ইলিয়াসের শার্টের কোনা ধরে হাঁটা

‘আমার সাহিত্যাদর্শ আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্যাদর্শ এক নয়। তাতে আখরতারুজ্জামান ইলিয়াসের রসাস্বাদনে আমার অসুবিধা হয়নি। যেমন আবু সয়ীদ আইয়ুব বলেন, “আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ” বইয়ে যে, অবিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের কবিতা আস্বাদনে তাঁর কোনো অসুবিধা হয় না। আখরতারুজ্জামান ইলিয়াসের জন্মমাসে তাঁকে নিয়ে আনিসুল হকের ভিন্ন রকম অবলোকন।

নাসির আলী মামুনের তোলা আখরতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছবি অবলম্বনে

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পেছনে পেছনে আমি হেঁটেছিলাম একদিন। এটা রূপকধর্মী কথা নয়। সত্যিই হেঁটেছিলাম। তখন আমার বয়স ছিল তিরিশের কম। তিনি এসেছিলেন বইমেলায়। আমি ‘ভোরের কাগজ’-এর জন্য ‘বইমেলা প্রতিদিন’ শিরোনামে লেখা লিখতাম। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এসেছেন। আমি তাঁর পেছনে পেছনে হাঁটছি। ছোটরা যেমন করে বড়দের পেছনে হাঁটে, অনেকটা সেই রকম করেই। প্রায় তাঁর শার্টের কোনা ধরে। আর তাঁকে সাংবাদিকসুলভ প্রশ্নও করেছিলাম। তিনি হেসে প্রশ্নগুলো এড়িয়ে গিয়েছিলেন। আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে তাঁর পিছু পিছু হেঁটেছিলাম। আমার খুশি খুশি লাগছিল। কিন্তু, ধূসর হয়ে আসা স্মৃতির ডিস্কে সার্চ দিয়েও মনে করতে পারছি না, তিনি কি আমাকে উদ্ধৃতিযোগ্য কিছু আদৌ বলেছিলেন, নাকি পুরোটাই এড়িয়ে গিয়েছিলেন?

তাঁর গল্পের বই থেকে গল্পগুলো পড়তাম। ‘জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল’, ‘দোজখের ওম’, ‘খোঁয়ারি’, ‘দুধভাতে উৎপাত’। আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করত তাঁর সেন্স অব হিউমার। আর এখনো আমি মনে করি, বাংলা কথাসাহিত্যে বাস্তবানুগ সংলাপ রচনায় তিনি মাস্টার, অদ্বিতীয়, অনুপম। ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ বেরোল কলকাতা থেকে, কিনে পড়েছি, সাহিত্যবিচারের কিংবা পাঠের ওই পদ্ধতিটিকে সম্মান করি। দেবেশ রায় অবশ্য এই ক্ষেত্রে আরও বিস্তারিতভাবে এবং বেশি পরিমাণে কাজ করেছেন। তারপর তো মওলা ব্রাদার্স থেকে বের হলো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রচনাসমগ্র।

বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় সাহিত্য করব, আর এসব বই সংগ্রহে রাখব না, তা তো হয় না।
কথাসাহিত্য বিচারের ওই পদ্ধতিটাকে সমীহ করি, পাঠ করি, দেবেশ রায়ের ‘সময় ও সমকাল’, ‘উপন্যাসচিন্তা’, ‘উপন্যাস নিয়ে’ আমার ভালোভাবেই পড়া। আমার নিজের প্রবন্ধ আছে, ‘উপন্যাস নিয়ে উপক্রমণিকা’, ‘লেখা নিয়ে লেখা’ নামের আমার প্রবন্ধের বইয়ে যা স্থান পেয়েছে, পড়ে দেবেশ রায় আমাকে ই-মেইল করেছিলেন। এরপর তিনি ঢাকা এলে আমাকে ডেকে নিতেন, আমি কলকাতা গেলেও আমাকে কাছে টেনে নিতেন, স্বউদ্যোগে আমার উপন্যাসের সমালোচনা লিখে ঠাঁই দিয়েছেন নিজের বইয়ে। কিন্তু তাঁদের সব মতের সঙ্গে আমি একমত নই। উপন্যাস পুঁজিবাদের উন্মেষকালে সৃষ্টি—এর কারণ মানুষ ব্যক্তি হয়ে উঠেছে ওই সময়, এই মতে আমার সন্দেহ আছে। ব্যক্তি চিরকালই ব্যক্তি ছিল। উপন্যাস পুঁজিবাদের উন্মেষকালে হয়েছে, কারণ প্রযুক্তি। ছাপাখানা। ছাপাখানা হওয়ার আগে মানুষ কাহিনিকাব্য লিখত, যা মনে রাখা সহজ, এবং গান করে গাওয়া যায়। নইলে হোমারেরও বেদনা ছিল, ব্যক্তিতা ছিল। সফোক্লিসেরও ছিল।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রসঙ্গে আসি। সেই যে বললাম, তাঁর পেছনে পেছনে হেঁটেছিলাম, সেটার কোনো রূপকমূল্য নেই। আমার সাহিত্যাদর্শ আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্যাদর্শ এক নয়। তাতে আখরতারুজ্জামান ইলিয়াসের রসাস্বাদনে আমার অসুবিধা হয়নি। যেমন আবু সয়ীদ আইয়ুব বলেন, ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ে যে অবিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের কবিতা আস্বাদনে তাঁর কোনো অসুবিধা হয় না।

কেন বললাম, আমাদের সাহিত্যাদর্শ এক নয়? ধরুন, ইলিয়াস ‘খোয়াবনামা’য় পায়খানা করার বর্ণনা দিয়েছেন, বমির স্বাদের বর্ণনা দিয়েছেন—এমন কোনো অভিনব ব্যাপার নয়, আমরা জানি, শার্ল বোদলেয়ারের (১৮২১ সালে জন্ম) কবিতায় এই রকম জীবনের দগদগে দিকগুলোর বর্ণনা সেই কবেই দেওয়া হয়ে গেছে। বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে:
‘সে-রাতে ছিলাম কদাকার ইহুদিনীর পাশে,
পাশাপাশি দুটো মৃতদেহ যেন এ ওকে টানে;
ব্যর্থ বাসনা; পণ্য দেহের সন্নিধানে
সে-বিষাদময়ী রূপসী আমার স্বপ্নেভাসে।’

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আমাদের জীবনের কথাই তো লিখেছেন। লিখেছেন ব্যক্তিজীবনের কথা। হাড্ডিখিজির কিংবা তমিজের বাপের কথা। নামহীন মানুষগুলো, যারা এই দেশ-রাষ্ট্র-সমাজের এক অন্ধকার কোণে না-মানুষের মতো বসবাস করে, তারা নায়ক হয়ে ওঠে, ইতিহাসের দীর্ঘশ্বাস, কুশীলব, কখনোবা নিয়ন্তাও হয়ে উঠতে দেখি তাদের। সাবল্টার্নদের কথাই তো ইলিয়াস বলেন।

আর এই যে বিমাতার সঙ্গে শোওয়া, এই-বা এমন নতুন কী, আমরা ইদিপাস এষণার কথা তো দুই হাজার বছর ধরেই জানি। আমি বাধ্য না হলে এসব লিখতে যাব না।
যেকোনো বিচারে ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ও ‘খোয়াবনামা’ বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর তালিকায় থাকবে। এরই মধ্যে এই বই দুটো ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পেয়ে গেছে। দুটো বই-ই অনুবাদ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা থেকে বের হবে। ‘খোয়াবনামা’ বিশ্বমানের, হাসান আজিজুল হক বলেছিলেন, ‘গার্সিয়া গাব্রিয়েল মার্কেস, গুন্টার গ্রাস, নগীব মাহফুজের বড় কাজগুলোর মতোই এই বই আন্তর্জাতিক মানের।’ আমি কথাটা সমর্থন করি।

আমি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কাছ থেকে নিশ্চয়ই অনেক কিছু শিখেছি, শিখব। একটা কথা এখানে বলব, তা হলো, শিল্পের মধ্যে সমাহিত হওয়া। সেই যে তিনি আমাকে সাক্ষাৎকার না দিয়ে হেসে হেসে কথা বলে আমাকে খুশি করেছিলেন, তা থেকে আমার প্রাপ্তি হলো: লেখা, পড়া, বোঝা, দেখা, ব্যাখ্যা করা, প্রস্তুত হওয়া—এসবের মধ্যে ডুবে থাকো। নিজের কাজটা করো ধ্যানমগ্ন হয়ে, জগৎসংসার ভুলে গিয়ে। শিল্পীর কাজ হলো শিল্পে সমাহিত হওয়া।

জগৎসংসার ভুলে যাওয়ার কথাটা ভুল বার্তা দিতে পারে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আমাদের জীবনের কথাই তো লিখেছেন। লিখেছেন ব্যক্তিজীবনের কথা। হাড্ডিখিজির কিংবা তমিজের বাপের কথা। নামহীন মানুষগুলো, যারা এই দেশ-রাষ্ট্র-সমাজের এক অন্ধকার কোণে না-মানুষের মতো বসবাস করে, তারা নায়ক হয়ে ওঠে, ইতিহাসের দীর্ঘশ্বাস, কুশীলব, কখনো-বা নিয়ন্তাও হয়ে উঠতে দেখি তাদের। সাবল্টার্নদের কথাই তো ইলিয়াস বলেন।

কবির সুমনের ‘তোমাকে চাই’ গানে একটা লাইন ছিল: ‘শীর্ষেন্দুর কোনো নতুন নভেলে, হঠাৎ পড়তে বসা আবোল তাবোলে... তোমাকে চাই’। সুমন ঢাকার মঞ্চে সেটা গেয়েছিলেন, ‘ইলিয়াসের কোনো নতুন নভেলে...’ এর চেয়ে ভুল আখ্যা ইলিয়াস সম্পর্কে আর কিছুই হতে পারে না।

শীর্ষেন্দুর নতুন নভেলের বিপরীতটাই হলেন ইলিয়াস।
আমি কাউকে ছোট বা বড় করছি না।
শিল্পের মহিমাই তো এটা যে একেকজন একেক জিনিস সৃষ্টি করবেন, তা এত অভিনব যে এই শিল্পী না সৃষ্টি করলে পৃথিবীতে তা আর কেউ করতে পারবে না।
ইলিয়াসের ক্ষেত্রে সেই কথাটাই সবচেয়ে সত্য। তিনি যা লিখেছেন, সেটা তিনি ছাড়া আর কেউ লিখতে পারতেন না, পারবেনও না।

যতই দিন যাচ্ছে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস দেশে ও বিদেশে বাংলা কথাসাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা হিসেবে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছেন।
সাহিত্যের ঈশ্বর ঠিক জিনিসটার কদর ঠিকই করতে জানেন।
অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]