বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্দরমহল

বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষেরা নৃত্যগীতসহ কৃত্যমূলক নানান পরিবেশনার মধ্য দিয়ে উন্মোচন করে চলেছেন নিজেদের সংস্কৃতির স্বরূপ। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সেই অন্দরমহলটি কেমন, বাংলা নববর্ষের এই লগ্নে জানা যাক সে সম্পর্কে

ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামে পাটবানের কৃত্যাচারের একটি দৃশ্যছবি: লেখক

দুই হাজার বছরের প্রত্নস্মৃতিচিহ্নবাহী এই ভূখণ্ডের নামই বাংলাদেশ। আদিকালের কবি ভুসুকুপা যে ভূখণ্ডের পরিচয় দিতে গিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘বাজ ণাব পাড়ী পঁউআ খালেঁ বাহিউ/ অদঅ বঙ্গালে দেশ লুড়িউ॥’ (চর্যাপদ: ৪৯)—এই উচ্চারণের ভেতর দিয়ে যে ‘অদঅ বঙ্গালে দেশ’ নামটি ধ্বনিত হয়, সে নামের পরপরই জনগোষ্ঠীর পরিচয়টিও চিহ্নিত করতে ভোলেননি প্রাচীন কবি ভুসুকুপা। তাই তো তিনি মল্লারী রাগের সুরের গ্রন্থনায় গেয়েছিলেন, ‘আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী/ নিঅ ঘরিণী চণ্ডালী লেলী॥’ ‘ভুসুকু বঙ্গালী’র এই আত্মপরিচয়ের সকরুণ বেদনার সঙ্গে ‘অদঅ বঙ্গাল’ ভূখণ্ডের ভৌগোলিক পরিচয়ের অনিবার্য অংশ হিসেবে প্রমত্ত পদ্মা নদীর কথাটি ‘পঁউআ খালেঁ’রূপে প্রকাশিত। শুধু তা-ই নয়, এ দেশের সাধন-সংস্কৃতির গুরুবাদী ধারার কথাও প্রাচীনকালের এই গীতি-নৃত্য-নাট্য সংস্কৃতির অমূল্য উপাদান ‘চর্যাপদ’-এর প্রথম পদেই ব্যক্ত হয়েছে, ‘লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জাণ॥’ (চর্যাপদ: ১) কিন্তু এই গুরু কোন গুরু? ‘চর্যাপদ’-এর ১৭ ও ৩৫ সংখ্যক পদে সেই গুরুর সন্ধান রয়েছে, ‘বাজিল’ ও ‘বাজুল’ নামে; আহমদ শরীফ তাঁর বাউলতত্ত্ব বইয়ে স্পষ্ট করেছেন—বাজিল > বাজুল > বাউল। এ ছাড়া নাট্য, নৃত্য, সংগীতপ্রবণ জাতিগোষ্ঠী হিসেবে এই ভূখণ্ডের ঐতিহ্যের ইতিহাস ‘চর্যাপদ’-এ যেমন খুঁজে পাওয়া যায়, তেমনি সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত, শার্ঙ্গদেবের সংগীতরত্নাকর, কহলনের রাজতরঙ্গিণী, লোচন দাসের রাগতরঙ্গিণী প্রভৃতি গ্রন্থে বিভিন্ন ধরনের প্রামাণ্য লভ্য। 

ঢাক ও কাঁসরের বাদ্যধ্বনি তুলে তারা এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে ঢুকতেই বাড়ির নারীরা এসে মাটি লেপে পাটবান মাথায় করে রাখা সন্ন্যাসীর দাঁড়ানোর জায়গা করে দিল।

সংগীত-সংস্কৃতির এমন বিস্তার এতটাই অপ্রতিরোধ্য ও প্রাণের আবেগে প্রবাহিত ছিল যে প্রাচীনকালের ধারাবাহিকতায় এর বিস্তার ঘটেছিল মধ্যযুগে। আসলে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যকর্মের অধিকাংশ পাঠজুড়ে এ ভূখণ্ডের ঋতুবৈচিত্র্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বৈভবকে প্রায় একই ধারাবাহিকতায় প্রত্যক্ষ করা যায়। গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের সংস্কৃতি, সাধনা ও জীবনচর্চায় সেই প্রাচীন মধ্যযুগের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উৎসারণ পরিবর্তিত আকারে প্রবহমান দেখা যায়। তা না হলে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের ঐতিহ্য সমকালীন উপস্থাপনায় পদ্মাপুরাণ, ভাসান, বেহুলার নাচাড়ি, পদ্মার নাচন, ঝাপান প্রভৃতি নামে বিচিত্র কৃত্য ও পরিবেশনশিল্পের আঙ্গিকে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে চলমান থাকত না। এই চলমানতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এ বছরের বাংলা নববর্ষ উদ্​যাপনে। চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসন নববর্ষ আয়োজনে মনসামঙ্গলের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি সর্পকেন্দ্রিক পরিবেশনশিল্প ঝাপানের আয়োজন করে। এতে জীবন্ত সর্পসহযোগে সাপুড়েদের ঝাপান পরিবেশনের নৃত্যগীত ও অঙ্গভঙ্গিতে যেন যুগের পরিক্রমায় পুরাণের নবরূপায়ণ ঘটে। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সর্বত্র বিভিন্ন পৌরাণিক উৎস থেকে নানা কৃত্যাচার গ্রহণ করে বিচিত্র সংগীত-নৃত্য-নাট্যে মত্ত হয়ে ওঠে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু কিছু প্রামাণ্যচিত্র উদ্ভাসিত হলেও মূলধারার প্রচারমাধ্যম কেবল শহরকেন্দ্রিক উৎসব ও উদ্​যাপনকে প্রাধান্য দিয়েছে। এতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হৃদয়ের আবেগ এবং সহস্রাধিক কাল ধরে চর্চিত বৃহত্তর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রবহমানতার চিত্র উপেক্ষিত হয়েছে। তাই বলে ঐতিহ্যগত সংস্কৃতিচর্চার ধারাবাহিতায় তেমন কোনো ছেদ পড়েনি। এই রচনায় তারই কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি।

যেমন সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার ফেনারবাক ইউনিয়নের ছয়হারা গ্রামে চলতি বছরের ১২ এপ্রিল বিকেলে পরিবেশিত হর-গৌরীর যুগল নৃত্যের একটি ভিডিও প্রকাশ করেন সুনামগঞ্জের সন্তান কল্লোল তালুকদার। এই যুগল নৃত্যের অন্তর্বয়ানে সূর্যের প্রতীক পুরুষশক্তি তথা শিব এবং ধরিত্রীর রূপক মাতৃশক্তি তথা গৌরীর মিলনক্রিয়ার বন্দনা প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন রাতে আদিম যুদ্ধবিদ্যাচর্চার রেশ হিসেবে কালিকা নাচের প্রসঙ্গ। 

পাটবান মাথায় নিয়ে গৃহাঙ্গনে এক সন্ন্যাসী

এ ঘটনার বেশ আগে ২০২৪ সালের ২৯ মার্চ চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তির ঘুঘুশাল নিবাসী শিল্পী সমীরণ দত্ত ‘ঢাকীর সাজ’ বা ‘কালীর সাজ’ নামে পৌরাণিক ও লোক চরিত্রদের নৃত্য ও আঙ্গিক অভিনয়ের একটি ভিডিও প্রকাশ করেন। যাতে ঢাক-কাঁসরের যুগলবন্দীর সঙ্গে হর-গৌরীর নৃত্য থেকে শুরু করে হনুমান, বাঘ, অসুর, কালীর নৃত্য ও আঙ্গিক অভিনয় চলে। পুরো নৃত্যাভিনয়ে  মহিষাসুর পালার পৌরাণিক দৃশ্যরূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। জানা যায়, সাধারণত গভীর রাতে হ্যাজাকের আলোয় গ্রামের বাড়ির উঠানে বা বাড়ির সামনের খোলা স্থানে ঘুঘুশাল গ্রামের পার্শ্ববর্তী সাহাপুর গ্রামের শিল্পীরা দলগতভাবে প্রতিবছর এ ধরনের শৈল্পিক-নৈপুণ্য বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে পরিবেশন করে থাকেন। শুধু এক দিন নয়, প্রায় চৈত্র মাসজুড়ে এই পরিবেশন আশপাশের গ্রামকে মুখর করে রাখে।

খুলনার ডুমুরিয়ার ঘোনাবান্দা গ্রামে চৈত্রসংক্রান্তিতে লোকমানুষের নৃত্যগীত পরিবেশনার ভিডিও চিত্র প্রকাশ করেছেন হিরণ্ময় হিমাংসু। এ বছরের ১১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এই নৃত্যগীতে গ্রামীণ মানুষের ঐতিহ্যিক সৃষ্টিশীলতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ সারা রাতব্যাপী উপভোগ করার তথ্য পাওয়া যায়।

চিত্রশিল্পী ও লেখক জাহাঙ্গীর আলম নিজের ফেসবুকে ১২ এপ্রিল ২০২৪-এ সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার ব্রহ্মগাছা গ্রামের সঙ নৃত্যগীতের দুটি ভিডিও প্রকাশ করেন। গ্রামের সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে বিচিত্র সাজে সঙের শিল্পীরা নৃত্যগীতে যেভাবে মেতে উঠেছিলেন, তাতে লোকায়ত মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি ও নানন্দিক শিল্পচেতনার পাশাপাশি হাস্যরস সৃষ্টির সৃষ্টিশীলতা প্রত্যক্ষ করা গেছে। 

অন্যদিকে এ বছরেরই ১৩ এপ্রিল আলোকচিত্রশিল্পী কমল দাস ফেসবুকে চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন তৈলারদ্বীপের ভ্রাম্যমাণ ঢাকিসহ হর-গৌরীর একটি আলোকচিত্র প্রকাশ করেন। আলোকচিত্রে দেখা যায়, সারা গায়ে নীল রং মাখা, ডোরাকাটা বাঘের চামড়ার মতো পোশাক পরা, পাটের আঁশের তৈরি দাড়ি–গোঁফ ও চুলের জটাধারী হর তথা শিবের এক হাতে ত্রিশূল, আরেক হাতে পিতলের ঘটি। তার পাশে সুন্দর রঙিন শাড়ি ও মুকুল পরা সোনার বরন গৌরী তথা পার্বতী। তাদের এক পাশে সোনালি রঙের ধুতি পরনে, সাদা গেঞ্জি গায়ে ও লাল পাগড়ি মাথায় ঢাক বাদনরত ঢাকি, অন্য পাশে প্যান্ট-শার্ট পরা করতালবাদক। প্রান্তরের এক জলমগ্ন ধানখেতের পাশে এমন দৃশ্যটি পৌরাণিককালের সঙ্গে সমকালকে কী আশ্চর্যভাবেই না গেঁথে দেয়! তা না হলে পৌরাণিক চরিত্রের সাজের পাশে কী করে অতি সহজ ও সাধারণ ভঙ্গিতে আধুনিক কালের প্যান্ট-শার্ট করা লোকটা অবলীলায় করতাল বাজিয়ে চলে! 

তা ছাড়া ২০২৪ সালের ১৩ এপ্রিল রাজবাড়ী জেলার কালুখালী উপজেলার মুরারীখোলা গ্রামের বালা সন্ন্যাসী নিতাইচন্দ্র পাড়ইয়ের উত্তরসূরিদের পরিবেশনায় ‘পাট/আসন শুদ্ধি’র কৃত্যমূলক নৃত্যগীতের কিছু ভিডিও চিত্র সে গ্রামের মানুষ কেয়া প্রামাণিকের মাধ্যমে ফেসবুক মেসেঞ্জারে পাই। জানতে পারি, কল্যাণী রানী পাড়ইয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বিমলচন্দ্র পাড়ই, প্রসেনজিৎ পাড়ই এবং তাঁদের সহশিল্পীরা ধূপের ধোঁয়ায় ঢাকের বাদ্যের তালে তালে লাঠি ও পৌরাণিক কালের অস্ত্র হাতে এই নৃত্যগীতে অংশ নিয়ে থাকেন। এই ঐতিহ্যের প্রাচীনত্বকে বংশপরম্পরায় টিকিয়ে রেখেছেন বর্তমান প্রজন্ম। এ ক্ষেত্রে ঐতিহ্য সংরক্ষণে নর-নারীর কোনো লিঙ্গবৈষম্য করা হয় না বলেও জানা যায়।

মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওরের জাবরা গ্রামে ১৩ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে পরিবেশিত রাজবংশীদের চৈত্রসংক্রান্তির গীতিনৃত্যের একটি ভিডিও ফেসবুকে প্রকাশ করেন লেখক শফিক সেলিম। এতে এ দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আদিম সংস্কৃতি প্রেমের চিত্র উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। এই চিত্র শুধু সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে লভ্য নয়, বিভিন্ন সূত্র থেকে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের বিচিত্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীতে বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায় উপলক্ষে বৈচিত্র্যময় কৃত্যাচার ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তথ্য ও চিত্রভাষ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কৃত্য ও ঐতিহ্যের উদ্ভাস সত্যিকার অর্থে অনন্য নানন্দিকতায় পূর্ণ, কিন্তু প্রকৃতির গভীর অন্তর্দেশে বিকশিত সেই ঐতিহ্যের বিস্তার এখনো অনেকটাই অজানা। তাকে জানতে ও বুঝতে গেলে নিজের অন্তর্দেশের অবগুণ্ঠন যেমন খুলে ফেলা প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন প্রকৃতির গভীর নৈকট্যে যাওয়ার সরল ও দুর্মর সাহস। 

বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল প্রচারমাধ্যম, এমনকি এ দেশের অধিকাংশ শহরকেন্দ্রিক সংস্কৃতিকর্মী, সাংস্কৃতিক সংগঠন, লেখক, বুদ্ধিজীবী যেখানে প্রান্তিক পর্যায়ের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির চলমানতা সম্পর্কে ভীষণ উদাসীন, সেখানে আমাদের বিস্ময়ে ফেলে দিলেন পোল্যান্ডের চলচ্চিত্র-পাণ্ডুলিপির অনুবাদক ও লেখক পিটার জেলেনস্কি। ১১ এপ্রিল দুপুরে তিনি উপস্থিত হয়েছিলেন ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার আমাদের বসন্তপুর গ্রামে। কবি ও অনুবাদক অনন্ত উজ্জ্বলের সূত্র ধরে তাঁকে সঙ্গে নিয়েই তিনি জানতে চাইলেন, এ দেশের বাউলসাধনার প্রাচীনত্বের ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসের সঙ্গে ভাব মিলিয়ে তিনি বিহার করলেন এ দেশের যোগসাধকদের তীর্থস্থান। ঝিনাইদহ জেলার পাঞ্জু শাহের পরম ভক্ত আরমান শাহ ওরফে ন্যাংটা শাহের সমাধিক্ষেত্র তমালতলা গ্রামে গিয়ে আদি যোগীদের তন্ত্রবুনন পদ্ধতি দেখে নিলেন। শুধু তা-ই নয়, কুষ্টিয়ার হরিনারায়ণপুর গ্রামের প্রাচীন কৃত্যাচার আগুন খেলা, কাঁটাভাঙা ইত্যাদি সরেজমিনে দেখা ও বোঝার জন্য সারা রাত যে জেগে থাকলেন, এর প্রধান কারণ, বাংলাদেশের প্রান্তিক সংস্কৃতির ওপর পর্যবেক্ষণমূলক একটি বই লিখতে চান তিনি।

এর মধ্যে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুরের লেখক ও ছোটকাগজকর্মী শুভজিৎ দত্তের ফেসবুক পোস্ট থেকে জানতে পারি, আমাদের অদেখা অনন্য এক পরিবেশনরীতি ‘বালাকী নৃত্য’ সম্পর্কে। দেরি না করে সাধিকা সৃজনী তানিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। বসন্তপুর গ্রাম থেকে একটানা প্রায় আড়াই ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে যখন আমরা মহেশপুরে পৌঁছাই, তখন ভরদুপুর। শিবমন্দির, নবনির্মীয়মাণ কাঠের রথ (১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসররা রথটিকে পুড়িয়ে দিয়েছিল, এত বছর পর তা আবার নির্মিত হচ্ছে), শতবর্ষী প্রাচীন বটবৃক্ষ, শ্রীপাট মন্দির, অবহেলিত প্রত্নসম্পদ, পড়ো জমিদারবাড়ি ইত্যাদি দেখতে দেখতে আমরা ছুটে যাই রামচন্দ্রপুর গ্রামে। সে গ্রামের সংগীত, নাট্যরসিক ও সংস্কৃতিমান স্কুলশিক্ষক শ্যামপদ ঘোষের আতিথেয়তা ও সংগীতের মাঝখানে জানতে পারি, রামচন্দ্রপুর আশ্চর্য একটি গ্রাম, যে গ্রামে চারটি মসজিদ ও দুটি মন্দির রয়েছে। সেখানকার মুসলমান-হিন্দু পরস্পর সম্প্রীতির বন্ধনে নিবিড়ভাবে আবদ্ধ। আমাদের কথোপকথনের মধ্যে কানে এল ঢাকের শব্দ। শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতেই একটি বাড়ির উঠানে পাটবানসহ সন্ন্যাসীদের দেখা মিলল। ঢাক ও কাঁসরের বাদ্যধ্বনি তুলে তারা এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে ঢুকতেই বাড়ির নারীরা এসে মাটি লেপে পাটবান মাথায় করে রাখা সন্ন্যাসীর দাঁড়ানোর জায়গা করে দিল। এরপর প্রদীপ জ্বালিয়ে, ধূপের ধোঁয়া ছড়িয়ে, উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনিতে সঙ্গে আসা সব সন্ন্যাসীকে বরণ করে নেওয়া হলো। পরে বরণকারী নারী পাটবানের মাথায় পর্যায়ক্রমে নীলকণ্ঠ ফুল দিয়ে দুধ ঢেলে, সিঁদুরের গুঁড়া ঢেলে ভূমিতে মাথা ঠেকিয়ে পাটবানধারী সন্ন্যাসীকে ভক্তি অর্পণ করেন। শেষ পর্যায়ে একজন সন্ন্যাসী পাটবানের মাথা থেকে সিঁদুরের একটুখানি গুঁড়া নিয়ে ভক্তি প্রদানকারী নারীর কপালে ছুঁয়ে দেন। এরপর পাটবানের সন্ন্যাসীরা ঢাক ও কাঁসার ধ্বনির সঙ্গে অন্য বাড়িতে যেতে উদ্যত হয়। অবশ্য তখন আরেক সন্ন্যাসী ভিক্ষা হিসেবে নারীটির কাছ থেকে এক বাটি চাল ও কাঁচা সবজি গ্রহণ করেন। পাটবানের এই সন্ন্যাসীদের সঙ্গে সেদিন রামচন্দ্রপুর গ্রামের ঘোষপাড়ার বেশ কয়েকটি বাড়িতে এই দৃশ্য দেখে মনের ভেতর থেকে একটি ভাবনা উদিত হয়। তা হলো, ঐতিহ্যিক এই কৃত্যের ধারাবাহিকতা রক্ষার অন্তর্মূলে নিশ্চিতভাবেই রয়েছে গ্রামীণ নারীদের সশ্রদ্ধ প্রণাম ও ভক্তি আরতির নিবেদন। প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে সন্ন্যাসী বেশের তরুণ যে সম্মান ও আরতি লাভ করছেন, সে কারণেই হয়তো নিজের ভেতর থেকে এই কৃত্য রক্ষায় পরম্পরাগতভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভূমিকা রেখে চলেছে। আমরা যদি সর্বান্তঃকরণে ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির প্রতি এই ভক্তির অর্ঘ্য নিবেদন করতে পারি, তবে নিশ্চিত এ দেশের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির পরম্পরাগত অভিযাত্রা কোনো দিন শেষ হবে না।