পশ্চিমের সংগীত, আমাদের সংগীত

এ বছর কালজয়ী কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র জন্মশতবর্ষ। আসছে ১৫ আগস্ট ১০০ বছর হবে তাঁর

ইতালির তাসকানিতে ১৯৬০ সালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌ (১৫ আগস্ট ১৯২২—১০ অক্টোবর ১৯৭১)ছবি: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌: মাই হাজব্যান্ড অ্যাজ আই স হিম বইয়ের সৌজন্যে

আমাদের সংগীতের ঐতিহ্য বেশ দীর্ঘ। এর আছে এক দৃঢ় আর বিস্তৃত ভিত্তি ও পদ্ধতি। তবে এখনো পশ্চিমে আমাদের সংগীতকে অদ্ভুত কোনো বস্তু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পশ্চিমের খুব কম মানুষই অবশ্য আমাদের সংগীত বুঝতে পারার দাবি করতে পারেন।

আনকোরা কোনো গান শুনতে গেলে একটা ব্যাপার আমরা ভুলে যাই। তা হলো, লোকসংগীতের মতো সরল সুর আর সহজ মানবীয় আবেগের প্রকাশের ওপর নির্ভরশীল নয়, এমন কোনো বিকশিত বিদেশি সংগীত পুরোপুরি একটি দেশাচারের ব্যাপার। উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরে নিই, আপনি বিটোফেন পছন্দ করেন। সে ক্ষেত্রে আপনি ধরেই নেবেন যে পৃথিবীর যে কেউই বিটোফেনের সংগীতের তারিফ করবে। কিন্তু যদি বিটোফেন শুনতে অনভ্যস্ত পাকিস্তানের (অধুনা বাংলাদেশ) কোনো গ্রামের মানুষকে আপনি তা শোনান,দেখবেন, সেই লোক এর তারিফ তো করবেনই না, বরং তাঁর কানে তা নিতান্ত আজব শোনাবে। এই সহজ কথা মনে রাখলে হয়তো যে সংগীত আমাদের নয়, তার প্রতি আমরা আরেকটু সহানুভূতিশীল হতে পারব।

আমাদের সংগীতের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। অতীতে শিকড় গাড়া যেকোনো কিছুর মতোই এর উৎস হারিয়ে গেছে পুরাণকথা আর কিংবদন্তিতে। প্রাচীন সংগীতবিজ্ঞানী আর ইতিহাসবিদেরা বিজ্ঞানের পাটাতনের ওপর রেখে জটিল সংগীততত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছেন। পাশাপাশি সংগীতের সরল তথ্যে দৈবকে মিশিয়ে কাল্পনিক গল্পও ফেঁদেছেন। সংগীত নিয়ে সবচেয়ে পুরোনো বইগুলোর মধ্যে একটি রিকপ্রতিসাক্ষ্য। লেখা হয়েছিল আনুমানিক ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। বইটি ছিল সত্য আর কল্পনার মিশেল। মজার ব্যাপার হলো, এর কিছুটা আগেই পিথাগোরাস গ্রিকদের জন্য এক বিস্তৃত সংগীততত্ত্ব গড়ে তুলেছিলেন।

এখানে চিত্তাকর্ষক একটা ব্যাপার লক্ষ করা যায়, আমরা জানি না কে কাকে প্রভাবিত করেছে, তবে আমাদের দেশ আর গ্রিসে গড়ে ওঠা সংগীততত্ত্বে প্রচুর মিল। প্রথমত, দুই সংগীতপদ্ধতিতেই কিংবদন্তি আর ইতিহাসের মিশ্রণ একই রকম। দ্বিতীয়ত, দুটোতেই গড়ে তোলা স্বরের পর্দায় বা স্কেলের ফাঁক কমবেশি এক। গ্রিসে অষ্টককে ভাগ করা হয়েছিল চব্বিশটি ছোট অংশে। আর আমাদের সংগীতের স্কেলে এর ভাগ বাইশটি। অনেকেই বিশ্বাস করেন, ইতিহাসের কোনো একসময় আমাদের স্কেলও গ্রিসের মতো চব্বিশটি ছোট অংশে ভাগ করা হতো। এ ছাড়া গ্রিসের দুটি আদিতম স্কেল ডরিক ও মিক্সোলাইডিকের সঙ্গে আমাদের দুই আদি স্কেলেরখুব মিল পাওয়া যায়। এখানেই শেষ নয়। দুই সংগীতপদ্ধতিতেই ছন্দ আর সময় পরিমাপের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

এসব থেকে অনুমান করা যায়, একসময় এই দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান ঘটত পর্যাপ্ত। এটি খুবই সম্ভব যে আমাদের আদি সংগীততত্ত্বে গ্রিকদের সরাসরি প্রভাব পড়েছে। আমাদের দেশের ভাস্কর্যে যে অন্তত গ্রিক প্রভাব পড়েছিল, কান্দাহার জেলার গান্ধারায় সে ইতিহাসের নজির রয়ে গেছে। জায়গাটি একসময় ছিল ইন্দো-গ্রিক সংস্কৃতির বিরাট কেন্দ্র। গ্রিক স্কেলের সঙ্গে ব্যাপক সাদৃশ্য থাকায় একটি স্কেলের নাম ছিল গান্ধার স্কেল। তবে খোদ গ্রিক সংগীত লক্ষণীয় রকম প্রভাবিত ছিল প্রাচীন পারস্য আর এশিয়া মাইনরের সংগীত দিয়ে। লিডিয়ার নামে নাম রাখা স্কেলগুলোয় সেটি দেখাযায়। তবে এখনকার মতো সমস্যাটিকে হয়তো সমাধান করা যায় এই বলে যে দুটি সংগীতপদ্ধতির উদ্ভব ঘটেছে একই আর্য উৎস থেকে।

অষ্টককে ছোট অংশে ভাগ করাও আরেক বিস্ময়কর ব্যাপার। আমাদের দেশ আর গ্রিসের সংগীতবিজ্ঞানীরা প্রতিটি স্বরের কম্পনের পরিমাণ জানতেন। এই কম্পন পরিমাপের জন্য এ যুগের মতো কোনো বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি তাঁদের ছিল না। তাঁদের পরিমাপ যে একেবারে নিখুঁত ছিল, তা-ও অবশ্য নয়।

স্কেল

আজকের পশ্চিমা স্কেলের মতো আমাদেরও এখন একটি নির্ধারিত স্কেল আছে। তবে নিজেদের আদি স্কেলের বিকাশ সম্পর্কে আমাদের স্পষ্টভাবে জানা নেই। শুধু এটুকুই জানতে পারি যে সেটি ছিল চারটি স্বরের ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা। এই চার স্বর ছিল আর্যদের স্কেল। আদি গ্রিক স্কেলও ছিল চার স্বরের ভিত্তিতে তৈরি। কিন্তু ভারতীয় আদি স্কেল গ্রিকদের মতো আরোহী না হয়ে অবরোহণের দিকে বিস্তৃত হতো। কালের পরিক্রমায় পঞ্চম একটি স্বর প্রতিষ্ঠিত হয়ে স্কেল হয়েছে পাঁচ স্বরের। পৃথিবীর যেকোনো অংশে এখনো পাঁচ স্বরের স্কেল পাওয়া যায়। এরপর স্পষ্টতই বাদ্যযন্ত্রের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে আরও দুটি স্বর গৃহীত হয়। এভাবে স্কেল হয়ে যায় সপ্তস্বরের। তবে দীর্ঘদিন দুটো ভিন্ন স্কেল পাশাপাশি টিকে ছিল-একটা মানুষের গলার জন্য অবরোহী, আরেকটা বাদ্যযন্ত্রের জন্য আরোহী।

আমি বলেছি যে গ্রিক স্কেল আর আমাদের স্কেল দুটোই ছিল অনেক ফাঁকে বিভক্ত। শ্রুতি (মাইক্রোটোন) হলো অর্ধস্বরের (সেমিটোন) বিভাজন। তবে শ্রুতির ধারণাটি বিভ্রান্তি তৈরি করে। কারণ,আমাদের স্কেল এখনো বাইশ পর্বে বিভক্ত বলে মনে করা হয়। সাধারণত পশ্চিমা শ্রোতারা মনে করেন, তাঁদের পক্ষে আমাদের সংগীতের তারিফ করা সম্ভব নয়, এর কারণ আমাদের গানে শ্রুতির ব্যবহার। আদতে অর্ধস্বরের শ্রুতিতে বিভাজন যতটা না সংগীতজ্ঞদের, তার চেয়ে বেশি গণিতজ্ঞদের কাজ। যদি এই শ্রুতির কার্যকারিতা আর নন্দনতাত্ত্বিক উপযোগ মেনে নিই, তাহলে আমরা বর্তমানের পশ্চিমা অষ্টককে অন্তত বাইশটি শ্রুতিতে ভাগ করব এবং এতে পশ্চিমা সংগীতের কোনো হেরফের হবে না। উল্লেখ্য, বিংশতিতম সন্ত গ্রেগরির আগে গ্রিক স্কেলনির্ভর পশ্চিমা স্কেল চব্বিশ পর্বে ভাগ করা হতো।

আমাদের সংগীতের সুরের ভিত্তিকে ‘রাগ’ বলা হয়। এটি আসলে পশ্চিমা স্কেলের বিকল্প। রাগ নিছক অষ্টকের ভেতর বিভিন্ন স্বরের ভিন্ন ভিন্ন চলন। নির্দিষ্ট স্থির স্বর এবং নির্দিষ্ট স্বরের চলন অনুসারে একটি রাগ অন্য রাগ থেকে আলাদা। রাগ সুরের ধরন ছাড়া অন্য কিছু নয়। কিন্তু যেহেতু আমাদের সংগীত আবশ্যিকভাবেই সুরাশ্রিত এবং এর ইতিহাস যেহেতু খুবই দীর্ঘ, তাই রাগের বিকাশের ইতিহাসও বেশ জটিল। আর স্বাভাবিকভাবেই রাগের ওপর বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। একসময় ধারণা করা হতো, রাগের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। তবে এখন গ্রহণ করা হয় ছয়টি প্রাথমিক রাগ আর কিছু গৌণ রাগের চলনকে। কেউ কেউ অবশ্য দাবি করতে পারেন, এসবরাগ বাঁধাধরা, এগুলোয় কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাগগুলোতে নিরন্তর বিবর্তন হয়ে আসছে, তারা নতুন সুর ধারণ করেছে, পুরোনো রাগ থেকে সৃষ্টি হয়েছে নতুন রাগের। একসময় এমন বলা হতো, রাগগুলোর সঙ্গে মহাজাগতিক শক্তির যোগ রয়েছে। তবে আজকাল রাগসম্পর্কিত এ রকম গালগল্পে আর তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আবার এমন বিশ্বাসও ছিল যে রাগগুলো মানুষ ও প্রকৃতিকে গ্রহ-নক্ষত্রদের মতোই প্রভাবিত করতে পারে। মানুষ একসময় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত, একেকটি রাগ দিনের নির্দিষ্ট সময়েই গাইতে হবে, যেহেতু সেগুলো মানুষের নির্দিষ্ট আবেগ বা মনের ভাবের সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে চব্বিশ ঘণ্টাকে ভাগ করা হয়েছিল আট প্রহরে, প্রতিটি প্রহরের জন্যই ছিল সুনির্দিষ্ট রাগ। বিভিন্ন ঋতুর জন্যও রাগ নির্দিষ্ট ছিল।

আমরা যদি রাগকে আনন্দ আর বেদনা হিসেবে ভাগ করি, তাহলে দেখব যে বেদনার রাগগুলোতে গড়ে তিনটি খাদের সুর আর আনন্দের রাগগুলোতে গড়ে দুটি খাদের সুর রয়েছে। যদি রাগগুলোকে প্রভাত আর সন্ধ্যার রাগে ভাগ করি, দেখা যাবে, প্রভাতের রাগগুলোতে থাকে ‘জি’(g) স্বরের প্রাধান্য এবং সন্ধ্যা রাগে ‘ই’(E) স্বরের।

গমক

আমাদের সংগীতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হলো এর লাবণ্য, যাকে বলে গমক। আমাদের সংগীত প্রামাণিকভাবেই অলংকারসমৃদ্ধ। এর প্রতিটি সম্ভাব্য কৌশলই ব্যবহৃত হয় নির্দিষ্ট সুরের মধ্যে থাকা সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে—তা সে গান বা বাজনা যা-ই হোক না কেন। আর আমাদের সংগীতে গমকের ব্যবহার প্রায় সীমাহীন। কারণ তা ঐকতানভিত্তিক নয়।

দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, পশ্চিমা কণ্ঠ বা যন্ত্রসংগীতে গমকের মতো কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে দূরবর্তী একটা তুলনা হয়তো দেওয়া যেতে পারে পশ্চিমা সংগীতের ট্রিলের (স্বরের কম্পন) সঙ্গে। তবে দুটোর লক্ষ্য এক নয়। পশ্চিমা সংগীত একটি স্বর থেকে আরেকটি স্বরের পথে বহু বৈচিত্র্যের অনুমতি দেয় না। পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্রে তারগুলো অপেক্ষাকৃত মোটা আর টানটান করে বাঁধা থাকে। তাতে প্রতিটি স্বর একক সম্পূর্ণ-শরীর স্বর তৈরি করে। আর আমাদের বাদ্যযন্ত্রে তা থাকে শিথিল অবস্থায়। এতে করে প্রতিটি স্বর বিভিন্ন সুরের তারতম্য তৈরি করতে পারে। অন্যভাবে বললে, আমাদের বাদ্যযন্ত্রের তারগুলোতে লক্ষণীয় রকম বিচ্যুতি ঘটানো সম্ভব।গমকের প্রধান উদ্দেশ্য হলো আলো-ছায়ার নানা পর্দা ব্যবহার করে প্রতিটি স্বরের পূর্ণ তাৎপর্য প্রকাশ করা।

গুঞ্জন

আমাদের পুরো সংগীত গুঞ্জনধ্বনিতে গাওয়া ও বাজানো হয়। এই গুঞ্জনধ্বনি সম্ভবত পশ্চিমা ঐকতানের জায়গা নেয়, পাশাপাশি সুরের জন্যও চমকপ্রদ প্রেক্ষাপট গড়ে তোলে। এটি না হলে আমাদের সংগীতকার ও বাদকেরা দিশাহারা বোধ করবেন।

গুঞ্জন সাধারণত উদ্‌গত হয় তানপুরা থেকে। যদিও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রেরও নিজস্ব গুঞ্জন আছে।

আবার অনুষঙ্গী গুঞ্জন দেওয়া হয় সমবেদী তার দিয়ে, যার সংখ্যা হতে পারে বাইশটি পর্যন্ত। তারগুলো সরাসরি মূল তারের নিচে থাকে। সমবেদী তারগুলো তাদের ওপরের মূল তারগুলো সঙ্গেই কেবল বাজানো হয়। এ সময় এই সমবেদী তারগুলোর ধ্বনি এক মোহনীয় পট সৃষ্টি করে, তৈরি হয় সূক্ষ্ম একগুচ্ছ ধ্বনি, আর সেটি গড়ে তোলে এক জমজমাট ঐকতান।

নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংগীতের সবচেয়ে বিকশিত দিক হলো সময়ের পরিমাপ, যাকে বলা হয় ‘তাল’। এটি আমাদের সংগীতের খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট। আমাদের মধ্যে পশ্চিমা সংগীতের অনেক শিক্ষার্থী আছেন, যাঁরা এই সময়ের পরিমাপকে পশ্চিমা সংগীতের তুলনায় অনেক বিকশিত বলে মনে করেন।

আমাদের দেশে সংগীতের এই তালের উদ্ভব ঘটেছে মূলত কবিতার ছন্দ থেকে। প্রাচীনকালে কাব্যে ব্যবহৃত অক্ষরের সঠিক মানের ওপর খুব গুরুত্ব দেওয়া হতো। উচ্চারণের ধরন যেমনই হোক, কাব্যে ব্যবহৃত অক্ষরের উচ্চারণের কাল-দৈর্ঘ্য ছিল মূল উপজীব্য। উনিশ শতক অবধি আমাদের দেশে গদ্যের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। এর ফলে আমাদের সংগীতে সময়ের পরিমাপের অসাধারণ বিকাশ ঘটেছে। গড়ে উঠেছে সীমাহীন ছন্দবৈচিত্র্য। ছন্দের এসব দল শুধু গাণিতিকভাবেই নিখুঁত নয়, নন্দনতাত্ত্বিকভাবেও মনোরম।

পশ্চিমা ও আমাদের সংগীতের ভিন্নতা

পশ্চিমে আমাদের সংগীত নিয়ে এখনো কিছু ভুল ধারণা আছে।সাধারণভাবে মনে করা হয়, আমাদের ব্যবহার করা শ্রুতির কারণে পশ্চিমাদের শ্রবণেন্দ্রিয় আমাদের সংগীতের তারিফ করতে পারবে না। ধারণাটি একেবারেই ভুল। এখানে আসলে গমককে শ্রুতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়।

আরেকটি ভুল ধারণা এই যে আমাদের আর পশ্চিমের ব্যবহার করা স্কেল আলাদা। পশ্চিম ও আমাদের উভয়ের ব্যবহার করা স্কেল অষ্টকভিত্তিক।

এই দুই সংগীতপদ্ধতির ভিন্নতা হলো:

১. আমাদের সংগীত পুরোপুরি সুরভিত্তিক, অথচ পশ্চিমের গান ঐকতানভিত্তিক। অন্যভাবে বললে, আমাদের গান গড়ে উঠেছে পুরোপুরি সুরের ধারা অনুযায়ী; পশ্চিমা সংগীত গড়ে উঠেছে ঐকতানের জগতে—বহু সুরে, এক সুরের ওপর অন্য সুরের সংযোজনের উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে। পশ্চিমা সংগীতে এই পরিবর্তনের আগপর্যন্ত এই দুই সংগীতপদ্ধতি মোটামুটি একই ছিল।

২. আমাদের সংগীতের সুর একটি নির্দিষ্ট মেজাজের ছাঁচে তৈরি হয়েছে। এই মেজাজের মধ্যে কোনো ভিন্নতা আমলে নেওয়া হয় না। আর এখানে প্রতিটি বাদ্যযন্ত্রই সেই মেজাজ পরিপূর্ণভাবে প্রকাশের জন্য বাজানো হয়। কিন্তু পশ্চিমা সংগীত কেবল একটি মেজাজে ঢেলে তৈরি হয় না। এ জন্য কোনো অনভ্যস্ত কান পশ্চিমা সংগীতের ধ্বনির বহুমুখিনতায় দিশাহারা হয়ে যায়। কারণ, প্রতিটি সুরের একটি সুনির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোতেই তা অভ্যস্ত।

৩. এরপরের বড় ভিন্নতা হলো, আমাদের সংগীতে গমকের ব্যবহার।

৪. পশ্চিমা শ্রবণেন্দ্রিয় নির্দিষ্ট সুরে বাঁধা স্কেলের একটি স্থির ফাঁকে অভ্যস্ত। আমাদের গানে সেটি নেই। এ জন্য বিভিন্ন ফাঁকসমন্বিত সংগীতের তারিফ করা পশ্চিমাদের পক্ষে কঠিন।

৫. এসব ছাড়া দুই সংগীতের মধ্যে রয়েছে সময় পরিমাপের ভিন্নতাও।

লেখা প্রসঙ্গে

কথাসাহিত্য ছাড়া আরও নানাকিছু নিয়ে লিখেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌। শিল্পকলা বিষয়ে এ লেখকের মননশীল রচনা যেমন আছে, তেমনি সংগীত নিয়ে ইংরেজিতে লেখা তাঁর একটি রচনা সম্প্রতি পাওয়া গেছে। পশ্চিমের ও ভারতীয় সংগীতের বৈশিষ্ট্য ও মিল-অমিল নিয়ে ‘মিউজিক’নামের এই প্রবন্ধ ১৯৫৭ সালে জাকার্তায় বসে লিখেছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌। ইংরেজিতে টাইপ করা নয় পাতার পাণ্ডুলিপির প্রথম পৃষ্ঠার ওপরে হাতে লেখা তারিখটি অন্তত তা-ই বলে।

টাইপ করা এই পাণ্ডুলিপির বিভিন্ন স্থানে নিজ হাতে বিস্তর কাটাকুটি করেছেন লেখক, যোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে দুই ঘরানার সংগীত সম্পর্কে তুলে ধরেছেন পর্যবেক্ষণ ও নিজস্ব মতামত।

ইংরেজি এই প্রবন্ধ আগে কোথাও প্রকাশিত হয়েছিল কি না, তার সঠিক হদিস পাওয়া এখন দুষ্কর। তবে এটি বলা যায় যে লেখাটি এই অঞ্চলে আগে প্রকাশিত হয়নি, আর বাংলা ভাষায় তো নয়ই। ফলে আমাদের দেশের বাস্তবতায় প্রবন্ধটি দুর্লভ তো বটেই, একে অপ্রকাশিত রচনার পর্যায়েও গণ্য করা যায়। আমাদের ধারণা, লেখাটি অসম্পূর্ণ।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র জন্মশতবর্ষে দুর্লভ এই লেখা প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষায় অনূদিত হলো।

অনুবাদ: জাভেদ হুসেন