আপন গল্পের কথক

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

মেমোরিয়েল স্লোন কেটারিং ক্যানসার সেন্টারে ‘দীর্ঘদেহী সুস্বাস্থ্যের বয়স্ক’ চিকিৎসক স্টিফেন আর ডিচের কাছে চিকিৎসা নিতে গিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। চিকিৎসক তাঁর কাছে জানতে চাইলেন পেশাবদলের বিষয়ে। চিকিৎসক তাঁকে বললেন, ‘ছিলে কেমিস্ট, হয়েছে লেখক।’ উত্তর যেন প্রস্তুতই ছিল রোগী হওয়া এই লেখকের কাছে। বললেন, ‘পৃথিবীতে অনেক কেমিস্ট আছে, সেই তুলনায় লেখক কম বলেই পেশা বদলেছি।’

‌‘বিচিত্রা’র ঈদসংখ্যার জন্য ‘অচিনপুর’ উপন্যাস লিখছেন হুমায়ূন আহমেদ। বাংলাদেশে প্রথম প্রকাশিত হতে যাওয়া ঈদসংখ্যায় উপন্যাস লেখার ‘ফরমাশ’ পেয়েছেন তিনি। মাত্রই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়া এই শিক্ষক উপন্যাস লিখতে ‘অতি জরুরি কারণে’ ছুটির জন্য দরখাস্ত করেছেন। নানা রকম জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়ায় ছুটি নেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। গ্রামীণ পটভূমিতে ‘অচিনপুর’ উপন্যাস লিখবেন বলে চিন্তা করেছিলেন, সেটাও তিনি মাথা থেকে দূর করে দিলেন। লিখবেন শহরকেন্দ্রিক উপন্যাস। মা-বাবা ও দুই বোনের মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প। উপন্যাসটি লিখতে শুরু করেছিলেন গ্রামীণ পটভূমিতে। কিন্তু লিখতে থাকা এই উপন্যাসের চরিত্রদের ঢাকা শহরে আনতে পারছিলেন না লেখক। এমন অবস্থায় সেদিনই তাঁর প্রথম মনে হয়েছিল, ‘লেখালেখির পুরোটা লেখকের হাতে থাকে না। তার পেছনে অন্য কেউ থাকে, মূল সুতা যার হাতে।’

‘নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’ ও ‘বলপয়েন্ট’ বইতে লেখক ও লেখা হয়ে ওঠার এমন আপন উপলব্ধির কথা লিখেছেন তিনি। অন্য সবার মতোই স্মৃতি তাঁর কাছে মহামূল্যবান। স্মৃতি নিয়ে কোনো গর্ব ছিল না তাঁর। তবে স্মৃতিনির্ভর ছিলেন তিনি। কল্পনানির্ভরও ছিলেন নির্ভয়ে। স্মৃতি আর কল্পনা মিলিয়ে তাঁর সৃষ্টি। এটা বোঝা যায় তাঁর লেখায়—এক বাক্য থেকে আরেক বাক্যে। তবে স্মৃতিই তাঁর লেখার প্রাণভোমরা। স্মৃতি নিয়েই একটা জীবনকে সম্পূর্ণ করে তুলেছেন। হয়তো স্মৃতি ছাড়া তাঁর লেখকজীবনে আর কিছুই নেই।

চরিত্র সম্পর্কে যতটুকু না বললেই নয়, তিনি ততটুকুই লিখেছেন। হয়তো পাঠককে তিনি বাড়তি কিছু জানাতে চাননি। অথবা পাঠকের পক্ষে বাড়তি কিছু জানার প্রয়োজনও ছিল না। আসলে পাঠককে তিনি অপেক্ষায় রাখতে চাননি, নিতে চাননি ধৈর্যের পরীক্ষা। পাঠককে হয়তো নিজের মতো করে ভাবার সুযোগ দিয়েছেন, মুক্তি দিয়েছেন লেখকের ভাবনাকে গ্রহণের বাধ্যবাধকতা থেকে।

‘মিসির আলী’ কিংবা ‘হিমু’ চরিত্রের স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদ ছোট ছোট বাক্যে চরিত্রের সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এক উপন্যাস্যের সূত্র আরেক উপন্যাসে লিখেছেন। ফিরিয়ে আনছেন স্মৃতিকে আপন নিয়মে। যে বাক্য না লিখলেই নয়—এর সঙ্গে জগৎ, চরিত্র, চরিত্রের চারপাশ, যাপিত সাদাসিধে জীবন ও ভাষার নির্যাসই তাঁর গল্প লেখার কৌশল। চরিত্র সম্পর্কে যতটুকু না বললেই নয়, তিনি ততটুকুই লিখেছেন। হয়তো পাঠককে তিনি বাড়তি কিছু জানাতে চাননি। অথবা পাঠকের পক্ষে বাড়তি কিছু জানার প্রয়োজনও ছিল না। আসলে পাঠককে তিনি অপেক্ষায় রাখতে চাননি, নিতে চাননি ধৈর্যের পরীক্ষা। পাঠককে হয়তো নিজের মতো করে ভাবার সুযোগ দিয়েছেন, মুক্তি দিয়েছেন লেখকের ভাবনাকে গ্রহণের বাধ্যবাধকতা থেকে। 

নিজের নিঃসঙ্গতা সম্পর্কে লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি যে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ ছিলেন, এমনটা তিনি মনেও করেন। দাবিও করেছেন একই রকম। অথচ আড্ডা-আলাপ আর ব্যক্তি মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক-সম্মান-বোঝাপড়া নিয়ে লিখেছেন অনেক। নিজের জীবনযাপনে জমে থাকা এমন ঘটনার কথাও লিখেছেন খুব স্বাভাবিকভাবেই। সমাজ-রাষ্ট্র-দেশ আর মানুষকে কেন্দ্রে রেখে, মানুষকেই ঘিরে হুমায়ূন আহমেদ চিন্তা করেছেন নিশ্চিন্তে, অকপটে। এক প্রসঙ্গের অবতারণা করতে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গে গিয়েছেন অবলীলায়।

আরও পড়ুন

‘হোটেল গ্রেভার ইন’-এ লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পিএইডি ডিগ্রি অর্জনের কাল নিয়ে। দেশ ছেড়ে দীর্ঘদিনের জন্য বাইরে থাকতে উৎসাহী ছিলেন না তিনি। বর্ষাকালে বৃষ্টির শব্দ না শুনতে পারার দুঃখ, ব্যাঙের ডাক না শুনতে পারার পীড়ায় আক্রান্ত ছিলেন। দেশের সঙ্গে তাঁর বিচ্যুতির বোঝাপড়া করেছেন বিদেশের মাটিতে আরেক বাংলাদেশ খুঁজে। 

স্বাধীন বাংলাদেশে আত্মপ্রকাশ করা এই লেখকের কাছে দেশকে ভালোবাসার স্বাধীনতাই ছিল প্রথম বিষয়। এটাই তাঁর সৃজনশীল জীবনের ভিত্তি। তাঁর লেখকজীবনের প্রতিটি পর্বে এ কথা আছে নানাভাবে। শিক্ষকজীবন থেকে লেখকজীবনে এই বাংলাদেশই আছে। ‘বাংলাদেশ নাইট’ লিখতে গিয়ে তিনি নিজে কীভাবে এই দেশকে দেখেন, অনুভব করেন—এ কথা হয়তো তিনি লেখেননি। তবে লিখেছেন এমন সব মানুষের কথা, যারা ‘বিদেশের মাটিতে’ বাংলাদেশকে দেখতে চায়, একটা বাংলাদেশের প্রকাশ ঘটাতে চায়। 

হুমায়ূন আহমেদ (জন্ম: ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—মৃত্যু: ১৯ জুলাই ২০১২)
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

‘বাংলাদেশ নাইট’ লেখায় একের পর এক চরিত্র আসছে, একের পর এক গল্প বলছেন হুমায়ূন আহমেদ। এই চরিত্র—এই মানুষের বাংলাদেশ নাইট উদ্‌যাপনের আগে কত আলাপ। নানা সংলাপে আছে এক অনন্য অসাধারণ আবেগ, ‘দেখ শালা বাংলাদেশ কী জিনিস। শালা দেখে যা।’ বিদেশ-বিভূঁইয়ে দেশাত্মবোধক গান শুনে লেখক লিখলেন, ‘দেশের জন্য আমার বুক হু হু করতে লাগল। চোখে জল এসে গেল। কেউ যে তা দেখতে না পায় সে জন্যে মাথা নিচু করে বসে রইলাম।’

এমন সব ‘সাধারণ’ কথাই লিখেছেন কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ। গভীর ভালোবাসার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন। রবীন্দ্রনাথের পঙ্‌ক্তি-বাক্য আর সৃষ্টিতে ভর করে ছড়িয়েছেন তাঁর লেখার ডালপালা। পাতাগুলো সজীবভাবে আপন শক্তিতে বড় হয়েছে তাতে। এ লেখায় আরও কত কিছুই তো যুক্ত হয়েছে। তিনি সেই লেখক, যাঁর লেখা পড়তে পড়তে আরও অনেক কিছু জানার জগৎ প্রসারিত হয়। নানা বিদ্যার সংস্পর্শে পাঠকের ভাবনাজগৎ যেন জড়িয়ে যায় জানা-অজানা কিছুর সঙ্গে। অলস মন, থেমে থাকা জীবন যেন চলতে শুরু করে। ধর্ম থেকে বিজ্ঞান, বিশ্বাস থেকে অবিশ্বাস, লৌকিকতা থেকে অলৌকিকতা, ইহজীবন থেকে পরজীবন, জীবন থেকে কল্পনা—এসবই সাধারণ কিছুর মতো লেখা, এসব কথা মনের অন্দরে পৌঁছে যায়। সাধারণ আর সহজ কিছুই থেকে যে জানার ইচ্ছার জন্ম হয়। পরকে আপন করে নেওয়া যায়। এ কথা খুব ভালো করে জানতেন হুমায়ূন আহমেদ।

ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তাঁর ছিল দ্বিধা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চিন্তায় আক্রান্তও ছিলেন তিনি। তাঁর দ্বিধার কথা লিখেছেন কোনো সংকোচ না করেই। নৈতিকতার নিক্তিতে এগুলো মেপে দেখারও চেষ্টা করেছেন চিন্তার জগতে, লেখার জগতে। এই দ্বিধার মীমাংসাও করেছেন হয়তো। পাঠক হয়তো এসব জানেন, নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেবেন। আবার সঠিক সময়ে দায়িত্ব পালনে ছিলেন সদাসজাগ। এমনই জীবন ছিল তাঁর। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটর ছিলেন তিনি। টিয়া পাখির রাজ্যে থাকতেন। হলের পাশে থাকা বিশাল দিঘিতে মেয়েদের সাঁতার কাটা শিখিয়েছেন। শুনেছেন মিছিলে দেওয়া স্লোগান—‘হুমায়ূন আহমেদের চামড়া তুলে নেব আমরা’। এরপর শুনেছেন তাঁর তিন মেয়ে ও তাঁদের এক বান্ধবীর কণ্ঠে পাল্টা স্লোগান— ‘হুমায়ূন আহমেদের চামড়া লাগিয়ে দেব আমরা’। দুঃখের স্মৃতিও আছে তাঁর এই শহীদুল্লাহ হলে। একদিন রাত আটটায় হলের গেটের সব বাতি নিভিয়ে দেওয়ার পর শুনতে পেলেন ভয়াবহ আর্তচিৎকার, ‘স্যার, আমাকে মেরে ফেলছে। আমাকে বাঁচান।’

বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলেন, তিনজন মিলে একটা ছেলেকে গেটের সামনে চেপে ধরেছে। চেপে ধরা ছেলেটিকে কেউ একজন শরীরে ছুরি ঢুকিয়ে দেওয়ায় ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে। লুঙ্গি পরে খালি গায়ে হুমায়ূন আহমেদ দৌড়ে গেলেন সেখানে। কেউ সেদিন তাঁর সঙ্গে আসেনি। রক্তে তাঁর সারা শরীর ভিজে গেল। জীবনে প্রথমবারের মতো রক্তস্নাত হলেন তিনি। হাসপাতালে নিয়ে গেলেন আহত হওয়া যুবককে। জেনেছিলেন, এই যুবক ভয়ংকর এক সন্ত্রাসী। 

মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি দিন থেকে শুরু করে কত ঘটনার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ এ জীবনকে সহচর করে নিয়েছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে এসব কথা লেখেননি কোথাও। স্মৃতিকে সম্বল করে লিখেছেন আত্মজৈবনিক কথা। ‘আমার ছেলেবেলা’ দিয়ে এর শুরু। দিনগুলো যেতে যেতে বদলেছেও তাঁর লেখা, লেখার কাঠামো আর গল্প বলার ভঙ্গি। গল্পে গল্পে মুক্ত গদ্যের ধরনে লিখেছেন এসব। শুধু শব্দকে অবলম্বন করে জীবনের গল্প লিখেছেন, ঘটনার সঙ্গে ঘটনা জোড়া লেগেছে নিমিষেই লেখকের অজান্তে।

গল্প-স্মৃতি আর জীবনের আলাদা করে কোনো সীমানা রাখেননি তিনি। এমন কোনো দেয়াল না তুলে আসা-যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করেননি। সমাজের ইতিহাস, মানুষের ইতিহাসই লিখেছেন তিনি। এক চরিত্রের কিংবা অনেক মানুষের—গল্পে নেই কোনো বিরতি। গল্প-স্মৃতি-চলচ্চিত্রে—যখন যেভাবে ভেবেছেন, সুযোগ পেয়েছেন—ফিরেছেন মানুষের কাছে; আপন জীবনের কথাও তাঁর লেখা উপন্যাস-গল্প-আত্মজৈবনিক গদ্য কিংবা গানে এসেছে অবধারিতভাবে। এসব লিখতে লিখতে নিয়ন্ত্রণ করেছেন বাক্যকে। যদিও বাক্যের সঙ্গে বাক্য জুড়ে লিখেছেন আবেগকে আশ্রয় দেওয়ার আখ্যা। সহজেই গল্পের সঙ্গে পাঠকের সংযোগ ঘটিয়ে দিতে চেয়েছেন। বাংলার লোকগান থেকে মহাজগৎ—সবকিছু নিয়েই যে তিনি। 

তাহলে হুমায়ূন আহমেদ কোথায় আছেন, আর কোথায় নেই? তাঁর সৃষ্টিতেই তিনি আছেন। তবে এ নিয়ে নিজেই একটি বিভ্রান্তি তৈরি করেছেন। লিখেছেন, ‘বিরাট একটা বৃত্ত এঁকে নিয়ে,/ বৃত্তকেন্দ্রে আমি নাকি বসে থাকি।’ একই লেখায় আবার লিখছেন, ‘বৃত্তকেন্দ্রে কেউ নেই কেউ নেই,/ আমি বাস করি বৃত্তের বাইরেই।’ 

হুমায়ূন আহমেদ সবখানেই আছেন নিজের গল্প বলে, নিজের গল্পেই। লিখতে চাওয়া গল্পে, লিখতে না যাওয়া গল্পে, হারিয়ে না যাওয়া গল্পে, মৃত্যু না হওয়া গল্পেও তিনি আছেন। এই গল্প অচেনা মানুষের, যাকে সবাই চিনতে চায়। কিছু বিষয় না জানা থাকুক, অচেনা থাকুক—হুমায়ূন আহমেদ নিশ্চয়ই এমনটাই চেয়েছেন। চাইলে কি সব পাওয়া যায়? সব ইচ্ছা পূরণ হয়? তবু হুমায়ূন আহমেদ নিজের গল্পই লিখেছেন।