লেখক-সাহিত্যিকদের দিনলিপি ও স্মৃতিকথায় বিজয়ের মুহূর্ত
স্বাধীনতার জন্য বাঙালি লড়াই দীর্ঘকালের। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালির জীবনে এসেছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। অবিস্মরণীয় সেই বিজয়ের মুহূর্তে কীভাবে উদ্যাপন করেছিল মানুষ? লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের দিনপঞ্জি ও স্মৃতিকথায় ধরা আছে তার চিহ্ন।
এখানে যেসব লেখকের স্মৃতিকথা ও দিনলিপি আলোচিত হয়েছে, এঁদের অধিকাংশই সে সময় ঢাকায় ছিলেন। আর কেউ কেউ শরণার্থী হিসেবে ছিলেন ভারতের কলকাতায়। একজনের অবস্থান ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। তা ছাড়া চট্টগ্রামেও ছিলেন দুজন। ফলে তাঁদের লেখা থেকে এটি স্পষ্ট বোঝা যায়, কোনো কোনো লেখকের ক্ষেত্রে বিজয়ের মুহূর্ত উদ্যাপনে অনুভূতির যে তারতম্য ঘটেছে, তা কেবল ভৌগোলিক দূরত্বের কারণেই। এসব লেখার মধ্য দিয়ে কেবল বিজয়মুহূর্তের আনন্দ নয়, আবেগ-অনুভূতি, রাগ-অনুরাগ ও দুঃখ-বেদনারও সমাবেশ ঘটেছে।
১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ২১ মিনিটে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল নিয়াজি। এরপর লেখকেরা তাঁদের অনুভূতি প্রকাশ করে দিনলিপি ও স্মৃতিকথায় লিখেছেন বর্ণিল ভাষ্য।
চট্টগ্রামে বসে প্রাবন্ধিক আবুল ফজল ১৬ ডিসেম্বর দিনটিতে লিখছেন, ‘যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে বাংলাদেশ রক্ষা পেল, বাঙালি জাতি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে যেন বাঁচল এবার। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব যে সুনিশ্চিত হলো শুধু তা নয়, লক্ষ লক্ষ বাস্তুহারা বাঙালি শরণার্থীরাও এবার নির্ভয়ে ও নিশ্চিন্ত মনে নিজেদের বাস্তুভিটায় আসতে পারবে ফিরে। এ বিজয়ের সবচেয়ে বড় আর সর্বাপেক্ষা ফলপ্রসূ দিক এটিই।... আজ শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করব যাঁরা আমাদের জন্য এ বিজয়ের পথ রচনা করেছেন রক্ত দিয়ে, অশ্রু দিয়ে, পুত্র দিয়ে, স্বামী দিয়ে, পিতা আর ভাইকে বলি দিয়ে, সেসব অখ্যাত আর অজ্ঞাতনামাদের। ইতিহাসে তাঁরা উল্লিখিত হবে না সত্য, কিন্তু কৃতজ্ঞচিত্ত বাঙালি জাতি কখনো ভুলবে না তাদের আত্মোৎসর্গের এ অমর স্মৃতি।’ (দুর্দিনের দিনলিপি, মুক্তধারা, ঢাকা, ১৯৮২)
আর ঢাকাবাসী কবি সুফিয়া কামালের লেখায় পাওয়া যায় সেই দিনের পষ্ট ছবি, ‘আজ ১২টায় বাংলাদেশ যুদ্ধবিরতির পর মুক্তিফৌজ ঢাকার পথে পথে এসে আবার সোচ্চার হলো “জয় বাংলা” উচ্চারণে। আল্লাহর কাছে শোকর। বুক ভেঙে যাচ্ছে। সুখ-দুঃখের অনুভূতি কমে গেছে যেন, তবুও এ কী শিহরণ। আল্লাহ! তোমার দানের অন্ত নেই।... আমার বাবা আমার কাহ্হার আজ বেঁচে নেই। আজ ২৯ দিন হলো, সে শুয়ে আছে মাটির কোলে। আর আজ কী শোকাবহ ঘটনা। জয় মিছিল দেখতে গিয়ে হাতেম আলীর শালীর মেয়ে জলির বড়বোন ডলি ১৮ নং রাস্তায় গিয়ে মিলিটারির উন্মত্ততার দরুন গুলিতে মারা গেল। আহা! মা বেঁচে আছে যে। এ যে কী করুণ দৃশ্য।’ (একাত্তরের ডায়েরি, জাগৃতি, ঢাকা, ১৯৯৫)
কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান সেদিন ভোরে সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে কলকাতা থেকে যশোর যাত্রা করেছিলেন। তাঁর ১৬ ডিসেম্বর দিনপঞ্জির পাতায় লেখা, ‘দোদুল্যমানতার মধ্যে চিন্তামগ্ন হঠাৎ বাসেই জানা গেল, নিয়াজি সব শর্ত মেনে নিয়েছে। চোখে পানি এসে গেল। আনন্দের অভিঘাত আমাকে বিষণ্ন করে তুলেছিল। কত প্রাণের বিনিময়, কত বুকফাটা আর্তনাদ, কত শোকের মিছিল নেপথ্যে। তাই নিঃসাড় প্রাণ উল্লাসে লম্ফ দিয়ে ওঠে না, ঝম্প দিয়ে ওঠে না।...বর্বর পাকিস্তানিদের পাশবিকতা ও ধ্বংস করার মনোবৃত্তি-জাত চিহ্নের ত অন্ত নেই।....মানসচক্ষে দেখা যায়, ন’মাসের জিন্দান-খানা থেকে মানুষ কী-ভাবে বেরিয়ে আসছে। স্বোয়াস্তির নিঃশ্বাস শীতের ঠাণ্ডা দিনগুলো ওমমুখর করে তুলছে। স্পর্শ পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল মন।...১৬ ডিসেম্বর বাঙলাদেশের ইতিহাসের নতুন পরিচ্ছেদে প্রথম পৃষ্ঠা।’ (১৯৭১: স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর, বিউটি বুক হাউস, ঢাকা, ১৯৯২)
মুক্তিযুদ্ধে স্বামী আর মুক্তিযোদ্ধা সন্তান রুমীকে হারিয়েছেন জাহানারা ইমাম। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর কেমন ছিল তাঁর অভিব্যক্তি, তা জানা যায় শহীদ জননীর দিনলিপিতে, ‘আজ সকাল ন’টা পর্যন্ত যে আকাশযুদ্ধ বিরতির কথা ছিল, সেটা বিকেলে তিনটে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। দুপুর থেকে সারা শহরে ভীষণ চাঞ্চল্য ও উত্তেজনা। পাক আর্মি নাকি সারেন্ডার করবে বিকেলে। ...মঞ্জুর যাবার সময় পতাকাটা আমাকে দিয়ে গেলেন। বললেন, ‘আজ যদি সারেন্ডার হয়, কাল সকালে এসে পতাকাটা তুলব।’
আবার পরদিন তিনি লিখেছেন, ‘আজ ভোরে বাসায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হলো। ...২৫ মার্চ থেকে ফ্ল্যাগপোলটায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে আবার নামিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম, সেই ফ্ল্যাগপোলটাতেই আজ আবার সেদিনের সেই পতাকাটাই তুললাম। সবাই কাঁদতে পারলাম না। জামীর হাত মুঠিতে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম।’ (একাত্তরের দিনগুলি, সন্ধানী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৭)
কবি শামসুর রাহমান বিজয়ের দিনে ছিলেন পুরান ঢাকায়। তিনি সেদিনের কথা লিখেছেন এভাবে, ‘১৬ ডিসেম্বরের দুপুরে ঢাকার রাজপথে বহুদিন পর শোনা গেল “জয়বাংলা” ধ্বনি। আমার কণ্ঠেও কি তখন ধ্বনিত হয় “জয়বাংলা”? মনে পড়ে না। তবে জয়বাংলা ধ্বনি সর্বক্ষণই বাজত হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে। ...আনন্দে আমার চোখ ছলছলিয়ে উঠেছিল...।’
পরে সন্ধ্যায় বেরিয়ে কবি শুনেছিলেন বুদ্ধিজীবী-নিধনের কথা। বড় বেদনার্ত হয়ে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘বেঁচে থাকলে তাঁরাও বিজয়ের মুহূর্তে আনন্দের উচ্ছ্বসিত তরঙ্গে তরঙ্গে আন্দোলিত হতে পারতেন। ফ্যাসিবাদী ঘাতকেরা তাঁদের সেই অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত করেছে। কান্নায় ভেঙে পড়লাম, নিজেকে দেখতে পেলাম অবিন্যস্ত বিছানায়, “কী হয়েছে”, আম্মা জিজ্ঞেস করেন আমাকে। কী জবাব দেব আমি? সেই মুহূর্তে আমি বাক্শক্তিরহিত। আমার চোখে পানি, বুকের ভেতর হাহাকার।’ (‘দীর্ঘ কৃষ্ণপক্ষের পর অনুপম সূর্যোদয়’, বিজয়ের মুহূর্ত ১৯৭১, সম্পাদক: মতিউর রহমান, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৯)
বিজয়ের সেই অমলিন সময়ে দেশে ছিলেন না সন্জীদা খাতুন। শান্তিনিকেতনে কাটাচ্ছিলেন শরণার্থী-জীবন। তাঁর বিজয়দিনের অনুভূতি, ‘প্রতীক্ষায় অধীর হয়ে আছি। বাইরে কাজে গেলে তড়িঘড়ি ফিরে আসি খবর শুনব বলে। তারপরে এল ১৬। দুপুরের রান্না করছি তখন। হঠাৎ রেডিওর খবর শুনে ঘরে কে চিৎকার করে উঠল, “বিজয় হয়ে গেছে! নিয়াজি সারেন্ডার করবে!” আমি ঘুরে তাকিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলাম। কেন? পরে ভেবে দেখেছি, প্রত্যাশিত মুহূর্ত উপস্থিত হতেই শরণার্থী-জীবনের যত দুঃখ অপমান মা-বাবা, ভাই-বোন সব ছেড়ে দূর অজ্ঞাতবাস পরিস্থিতির অনিশ্চয়তার দরুন সার্বক্ষণিক অসহায়তাবোধ সবকিছু জট পাকিয়ে গিয়ে ওই দুর্বার কান্না ফেটে পড়েছিল।’ (‘আমি হু হু করে কেঁদে উঠলাম’, বিজয়ের মুহূর্ত ১৯৭১)
১৯৭১-এর ডিসেম্বর মাসে রাজনীতিক ও লেখক আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। নিজের অভিব্যক্তি তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন নিজের স্মৃতিকথায়, ‘দুপুর রাতের একটু পরেই মোয়াজ্জেম এবং নিশাতের টেলিফোনে পেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত সুখবর। বাংলাদেশে পাকিস্তানিরা ষোল ডিসেম্বর অপরাহ্ণে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমাণ্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করবে। বাংলাদেশে সুদীর্ঘ কালরাত্রির অবসান হবে। ...এই মুহূর্তের জন্য বাঙালির নয় মাসের এত কষ্ট, এত বঞ্চনা, এত মৃত্যু ও এত ত্যাগ। এতদিনের ক্ষোভ ও বেদনার পরিসমাপ্তি হলো মুক্তির তৃপ্তিতে। শেষ মুহূর্তের উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা ছাপিয়ে এল বিজয়ের আনন্দ। ...অনেক দিন পরে নিরুদ্বেগে এবং তৃপ্তির সাথে ঘুমের আশ্রয় নিলাম।’ (স্মৃতি অম্লান ১৯৭১, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৬)
একাত্তরে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন থাকতেন সায়েন্স ল্যাবরেটরির কলোনিতে। ১৬ ডিসেম্বর তিনি শুনতে পান শত্রুর গোলার আঘাতে খালাতো ভাই কর্নেল তাহেরের বাঁ পা উড়ে গেছে। তখনো তাহের নিজের দিকে খেয়াল করেননি। পায়ের নিচের অংশ চামড়ার সঙ্গে ঝুলছিল, কিন্তু তাঁর চেহারায় যন্ত্রণার চিহ্নটুকু ছিল না। সেলিনা হোসেন হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন এ ঘটনার বর্ণনাকারীর দিকে। সেই বেদনার কথা উল্লেখ করে তিনি লিখছেন, ‘এখন বেদনা অন্যরকম। এ বেদনার ক্ষত আরও মর্মন্তুদ। কবে শুকোবে কে জানে!’ (‘কষ্ট ও বেদনার ক্ষত’, বিজয়ের মুহূর্ত ১৯৭১)
বিজয়ের ক্ষণে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উপস্থিত না থাকতে পারায় আফসোস ঝরে পড়েছে গবেষক গোলাম মুরশিদের লেখায়, ‘সেই মুহূর্তে সবার মুখেই ছিল সরল হাসি। ন মাসের দুঃখ, উদ্বেগ, আশঙ্কা, ক্ষোভ সমস্তই মুহূর্তে ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পলাতক থেকে ব্যক্তিগতভাবে আমি অনেক কিছুই হারিয়েছিলাম। সবচেয়ে যা হারিয়েছিলাম, তা রেসকোর্স ময়দানে এই অভূতপূর্ব দৃশ্য। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধে পলাতকের সেটা আশা করাও অন্যায়।’ (যখন পলাতক: মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯৩)
মুনতাসীর মামুন একাত্তরে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ১৬ ডিসেম্বরে তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দর আবাসিক এলাকায়। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের কারণে বন্দরের চারপাশের পরিস্থিতি ছিল অবরুদ্ধ। তাই এই ইতিহাসবিদের তাঁর বিজয়ের ক্ষণের স্মৃতিচারণায় স্বভাবতই ঝরে পড়েছে আবেগ, ‘১৬ ডিসেম্বর প্রায় সন্ধ্যায় জানতে পারলাম পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। স্বাধীন এই বোধটি তখনো নির্বস্তুক ঠেকে আমাদের কাছে। আরও সংবাদের আশায় বসে থাকি। ঘর ছেড়ে বেরোই না, কোথায় যাব? নির্দিষ্ট ঠিকানায় তো নেই কেউ।...ঘর ছেড়ে
সবাই বেরিয়ে আসেন। ‘আজ আমরা স্বাধীন’ কে যেন বলে ওঠে। জাহাঙ্গীর চৌধুরীর সঙ্গে বেরিয়ে আসি রাস্তায়। শূন্যে কারা যেন গুলি ছুড়ছে। ...দূর থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসে“জয়বাংলা”। ...বহুদিন পর চোখ ভরে ওঠে পানিতে।’ (‘স্বাধীনতার আনন্দে নয় মাস ভেসে যায়’, বিজয়ের মুহূর্ত ১৯৭১)
লেখকদের দিনলিপি ও স্মৃতিভাষ্যে দেখা যায়, বিজয়ের মুহূর্তে প্রায় সবার চোখেই ছিল অশ্রু, যে অশ্রু আনন্দ-বেদনায় অম্লমধুর এবং স্বাধীনতা পাওয়ার উচ্ছ্বাসে টলমল ।