ঐতিহ্যের উজ্জ্বল কান্ডারি

বাংলাদেশের লোকায়ত সংস্কৃতির অন্দরমহলে বিরাজ করছেন অজস্র সাধক কবি, শিল্পী, পুঁথিকার, পালাকার, সুরকার, বাদ্যকর, নাট্যকার। যাঁরা আপন চিত্তের মাধুরী মিশিয়ে প্রজ্ঞার আলোয় সৃষ্টিশীল আনন্দে তৃপ্ত করে চলেছেন বৃহত্তর গ্রামের মানুষের মনোবৃত্তি ও বৃদ্ধিবৃত্তিক হৃদয়। তাঁরা আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে অপার মহিমায় আলোকিত ও সমৃদ্ধ করে চলেছেন পরম্পরাগত ঐতিহ্যের ভান্ডার। কিন্তু সেই ভান্ডারিদের কথা খুব কমই দৃশ্যমান দেখা যায়। দেশের প্রধান প্রধান প্রচারমাধ্যম বা তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চলমান পৃষ্ঠে তাঁদের স্থান সংকুলান হয় খুবই কম। আসলে আমাদের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার সাধক শিল্পীদের জীবনব্যাপী নিবেদন প্রচারপিয়াসী মিডিয়োকারদের প্রচারণার নিচে চাপা পড়ে থাকে। এতে পরম্পরাগত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারদের কোনো খেদ নেই, দুঃখ নেই; বরং তাঁরা এই উপেক্ষার মধ্যে আরও অধিক সাধনার সুযোগ পেয়ে ঐতিহ্যের আলোকবর্তিকাকে কালের গ্রাস থেকে রক্ষা করে মহাকালের দিকে এগিয়ে দিতে থাকেন। এভাবেই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার চর্যাপদের কবি লুইপা, কাহ্নপা, ভুসুকপা, বিরূপা কিংবা পরবর্তীকালের মহাসাধক লালন, হাসন, মনমোহনের পরম্পরায় বিজয় সরকার, মোসলেম উদ্দিন বয়াতি, খোদাবক্স সাঁই, আবদুল গফুর হালী প্রমুখ, তাঁদের গীতবাণীর ভাষ্যে লোকায়ত জীবনের বহুমাত্রিক সংস্কৃতি সাধনা ও দর্শনের মর্মকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে অমর হয়েছেন। জীবদ্দশায় তাঁরা যতটা না অভিনন্দিত হয়েছেন, অমরত্বের আস্বাদ নিয়ে তার অধিক উজ্জ্বল হয়েছেন, হচ্ছেন। 

এবার সময় হলো আমাদের সময়ের উজ্জ্বলতম ঐতিহ্যচারী জীবন্ত কিংবদন্তিদের নিয়ে কিছু কথা লেখার। কারণ, ঐতিহ্য প্রবাহিত হয় অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে মেলবন্ধনকে স্বীকার করে। এই কাজটি গোপনে ও প্রকাশ্যে নিরন্তর করে চলেন ঐতিহ্যের বর্তমানকালের কান্ডারিরাই। 

সাইদুর রহমান বয়াতি

সাইদুর রহমান বয়াতি

বাংলাদেশের এ সময়ের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির কান্ডারিদের মধ্যে অগ্রগণ্য এক বহুমাত্রিক সাধক হিসেবে সাইদুর রহমান বয়াতির নাম উচ্চারণ করা যায়। কেননা তিনি একাধারে সাধক কবি, পালাকার, পরিবেশনশিল্পী ও পরিবেশনশিল্পের পরিচালক; অন্যদিকে তিনি একজন উজ্জ্বলতম সুফি সাধক; এমনকি ঐতিহ্যগত তন্ত্রমন্ত্রের সাধক ও লোকায়ত চিকিৎসক হিসেবেও তাঁর রয়েছে বিশেষ পরিচিতি।

সাইদুর রহমান বয়াতি মানিকগঞ্জ জেলার পুটাইল ইউনিয়নের পশ্চিম হাসলী গ্রামে ২৫ মে ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তিনি মানিকগঞ্জের ভাষাশহীদ রফিক স্মরণে গান রচনা করেন। দারিদ্র্যের কশাঘাতে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ সম্পন্ন করতে সক্ষম হননি। কিন্তু বাল্যকাল থেকে সংস্কৃতিচারী এই সাধক কবি ঐতিহ্যগত ধারায় প্রায় ৬০ প্রকারের সংগীত-বাণী রচনা, সুরকরণ ও পরিবেশন করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি জারি, সারি, মর্সিয়া, কীর্তন, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, ধুয়া, মালসি, তর্জা প্রভৃতি ঐতিহ্যগত সংগীতরীতিতে সহস্রাধিক গান রচনা করেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগ্রাম, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও বিবিধ সংকটে মানুষকে সাহস জোগাতে, উদ্বুদ্ধকরণে সংগীতের সমান্তরালে পুঁথিকাব্য রচনা ও পরিবেশন করে আসছেন। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, করোনা মহামারির কাল নিয়ে তাঁর রচিত গান ও পুঁথিকাব্য মানুষকে সাহস জুগিয়েছে।

সাইদুর রহমান বয়াতির সংগীত রচনা ও পরিবেশনের দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন বাংলাদেশের কবি জসীমউদ্​দীন, যুক্তরাষ্ট্রের ফোকলোরবিদ হেনরি গ্লাসি প্রমুখ। হেনরি গ্লাসি বিরচিত আর্ট অ্যান্ড লাইফ ইন বাংলাদেশ এবং ট্র্যাডিশনাল আর্ট অব ঢাকা শীর্ষক দুটি গ্রন্থে সাইদুর রহমান বয়াতির ছবিসহ পরিচিতি লভ্য। সংগীত রচনা, সুরসাধনা ও তা আসরে পরিবেশনের পাশাপাশি তিনি ঐতিহ্যগত বাদ্যযন্ত্র দোতারা, সারিন্দা, বেহালা, খঞ্জনি, মন্দিরা-করতাল, একতারা, ঢোল, বায়া, চটি বা প্রেমজুড়ি প্রভৃতি বাদন ও প্রশিক্ষণ প্রদানে দক্ষ।

ঐতিহ্যগত পরিবেশন শিল্পকলার সঙ্গেও সাইদুর রহমান বয়াতি বাল্যকাল থেকে সম্পৃক্ত। মাত্র ১০ বছর বয়সে পারিবারিক সদস্যদের হাত ধরে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন আসমান সিং যাত্রাদলে। যাত্রাদলে নারী চরিত্রে অভিনয় করার জন্য তিনি ‘ছবি রানী’ নাম ধারণ করেছিলেন। শুধু তা–ই নয়, সাজ গ্রহণের সুবিধার জন্য দুই কানের লতিতে ছিদ্র করেছিলেন, যা এখনো দৃশ্যমান। যাত্রাদলে নারীর ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে তিনি নারীদের মতো হাতে রুপার চুড়ি, কানে ঝুমকা ও গলায় মালা পরে কাটিয়েছেন অনেক দিন। নারী চরিত্র হিসেবে তিনি সিরাজ-উদ-দৌলা যাত্রায় লুৎফা, হরিশচন্দ্র যাত্রায় শৈব্যা, হোসেন শহিদ যাত্রায় মায়মুনা, রঘু ডাকাত যাত্রায় মনিকা দেবী প্রভৃতি নারী চরিত্রে রূপদান করেন। এর পাশাপাশি তিনি প্রায় ১০০টি যাত্রাপালায় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন।

এই সাধক সামাজিক জীবনে লোকচিকিৎসক হিসেবেও পরিচিত। এ ক্ষেত্রে তিনি সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনা করেছেন। কেননা সমাজের সাধারণ ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের সুচিকিৎসার জন্য তিনি একদিকে প্রাকৃতিক জ্ঞান তথা প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান গাছগাছড়া, লতাপাতা, শিকড়বাকড়কে ব্যবহার করেছেন। জীবনের একটি পর্যায়ে সাইদুর রহমান বয়াতি খাগড়াছড়ি জেলার একজন সন্ন্যাসী রামানন্দ চাকমার কাছে তন্ত্রমন্ত্রের শিক্ষা গ্রহণ করেন। এখনো তিনি রামানন্দ সন্ন্যাসীর কাছ থেকে প্রাপ্ত তিন শতাধিক মন্ত্র মানবকল্যাণের জন্য স্মৃতিতে ধারণ করে চলেছেন। সাপের কামড় থেকে রক্ষার মন্ত্র, গরু-বাছুরের চিকিৎসার মন্ত্র প্রভৃতি চর্চার মাধ্যমে তিনি নিজের এলাকার জনগোষ্ঠীকে নানাভাবে উপকৃত করেছেন। 

সুফি সাধনায় দীক্ষিত এই সাধকের ঐতিহ্যিক পরম্পরায় জীবনের নানা পর্যায়ে দেহকেন্দ্রিক সাধনা, বিচিত্র সংগীত উপাসনা, লৌকিক ও মারেফতি আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে সামাজিক মানুষের আত্মিক সম্পর্ক উন্নয়ন করে আসছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি একই সঙ্গে ইসলামি শরিয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারেফতপন্থী ধর্মসাধনার সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনের মাধ্যমে অদ্যাবধি সংগীত, নৃত্য, কৃত্য, নাট্য ইত্যাদি চর্চা ও প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তাঁর এই ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সাধনার সঙ্গে হিন্দু, মুসলিম, বৈষ্ণব, বাউল, তান্ত্রিক, যোগাচারীদের নিবিড় মৈত্রী প্রত্যক্ষ করা যায়। অনন্য এই সাধক বাংলাদেশের বিচিত্র ধরনের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির যেমন কান্ডারি, তেমনি এই ভূখণ্ডে আগত, জন্ম নেওয়া এবং চর্চিত বিচিত্র ধরনের ধর্ম, মত, ভাব, দর্শন ও পথের স্বচ্ছ অধিকারী।

ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি সাধনার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পদক এবং কণ্ঠশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন। 

কৃপাসিন্ধু রায় সরকার

কৃপাসিন্ধু রায় সরকার

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের ভারত সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামের একজন জীবন্ত কিংবদন্তি সাধক শিল্পী কৃপাসিন্ধু রায় সরকার। তাঁকে বর্তমানে উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত ঐতিহ্যগত পরিবেশনশিল্প ‘কুশানগান’-এর সর্বশেষ পালাকার, দলপতি ও সাধক শিল্পী বললে অত্যুক্তি হবে না। কেননা একসময় উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম অঞ্চলে কুশানগানের বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন নারায়ণচন্দ্র দাস, হীরালাল গোঁসাই, মেহেন্দ্র গোঁসাই, ভজেন্দ্র গীদাল, যজ্ঞেশ্বর গীদাল, শ্যামল কুশানী প্রমুখ। ওই অঞ্চলে স্বাধীনতা–পূর্ববর্তী সময়ে কিছু মুসলমান শিল্পী-কুশীলব এই ধরনের নাট্য পরিবেশন করতেন এবং স্বাধীনতা–পরবর্তীকালেও তাঁরা কুশানগান পরিবেশনে সক্রিয় ছিলেন বলে জানা যায়। কুড়িগ্রাম অঞ্চলের কুশানগানের বিখ্যাত মুসলমান শিল্পীদের মধ্যে নান্দু গীদাল, মকবুল গীদাল ও বন্দে আলী গীদালের নাম এখনো অনেকের স্মৃতিতে আছে। এ ছাড়া লালমনিরহাট জেলার হোগলাবাড়ির রবীন্দ্র কুশানে বা রবীন্দ্র সাধু, কুরুল গ্রামের অমল গীদাল, হবিগঞ্জ গ্রামের চন্দ্রধর গীদালের নামও অতীত ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। এখন একমাত্র কৃপাসিন্ধু রায় সরকারই কুশানগানের বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হিসেবে সক্রিয় রয়েছেন। কুশানগান পরিবেশন-ঐতিহ্যে নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ দৃষ্ট না হলে হয়তো তাঁর নামটিই শেষ প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশের কুশানগানের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থেকে যাবে। 

এই গুরুত্বপূর্ণ সাধক শিল্পী কৃপাসিন্ধু রায় সরকার কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার রতিগ্রাম-চতুরা গ্রামে ৩১ আগস্ট ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকে ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি সাধনায় আকৃষ্ট হয়ে ভাওয়াইয়া, চটকা থেকে শুরু করে কীর্তন, জারি, পালাগানের ঐতিহ্যিক দীক্ষা গ্রহণ করেন। একান্ত নিজের আগ্রহে একপর্যায়ে কুড়িগ্রামের বিখ্যাত শিল্পী মেহেন্দ্র গোঁসাইয়ের কাছ থেকে বেনা বাজিয়ে কুশানগান পরিবেশনের শিক্ষা গ্রহণ করেন। প্রথম পর্যায়ে গুরুর সঙ্গে কুশানগানের আসরে দোহারি গেয়ে শিল্প-দক্ষতা অর্জন করেন। পরবর্তীকালে গুরুর নির্দেশিত পথ দিয়ে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় ঐতিহ্য রক্ষায় উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। নিজের এলাকার হিন্দু, মুসলিম, বৈষ্ণব ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী গুণী শিল্পীদের সমন্বয়ে কুশানগান পরিবেশনের দল গড়ে তোলেন। কুশানগান পরিবেশনের পূর্বের ঐতিহ্যের সঙ্গে অভিনবত্ব সংযোজন করেন নারী শিল্পীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এভাবেই তিনি দলীয়ভাবে অর্ধশতাধিক বছর ধরে কুশানগান পরিবেশন করে কুড়িগ্রাম জেলায় নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। কেননা তাঁর নেতৃত্বের গুণে বাংলাদেশের কুশানগান ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সার্ক ফোকলোর উৎসবে পরিবেশিত হয়ে প্রভূত প্রশংসা অর্জন করেছে। এ ছাড়া তাঁরই নেতৃত্বে প্রান্তিক পর্যায়ের কুশানগানের ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনা জাতীয় পর্যায়ে যথা বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

কৃপাসিন্ধু রায় সরকার নিজের প্রজ্ঞা ও মেধার সমন্বয়ে বাল্মীকি ও কৃত্তিবাসী রামায়ণের আখ্যান অনুসরণে মৌখিক রীতিতে রামায়ণের আখ্যানকে সাধারণত মোট ১৩টি পালায় বিভক্ত করে কুশানগানের আসরে পরিবেশন করেন। তাঁর রচিত ও পরিবেশিত পালাগুলো হচ্ছে রাম-সীতার জন্ম, রাম-সীতার বিবাহ, রামচন্দ্রের বনবাস ও সীতা হরণ, বালি বধ, সাগর বন্ধন, সীতা হরণ, মহীরাবণ, তরণীসেন বধ, রাবণ বধ, লক্ষ্মণ শক্তিশেল, সীতা উদ্ধার ও অগ্নিপরীক্ষা, অশ্বমেধযজ্ঞ ও সহস্রকাণ্ড রাবণ বধ সপ্তকাণ্ড রামায়ণ পরিবেশনে তাঁর দক্ষতার কোনো তুলনা হয় না। রামায়ণের ঐতিহ্যগত আখ্যান পরিবেশনে সংস্কৃতি শ্লোক থেকে শুরু করে মধ্যযুগের ধ্রুপদি বাংলা ও আধুনিক শুদ্ধ বাংলার পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগে তিনি নিরন্তর অতুলনীয় দক্ষতা প্রদর্শন করে থাকেন। এমনকি রামায়ণের আখ্যান পরিবেশনায় তাঁর স্বকীয় ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ গ্রামের সাধারণ মানুষকে এমন এমন চেতনাবোধে উদ্বুদ্ধ করে যে কখনো দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে অশ্রুধারা বয়ে যায়, কখনো ভক্তিরসে অভিষিক্ত হয়ে দর্শক-শ্রোতারা একে অপরকে চরণ ছুঁয়ে ভক্তি দিতে ভুল করেন না, কখনোবা রামায়ণের শিক্ষা নিয়ে গ্রামের নর-নারী পরস্পরের মধ্যের মান-অভিমান, ভেদাভেদ ভুলে গভীরতর সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার পথ খুঁজে পান। 

কৃপাসিন্ধু রায় সরকার কুশানগান ছাড়াও রামলীলা, পদ্মপুরাণ গান, লীলাকীর্তন, যাত্রা, জারিগান, ভাওয়াইয়া গান প্রভৃতি পরিবেশন করেন। এর বাইরে তিনি লোকশিক্ষামূলক নানা ধরনের সংগীত রচনা, সুর সংযোজনাতেও দক্ষ। সম্প্রতি কৃপাসিন্ধু রায় সরকার প্রাচীন বাংলার চর্যাপদের পুনর্জাগরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে বেশ কয়েকটি চর্যাপদ পরিবেশন করেছেন।

জানা যায়, ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে রংপুর বেতারের একজন পালাকার তিনি মহাভারতের কাহিনি অবলম্বনে দাসী-পুত্র, লোকায়ত জীবনের কাহিনি অবলম্বনে গয়না প্রভৃতি পালা রচনা ও পরিবেশন করেন। তাঁর রচিত এ ধরনের পালার সংখ্যাও কম নয়, তাঁর হিসাবে তিনি অর্ধশতাধিক পালা রচনা করেছেন। উল্লেখ্য, তিনি শুধু নিজেই ঐতিহ্যবাহী শিল্পধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে আনন্দ পাননি, পাশাপাশি নতুন গায়ক-শিল্পী সৃষ্টিতে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। তাঁর পরিবেশিত কুশানগানের ঐতিহ্যিক পরিবেশন–সংস্কৃতি নিয়ে জাতীয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ কিছু গবেষণামূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি তাঁর শিল্পসাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সম্মাননা অর্জন করেছেন।

লাল মাহমুদ

লাল মাহমুদ

বাংলাদেশে মৌখিক রীতিতে তাৎক্ষণিকভাবে পুঁথি রচনা ও পরিবেশনার বহুমাত্রিক ঐতিহ্য দীর্ঘদিন ধরে চর্চিত রয়েছে। কালের প্রবাহে এই সংস্কৃতি এমন বিলুপ্তপ্রায়। এই বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি হলেন কিশোরগঞ্জের স্বল্পমারিয়া গ্রামের লাল মাহমুদ।

পুঁথিকার লাল মাহমুদ ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জুলাই কিশোরগঞ্জ জেলার স্বল্পমারিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বর্তমান আবাসস্থল টিকনির চর গ্রামে। তিনি অর্ধশতাধিক বছর ধরে গ্রামে ও শহরের আসরে মৌখিক রীতিতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বহু ধরনের পুঁথি পরিবেশন করে আসছেন।

সাংগীতিক সুর-সহযোগে ছান্দিক বুননে পুঁথি রচনা ও পরিবেশনের তিনি এমন একজন মৌলিক প্রতিভা, যিনি অতীত ও বর্তমানকালের যেকোনো বিষয় নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মৌখিক রীতিতে পুঁথি রচনা ও পরিবেশন করতে সক্ষম। আমরা দীর্ঘ দুই দশক ধরে বিভিন্ন সময় তাঁর মুখ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে পুঁথি শ্রবণ করেছি। বিশেষভাবে লক্ষ করেছি যে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যগত পুঁথি পাঠকেরা সাধারণত লিখিত বা মুদ্রিত কোনো ভাষ্যের আশ্রয়ে পুঁথি পরিবেশন করে থাকলেও তিনি কখনোই কোনো লিখিত রূপ বা মুদ্রিত ভাষ্য ব্যবহার করেন না। তা করবেনই–বা কেমন করে! কারণ, তাঁর না আছে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, না আছে অক্ষরজ্ঞান। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, যখন তিনি পুঁথি পরিবেশনে উদ্যোগী হন, তখন একেকটি ঘটনার ছান্দিক কাব্যগীত সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তাঁর কণ্ঠে ভর করে, আর তিনি তা খুব স্বাভাবিক আবেগে সুর-ছন্দে গেয়ে গেয়ে আসরে উপস্থাপন করেন। তাঁর মুখে ও কণ্ঠে উচ্চারিত একেকটি পুঁথি তিনি স্মৃতিসত্তায় ধারণ করেন এবং পরবর্তীকালে কেউ তা শুনতে চাইলে তা তিনি আবার উপস্থাপন করতে সক্ষম হন। বিভিন্ন সময়ে তাঁর মুখ থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের মাছ নিয়ে অসাধারণ পুঁথিগীত শুনেছি। এ ছাড়া তাঁর রচিত ও উপস্থাপিত গাছের পুঁথি, ধানের পুঁথিতে আশ্চর্যভাবে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের মধ্যে বর্তমানে সব ধরনের গাছ ও ধানের নামসহ তার বিচিত্র পরিচয় গীতিকাব্যের ছান্দিক ভাষ্যে উপস্থাপিত হতে দেখেছি। শুধু তা–ই নয়, তিনি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসের চরিত্র ও কবি চন্দ্রাবতীর জীবনালেখ্যকে পুঁথিকাব্যের ছান্দিক বুননে উপস্থাপন করে আমাকে চমকে দিয়েছিলেন। এমনকি মহাকবি আলাওলের বিখ্যাত আখ্যানকাব্য সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল–এর কাহিনি, পুঁথিকাব্যের অমর কবি আবদুর রহিমের গাজী কালু-চম্পাবতীর আখ্যানকেও নিজের সৃজনপ্রতিভায় মৌখিকভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করেন। বাংলাদেশের চৌষট্টি জেলার নাম-পরিচয়কেও তিনি মৌখিক রীতিতে পুঁথিতে গ্রন্থন করেছেন।

লাল মাহমুদ সাধারণত এককভাবে পুঁথি উপস্থাপন করে থাকলেও কখনো কখনো দু-একজন দোহারসহযোগে পুঁথি পরিবেশনের মাধ্যমে আসরকে উপভোগ্য ও আকর্ষণীয় করে তোলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি প্রায় পঁচিশ বছর ধরে কিশোরগঞ্জের হাওলা সিংহের চরের বাসিন্দা মোহাম্মদ আবদুস সালামের সঙ্গে জোট বেঁধে পুঁথি পরিবেশন করে থাকেন। পুঁথিগীতের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হিসেবে লাল মাহমুদ নিজের এলাকার গণ্ডি অতিক্রম করে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় পুঁথি পরিবেশনের মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলেছেন।

আমাদের কালের এই তিনজন জীবন্ত কিংবদন্তি সাধক শিল্পীর পাশাপাশি আরও বহু লোকায়ত শিল্পী বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো ভাস্বর রয়েছেন। নিশ্চিতভাবেই তাঁরা তথাকথিত প্রচার-প্রচারণার অন্ধ মোহের বাইরে অবস্থান করেন। আর তাঁরা আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে ঐতিহ্যগত সংগীত-সংস্কৃতির সাধনায় জীবনের আনন্দটুকু নিজেরাই উপলব্ধি করে চলেছেন। আমরা কি পারি না একটুখানি উদার হয়ে তাঁদের ঐতিহ্যচারী সাধনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে!