছিল না। তো ট্রেইসি স্পনসর হয়ে চেষ্টা করেন তার অভিবাসনের। বছর তিনেকেও অভিবাসনপ্রক্রিয়া কোনো সন্তোষজনক পরিণতিতে না পৌঁছালে অবশেষে ট্রেইসি তাঁর দোকানে কর্মরত চিনবোর সঙ্গে আবদ্ধ হন বিবাহবন্ধনে।
কান্তোর জন্মের তিন বছর পর, পেরুর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে দোকানটি বিক্রি করে দিয়ে ট্রেইসি-চিনবো দম্পতি চলে আসেন এখানে। কেচোয়ারা ভিন্ন সংস্কৃতির এক শ্বেতাঙ্গ নারীকে বিবাহের অপরাধে চিনবোকে গ্রাম্য সমাজে গ্রহণ করতে আপত্তি জানায়। তবে প্রচুর ব্যয়ে, কাঠখড় পুড়িয়ে ফার্মহাউসটি গড়ে তোলার লিজ নিতে সমর্থ হন ট্রেইসি।
আমার প্রশ্নের জবাবে ট্রেইসি স্বীকার করেন যে পুরাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ইনকা ট্রেইলের আশপাশে গড়ে ওঠা কেচোয়া জনগোষ্ঠী–চালিত ইনফরমাল ক্যাম্পসাইট ও হোম–স্টে কিংবা অন্য ধরনের আবাসিক ফ্যাসিলিটি ইত্যাদি মূলত অবৈধ। কিন্তু লিমাভিত্তিক সরকার তো কেবল স্প্যানিশ সেটলারদের মালিকানাধীন ট্যুর কোম্পানির অনুমোদন দিচ্ছে। আর কেচোয়ারা জীবনধারণের প্রয়োজনে তাদের পোর্টার হয়ে মুটে–মজুরদের মতো মানবেতর জীবন যাপন করছে। এটা নিয়ে মাঝেমধ্যেই কোচোয়ারা মাতে আন্দোলনে। কিছুদিন আগে তারা ধর্মঘট করে ইনকা ট্রেইলে পর্যটন বন্ধ করে দিয়েছিল। আগামী দিনের সরকার হয়তো এসব অবৈধ ইনফরমাল ক্যাম্পসাইট ইত্যাদি মেনে নিতে বাধ্য হবে।
জানতে চাই ট্রেইসির স্বামী চিনবোর কথা। তরুণটি এখনো ভুগছে অল্পবিস্তর স্বাস্থ্য সংকটে। তাকে চিকিৎসার জন্য মাঝেমধ্যে নিয়ে যেতে হয় রাজধানী লিমায়। আর সুস্থ থাকলে সে পর্যটকদের নিয়ে যায় দারুণ সব জায়গায়। চিনবোর ছবি তোলার হাত খুব সুন্দর। এই ফ্যাসিলিটিতে আছে কয়েকটি পোষা আলপাকা। কোনো পযর্টক এদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে চাইলে তার কিছু বাড়তি উপার্জনও হয়।
জানতে চাই, তার সঙ্গে কথা বলতে পারি কি না? কিন্তু চিনবো এখন পাখিপ্রিয় এক ট্র্যাকারকে নিয়ে গেছে। কাছেপিঠে কোথাও একটা পাথুরে জায়গায়। ওখানে নীড় বেঁধে এক জোড়া কনডর বা আনদিজের শুকুন ফুটিয়েছে দুটি ছানা। একটা জায়গা থেকে নীড়টির পরিষ্কার দৃশ্য দেখা যায়।
আমাদের পাখিপ্রেমী বন্ধু উইলিয়ামের কথা ভেবে জানতে চাই, আগামীকাল চিনবো ফ্রি আছে কি না? বাতচিতে মনে হয়, ট্রেইসির সঙ্গে এলিয়াসিনের যোগসূত্র আছে। চিনবোর প্রয়োজন পড়লে আগামীকাল সে যেন তাকে ফোন করে অথবা রেডিওতে মেসেজ পাঠায়, বলে ট্রেইসি আমাকে গোসলখানার পথ দেখিয়ে দেন।
বারান্দালাগোয়া দুটি কামরায় গোসলের জন্য নির্দিষ্ট বাথরুম আছে। আঙিনায় কাঠের বেড়ার ভেতর বসে চুপচাপ জাবর কাটছে হরেক আকারের কয়েকটি আলপাকা। আমাকে দেখতে পেয়ে কালো পশমে ছাওয়া একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় আলপাকা উঠে দাঁড়ায়। তাকে কিছু খাওয়াতে হলে পাঁচ ডলার ব্যয় করে খরিদ করতে হয় খড়বিচালি। জন্তুটি ডাগর চোখে প্রচুর প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অন্য এক পর্যটক এসে তাকে অফার করেন তাজা ঘাস। আমি কড়কড়ে একখানা নোট বাক্সে ফেলে কেবিনেট থেকে তুলে নিই ধবধবে সাদা তোয়ালে।
অনুভব করি, কে যেন আমার দিকে তাকাচ্ছে। খানিক ঘুরে যেতেই মোকাবিলা হয় অজানা এক নারীর নিবিড় দৃষ্টিপাতের সঙ্গে। মেয়েটির ঠোঁটে লেগে আছে রহস্যময় হাসি। দ্রুত ঘাড় ফিরিয়ে সে আরেকটির বেড়ার ভেতর রাখা কয়েকটি গিনিপিগকে কিছু খাওয়াতে শুরু করে। মাত্র গোসল সেরে আসায় তার টাইটসের এখানে–ওখানে লেগে আছে আর্দ্রতার ছোপছাপ। পাঁজরের নকশা আঁকা একটি স্লিভলেস টপ পরাতে নারীটির ঊর্ধ্বাঙ্গে এসেছে কঙ্কালের অনুকৃতি। ঘুরে দাঁড়িয়ে সে হাসিমুখে বলে, ‘ইউ মে ওয়াচ মি, আই অ্যাম আ ফেরার গেম... ।’
পাল্টি দেই, ‘আই অ্যাম ইন্টারেস্টেড টু সে হ্যালো টু ইউ।’
এগিয়ে এসে হাত মিলিয়ে সে বলে, ‘আই অ্যাম স্যান্ডি গ্রিনগ্লাস। ফুড রাইটার, ট্রেইলে কে কী খাচ্ছে, তা নিয়ে লিখব।’
নিজের পরিচয় দিতে চাইলে, সে আমার কাঁধে অপ্রত্যাশিতভাবে হাত রেখে বলে, ‘আই নো হু ইউ আর, হুম ইউ হ্যাভ টকড্, অ্যান্ড হোয়াট ইউ ডু...। তোমাদের সিনিয়রদের ট্র্যাকিং ট্রুপটিকে আমার ভালো লেগেছে। তোমরা কে কী খাও, এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে, জাস্ট ফাইন্ড মি ইন দ্য ট্রেইল। আমি উড বি হ্যাপি টু ইন্টারভিউ ইউ।’
আমি কোনো প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ পাই না। ‘গুডবাই ফর নাউ’ বলে স্যান্ডেল–উড শ্যাম্পুর ঘ্রাণ ছড়িয়ে হেঁটে যায় স্যান্ডি। আমি তার গ্রীবা ও কোমরে উল্কিতে আঁকা আভানগার্ড ডিজাইনের কথা ভাবি।
চকিতে মনে পড়ে, ঠিক একই ধরনের নকশা, যাতে ড্রাগনের গলায় ঝুলছে শনি গ্রহের বলয়, আমি এল-নোরা ও কারামুচি ক্রামের শরীরে দেখেছি। হয়তো স্যান্ডি এল-নোরার কাছ থেকে আমার সম্পর্কে অবগত হয়েছে। হোক, আপত্তির কিছু দেখি না। তবে ভাবি, কিছুক্ষণ আগে ফার্মহাউসে আসার পথে, মাঠে সাক্ষাৎ হলো করোটি-কঙ্কাল নির্মাতার সঙ্গে। আর এবার নাটকীয়ভাবে মোকাবিলা করলাম পাঁজরওয়ালিকে। এ যাত্রায় আর অধিক কিছু দেখার প্রয়োজন বোধ করি না।
বাথরুমের দিকে যাওয়ার পথে চোখে পড়ে, গিনিপিগদের বেড়ায় আটকানো একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘আমাদের মেয়ে কান্তো কারম্যান নিজের পকেটমানি বাঁচিয়ে এই গিনিপিগগুলো কিনে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে। প্লিজ বি কাইন্ড টু দেম। থ্যাঙ্কস।’
উষ্ণ জলে গোসল সেরে মেইন লবিতে এসে দেখি, আরও দুজন পর্যটকের সঙ্গে বসে স্যান্ডি গ্রিনগ্লাস সেলফোনে ব্রাউজ করছে। আমি ব্ল্যাকবোর্ডে খড়িমাটি দিয়ে লেখা ইন্টারনেট ব্যবহার করা বাবদ ফি ইত্যাদি আগ্রহ নিয়ে পড়ি, তবে সংযত থাকি। কিন্তু গ্লাস-কেবিনেটে চকলেট মাফেন ও ক্যারট কেকের টুকরা দেখতে পেয়ে ভেঙে যায় শৃঙ্খলার বাঁধ। এ ধরনের মিষ্টান্নের প্রতি সহযাত্রী গ্রেইসের অসীম আগ্রহের কথা আমলে এনে ক্রয় করি একটুকরা ক্যারট কেক। তখনই চোখে পড়ে, প্লাস্টিকের দীর্ঘ টিউবে করে বিক্রি হচ্ছে শরীর স্পঞ্জ করার জল। চড়া মূল্যে এটিও খরিদ করা থেকে বিরত থাকতে পারি না।
বাক্সে পানির টিউবটির দাম রাখছি, তখনই পর্দা গলে কামরায় এসে পড়া চড়া রোদের মতো স্যান্ডির দৃষ্টি এসে লাগে চোখেমুখে। এড়িয়ে গিয়ে মুখটি ভিন্ন দিকে ঘোরাই। পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ট্রেইসি দেখিয়ে দেন, কীভাবে জলের টিউবটিকে বেদের গায়ে সাপের মতো শরীরে জড়িয়ে পরা যায়।
ফেরার পথে খোলামেলা মাঠে আসতেই মোকাবিলা করি চরাচর ছেয়ে যাওয়া গোলাপি আলোর। সূর্যের এখনো মনে হয় ফুরসত হয়নি অস্তাচলে যাওয়ার। তার কিরণে দূরের রকি ক্লিফের বেজায় অসমতল পাহাড়-পর্বতে ছড়াচ্ছে জাফরানি আভা আর ভুঁইফোড়ে ঘাসের ডগায় লেপটে আছে অনেকগুলো বর্ণের সমারোহে সৃষ্ট পতঙ্গ। আমার পদাঘাতে তিতিবিরক্ত হয়ে উড়ছে একটি-দুটি; তাদের পাখা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে নীল, সবুজ, লাল ও সোনালি রঙের ঝলক। এগোতে এগোতে ভাবি, তবে কি আমি এ মুহূর্তে অতিক্রম করছি রেইনবো বাগ বা রংধনু রঙের পতঙ্গের হেবিটাট?
এদের বর্ণনা করে আমি লিখতে চেয়েছিলাম একটি কিশোরভোগ্য পুস্তক। কথা ছিল, গ্রেইস বইটির ইলাস্ট্রেশন করে দেবে। কিন্তু সে সংসার ছেড়ে বৌদ্ধ মনেস্ট্রিতে আশ্রয় নিলে এ ধরনের দুনিয়াদারি কিছু করার সুযোগ পাবে কি?
আমার হাঁটাপথে এবার রংধনু রঙের পতঙ্গের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়ছে অনেকগুলো চার-চারটি ডানায় উড্ডীন সম্পূর্ণ নীল রঙের ফড়িং। কোথা থেকে ফ্লাই ক্যাচার গোছের তিনটি পাখি উড়ে এসে ছোবল মেরে মেরে সাবাড় করছে তাদের। প্রকৃতিতে কোনো প্ররোচনা ছাড়া খুনখারাবির ঘটনায় বিষণ্ন হয়ে ওঠে মন।
ভুসুস আওয়াজে চমকে ঘাড় বাঁকিয়ে বাঁ দিকে তাকাই। বেজায় ভুড়োপেট পর্যটকটিকে শনাক্ত করতে কোনো অসুবিধা হয় না। দুই দিন আগে তাকে একটি ক্যাম্পসাইটে তাঁবুর সামনে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতে দেখেছি। মানুষটি খুব নিরিখ করে, দারুণ চিন্তাভাবনার সঙ্গে, মনে হয় দম বন্ধ করে পা ফেলছেন আর কয়েক পা অগ্রসর হওয়ার পর থেমে জল ফুঁড়ে জেগে ওঠা শুশুকের মতো ভুসুস আওয়াজে নিশ্বাস ছেড়ে, কানে গোঁজা টিপ কলমটি হাতে নিয়ে ক্লিপ বোর্ডে গাঁথা কাগজে দাগ দিচ্ছেন।
তার দিকে এগিয়ে গেলে, থতমত খেয়ে অজুহাত দেওয়ার মতো করে বললেন, ‘ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, আই অ্যাম আ ভেরি ফ্যাট ম্যান। চেষ্টা করছি, মাইন্ডফুলি হেঁটে ওজন কয়েক পাউন্ড কমানোর।’
প্রশ্ন না করে পারি না, ‘হোয়াইট ইজ দ্য মোটিভেশন বিহাইন্ড অল দিজ? এহেন পণ্ডশ্রম করছেন কেন, স্যার?’
জানতে পারি, মহাশয় চেষ্টা করছেন, নিত্যদিন মাইন্ডফুলি হাজার পাঁচেক ধাপ হাঁটার। এ প্রক্রিয়ায় ইতিমধ্যে শরীর থেকে আড়াই পাউন্ড খোয়া গেছে। এবার চেষ্টা করছেন, নিশ্বাস বন্ধ রেখে পাঁচ ধাপ সামনে গিয়ে, দম ফেলে, তা টুকে রাখতে। নিষ্পাপ মুখে জানতে চান, ‘আমি সবকিছু টালি করে রাখছি। তুমি কি জানতে চাও, ট্রেইলে মাইন্ডফুলি এ অব্দি সর্বমোট কত ধাপ হেঁটেছি?’
পরিসংখ্যানে আমার আগ্রহ সীমিত, তবে টুকটাক কথাবার্তায় যুক্ত হই। বছর দুয়েক আগে, তার জুটেছিল মিষ্টি গোছের এক গার্লফ্রেন্ড। ওজন–আধিক্যের অভিযোগে ছেড়ে গেছে সে। অন্তত পাউন্ড দশেক কমানোর অঙ্গীকার নিয়ে মহাশয় আপাতত ট্রেইলে পা ফেলেছেন, সফল হতে পারলে হয়তো মেয়েটি ফিরে আসবে। কথা বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘আই ফিল সো হাংগ্রি অল দ্য টাইম’, বলে মোটাসোটা মানুষটি চেবান একটুকরো বিফ জার্কি।
মনে মনে ভাবি, এ ধরনের বাদছাদা সারাক্ষণ চেবালে রোজ কিয়ামত ইস্তক ট্র্যাক করলেও হাসিল হবে না দশ পাউন্ড কমানোর লক্ষ্যমাত্রা। তবে মুখ ফুটে কিছু না বলে বিদায় নিই।
বুনো ফুলের হলদে নীল ডালপালা ধামসে জোরেশোরে হাঁটি ক্যাম্পসাইটের দিকে। দুটো কাঠবিড়ালি কচমচিয়ে খাচ্ছে ফুলের পাপড়ি আর থেকে থেকে থেমে পড়ে যেন ব্যঙ্গবিদ্রুপের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে আমার দিকে। ভাবি, একটু আগে দেখা হওয়া নাম না জানা স্থূলকায় মানুষটি যখন ফিরে যাবেন তার স্বদেশে, আর কাকতালে যদি ফুটপাতে দেখা হয়ে যায় তার এক্স গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে, সে–ও কি এ রকম বিদ্রূপমেশা কৌতূহল নিয়ে অবলোকন করবে তাকে? মঞ্চে যবনিকাপাতের মতো মুছে যায় অবশিষ্ট আলো আর দিগন্তজুড়ে ছুটে বেড়ায়, ট্যানজারিন অরেঞ্জের আশ্চর্য আভায় সূর্যরশ্মির অজস্র গোলাকার বলয়।