পান্তার সঙ্গে ইলিশ যোগ হলো যেভাবে

এখন পয়লা বৈশাখে পান্তা খেতে দেখা যায় শহরের মানুষকে। ‘পান্তা-ইলিশ’ কবে থেকে কীভাবে যুক্ত হলো নগর সংস্কৃতিতে, তা নিয়ে লিখেছেন তারিক মনজুর।

পান্তাভাতে ইলিশ খাওয়ার চলটি তৈরি হয়েছে সাম্প্রতিককালে
ছবি: প্রথম আলো

পান্তাভাত হলো পানিতে ভেজানো বাসি ভাত। ‘চর্যাপদ’–এ ভাতের কথা আছে, পান্তাভাতের কথা নেই। কিন্তু ইতিহাস ও সাহিত্যের নানা সূত্র থেকে এটি নিশ্চিত হওয়া যায়, প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলে পান্তাভাত খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। কাঁচা মরিচ-পেঁয়াজ দিয়েই লোকে পান্তা খেয়ে উঠত। অনেক সময় মানুষ পান্তা খেত শুধু লবণ মাখিয়ে। আগের রাতে ভিজিয়ে রাখা ভাত সাধারণত পরদিন সকালে পান্তাভাত হিসেবে খাওয়া হতো।

এই পান্তা খাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের সানকি বা মাটির পাত্র ছিল না। তারা মাটির হাঁড়ি থেকে পান্তাভাত তুলে নিয়ে কচুপাতায় বা কলাপাতায় করে খেত। বিজয়গুপ্তের ‘পদ্মাপুরাণ’–এ (১৬৫০) আছে, ‘আনিয়া মানের পাত বাড়ি দিল পান্তাভাত’। তার মানে, মানকচুর পাতা এনে সেখানে পান্তাভাত বেড়ে খেতে দেওয়া হচ্ছে।  

পান্তাভাতের পানিকে বলা হয় ‘আমানি’। এই আমানিও খেত মানুষ। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ (১৬০০) কাব্যে আছে, ‘মোচড়িয়া গোঁফ দুটা বান্ধিলেন ঘাড়ে।/ এক শ্বাসে তিন হান্ডি আমানি উজাড়ে।।’ ব্যাধ কালকেতুর ভোজনের বিবরণে দেওয়া খাদ্যতালিকা অনেক দীর্ঘ ও অবিশ্বাস্য; তবে মধ্যযুগের পরিশ্রমী মানুষ সহজেই দু-তিন হাঁড়ি আমানি উজাড় করে দিতে পারত।  

আসলে, গরমে-রোদে কাজ করার জন্য কৃষকের উপযোগী খাদ্য ছিল এই পানিভাত। সূর্য ওঠার পরপরই পান্তাভাত খেয়ে তারা কাজে বের হতো। এর সঙ্গে কখনো কখনো যোগ হতো একটু বেগুনপোড়া বা আলুসেদ্ধ। খুব কম সময়েই পান্তাভাতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাছের তরকারি। মাছ বলতেও সেসব মাছ, যেগুলো সাধারণত খালে-বিলে সহজে পাওয়া যেত। যেমন—কুচো চিংড়ি, ছোট ট্যাংরা, পুঁটি, টাকি এগুলো।  

কৃষিজীবী মানুষ তার উৎপাদিত ধানের ওপর নির্ভর করে বছর পার করত। ভাতের সঙ্গে খাদ্যতালিকায় যোগ হতো আশপাশে সহজে পাওয়া যায় এমন শাক, মাছ। দরিদ্র মানুষের কাছে পয়সা দিয়ে কিছু কিনে খাওয়া ছিল বিলাসিতা। ঘি ছিল ধনীদের খাবার। ধনীরা গরম ভাতে ঘি মেখে খেত। সাধারণ মানুষের জন্য ঘি কতটা অপাঙ্‌ক্তেয় ছিল, তার প্রমাণ নিয়ে ঘুরছে ‘পান্তাভাতে ঘি’ প্রবাদটি।  

গেল শতকের আশির দশকে ঢাকায় পান্তাভাতে ইলিশ খাওয়ার চলটি তৈরি হয়েছে। এটি সারা দেশে জনপ্রিয় হতেও দেরি হয়নি। বাংলা বর্ষবরণের নাগরিক রুচিতে এখন ভর করেছে পান্তা-ইলিশ।

সাধারণ মানুষের খাবার ছিল পান্তাভাত। তবে বিত্তবানেরা যে একেবারেই পান্তাভাত খেতে না, তা নয়। বাঙালি বড়লোক বন্ধু কৃষ্ণকান্ত নন্দীর বাড়িতে গিয়ে ভারতের প্রথম বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস পান্তাভাত আর কুচো চিংড়ি খেয়েছিলেন। আবার জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছেলেবেলায় পান্তাভাত খাওয়ার কথা লিখেছেন, ‘বৌঠাকরুন রাঁধতে পারতেন ভালো, খাওয়াতে ভালোবাসতেন, এই খাওয়াবার শখ মেটাতে আমাকে হাজির পেতেন। ইস্কুল থেকে ফিরে এলেই তৈরি থাকত তাঁর আপন হাতের প্রসাদ। চিংড়িমাছের চচ্চ্‌ড়ির সঙ্গে পানতা ভাত যেদিন মেখে দিতেন অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে, সেদিন আর কথা ছিল না।’

দেখা যাচ্ছে, পান্তাভাতের সঙ্গে চিংড়ি যোগ হচ্ছে পদ হিসেবে। চিংড়ির মতো সহজে লভ্য অন্য মাছও পান্তাভাতের অনুষঙ্গ হয়েছে। কিন্তু পান্তাভাতের সঙ্গে ইলিশের প্রসঙ্গ পাওয়া যায় না। ইলিশ ছিল দামি মাছ। ইলিশ যদি খেতেই হয়, তবে গরম ভাতেই খাওয়ার চল ছিল। সমুদ্রের ইলিশ নদীতে এসে জেলেদের জালে ধরা পড়ত; সেই ইলিশ বিক্রি হতো সমাজের বিত্তবানদের কাছে। সাধারণ মানুষ যদি ইলিশ কিনে বাড়ি ফিরত, তবে সেদিন তার ভাবসাবই থাকত আলাদা।  

কানকোয় দড়ি দিয়ে বেঁধে বড় মাছ আনা হতো বাজার থেকে। কেউ যদি এভাবে দড়িতে ইলিশ ঝুলিয়ে রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরত, তবে সবাই তার কাছে মাছের দাম জানতে চাইত। গোপাল ভাঁড় আর রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এমন একটা গল্পও আছে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র একদিন গোপাল ভাঁড়কে জব্দ করার জন্য বললেন, ‘আচ্ছা, গোপাল, তুমি বাজার থেকে ইলিশ কিনে ফিরবে, কিন্তু কেউ তোমার কাছে দাম জানতে চাইবে না। এমনটি কি পারবে?’ গোপাল সেই অসম্ভবপ্রায় শর্ত মেনেই বাজারে যায় এবং আরও অসম্ভবপ্রায় কাণ্ড করে বাজিতে জেতে।

পান্তাভাতে ইলিশ খাওয়ার চলটি তৈরি হয়েছে সাম্প্রতিককালে
ছবি: প্রথম আলো

সাধারণের পাতে সহজে ইলিশ উঠত না। তৈরি হওয়া কিছু প্রবচনেও ইলিশের এই মূল্য বোঝা যায়, ‘মাছের মধ্যে ইলিশ রাজা/ রুই-কাতলা তাহার প্রজা’, ‘পুঁইশাকে যদি দাও ইলিশের মাথা/ ননদিনী কয় তার গুপ্ত যত কথা’, ‘যদি ইলিশের মাথা দিয়া রান্ধ কচুশাক/ গোমড়া শ্বশুর আনন্দেতে হইবে সবাক’। বাঙালির গালগপ্পেও ইলিশের প্রসঙ্গ এসেছে যথাযথ মর্যাদার সূত্রে। তবে পান্তাভাতের সঙ্গে ইলিশ খাওয়ার কোনো রীতি সাহিত্য কিংবা ইতিহাসে নেই।

গেল শতকের আশির দশকে ঢাকায় পান্তাভাতে ইলিশ খাওয়ার চলটি তৈরি হয়েছে। এটি সারা দেশে জনপ্রিয় হতেও দেরি হয়নি। বাংলা বর্ষবরণের নাগরিক রুচিতে এখন ভর করেছে পান্তা-ইলিশ। উৎসবে মানুষ এক হতে চায়; শহরের মানুষও নতুন বছরের প্রথম দিনে এক হয়। ‘বৈশাখী মেলা’ নতুন বছরের মিলনের প্রধান উৎসব। ষাটের দশকে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে বাঙালি এক হয়েছে রবীন্দ্রসংগীতের সূত্রে নববর্ষ উদ্‌যাপনে। এরপর আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় মঙ্গল শোভাযাত্রার সূত্রে নগর মানুষ এক হয়েছে। এসব আয়োজন-অনুষ্ঠান যতই জনপ্রিয় হতে থাকে, ততই নাগরিক মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে রমনা-শাহবাগ এলাকায়।

আশির দশকের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী সুযোগটি গ্রহণ করেন। তাঁরা নিজেদের আগ্রহে অস্থায়ী দোকান দিয়ে পান্তাভাত আর ভাজা ইলিশ বিক্রি শুরু করেন। পান্তাভাত হাজার বছরের বাঙালির প্রাত্যহিক খাদ্য, আর ইলিশ মূলত বঙ্গ-উপকূলের মাছ—এই ধারণা জাতীয়তাবাদী চেতনার সঙ্গে যুক্ত করে তাঁরা পান্তা আর ইলিশকে জনপ্রিয় করেছেন। যদিও একত্রভাবে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ঐতিহ্যিক কোনো সূত্র নেই। পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশের সঙ্গে কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ তো থাকেই, আরও থাকে আলুভর্তা, শুটকিভর্তা, বেগুনভর্তা ও পোড়া মরিচ। এসব খাবার পরিবেশনে ব্যবহার করা হয় ঐতিহ্যবাহী মাটির সানকি।

তবে শহরের মানুষ যা নিয়েই মত্ত থাকুক না কেন, গ্রামের সাধারণ মানুষ নতুন বছরের প্রথম দিনে সাধ্যমতো ভালো খাওয়ার চেষ্টা করে। এদিন সকালে তারা মিষ্টি খেয়ে দিন শুরু করে। মজার ব্যাপার হলো, আগের রাতের খাবারে তারা তিতাজাতীয় কোনো পদ রাখে। এই তিতা খাবারটি তাদের কাছে পুরোনো বছরের দুঃখ-বেদনাকে বিসর্জন দেওয়ার প্রতীক।