যেভাবে গড়ে উঠেছিল কাজীদার সেবা প্রকাশনী

রহস্য-রোমাঞ্চের লেখক, ‘মাসুদ রানা’র স্রষ্টা ও সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ষাটের দশকে এ দেশে রহস্য–রোমাঞ্চ সাহিত্যের পথিকৃৎ তিনি, নতুন ধরনের এক প্রকাশনা শুরু হয়েছিল তাঁর হাত দিয়ে। কেমন ছিল সেই প্রকাশনার স্বরূপ?

কাজী আনোয়ার হোসেন (১৯ জুলাই ১৯৩৬—১৯ জানুয়ারি ২০২২) এবং সেবা প্রকাশনীর বইপত্র অবলম্বনেকোলাজ: সৈয়দ লতিফ হোসাইন

ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কাজী আনোয়ার হোসেন যখন প্রথমে ‘কুয়াশা’ ও তারপর ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ লিখতে ও প্রকাশ করতে শুরু করলেন, তখনই কি তিনি বুঝে গিয়েছিলেন যে তাঁকে কিছু স্বতন্ত্র কৌশল নিতে হবে বাজার ধরার জন্য? পেছনে ফিরে দেখলে সেটাই তো মনে হয়।

১৯৬৬ সালের মে মাসে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের প্রথম বই ও বাংলা ভাষার প্রথম স্পাই থ্রিলার ধ্বংস পাহাড় প্রকাশিত হওয়ার পর যে সাড়া পড়েছিল, সেটাই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করল ১০ মাস সময় নিয়ে ভারতনাট্যম (ভরতনাট্যম নয়) লেখার জন্য। এবার নিন্দা ও সমালোচনার পাশাপাশি পাঠকের কাছ থেকে যে সাড়া মিলল, তাতে স্পষ্ট হয়ে গেল যে ‘মাসুদ রানা’ তথা সেবা প্রকাশনীর বইয়ের একটা বাজার তৈরি হতে চলেছে। মার্কেটিং তথা বিপণনশাস্ত্রের ভাষায় বললে, এটা হলো একটা ‘নিশ মার্কেট’ মানে নির্দিষ্ট পণ্য ও সেবার চাহিদা রয়েছে, এমন নির্দিষ্ট ভোক্তাশ্রেণির বাজার। এই বাজার ধরে ব্যবসা বাড়ানোর জন্য সাহসী তরুণ উদ্যোক্তার মতো ঝুঁকি নিতে কোনো দ্বিধা করলেন না কাজীদা।

পাঁচকড়ি দের অনুসরণে দীনেন্দ্রকুমারও বসিয়েছিলেন নিজস্ব ছাপাখানা। মুদ্রক ও প্রকাশক ছিলেন দীনেন্দ্রকুমার রায়ের পুত্র দিব্যেন্দুকুমার রায়। সেবা প্রকাশনীর প্রথম দিকেও প্রকাশক হিসেবে ছাপা হতো সংগীতশিল্পী ফরিদা ইয়াসমীনের নাম, যাঁর সঙ্গে ১৯৬২ সালে কাজী আনোয়ার হোসেনের বিয়ে হয়।

প্রথমেই ঠিক করলেন যে বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে ‘রানা’ ও ‘কুয়াশা’র বই লিখবেন। তাতে দেড়-দুই মাসে একটা বই নামানো যাবে। সময়টা আবার ছিল পুরোপুরি হাতে লেখার, আর সেই হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি সিসার টাইপ দিয়ে হাতে কম্পোজ করে মুদ্রণযন্ত্রে তোলার। এতে কায়িক শ্রম দিতে হতো অনেক বেশি। আবার বই প্রকাশ করলেই তো হবে না, তা কম দামে বিক্রিও করতে হবে যেন বেশি বেশি পাঠক কিনতে পারেন। পাশাপাশি দামও এমনভাবে ধরতে হবে যেন মুনাফাও হয়। হাজার হোক, তিনি তো প্রকাশনার ব্যবসায় নেমেছেন আর এই ব্যবসাকেই জীবিকা করেছেন।

কম দামে বই বিক্রির চিন্তা অবশ্য ‘মাসুদ রানা’ লেখার আগে থেকেই ছিল। তাই তো সেবা প্রকাশনীর প্রথম বই কুয়াশা–১ বের হলো সস্তা নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছেপে ও পেপারব্যাকের প্রচ্ছদে মুড়ে। ‘মাসুদ রানা’র প্রকাশনাও একই পথে গেল। আর এসব বই পাঠক সস্তায় কিনবেন, আনন্দ পাওয়ার জন্য পড়বেন, তারপর একসময় সের দরে বেচে দেবেন, এটাই চিন্তা করেছিলেন কাজীদা। অবশ্য পরবর্তীকালে অনেক পাঠক ও ভক্ত প্রশ্ন রেখেছিলেন যে ভালো কাগজ ও বোর্ড বাঁধাইয়ের দিকে না গিয়ে সেবা প্রকাশনী কেবল নিউজপ্রিন্ট কাগজ ও সস্তা বাঁধাইয়ের নীতি অনুসরণ করল কেন? এর ছোট অথচ চমৎকার উত্তর মেলে কাজীদার লেখা তিনটি উপন্যাসিকা (১৯৭৭) বইয়ের ভূমিকায়। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘...ভালো কাগজে ছেপে ভালো বাঁধাই করে প্রকাশ করলে হয়তো শোভন হতো, কিন্তু বইয়ের যা মূল্য দাঁড়াত, তাতে গগনচুম্বী দ্রব্যমূল্যের চাপে ভারাক্রান্ত বাঙালি পাঠককে আনন্দের পরিবর্তে দুঃখই দেওয়া হতো বলে মনে করি। তাই অপেক্ষাকৃত সস্তা কাগজই বেছে নিলাম। সস্তা কাগজে ছাপা বলেই এসব লেখাকে সস্তা দরের বলে উড়িয়ে না দিলে আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।’

পাঁচকড়ি দে

বলা চলে, একেবারে গোড়া থেকেই কাজী আনোয়ার হোসেন একাধারে লেখক ও প্রকাশক হিসেবে পথচলা শুরু করেছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় তাঁর সম্পাদকসত্তা। তো একাধারে লেখক-প্রকাশক-সম্পাদক হয়ে ওঠার এই কাজে তিনি পূর্বসূরিদের দ্বারা কিছুটা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন কি না, তা এখন আর জানার উপায় নেই। তবে বাংলা রহস্যসাহিত্যের অন্যতম পুরোধা পাঁচকড়ি দে-ও একই পথে হেঁটেছিলেন। তিনি নিজে ছিলেন একাধারে লেখক ও প্রকাশক।

কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত সেকালের গোয়েন্দা কাহিনির ভূমিকায় বইটির সম্পাদক অরিন্দম দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘শুধু গোয়েন্দা কাহিনি লিখেই তিনি (পাঁচকড়ি দে) গাড়ি–বাড়ি হাঁকিয়ে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিলেন লেখকমহলে। পাঁচকড়িবাবুর আগে যে বাংলায় গোয়েন্দা কাহিনি লেখা হয়নি এমন নয়, আবার তাঁর সমসাময়িক কিংবা আরেকটু পরের লেখকের সংখ্যাও প্রচুর। তাহলে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, তাঁর এই হাতযশের কী কারণ? শুরুতেই তিনি যে কাজ করেছিলেন তা হলো, জোড়াসাঁকোর ৭ নম্বর শিবকৃষ্ণ দা লেনে “পার্ল ব্রাদার্স” নামে বইয়ের দোকান আর বাণী প্রেস তৈরি। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, প্রকাশকেরা যাতে লেখকের প্রাপ্য ফাঁকি দিতে না পারেন, তা নিশ্চিত করা। তাঁর দেখানো পথ পরে অনেকেই অনুসরণ করেন, রবার্ট ব্লেক খ্যাত দীনেন্দ্রকুমার রায় এঁদের মধ্যে অন্যতম। পাঁচকড়ি দে ঠিকভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে বাজারেও প্রতিপত্তি ধরে রাখতে হলে চাহিদামাফিক জোগান দিয়ে যেতে হবে। তাই বিলেতি ঢঙে তিনি তৈরি করলেন লেখকদের সিন্ডিকেট। প্রায় খান তিরিশ বই তাঁর নামে প্রকাশিত হলেও অনেক বইয়েরই তিনি আবার ছিলেন সম্পাদক। অন্য কেউ লেখক পাঁচকড়ি দে সম্পাদক ব্যাপারটা বোঝা গেল; কিন্তু অন্য কোনো লেখকের নাম নেই, শুধুই সম্পাদক পাঁচকড়ি দে—এই ব্যাপারটার মধ্যে পাঠকেরা খুঁজে পেলেন রহস্যের গন্ধ। সন্দেহ ঘনীভূত হলো তাঁরই অভিন্নহৃদয় বন্ধু আর পাল ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী যতীন্দ্রনাথ পাল মারা গেলে। যতীন্দ্রনাথ পাল মারা যাওয়ার পর পাচঁকড়ি দে আরও ৩০ বছর বেঁচে ছিলেন, কিন্তু আর কোনো গোয়েন্দা কাহিনি লেখেননি। তাঁকে ঘিরে তাই তৈরি হতে লাগল নানা গল্প, যেমন পাঁচকড়ি দে আসলে লেখক ছিলেন না, আসল লেখক হলেন যতীন্দ্রনাথ। গোয়েন্দা কাহিনির একজন লেখককে ঘিরে এহেন জমাট রহস্য অবশ্যই তাঁর জনপ্রিয়তা ও বইয়ের কাটতি বাড়িয়েছিল।’

কি, মনে হচ্ছে না কাজীদাও এ সম্পর্কে কিছুটা জানতেন?

আবার পাঁচকড়ি দের অনুসরণে দীনেন্দ্রকুমারও বসিয়েছিলেন নিজস্ব ছাপাখানা। তাঁর ‘রহস্য-লহরী ‘সিরিজের ১০৮ নম্বর বই বন্দিনী রাজনন্দিনী ছাপা হয় তাঁরই নিজস্ব ছাপাখানায়, যার ঠিকানা ছিল ২–এ অক্রূর দত্ত লেন, কলকাতা। মুদ্রক ও প্রকাশক ছিলেন দীনেন্দ্রকুমার রায়ের পুত্র দিব্যেন্দুকুমার রায়। সেবা প্রকাশনীর প্রথম দিকেও প্রকাশক হিসেবে ছাপা হতো সংগীতশিল্পী ফরিদা ইয়াসমীনের নাম, যাঁর সঙ্গে ১৯৬২ সালে কাজী আনোয়ার হোসেনের বিয়ে হয়। তবে প্রথম কয়েকটি বই সেগুনবাগান প্রেসের প্রকাশনী বিভাগ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে, এমনটিই উল্লেখ করা থাকত। ঠিকানা ছিল ১১৩, সেগুনবাগান, ঢাকা। কিছুদিনের মধ্যে সেগুনের ‘সে’ আর বাগানের ‘বা’ নিয়ে কালোর ওপর সাদা ব্লকে ‘সেবা প্রেস’ প্রতীক ছাপা শুরু হয়, প্রকাশনী বিভাগের উল্লেখ বাদ পড়ে। আবার দীনেন্দ্রকুমার রায় পাঠক টানতে চালু করেছিলেন উৎসবের ডবল নাম্বার বা শারদ উপহারের মতো চমক। তাঁর লেখা পল্লিকথা ‘রহস্য–লহরী’ সিরিজের শারদ উপহার হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। একাধারে লেখক ও প্রকাশক হওয়ার কৃতিত্ব অর্জনের জন্য তাঁকে যথেষ্ট ঝক্কি-ঝামেলা সামলাতে হয়, যা ছিল বেশ শ্রমসাধ্য। তবে একটা পর্যায়ে এর সুফলও মেলে। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক মোহাম্মদ নাসির আলীর কথা বলা যেতে পারে। ১৯৪৪ সালে বন্ধু আইনুল হক খানকে নিয়ে কলকাতায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নবযুগ লাইব্রেরী’, যা পরে বিদ্রোহী কবি নজরুলের দেওয়া নাম নিয়ে হয় ‘নওরোজ লাইব্রেরী’। আর দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে ঢাকার বাংলাবাজারে নতুন করে যাত্রা শুরু করে ‘নওরোজ কিতাবিস্তান’। এই প্রতিষ্ঠান ৭৫ বছরের পুরোনো।

অবশ্য ‘কুয়াশা’র দুটো বই লেখার পর দুজন প্রকাশকের দ্বারস্থ হয়ে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন কাজীদা, সেটাও যে প্রকাশনায় স্বনির্ভর হওয়ার ক্ষেত্রে একটা অনুঘটকের কাজ করেছিল, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

কিন্তু পাঠক জানবেন কী করে বইয়ের খবর? সদ্য প্রকাশিত বইয়ের শেষে পরবর্তী বইয়ের খবর জানানোর চল শুরু হলো। ‘মাসুদ রানা’র প্রথম দিককার কয়েকটি বইয়ের শেষ প্রচ্ছদে পরের বইয়ের কাহিনি সংক্ষেপসহ প্রকাশনার ঘোষণাও থাকত। যেমন, ১৯৬৭ সালের জুন মাসে প্রকাশিত মৃত্যুর সাথে পাঞ্জার শেষ প্রচ্ছদে ছাপা হয়েছিল, আগামী জুলাই মাসে বেরুচ্ছে বিদ্যুৎ মিত্র লিখিত রানা সিরিজের ষষ্ঠ রোমাঞ্চোপন্যাস দুর্গম দুর্গ। এরপরই কাহিনিসংক্ষেপ দেওয়া হয়েছিল এভাবে: ‘দূর যাত্রায় চলল দুঃসাহসী চারজন পাকিস্তানি অভিযাত্রী। পেশোয়ারি মাহবুব চানন, পাঞ্জাবি মিশ্রী খান আর সিন্ধি আলতাফ ব্রোহী একত্র হলো বাঙালি মাসুদ রানার নেতৃত্বে। তারা পাড়ি দিল আরব সাগর।’ কেন?... আপনি চুপিচুপি জানতে চাইলে পড়ুন দুর্গম দুর্গ। আবার ১৯৬৭ সালের মে মাসে প্রকাশিত সিরিজের চতুর্থ বই দুঃসাহসিক-এ একটি বিশেষ ঘোষণা দিয়ে বলা হয়েছিল: ‘রানা ও কুয়াশা সিরিজের লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন বিদ্যুৎ মিত্রের ছদ্মনাম পরিত্যাগ করে ভবিষ্যতে স্বনামে লিখবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ আবার সেবার বইয়ের শেষে পেছনের কয়েক পাতা বরাদ্দ হলো পাঠক ও সমালোচকদের জন্য। তাঁদের পাঠানো চিঠিপত্র ছাপানো হতো, যার মধ্যে অনেকগুলোর জবাবও দেওয়া হতো ‘আলোচনা’ বিভাগে, যা দারুণ জনপ্রিয়তা পায় প্রথম থেকেই। নিজেদের নাম ছাপার অক্ষরে দেখতে পাওয়ার ইচ্ছা থেকে অনেকেই চিঠি পাঠাতে থাকেন। (কাজী আনোয়ার হোসেন ও প্রকাশনা ব্যবসা—তানিম আসজাদ; বণিক বার্তা, জানুয়ারি ৩১, ২০২২ )

এরপর বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক পত্রিকায় ‘মাসুদ রানা’সহ সেবার বিভিন্ন বইয়ের পরিচিতি যেমন বের হতো, তেমনি ছিল ছোট ছোট বিজ্ঞাপন। ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে সেবা প্রকাশনীর নতুন বইয়ের বিজ্ঞাপন নিয়মিত ছাপা হয়েছে। তত দিনে বাজার মাত হয়ে গেছে। তাই সম্ভবত ’৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে এসব বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ হলো। এদিকে ১৯৮৪ সালের নভেম্বর থেকে প্রতি মাসে কাজী আনোয়ার হোসেন সম্পাদিত রহস্যপত্রিকায় সেবার বইয়ের পরিচিতি, বিজ্ঞাপন ও আলোচনা বেরোতে থাকল নিয়মিত।

সময় যত গড়াতে লাগল, নগদ কারবারের নীতিতে পরিচালিত সেবা প্রকাশনীর বই ততই সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকল—রেলস্টেশনের বুক স্টলে, হকারের হাতে, ফুটপাতে পত্রিকা বিক্রেতার কাছে। কাজীদার বড় ছেলে ও লেখক-অনুবাদক কাজী শাহনূর হোসেন এ প্রসঙ্গে জানান যে সে সময় কাজীদা নিজেও ‘মাসুদ রানা বুক স্টল’ নামে চট্টগ্রামে একটা বইয়ের দোকান দিয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকা থেকে ঠিকঠাকমতো দেখাশোনা করা কঠিন হয়ে পড়ায় একপর্যায়ে ওটা বিক্রি করে দেন।

এদিকে পরিবেশক বা বিক্রেতারা নগদ টাকায় সেবার বই কিনে নিয়ে যেতেন বা তাঁদের কাছে ডাকযোগ বই পৌঁছে দেওয়া হতো টাকা পাওয়ার পর। শাহনূর হোসেনের কাছ থেকে আরও জানা গেল, কেউ কেউ আবার সেবার বইয়েই নিজেদের দোকানের নাম-ঠিকানা জুড়ে দেওয়ার সুযোগ নিয়েছিলেন বিক্রি বাড়াতে। সে রকম একটি ছিল কুমিল্লার ‘লেখাপড়া’ নামের বইয়ের দোকান।

১৯৭০–এর দশকের শেষ ভাগে ছোট পিকআপ ভ্যানগাড়ির ব্যবহার করা হয়েছিল উত্তরবঙ্গে প্রচার–প্রচারণা চালানোর জন্য। সেই গাড়ির গায়ে একপাশে বড় করে ‘মাসুদ রানা’, আরেক পাশে ‘কুয়াশা’ লেখা থাকত।

নিয়মিত বই প্রকাশ করা কাজীদার ব্যবসার আরেক বৈশিষ্ট্য। বছরজুড়েই সেবা প্রকাশনীর বই বাজারে আসে। শুধু একুশে বইমেলাকে উপলক্ষ করে বই প্রকাশের ধুম পড়ে না। নিয়মমাফিক লেখকদের রয়্যালটি পরিশোধ করা হয়—বই বিক্রির ওপর নির্ধারিত হারে। সাধারণত, বই প্রকাশের এক মাসের মাথায় প্রথম রয়্যালটি শোধ করা হয়। এরপর তিন মাস অন্তর কিস্তিতে যত দিন বই বিক্রি শেষ না হয়, তত দিন। অনেক বছর পর কোনো পুরোনো লেখক কুশল বিনিময় করতে এসে জমে থাকা কিস্তির টাকা পেয়ে হতবিহ্বল বনে গেছেন, এমন ঘটনাও ঘটেছে।

ষাটের দশকে সেবা প্রকাশনীর মাধ্যমে কাজী আনোয়ার হোসেন রহস্য–রোমাঞ্চ সাহিত্যের যে ধারার সূচনা করেছিলেন, তা এখন নানা ফলফুলে শোভিত। প্রসার ঘটেছে এ ধারার ব্যবসারও। আর পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন কাজীদা।