মাসরুর আরেফিনের চতুর্থ উপন্যাস ‘আড়িয়াল খাঁ’ অনেক পাঠকপ্রিয় হয়েছে, মানুষ পছন্দ করেছে। আন্দাজ করি, বেশির ভাগ মানুষের এ উপন্যাস পছন্দ করার একটা কারণ, ভাষা আর গল্পের তুলনামূলক সহজবোধ্যতা। তবে কেউ যদি দাবি করেন, তাঁর আগের অন্য তিন উপন্যাসের চেয়ে ‘আড়িয়াল খাঁ’ খুব বেশিভাবে শুধু নিছক ‘সামাজিক কাহন’ এবং এথিকস ও মোরালিটি–সংক্রান্ত গল্প, সেটা ঠিক হবে না। মাসরুর আরেফিনের আগের ফিকশনগুলোর ধারাবাহিকতায় ‘আড়িয়াল খাঁ’ও সভ্যতার কথকতা ও দার্শনিক অভিজ্ঞানের উপন্যাস, এর ভেতরের অজস্র উপাদানসহ।
মাসরুর আরেফিনের আগের তিন উপন্যাসেও ‘এথিকস ও মোরালিটি’–সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো ছিল। ‘আগস্ট আবছায়া’য় ক্ষমতার অন্ধ নৃশংসতা, ‘আলথুসার’–এ রাষ্ট্রের দেবতা হয়ে ওঠা ও প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করা, ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’–এ রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠা—এই সবকিছু একটা নৈতিক সংকটের দিকেই নিয়ে যায়, আরও বড় পরিসরে দেখলে, শেষ পর্যন্ত একটা দার্শনিক গন্তব্যে নিয়ে যায়। যেটা ‘আড়িয়াল খাঁ’কেও নিয়ে যায়।
মানুষের ‘আড়িয়াল খাঁ’ পছন্দ করার কারণ হয়তো উপন্যাসটিতে তাদের পরিচিত পরিবেশ-প্রতিবেশ, সমাজ আর চরিত্রদের বেশি পাওয়া যায় বলে। আর হয়তো এ উপন্যাসে যে সময়, আশির দশকের শুরুর দিকের বাংলাদেশ, তা নিয়ে নস্টালজিয়ার কারণে।
আমেরিকার লেখক ডেভিড ফস্টার ওয়ালেস, যিনি লিখেছিলেন ‘ইনফিনিট জেস্ট’, কোথাও বলেছিলেন, ফিকশন হচ্ছে খুব অল্প কিছু অভিজ্ঞতার মধ্যে একটা, যেখানে একাকিত্বকে মোকাবিলা করা যায় এবং একই সঙ্গে নিস্তার পাওয়া যায় ওই একাকিত্ব থেকে। ওয়ালেসের এই কথা সত্য, আমি মানি। তবে কোনো কোনো ফিকশন বা উপন্যাস শুধু অতটুকু, ব্যক্তিমানুষের ওই একাকিত্বকে মোকাবিলা করার ব্যাপারে সীমাবদ্ধ থাকে না। আরও বড় কিছু বা বড় উদ্দেশ্যের দিকে মনোযোগ টেনে নেয়। তখন উপন্যাস নিজেই এমন এক অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে এবং আগেকার সব অভিজ্ঞতার—ভাষার, জগৎকে দেখার, যুক্তির যে সুতা ও কাঠামো দিয়ে বাস্তবতা তৈরি হয়—তার রূপান্তর ঘটায়।
আড়িয়াল খাঁ
মাসরুর আরেফিন
প্রকাশক: কথা প্রকাশ, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২২, প্রচ্ছদ: আনিসুজ্জামান সোহেল, দাম: ৩৫০ টাকা।
আলোচ্য উপন্যাসটি সেই ধরনের উপন্যাস, যে উপন্যাস বাস্তবতা সম্পর্কে আপনার যে সুরক্ষিত এবং আপাত নিষ্পাপ ও সরল এক অভিজ্ঞতা আছে, তাকে প্রলোভন দেখিয়ে আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে, পুকুরের পাড় আর নদীর কিনার ধরে এমন এক জনশূন্য খোলা প্রান্তরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেবে যে তখন আপনার সেই হতচকিত অভিজ্ঞতা বাতাসের প্রচণ্ড শোঁ শোঁ আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শুনতে পাবে না। এবং আপনি যদি আসলেই সাহিত্য বা উপন্যাসের সিরিয়াস পাঠক হয়ে থাকেন, ‘আড়িয়াল খা’র এই শোঁ শোঁ আওয়াজ হয়তো আপনার সদ্য রূপান্তরিত হওয়া অভিজ্ঞতার চিরস্থায়ী অংশ হয়ে যাবে। ফলে এই বই পড়ার পরের আপনি, জগৎ-সংসার ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চিরপরিচিত এই বাস্তবতাকে আরও কম ফিল্টার করে, আরও চাঁছাছোলাভাবে, যে রকম আছে, কিছুটা সে রকমভাবেই দেখতে থাকবেন, বা বলা যায় দেখার চেষ্টা করতে থাকবেন, আশা করা যায়।
উপন্যাসটি শুরু হয় দূর এক মফস্সলে ছিমছাম প্রবহমান ভাষায় স্নিগ্ধ এক সন্ধ্যা আর সুন্দর প্রকৃতির বর্ণনা দিয়ে, ১২ বছরের জাহেদ এসে আমাদের জন্য ‘আড়িয়াল খাঁ’ জগতের দরজা খুলে দেয়। সে-ই আমাদের গাইড এবং ঘটনার সঙ্গে আরও আরও ঘটনার সন্নিবেশ ঘটিয়ে এক মহাঘটনা তৈরির রিংমাস্টার। সেই জাহেদ যখন বইঠো নামের কুকুরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এবং কুকুরের ডাক ও উচ্চারণের নানারকম ব্যাখ্যা করতে করতে আমাদের নিয়ে যায় জাহান্নামের দিকের রাস্তায়, যেখানে এলাকার মানুষ সবাই মিলে জনি অথবা মুকুল নামের এক চোরকে মারতে মারতে মেরেই ফেলল, জাহেদের বন্ধু কাইল্লা কবির আকাশের দিকে এক হাত উঠিয়ে চিৎকার করল ‘ট্যারর’, আর ঝমঝম বৃষ্টি নামল, তখন মনে হয় জাহেদ বা লেখক আমাদের বললেন, ওয়েলকাম টু দ্য ডেজার্ট অব দ্য রিয়াল। যেন গ্রিক মিথলজির স্বপ্নদেবতা মরফিউসের মতো তারা বললেন, আমাকে অথবা আপনাকে, বাস্তবতার এই অসহ্য গনগনে মরুপ্রান্তরে স্বাগত, এই যে এখানেই চোখের সামনে সবাই মিলে উল্লাস করতে করতে এক হাড্ডিসার মানবসন্তান চোরকে পিটিয়ে মারতে মারতে মেরেই ফেলল। সে সময় সাবধানে অনুমান করি, এই জাহেদকে, ১২ বছর বয়সী জাহেদকে গাইড বা রিংমাস্টার বানিয়ে লেখক আমাদের আরও এমন এমন অন্ধকার জায়গায় নিয়ে যাবেন এবং এমন অনেক কিছুই দেখাবেন, যা ১২ বছর বয়সী কারও কাছে আমরা আশা করি না, এবং ১২ বছর বয়সী কারও সঙ্গে দেখার কথাও আশা করি না। কিন্তু ‘আড়িয়াল খাঁ’র জগৎ তো প্রচলিত আশা-নিরাশার বাইরের জগৎ। ফলে তাই-ই হয়, যা অনুমান করেছি।
এই উপন্যাসে লেখক এমন এক সময়ের এক মফস্সলের গল্প বলেছেন, যেখানে সময়, একটা সমাজ এবং মানুষ—এই তিনটি জিনিসের মধ্যকার ঠাসবুনোট সম্পর্ক তাদের সব প্রকাশ্য ও গোপন জীবন-জগৎ নিয়ে আমাদের সামনে উন্মোচিত হতে থাকে। উন্মোচিত হয় এমনভাবে, যখন ভোরে সূর্যের আলো প্রথম পৃথিবীতে পৌঁছায় আর মনে হয় ধীরে ধীরে পৃথিবীকে ঢেকে রাখা একটা চাদর ওপর থেকে সরিয়ে নিচ্ছে কেউ, অনেকটা তেমনই, ‘আড়িয়াল খা’র গভীরে যেতে যেতে প্রতি স্তরে উন্মোচিত হতে থাকে এই গল্পের সময়, সমাজ এবং মানুষের প্রকাশ্য ও গোপন সবকিছু—খুব অনায়াসেই, কোনো তাড়াহুড়া ও কোনো অস্বস্তি ছাড়াই।
আশির দশকের শুরুর দিকের বরিশাল শহরের বাইরের এক আধা গ্রাম আধা শহর মফস্সল ভাটিখানার গল্প, যেখানে এই উপন্যাসের সবাই মিলে একটা সমাজ। সবাই সর্বদা ক্রিয়াশীল সেই সমাজের অংশ। এনট্রপির চক্রান্তে পড়ে সময় যেন নিজেকে জীবন্ত রাখতেই ওই সমাজটাকে দিয়ে সবার নিজস্ব ভূমিকা পালন করিয়ে নিচ্ছে। উদ্ধত ধনী, তালকানা মধ্যবিত্ত, ছেঁড়াফাটা বেয়াদব গরিব, অস্বস্তিকাতর নিম্নমধ্যবিত্ত সবাই এই সমাজের ভেতরে, এমনকি বাড়ির কুকুর বইঠোও, পোষা হাঁস-মুরগি, কোকিল-কসাই-ভগীরথ আর গুধুও, এমনকি পুকুর পাড়ের গুইসাপ খছাকও, এমনকি ঈশ্বরদী থেকে আসা রেলগাড়ি ভেঙে খাওয়া ডাকাতের দলও, যে মারে সে–ও, যে মরে সে–ও; সবাই সমাজের ওই একটা বৃত্তের ভেতরেই আছে, ঘন-সন্নিবেশিত।
আর গল্পের ভেতরকার সেই সমাজ বা সেই জগৎকে মাঝেমধ্যে ঝাঁকি দিতে আসে তিনজন—জাহেদের মালেক হুজুর, জাহেদের বন্ধু সার্কাসের জোকার ঈমান ও চোরদের দলের আধ্যাত্মিক সর্দার ‘ভয়েমকর’ লোক রাজা ভক্তিমিশ্র।
এই তিনজন চরিত্রের জন্য এই উপন্যাসের ভেতরের জগৎ সময়ে সময়ে ত্রিমাত্রিকতার সব সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে জাদু, মিথ আর অলৌকিকতার জগতে প্রবেশ করে এবং স্পষ্টতই অসীমের ফিসফাস শোনা যায় তখন—যখন মালেক হুজুর জাহেদকে বলে, ‘তুমি নদীর জ্বলেন্ত পানি ধরবা আর কিছুই পাইবা না, পিরথিবি তো এত্তো ফালতু হয় নাই’—যখন ঈমান বলে জাহেদকে, আর যখন কোনো খাওয়া পাওয়া যায় না কোনোদিকে, তখন পানকৌড়িগুলারে খায় লালচেবুক ঈগোল—যখন রাজা ভক্তি মিশ্র বলে, ‘কোরানে বলছে—আছরয় চাইতেয়াছি ভোরের প্রভুর কাছে, আছরয় চাইতেয়াছি তার তৈরি করা জিনিসের খারাবি হইতে, আছরয় চাইতেয়াছি গিরায় ফুঁক দেয় যে মহিলা তার শয়তানি হইতে, বলে নাই কাশেম?’
উপন্যাসে লেখক এমন এক সময়ের এক মফস্সলের গল্প বলেছেন, যেখানে সময়, একটা সমাজ এবং মানুষ—এই তিনটি জিনিসের মধ্যকার ঠাসবুনোট সম্পর্ক তাদের সব প্রকাশ্য ও গোপন জীবন-জগৎ নিয়ে আমাদের সামনে উন্মোচিত হতে থাকে। উন্মোচিত হয় এমনভাবে, যখন ভোরে সূর্যের আলো প্রথম পৃথিবীতে পৌঁছায় আর মনে হয় ধীরে ধীরে পৃথিবীকে ঢেকে রাখা একটা চাদর ওপর থেকে সরিয়ে নিচ্ছে কেউ, অনেকটা তেমনই, ‘আড়িয়াল খা’র গভীরে যেতে যেতে প্রতি স্তরে উন্মোচিত হতে থাকে এই গল্পের সময়, সমাজ এবং মানুষের প্রকাশ্য ও গোপন সবকিছু—খুব অনায়াসেই, কোনো তাড়াহুড়া ও কোনো অস্বস্তি ছাড়াই।
‘আড়িয়াল খাঁ’ তার ঘটনা এবং ভাষা দিয়ে উপন্যাসে অসংখ্য দীর্ঘ এবং কম দীর্ঘ ম্যাজিক মুহূর্ত তৈরি করে, যেখানে আপনাকে থামতে হবে বা চমকাতে হবে। যখন মালেক হুজুর বলবেন, ‘কালাবদর, নয়া ভাংগানি, বিঘাই, কেত্তনখোলা সব আইসা জাহেদ চাইপা ধরছে আড়িয়াল খাঁ-রে, আমি দোয়া দুরুদের হিসাব মিলাইয়া দেখছি যে, সেই আড়িয়াল খাঁ-তে তুমি সেই জিনিস পাইবা, যা আমি তোমারে বলি তা তুমি পাইবা—যুদি খালি সাহস করো, যুদি খালি রাইতের বেলায় যাও, আর তোমার লগে যুদি থাহে এই তাবিজ’—তখন মনে হবে মালেক হুজুরের এই বিশ্বাসের পেছনে হয়তো আছে খোয়াজ খিজিরের সঙ্গে তার এক গোপন যোগাযোগ। সে জানে পানির নিচের আর আসমানের ওপরের এই দুই রহস্যময় জগৎ নিজেদের মধ্যে কোন ভাষায় কী বলাবলি করে। মনে হবে, যেন স্বপ্ন আর বাস্তবের সীমারেখায় দাঁড়ানোর পরে কেউ এসে তাকে বলে দিয়ে যায় এসব গুপ্তবিদ্যা। আর সে জাহেদকেও দাঁড় করাতে চায় সেখানে, শেখাতে চায় সেই গুপ্তবিদ্যার ভাষা।
জাহেদকে লোভ দেখাবে সে, বলবে, ‘আড়িয়াল খাঁর ওই বিরাট আকাশে রাইতে নখখত্র ছিটকাইয়া নদীতে পড়বেই। বোঝতেয়াছ জাহেদ? ওই নখখত্রের পানির এক বুতোল পাইবা তো, জীবনে আর কিচ্ছু লাগবে আমাদের?’
কাইল্লা কবির হঠাৎ কানের পেছনে এসে আপনাকে চমকে দিয়ে বলবে, ‘তোমরা বড়লোকেরা এই অ্যামুন—সিন্দেলচোরেরা তোমাদের দোকান ভাংবে ঠিকই, দুশকিরতিকারীরা তোমাদের টমেটোর খেতে আগুনও ধরো লাগাইবে ঠিকই, কিন্তু কুনোদিন এমন হইবে না যে তোমাদের বাকোল যাবে। গরিবের গেলে বাকোলও যায়, বাকলার কাপড়ও যায়।’
এখন একটা চিন্তা মাথায় হয়তো আসতে পারে যে উপন্যাস হিসেবে আশির দশকের শুরুর দিকের বরিশালের এক মফস্সলের এমন ঘনসন্নিবেশিত সমাজকে বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে কোন জিনিসটা লেখকের জন্য কাজ করেছে। এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে একটু পেছন ফিরে দেখলে ভালো হয়—মাসরুর আরেফিনের এর আগের দুই উপন্যাসেও বরিশাল এসেছে, বরিশাল আছে। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘আলথুসার’–এর গল্প লন্ডন থেকে বরিশালের আখ্যানে ঢুকে পড়েছে কখনো কখনো, তৃতীয় উপন্যাস ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’–এর গল্পও রাশিয়া থেকে বরিশালের এবং এই ভাটিখানার আখ্যানে ঢুকে পড়েছে অনেকবার। এবং এই ‘আড়িয়াল খাঁ’ উপন্যাসের কোনো কোনো চরিত্র ‘আলথুসার’–এ পাওয়া যাবে, এবং আরও অনেক বেশি করে পাওয়া যাবে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসে। কিন্তু ‘আড়িয়াল খাঁ’র গল্প বরিশালের বাইরে যায় না, সমগ্রটাই হয়ে ওঠে বরিশালের। বা এখানে বরিশালই সমগ্র। বরিশালের বারবার এবং এইবার এই ‘আড়িয়াল খাঁ’-তে সমগ্র হয়ে ফিরে আসার কারণ কি উপন্যাস লেখার উদ্দেশ্যে লেখকের শৈশবের স্মৃতিতে ফিরে যাওয়া? আমি বলব, না। কারণ, আমরা সব সময় স্মৃতিতেই থাকতে থাকি, তাই স্মৃতিতে আর আলাদা করে ফিরে যাওয়ার দরকার পড়ে না। আমি উপন্যাসকে শুধু উপন্যাস হিসেবেই পাঠ করতে চাই, স্মৃতিকে আলাদা করে এর ভেতরে চিহ্নিত করতে চাই না। হোসে সারামাগো একবার একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, স্মৃতি ছাড়া কোনো লেখা তৈরি হওয়া সম্ভব না। লেখকেরা যা স্মরণ করেন, সেগুলোই সব সময় লেখকদের পরিচর্যা করতে থাকে। স্মৃতিই হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে গভীর সত্যিকারের ভাষা।
স্মৃতির পুনর্নির্মাণকে তো আর যা–ই হোক স্মৃতি বলা যাবে না। স্মৃতি একটা উপকরণ হতে পারে। সেই উপকরণ ব্যবহার করে স্মৃতির পুনর্নির্মাণে যা ঘটে বা তৈরি হয়, সেটি লেখকের জন্য অনিবার্য এবং নতুন জিনিস।
আমরা আসলে স্মৃতির মধ্য দিয়েই এই জীবন কাটাই। যেহেতু স্মৃতি নিরপেক্ষ কোনো উপন্যাস এবং জীবন সত্যিকার অর্থে অসম্ভব, সেখানে আলাদাভাবে স্মৃতির ইতিহাস খোঁজার আর অর্থ নেই। তাই জাহেদ, গুপ্তধন আনতে যাত্রা করার আগে ওই দিন সে তার স্মৃতির মাধ্যমেই সমস্ত কিছু আমাদের সামনে নিয়ে আসে। সুতরাং আপনার যাত্রা সার্থক হবে ‘আড়িয়াল খাঁ’র নিজস্ব জগতে জাহেদের স্মৃতিতে ও বর্তমানে ভ্রমণ করলে। যেখানে জাহেদ সেই চাখারে বেড়াতে যাওয়ার কথা মনে করে, মালেক হুজুরের বাড়িতে, আর দুজন নিজেদের অজ্ঞাতসারেই একটা মনস্তাত্ত্বিক খেলার ভেতরে পড়ে যায়।
জাহেদ জিজ্ঞাসা করে, ‘দোয়াটা শিখাবেন না হুজুর?’
মালেক হুজুর জাহেদের মরিয়া ভাব বুঝে উঠেও সে পথ এড়িয়ে যায়, বলে, ‘আমাগো এইহানে কেলিকদমরে কয় কুমিয়ারি। আমার মায় কয় ফুটিকদম। কেমন সুন্দর না গাছগুলা, জাহেদ? তা তুমি সকালে কী খাইছ?’
জাহেদ উত্তর দেয়, ‘সাথি আপা আজকে দিছে মুড়ি দিয়া গুড়, আবার সবেদা ফলও দিছে একখান। আমি মজ্যা কইরা খাইছি হুজুর।’
হুজুর এবার হীনম্মন্যতাবোধ থেকে সতর্ক হয়ে যায়, ‘বাড়িতে গিয়া বইল্যা দিবা এইসব?’
খেলা যেহেতু শুরু হয়ে গেছে, জাহেদ সুযোগটা নেয়, বলে, ‘বলমু না, যদি দোয়াটা শিখান।’
এই পাল্টাপাল্টি শর্ত দেওয়ায় মালেক হুজুর এগিয়ে যায়, ধরে ফেলে জাহেদকে, বলে, ‘দোয়া শিখামু যদি আমারে বলো যে, কী তুমি আমারে বলতে গেছিলা, কিন্তুক বললা না?’
একপর্যায়ে হুজুর যখন জাহেদকে ধমক দেয়, ‘বলো, আর যদি না বলো, তাইলে আমি তোমারে দোয়া শিখামু না। তহন তাবিজ লইয়া আড়িয়াল খাঁ যাইবা ঠিক, কিন্তু পানি থাইক্যা যাইবে খালিই পানি। আড়িয়াল খাঁ যেইখানে মেলছে জাহেদ কেত্তনখোলার লগে…।’
ঠিক তখন, ঠিক তখন এই খেলায় জাহেদ এক চালে যেন হুজুরের সমস্ত গাম্ভীর্য, জ্ঞানকে তুড়ি মেরে শূন্যে উড়িয়ে দেয়, হুজুরের আগে আগে বলতে থাকে—‘যেইখানে মেলছে কালা বদর, নয়া ভাংগানি, বিঘাইয়ের নামায়…’
আর ওই চাখারেই এই জাহেদকেই আবার এক জটিল ধন্ধে ফেলে দেয় হামিং বার্ডের মতো ডানা ঝাপটানো এক চরিত্র—সার্কাসের জোকার, জাহেদের ‘চিরকালের বন্ধু’ ঈমান, যখন বলে, ‘ওরে পঙ্খীরে পঙ্খী, তোর কত যে নিশানা!’
ঈমানের সঙ্গে এই মনস্তাত্ত্বিক খেলার এবং ঈমান যা বলে তার কোনো কূলকিনারা করতে পারে না জাহেদ। বিস্ময়াভিভূত জাহেদের আরও অনেক অনেক কিছু মনে হতে থাকে, আর জাহেদ বুঝতে পারে এই জগৎ সংসার ও জীবন আসলে নক্ষত্রের আলো আড়িয়াল খাঁর পানিতে পড়ে গুপ্তধন হয়ে যাওয়ার থেকেও আরও অনেক অনেক জটিল এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ঈমান যা যা কিছু বলে, তার মত বা সম্ভবত তার থেকেও অনেক জটিল।
তার মনে পড়ে তার বড় ভাই শাহেদের চোরকে পেটানোর কথা, তার নানির কথা যে মারা গেল তাদের পাশের বাড়ির বারান্দায়, শুয়ে শুয়ে যেহেতু জাহেদের মা তাকে বের করে দিয়েছিল বাড়ি থেকে, মনে পড়ে গোলাপপ্রতিম আঁখির বাপ সামাদ আর মমতার কথা—গোডাউনে কাজ করা মমতা যে সামাদকে দাবি করেছিল তার সন্তানের পিতা বলে, মনে পড়ে তার বন্ধু কাইল্লা কবিরের কথা, রিকশাওয়ালা শামছুর কথা, চিটটাগুড় চাচার কথা, মনে পড়ে তার বড় বোন পারভীন ও তার প্রেমিক নাঈমের কথা—নাঈমের কাছে যে পারভীন দাবি করেছিল মুরাদের জননাঙ্গ কেটে এনে তাকে উপহার দিতে হবে, আর সেটা সে পুঁতে রাখবে টমেটো ঝোপটার সবচেয়ে বড় গাছটার গোড়ায়।
এখানে একটা কথা বলতেই হবে, ‘আড়িয়াল খাঁ’ উপন্যাসে যৌনতা যেভাবে এসেছে, যে রকম সাহসী ও হিমশীতলভাবে ইরোটিক আর নন–ইরোটিকের মাঝখানের শেষ সীমান্তরেখা ধরে এগিয়েছে, সেটা বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ।
এখানে যৌনতা এসেছে সেনসেশনের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা কিছু হয়ে—এলিজাদের জামবাগানে বা আড়িয়াল খাঁ নদের তীরে এসে যখন পারভীন কথা বলে, মেরুদণ্ড বেয়ে এক হিমশীতল বরফের চাঁই নামতে থাকে ধীরে ধীরে।
এখানে এসে আবারও আমার এখানে মনে পড়বে ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসের কথা, যে তিনি বলেছিলেন, ভালো উপন্যাসের কাজ হলো অস্বস্তিদায়ক জিনিসকে স্বস্তি দেওয়া, আর স্বস্তিদায়ক জিনিসকে অস্বস্তিতে ফেলা। পুরো উপন্যাসে আড়িয়াল খাঁ সেটা বারবার ঘটায়।
আর একটা তীব্র জিনিস হলো ‘আড়িয়াল খাঁ’র ভাষা। মাসরুরের উপন্যাসের একটা বড় এবং শক্তিশালী দিক সবসময়ই এর ভাষাগত সৌকর্য, ভাষা ও ভাষার সিনট্যাক্স নিয়ে তাঁর খেলা। এ উপন্যাসে এসে বরিশালের আঞ্চলিকতার সঙ্গে মিশে উপন্যাসের বাংলা ভাষা এক অন্য তীব্রতায় চলে গেছে। ঢেউখেলানো বাতাসের মতো এক ভাষা—যেটা শুধু বারবার কমলকুমার মজুমদার ও অমিয়ভূষণ মজুমদারের পরম্পরার কথা মনে করিয়ে দেয়। ভাষার দিক থেকে মাসরুর অবশ্য সেই পরম্পরারই লেখক।
মাসরুর আরেফিন এই উপন্যাসে পাঠকের প্রত্যাশা আর অভিজ্ঞতাকে এই যে বিভিন্ন পথে, বিভিন্ন গতিতে ভ্রমণ করিয়েছেন; সময়ে সময়ে দিগ্বিদিক শূন্য করে তুলেছেন, শেষ পর্যন্ত জাহেদকে তিনি হয়তো একটা জায়গায়ই নিয়ে যেতে চেয়েছেন। ওমর আলীর সঙ্গে নেতার বাসায় গিয়ে সেখানে চালাকি করে মিথ্যা পরিচয় দেওয়া বাপকে জেল থেকে ছাড়ানোর জন্য, ঈমানের সঙ্গে সার্কাসের আসর থেকে অন্ধকার রাতে নৌকায় উঠে পালানো, জেল থেকে ঈমানের চিঠি পাওয়া, আর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়া বা লাখুটিয়ার খালে এসে লুকিয়ে থাকার রাতে ওমর আলীর সঙ্গে আড়িয়াল খাঁর বুকে নৌকায় যাত্রা করা—সবকিছুর মধ্য দিয়ে এসে মাসরুর আরেফিন জাহেদকে এক বৌদ্ধিক অভিজ্ঞতার, এক বৌদ্ধিক জীবনবোধের সামনাসামনি দাঁড় করিয়েছেন। এমন এক জায়গায় দাঁড় করিয়েছেন, যেটা জীবন ও ব্রহ্মাণ্ডের অর্থ আর নিরর্থকতার বাইরের একটা ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’।
যেখানে দাঁড়ানোর পরে আপনার মনে হবে, যেমন আমার হয়েছে, জীবনে প্রত্যেকেরই অবশ্যই অন্তত একবার নক্ষত্রভরা রাতে গুপ্তধনের সন্ধানে আড়িয়াল খাঁর বুকে নৌকাযাত্রা করা প্রয়োজন।