শাহীন যেভাবে আমাদের ধরে ফেলে
কয়েক দিন আগে ফেসবুকে ছড়িয়ে গেল শাহীনের নাম। মুহূর্তেই শাহীন নামের এক চরিত্রকে ‘ভাইরাল’ করে তুললাম আমরা। কিন্তু এই ‘ভাইরাল’ প্রক্রিয়ায় শেষমেশ লাভ হলো কার?
আপনি কি শাহীনকে চেনেন? বাংলাদেশের ফেসবুক ব্যবহারকারী হয়ে থাকলে এর মধ্যেই আপনি ‘শাহীন’ নামটি শুনেছেন।
শাহীন নামের ব্যক্তিটিকে যদিও দেখা যায় না, কিন্তু সবাই তাঁর নাম জানে। কয়েক দিন আগে এই শাহীনকে এক মানবসন্তান ধরে ফেলতে বলা হয়েছিল এবং কীভাবে তাঁকে ধরে ফেলতে বলেছিলেন, সেটা অসামান্য নৈপুণ্যে অভিনয় করে দেখিয়েছিলেন তাঁরই বড় ভাই। আর তাতেই মানুষের মুখে মুখে শাহীনের নাম।
আগেই বলেছি, ডাকাত ধরার সরল বিবরণ ফেসবুকে ‘ভাইরাল’ হয় দিন কয়েক আগে। মুহূর্তেই ফেসবুকের নিউজফিড ছেয়ে যায় শাহীনের ভিডিওতে।
এ ধরনের ভিডিও প্রায়ই ভাইরাল হয়। ফেসবুক বা মেটা-দুনিয়ায় আলাপের ঢেউ ওঠে। খুব দ্রুতই একটা বয়ান তৈরি হয় এবং তা প্রতিষ্ঠা পায়। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা যাঁরা ফেসবুকের বাসিন্দা, তাঁরা প্রতিনিয়ত শাহীনকে কীভাবে ধরে ফেলি, আর এসব বয়ান কার আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা দেয়?
ফেসবুকে যে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে, সেই ‘ভাইরাল’ খবর শেয়ার করার তাড়না কেন অনুভব করেন আপনি? সংখ্যাগরিষ্ঠের মত যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকেই কি হেলে পড়ে আপনার মন ও মত? মত দেওয়ার আগে আপনি কি এটা ভাবেন যে আপনার অবস্থানকে কীভাবে বিবেচনা করা হবে? তাহলে কি মেটা-দুনিয়াই আপনার-আমার শ্রেণি নির্ধারণের নতুন নিয়ামক হয়ে উঠছে? হয়ে উঠছে নতুন ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রকাঠামোর সবচেয়ে কার্যকর মতাদর্শিক যন্ত্র?
ফরাসি মার্ক্সবাদী দার্শনিক লুই আলথুসারের মতে, মতাদর্শ হলো ব্যক্তির অস্তিত্বের প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে তার কাল্পনিক সম্পর্ক। ব্যক্তি মনে করছেন, তিনি স্বাধীন এবং নিজের চিন্তাচেতনার এজেন্সিধারী। ব্যক্তিকে আলথুসার বলছেন ‘সাবজেক্ট’ বা ‘অধীন’। তাঁর ভাষ্যে, প্রত্যেক ব্যক্তি হলো ‘অলওয়েজ-অলরেডি’, বাংলা অনুবাদে যাকে বলা যায়—‘সর্বদা-ইতিমধ্যে’ অধীন। মানে ‘অলওয়েজ-অলরেডি’কে তিনি হাজির করছেন একটি পরিভাষা হিসেবে। মূলত এ পরিভাষা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আলথুসার বোঝাতে চাইছেন, কিছু বুঝে ওঠার আগেই আপনি অধীন হয়ে যাচ্ছেন ক্ষমতাসীন মতাদর্শের। বিষয়টাকে তিনি ব্যাখ্যা করছেন এভাবে: ধরুন, আপনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। এ সময় এক পুলিশ আপনাকে ডেকে উঠল, ‘এই শোনো!’ আপনি দাঁড়ালেন এবং তার কথার জবাব দিলেন। আর এ প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়েই আপনি অধীন হয়ে গেলেন ওই পুলিশের। এই ‘পুলিশ’কেই আলথুসার বলছেন, মতাদর্শ বা বয়ান।
মতাদর্শের মাধ্যমে শোষণযন্ত্র সচল রাখতে আরও কিছু কার্যকর পন্থা ব্যবহারের কথা বলছেন আলথুসার। এগুলোর নাম তিনি দিয়েছেন ‘আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস’, যাকে বাংলায় ‘মতাদর্শিক রাষ্ট্রীয় প্রযুক্তি বা কাঠামো’ বলে ডাকা যেতে পারে। এ প্রযুক্তি বা কাঠামোগুলো সহিংসতা ছাড়াই মানুষকে শোষণ মেনে নিতে শেখায়। সংগত কারণেই এই মতাদর্শিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে আলথুসার ফেলছেন বেশ কিছু সামাজিক প্রতিষ্ঠান-শিক্ষালয়, ধর্মপীঠ, গণমাধ্যম ও পরিবারকেও। এই কাঠামোগুলো ব্যক্তির ক্ষমতাসীন শ্রেণির অধীন হিসেবে গড়ে তোলার কাজ করছে বলে মনে করেন তিনি।
মেটা-দুনিয়া বিশেষ করে ফেসবুককে আপাতদৃষ্টে এক শ্রেণিহীন স্পেস বা স্থান বলে মনে হয়, যেখানে যেকোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ নিজের মত প্রকাশ করতে পারেন। ছাপার অক্ষরের যে বিশেষ ক্ষমতা, স্বল্প সময়ের জন্য হলেও তা অনুভব করতে পারেন। কারণ, ফেসবুক আপনার জন্য বাড়িয়ে দিচ্ছে অগণিত পাঠক। আপনার কথা তাঁরা পড়বেন এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাবেন। একইভাবে আপনিও তাদের কথা পড়বেন এবং মতামত জানাবেন।
কিন্তু আসলেই কি তা–ই? ফেসবুকে যে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে, সেই ‘ভাইরাল’ খবর শেয়ার করার তাড়না কেন অনুভব করেন আপনি? সংখ্যাগরিষ্ঠের মত যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকেই কি হেলে পড়ে আপনার মন ও মত? মত দেওয়ার আগে আপনি কি এটা ভাবেন যে আপনার অবস্থানকে কীভাবে বিবেচনা করা হবে? তাহলে কি মেটা-দুনিয়াই আপনার-আমার শ্রেণি নির্ধারণের নতুন নিয়ামক হয়ে উঠছে? হয়ে উঠছে নতুন ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রকাঠামোর সবচেয়ে কার্যকর মতাদর্শিক যন্ত্র?
একদা আলথুসার যে পুলিশকে মতাদর্শ বা বয়ান বলে মনে করতেন, ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট করে হয়তো সেই পুলিশেরই ডাকের জবাব দিচ্ছেন আপনি। মেটা-দুনিয়ার গ্রাহক ও বাসিন্দা হয়ে নিজের এজেন্সির বেসাতিতে নিজেই অংশ নিচ্ছেন স্বেচ্ছায়।