বাউলগানের মালিকানা

সম্প্রতি ‘মা লো মা’ গানটি কোক স্টুডিও বাংলা থেকে প্রচারিত হওয়ার পর থেকেই এর রচয়িতা নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। তারও আগে লালন সাঁইয়ের ‘কানার হাটবাজার’ গানটি নিয়েও এমন বিতর্ক উঠেছিল। সেসব তর্কের সূত্র ধরে বাউলদের গান এবং গানের মালিকানার তত্ত্বতালাশ।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

কোক স্টুডিও বাংলা মারফত রেকর্ডকৃত ‘মা লো মা’ গানের আসল রচয়িতা কে? খালেক দেওয়ান নাকি রশিদ উদ্দিন? সম্প্রতি এ নিয়ে প্রচুর তর্ক হচ্ছে, সাক্ষীসাবুদ পেশ হচ্ছে, দুই বাউলের নিকটজনেরাও নানাবিধ দাবি করছেন।

রশিদ উদ্দিন আর খালেক দেওয়ানের নামে প্রচলিত গান দুটি হুবহু এক না হলেও পার্থক্য খুব অল্প। সুরেও তেমন ফারাক নেই। অনেকের আলাপে মনে হচ্ছে, বাউল রশিদ উদ্দিন খালেক দেওয়ানের অগ্রজ বলে দাবিটা যেন তাঁর খানিকটা বেশি! আবার বাজারে খালেক দেওয়ানের গানের যে বইটি পাওয়া যায়, তা প্রকাশ পেয়েছে ১৯৯৯ সালে, যেখানে রশিদ উদ্দিনের সংগীত সংগ্রহ বেরিয়েছে ২০১৩ সালে। সেই দিক বিচারে খালেক দেওয়ানের দাবি শক্তপোক্ত।

এসব বইয়ের প্রকাশকালের ওপর ভরসা করা মুশকিল, দুটি বই-ই ‘প্রথম সংস্করণ’ বলে নিজেদের দাবি করছে। কিন্তু বারী সিদ্দিকীর মতো শিল্পী যখন এই গান গাইতে গিয়ে ভণিতায় রশিদ উদ্দিনের নাম উল্লেখ করেন, তখন গানটির ওপর রশিদ উদ্দিনের দাবি আবারও জোর ভিত্তি পায়; কিন্তু সুরাহা হয় না। খালেদ থেকে রশিদ, রশিদ থেকে খালেদ—পেন্ডুলাম দুলতেই থাকে। এ পর্যন্ত কোনো গবেষণাই এককভাবে এই গানের মালিকানা কার, সে তর্কের অবসান ঘটাতে পারেনি।

এই লেখার উদ্দেশ্য কিন্তু এই মালিকানা–বিতর্কের রায় দেওয়া নয়। বর‍ং বিতর্কটাকে ধরে কিছু প্রশ্ন তোলা। যেমন বাউল রশিদ উদ্দিন ও খালেক দেওয়ান দুজনেই অত্যন্ত প্রভাবশালী সংগীতকার। বিপুল তাঁদের ভক্তকুল। সমসাময়িক সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে আমরা এ-ও বুঝতে পারছি যে ‘মা লো মা’ গানটি তাঁদের দুজনের নামেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়েছে এবং রেকর্ডও করা হয়েছে। কিন্তু কোক স্টুডিও বাংলা এই গান পরিবেশন করার আগে এ রকম কোনো তর্ক কোনো তরফেই ওঠেনি। কেন ওঠেনি? তাঁরা দুজনেই একই ‘লিভিং ট্র্যাডিশন’ বা ‘সজীব ঐতিহ্য’-এর অংশ, তাঁদের শ্রোতারাও ‘মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ’ বা ‘পরস্পর-বিচ্ছিন্ন’ নন। কিন্তু এই গানের মালিকানা কার—সে প্রশ্ন অতীতে কেন উঠল না? এবং এখন কেন উঠল?

এই আলাপের মধ্যে আপনাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে, কয়েক বছর আগে ‘সর্বতো মঙ্গল রাধে’ গানটি নিয়েও মালিকানা–বিতর্ক উঠেছিল। মেহের আফরোজ শাওন ও চঞ্চল চৌধুরীকে দিয়ে গানটি করিয়েছিলেন পার্থ বড়ুয়া। নামতালিকায় গানের কথা ও সুর ‘সংগৃহীত’—এমনটাই লেখা ছিল। ইউটিউবে গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলে ‘সরলপুর’ নামে একটি ব্যান্ড দাবি করে, এ গান তাদের লেখা। শুধু লেখা নয়, কপিরাইটও করা। পরে আমরা জানলাম, গানটি রচিত হয়েছে মঙ্গলকাব্যের কবি দ্বিজ কানাইয়ের লেখা থেকে। আবার দ্বিজ কানাইয়ের স্টেশন থেকেই যে গাড়ি সরাসরি সরলপুর এসে থেমেছে, ব্যাপারটা এমনও নয়। মাঝখানে নানান লোকগান, গ্রাম্য ছড়া, চাপানগানে ‘মহুয়া’ পালার এসব মোটিফ নানাভাবে এসেছে। সরলপুর এগুলোকে একটা ন্যারেটিভে গেঁথেছে মাত্র। অবশ্য এটি কপিরাইট দাবি করার মতো বিষয় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। পার্থ বড়ুয়াদের ভার্সন সরলপুরের ভার্সনকে সরলমনে ফোক-ভার্সন হিসেবে ধরে নিয়েছিল। তবে সরলপুর জিনিসটাকে অত সরলভাবে নেয়নি। ফলে পার্থদের বিব্রত হতে হয়।

সরলপুর কপিরাইট করে ফেলায় পরবর্তী শিল্পীরা এই গানের ওপর স্বত্ব হারান। কিন্তু ‘মা লো মা’ গানটি তখন পর্যন্ত কেউ কপিরাইট করেনি। তাই ‘সর্বতো মঙ্গল রাধে’ গানের মতো এটা কোনো আইনি ইস্যু হয়ে ওঠেনি। কিন্তু যেহেতু এই গান কোক স্টুডিও বাংলাতে এসেছে, তার কোকাকোলা-করণ না হওয়ার কারণ নেই। ‘কোকাকোলা-করণ’ বলতে এখানে বোঝাচ্ছি মোটাদাগে গানের পণ্যায়ন। সেটা করতে গেলে বিস্তৃত চরাচরে বহুকাল ধরে ঘুরে ঘুরে বেড়ানো গানের ওপর তো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ‘সিগনেচার’ বসাতে হবে! কারণ, ইউটিউব টাকা দেবে শনাক্তযোগ্য ব্যক্তিকে।

কোক স্টুডিও বাংলা উত্পাদিত গানের বেলায় মালিকানার দাবি কেন উঠল, সেটা নিশ্চয়ই এখন বোধগম্য। যদিও টাকাই একমাত্র প্রণোদনা, এমনটা নয়। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের নাগরিক সমাজে বাউলগানের উত্তরাধিকার নিয়ে নব্য বাউল এবং পুরোনোদের বংশধরেরা ক্রমেই সচেতন হয়ে উঠেছেন। বহু ক্ষেত্রে তাঁরা এখন নাগরিক সমাজের সঙ্গে নানাবিধ বোঝাপড়ার জন্য তাঁদের গানকে ব্যবহার করেন। ক্লোজআপ ওয়ানের এক প্রতিযোগী একবার আক্কাস আলী দেওয়ানের একটি গান পরিবেশন করলেন, শিল্পীর অনুমতিসহ। কিন্তু সম্প্রচারের সময় টেলিভিশনে গানের শেষ চার লাইন কেটে দেওয়া হয়। আক্কাস আলী খান সরাসরি ওই টেলিভিশনকে আইনি হুমকি দিলেন। কারণ, ওই চার পঙ্‌ক্তির মধ্যেই ভণিতা ছিল, যেখানে শিল্পীর নামটি উচ্চারিত হয়েছে।

আরেকটা ঘটনা বলি। শিল্পী মমতাজের ২০০১ সালের তুমুল হিট অ্যালবাম ‘রঙের মানুষ’-এর সব কটি গান শাহ আলম সরকারের লেখা। শাহ আলম সরকার নিজে অ্যালবামটি আগের বছর প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। মমতাজের এই গানগুলো ভালো লাগায় তিনিও এটি করতে চাইলেন। শাহ আলম সরকার সম্মতি দিলেন। একপর্যায়ে মমতাজ জানতে চাইলেন, গানের শেষে ভণিতাটুকু তিনি বদলে দিতে পারবেন কি না? অর্থাৎ গানে যেখানে ‘শাহ আলম বলে’ আছে, সেখানে ‘মমতাজ বলে’ করা যাবে কি না? শাহ আলম সরকার সেই প্রস্তাবে কোনোভাবেই সম্মত হলেন না। ফলে মমতাজকে গাইতে হলো শাহ আলম সরকারের ভণিতাসহই।

এই গল্প আমি শাহ আলম সরকারের মুখেই শুনেছি। জানতে চেয়েছি, কেন তিনি গান বেচলেন, কিন্তু ভণিতাটুকু ‘বিক্রি’ করলেন না? প্রশ্নের উত্তরে তিনি তাঁর মেধাস্বত্বের কথাই বললেন। বললেন, লালন-হাসনসহ সবাই এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। এটা প্রত্যেক বাউলের স্বাক্ষর—নিজ নিজ সৃষ্টির ওপরে।

আমি বিস্মিত। এটা কি ব্যক্তি অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বাক্ষর, প্রাগাধুনিক কাল থেকে চলে আসা বাউলসমাজে? এমনকি যখন তারা কৌম হিসেবে জীবনযাপন করছে? বাউল কসমোলজি তো তেমনটা বলে না। বাউলেরা মনে করেন, দেহের মধ্যেই পরমতত্ত্ব বা ঈশ্বরের বাস। সামাজিক ও ধর্মীয় বিভেদ মানেন না তাঁরা। বাউলদের অনেকেই পরিব্রাজক, দেশে দেশে ঘুরে বেড়ান। এমন একটা মুষ্টিযোগে বেঁচে থাকার জীবনে তাঁদের গানের ওপরে এতখানি স্বত্ব আরোপ করার কথা তাঁরা ভেবেছেন?

যদি না ভাবেন, তবে গানের শেষে নামের ভণিতা কেন? কিসের জন্য? সেটি কিসের দ্যোতক? গানের মালিকানার?

খালেক দেওয়ান ও রশিদ উদ্দিনের বইয়ের পৃষ্ঠা
বাউল–ঐতিহ্যে ব্যক্তি থাকলেও ব্যক্তিমালিকানা বলে কিছু নেই। বাউলগানের ক্ষেত্রে ভণিতা একটা ভঙ্গিমাত্র, মালিকানা ‘নথিবদ্ধ’ করার জায়গা নয়। অন্তত প্রাগাধুনিক চর্চায় তা ছিল না।

এই প্রশ্নের কোনো সরল ঐতিহাসিক উত্তর নেই। কিছু প্রকল্পনা দাঁড় করানো যায় মাত্র। গানের মালিকানা নিয়ে যেসব এঁড়ে তর্ক চলছে নানা দিকে, তাতে মনে হচ্ছে এই প্রকল্পনাটিরও মাঠে থাকা দরকার।

ভণিতা বাংলা গীতিকাব্যে বাউলদের উদ্ভাবন নয়। চণ্ডীদাস থেকে ধরে বহু রচয়িতার মধ্যে এমনটা মেলে। ভণিতা-প্রশ্নে গোটা মধ্যযুগের গীতিকবিতায় চণ্ডীদাস একাই এক প্রহেলিকা। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বাংলার বাউল ও বাউলগান বইতে লিখেছেন, ‘বাংলায় গীতি-কাব্য-রাজ্যে এমন একটা সময় আসিয়াছিল, যখন যে-কোনো কবি রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক পদ রচনা করিয়া চণ্ডীদাসের নামে চালাইয়া দিয়াছেন বলিয়া অনুমান করা যায়।’ এই যে একাধিক পদ-রচয়িতা এক চণ্ডীদাসের ভণিতা ব্যবহার করে গান লিখলেন, তাতে তাদের ব্যক্তিবোধ একটুও আহত হলো না কেন? ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তার কাঠামো থেকে এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া কঠিন।

আরেকটা গানের দৃষ্টান্ত দিই। ‘এসব দেখি কানার হাটবাজার’ গানটি লালনগীতি হিসেবে পরিচিত এবং সংগৃহীত। আবার মনোমোহন দত্তেরও একই গান আছে। দুই গানের মধ্যে অন্তত ৯৫ শতাংশ মিল পাওয়া যায়। সুরেও। এখন এই গানের মালিকানা কার হবে? যেহেতু লালন মনোমোহনের অগ্রজ, তাঁর দাবি বেশি। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে লালনের শক্ত হেজিমনি অপরাপর ফকিরি ও আধ্যাত্মিক গানকে জনমানসে লালনের বলে আত্মীকৃত করে নিচ্ছে! নজরুল লেখেননি, এমন অনেক তিরিশ দশকি গান আজও জনমানসে নজরুলসংগীত বলে পরিচিত। তো, বেনিফিট অব ডাউট কাকে দেবেন?

এটাই মালিকানার সমস্যা। আপনারা বেনিফিট অব ডাউট দেবেন, কপিরাইট দেবেন, স্যাংশন দেবেন—সবই মালিকানা প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে। বাংলার বৃহত্তর বাউলসমাজে ব্যক্তি ও মালিকানা অত বড় সমস্যা আকারে হাজির হয়নি। মধ্যযুগের গীতিকাব্যে ভাবের উপমার দৃশ্যকল্পের ক্লান্তিহীন পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। বাউলধর্মও শাক্ত ও সুফি মতাদর্শের ওপর দাঁড়িয়ে। পুনরাবৃত্তি এড়ানো তার লক্ষ্য নয়। বরং পুনরাবৃত্তি তার একটা কৌশল।

একই গান খুব সামান্য একটু বদলে আরেকজন গাইছেন। ভণিতায় জুড়ে দিচ্ছেন নিজের নাম। ভণিতা জিনিসটাকে মালিকানা বলে মানছি আমরা লিখিত সভ্যতার এই যুগে। মৌখিক ঐতিহ্যে কি এমনটা ছিল? লালনের বহু গান খেয়াল করুন। তিনি ভণিতায় তাঁর গুরু সিরাজ সাঁইকে ডেকে আনছেন, গুরুর সঙ্গে একটা সংলাপিকা হিসেবে গানটাকে পরিবেশন করছেন, নিজেকেও হাজির রাখছেন গানে। আমরা ভণিতাকে যেভাবে দেখছি, তাতে এসব গানকে এখন সিরাজ সাঁইয়ের লেখা বলে মানতে হবে! কিন্তু বাউল–ঐতিহ্যে ব্যক্তি থাকলেও ব্যক্তিমালিকানা বলে কিছু নেই। বাউলগানের ক্ষেত্রে ভণিতা একটা ভঙ্গিমাত্র, মালিকানা ‘নথিবদ্ধ’ করার জায়গা নয়। অন্তত প্রাগাধুনিক চর্চায় তা ছিল না।

একটা অর্গানিক ও জীবন্ত ঐতিহ্যে পুরো কৌমই সময়ের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে। বাউল–ঐতিহ্যেও এটা খুবই সম্ভব। রশিদ উদ্দিন ও খালেক দেওয়ান প্রায় একই সময়ে পৃথিবীতে জীবিত ও কর্মক্ষম ছিলেন। তাঁরা দুজনেই যে এই একই গান গাইছেন, এটা তাঁদের অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু এটা সম্ভবত তাঁদের গুরুতরভাবে ভাবায়নি। ভাবনাটি ঘটেছে পরে, যখন কৌম ছাপিয়ে ব্যক্তি মুখ্য হয়ে গেল, মুষ্টিভিক্ষার জায়গা নিল মনিটাইজেশন, ফোকের জায়গায় এল কোক, কসমোলজি হয়ে গেল ইউটিউব, আর কপিলেফটের ঐতিহ্য এসে মুখ থুবড়ে পড়ল কপিরাইটের ঘরে। ফলে মালিকানার যে লড়াই আমরা কোক-ভার্সনের পরে দেখছি, তা মূলত বংশধরদের লড়াই, কোনোভাবেই রশিদ উদ্দিন আর খালেক দেওয়ানের লড়াই নয়।

তাহলে কি মালিকানাহীনভাবে চলতে থাকবে বাউলগান? সেই উপায় আর নেই। ক্ষমতা, মনিটাইজেশন আর তারকাখ্যাতির এই যুগে বাউলগানের পক্ষে আমাদের শ্বাপদসংকুল মিডিয়ায় মালিকবিহীন থাকা অসম্ভব। অনাদিকাল ধরে যেসব সুর বা কথা স্বত্বাভিমান ছাড়াই চরে বেড়াত এই বাউল থেকে সেই ফকিরের গলায়, বেশ কিছু দিন ধরেই তাঁদের বিভিন্ন স্বত্বাধিকারের খুপরিতে আটকানো হচ্ছে। যাঁর ক্ষমতা আছে, চাতুর্য আছে, সে–ই জিতছে এই আটকানোর খেলায়। রশিদ উদ্দিন বনাম খালেক দেওয়ানের এই মালিকানার লড়াইয়েও হয়তো ভবিষ্যতে কেউ জিতবেন। কিন্তু সেটা বাউলগানের বিজয় নয়, তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের উকিল-সুলভ চাতুর্যের বিজয় বড়জোর।