শীতকাল আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে

অলংকরণ: আরাফাত করিম

সবখানেই হিম আর কুয়াশা। শীতে মাঠে নাড়ার আগুন জ্বালিয়ে ফেরা সন্ধ্যা ছিল আমাদের, একদা। আর এখনকার শীতকাল আগুনের গন্ধমাখা, মোটেই ‘মন কেমন করা’ নয়। তবে কেমন এই শীতকালের রূপ?

আমরা যাচ্ছিলাম, আমরা যেন কোথায় যাচ্ছিলাম? গ্রামের পরে গ্রাম, আমরা যাচ্ছিলাম। একটা শুকনো নদী। নদীতে বাঁশের সাঁকো। আমরা সাঁকো পার হলাম। আমরা কোথায় যাচ্ছিলাম? নদীর ওপারে মাঠ, মাঠে ছড়ানো শর্ষে ফুলের হলুদ, আমরা হলুদ রঙের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। দেখি, আস্তে আস্তে রোদ পড়ে যায়। এবার কুয়াশা দেখার পালা। সন্ধ্যার আগেই নেমে আসে কুয়াশা। কুয়াশা কি আমাদের ঘিরে ধরছিল? তখন কিন্তু বুঝতেই পারিনি, সেই গ্রাম কবিতায় ঝুপ করে নেমে আসবে একদিন। বুঝতে পারিনি, বাঁশের সাঁকোটি কীভাবে কবিতা হয়! ভ্যান গঘের গমখেত যতটা বিখ্যাত, ততটা কি বিখ্যাত শর্ষে ফুলের লাবণ্য? ‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতো’ নেমে আসা সন্ধ্যা কত কবিতায় তারাবাতি হয়ে জ্বলে উঠল পরে, সেদিন তা বুঝতে পারার মতো অভিজ্ঞতা ছিল না; এবং আজ যদি স্ক্যান করে দেখি, দেখব, অসংখ্য কবিতার ভেতরের কুয়াশা লেপটে আছে। কবিতা পড়তে গেলেই দেখি কুয়াশায় সাদা হয়ে আছে গ্রন্থের পৃষ্ঠা, এগোনো যাচ্ছে না। মাঠের পরেই নদী—নদী ও  কুয়াশা সহচর হয়ে আছে। বাংলাদেশের নদীরা ঢুকে পড়েছে কবিতায়, কবিতার নদীতে ঢেউ আছে আজ? নাকি বালুচর, কবিতার মধ্যে? চাই বা না চাই, ভরপুর দানা বেঁধে আছে কুহক-বিভ্রম! কোথায় যাচ্ছি আমরা? কোথায় গন্তব্য আমাদের? শীতকাল আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? 

বসন্তের দিকেই যাওয়ার কথা কিন্তু বসন্তের সঙ্গে হয়তো আমাদের দেখাই হয়নি! আমরা বানিয়ে তোলা বসন্তকে কবিতায় রোপণ করেছি। সেখানে লিখিত বর্ণের পাখি ও ফুল ফুটেছে। ভালোবাসা লিখিত হয়েছে। ভালোবাসা কি লিখিত হওয়ার কথা? লিখিত বর্ণের ফুল থেকে কি ঘ্রাণ পাওয়া যায়? লিখিত পাখি কি ডাকে? ডানা মেলে ওড়ে আকাশে? বাংলা ভাষার থরে থরে শুধু দুঃখগাথা রচিত হয়ে আছে। তরুণ-তরুণীদের মনে জমে আছে বিরহের স্তূপ। বয়স্করা বিষণ্ন এখানে। শিশুদের কান্নায় পাড়া জাগে। যেনবা কোথাও কিছু ঠিকঠাক নেই। নদীগুলো দখল হয়ে গেছে। থানা-পুলিশ-আদালত-কয়েদখানা-হাসপাতালই মুখ্য প্রতিষ্ঠান আমাদের। এ কেমন জীবন আমাদের? কৃষক ও শ্রমিকের মুখে আঁকা দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্র! সবখানেই হিম আর কুয়াশা। যেন কেউই তার পছন্দের কাছে পৌঁছাতে পারছে না! ছেলেটির ভালোবাসা মেয়েটির কাছে ধর্তব্য হচ্ছে না। মেয়েটির চাওয়া–পাওয়া কেউ বুঝতে চাইছে না। মা তার হারানো সন্তানের ফেরার পিপাসা নিয়ে নির্ঘুম রাত্রির জানালায় চোখ মেলে আছে যেন সহস্র বছর! বাবা যেন হতবাক, তার ছেলে ইয়াবা ধরেছে! স্বাধীন দেশের পাসপোর্ট পকেটে করে বেঁচে থাকার আশায় জীবিকার সন্ধানে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরছে কতজন? কোনো তালিকা আছে? জীবনের প্রয়োজনে কত নারী গতর–শ্রমিকের জীবন নিয়ে মরুভূমির দেশে গিয়ে শিকার হয়ে ফেরেনি আর? তালিকা আছে? পোশাক নির্মাণশ্রমিকের শরীর দেখতে কেমন? তার শরীরের পোশাকের কী হাল? না। এসব নিয়ে বাংলা কবিতার কবিরা বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন। যেনবা পোশাকশ্রমিক বা ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরা মানুষেরা আমাদের কেউ নয়। আমাদের শুধু বকুলতলা, আমাদের শুধু ঋতুকীর্তন, আমাদের শুধু ক্ষমতার কাছে নত হওয়া! ক্ষমতাহীনের ভাই হতে পারছি না আমরা! ক্ষমতাহীনের বোন ভরসা পাবে কার কাছে? 

এই শীতে মাঠে নাড়ার আগুন জ্বালিয়ে ফেরা সন্ধ্যা ছিল আমাদের, একদা। এখন ‘কিশোর গ্যাং’–এর কাল। এই শীতে আগুন জ্বলেছে বাসে, চলন্ত ট্রেনের বগিতে। মা তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে পুড়ে মরেছে। মানুষ মরেছে মানুষের দেওয়া আগুনে। সে মানুষ কে? সেই মা কে? উনিশ শ একাত্তরে যাঁরা জীবন দিলেন, তাঁরা কারা? যে মা ও বোনের শরীর রক্তাক্ত হলো, লুণ্ঠন হলো, প্রাণ বলিদান হলো, তাঁরা কারা? এখনো পাড়ায় পাড়ায়, ঘরে ঘরে যত কান্না—এসব ধারণ করতে পারেনি বাংলা কবিতা। বাংলাদেশের কবিরা ব্যর্থ বৃহত্তর মানুষের আকাঙ্ক্ষার কাছে পৌঁছাতে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের অনুভূতিপুঞ্জ ব্যক্ত করতে করতেই ফেনা তুলতে থাকেন। আবার এ–ও আশা করেন যে অনেক পাঠক তাঁর বই কিনে নিয়ে যাবে। কী অদ্ভুত! যে রাজনৈতিক ক্ষমতা গণমানুষের স্বার্থের বিপরীতে যেতে থাকে, তার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারায় যদি কোনো কবি বা সাহিত্যিক লজ্জা বোধ না করেন, তাহলে তাকে কী বলা যায়? এ রকম সময় আমাদের পার করতে হচ্ছে, বেশির ভাগ কবিতাই আর বৃহত্তর মানুষের কাছে পৌঁছাতে অসমর্থ। মানুষ প্রাণী হিসেবে যেহেতু রাজনৈতিক, অতএব রাজনীতিকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কবি যেহেতু মানুষও বটে, রাজনীতির বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই তাঁরও। অর্থাৎ কবিতাও রাজনীতির বাইরে নয়, তা যদি বিরহের কবিতাও হয়। তাই ‘রাজনৈতিক কবিতা’ বলে যে কথাটা আলাদা করে চালু করা হয়েছে, তার আর হেতু নেই। প্রেমিক নিজের মনের অবস্থান ব্যক্ত করে যা বলতে চান, তা–ও রাজনীতি। কথা হচ্ছে, সেটা কার বা কাদের পক্ষের রাজনীতি? আধিপত্যবাদী ক্ষমতার পক্ষের, নাকি ক্ষমতাকে মোকাবিলার পক্ষের? সেই ভাবনা যার যার নিজের, কেউ চাপিয়ে দিতে পারবে না। যখন স্বাধীনতার কবিতা লেখা হচ্ছে, তখন স্বাধীনতা কতটুকু আছে—এই প্রশ্ন জরুরি হয়ে ওঠে। 

মনই একটা দেশ। এখন সেই দেশে শীতকাল এসেছে? সেই দেশে কি এখন শর্ষে ফুল হলুদ করে রেখেছে মাঠ?

মনই একটা দেশ। এখন সেই দেশে শীতকাল এসেছে? সেই দেশে কি এখন শর্ষে ফুল হলুদ করে রেখেছে মাঠ? সে দেশে যে নদী আছে, সেই নদী কি ক্ষমতাশালী কেউ দখলে নিয়েছে? সেই দেশের মানুষেরা কি কবিতা পড়ে? সেই দেশের মায়েদের ডাকনাম কি উৎকণ্ঠা? সেই দেশেও কি সন্তানেরা অপঘাতে মরে? সেই দেশে কি রক্তপাত হয়? ফুটপাতে অভুক্ত নারী-শিশু ও বৃদ্ধরা ঘুমাতে যায় মাঝরাতে? ঢাকা শহরে কিন্তু এ রকম দেখা যায়। সত্যিই দেখা যায়। পাশ দিয়ে হেঁটে যাই আমরাই। আমাদের নীতিবোধ, ধর্মবোধ ও মানবিকতা দিয়ে আমরা থমকে যাই না। ঘরে ফিরে কবিতা লিখি, গল্প লিখি। সেই কবিতা, সেই গল্প, সেই শিল্পকলা কোথায় যায়? এসব লেখা জীবনের অপচয় করা কি না—এই প্রশ্ন উঁকি দেয় মনে। আবার মন! মনকে এড়িয়ে আমরা থাকতে পারব না। মনে হয়, বাংলাদেশে শীতকাল আসুক। ফুটপাতে যারা ঘুমায়, তাদের ঘরের ব্যবস্থা হোক। কিন্তু ব্যাপারটা তো রাজনৈতিক। কাজেই রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধান সামগ্রিক মানুষের ভালো থাকার জন্যই জরুরি। ছেলেমেয়েরা যে পরস্পর মিশতে পারে না, পারিবারিক ও  সামাজিকভাবে বাঁধা—এ–ও তো রাজনীতির বাইরে নয়। সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। এর কোনো সম্ভাবনা দেখা যায় কি? উত্তরাধিকারসূত্রে বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করছেন কবিগণ, লেখকেরা, তাহলে বাংলার গোটা সমাজব্যবস্থাকে পাশ কাটানোর সুযোগ তো নেই। শুধু নিজে ও নিজের পরিবার নিয়ে ভালো থাকব—এমন চেতনায় তো উৎকৃষ্ট সাহিত্য হবে না, হয়ও না। না হলেও ‘হয়’—এই দাবি স্বৈরতান্ত্রিক। অন্য কাউকে ‘স্বৈরাচার’ বলে গালি দেওয়ার আগে নিজের স্বৈরাচারী মনোভাব আমরা লুকিয়ে কথা বলি কেন?  

‘ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো’—ঋত্বিক ঘটকের এ বার্তা তো শুধু টি–শার্টে লিখে ঘুরে বেড়ানোর নয়। মৃত সন্তান প্রসব করার মতো কবিতা নয়, জীবিত কবিতার প্রসব দরকার, তবেই না তিনি তরুণ কবি। শুধু কাতরামো করা কিছু বাক্য জড়ো করে লিখে ‘প্রেমের কবিতা’ বলে চালিয়ে যাওয়ার দিন তো অনেক দেখা গেল। ওতে কিছু হয়নি। জীবিত কবিতা জরুরি। যে কবিতার উচ্চারণ থেকে আমরা ওঙ্কার পেতে পারি। আদিতে ওঙ্কার ধ্বনি ছিলেন, ধ্বনি শব্দ ছিলেন, শব্দ বাক্য ছিলেন—এই শ্লোক কি আমরা জানি না? দায় শুধু কবিদের ওপরেই বর্তাবে কেন? গান-কবিতা-চলচ্চিত্র-নাটক বা সামগ্রিক শিল্পকলাতেই শীতকাল আজ। পৃথিবী শীতঘুমে বেঘোর। এই শীতনিদ্রা কবে ভাঙবে, কখন ভাঙবে? 

দলীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারার ক্ষমতাসম্পন্ন কবিতা দরকার। সামাজিক মানুষকে প্রভাবিত করতে পারার ক্ষমতাসম্পন্ন ট্যাবু ভাঙা গল্প–উপন্যাস দরকার। এর বাইরে ম্যাড়মেড়ে লেখা দিয়ে বই হতে পারে, বইমেলায় তা পাঠকের হাতে গছিয়ে দেওয়াও যেতে পারে, তাতে ফল কী? কিছু নামডাক ও অর্থ পেলেও আদতে তা বিফলে পতিত। এই অর্থে লেখালেখি তখন কেরানির কাজ। কেরানি যতই যা করুক না কেন, কেরানির কাজ বেশি মানুষকে ভাবায় না। তাই কেরানি-কবিতার অহেতুকতা থেকে বাঁচতে ক্ষান্ত দরকার। অহেতুকতার গ্রন্থাবলি ছাপানো থেকে কাগজ বাঁচানো দরকার। অহেতুক কাগজ ব্যবহার কমাতে পারলে গাছ বা বনভূমি বাঁচে। মানুষ অক্সিজেন পাবে পর্যাপ্ত। পরিবেশ সংরক্ষণ হয়। পৃথিবীর ভারসাম্য থাকে। এমনিতেই উৎপাদন বাড়াতে প্রকৃতির বিনাশ ঘটিয়ে কলকারখানার নামে পরিবেশ ধ্বংস করে আজ পৃথিবী বিপদের মুখোমুখি। ভাবার সময় আজ। ভেবে, সেই অনুযায়ী কাজ করার সময়ও। এখনো সেই পচা পচা লুতুপুতু প্রেম নিয়ে ছবি বানানো হচ্ছে। সেখানে একজন নায়ক, এক নায়িকা ও এক ভিলেন আছে। প্রসেনিয়াম থিয়েটারের দশা বেহাল। কারণ, দলীয় রাজনীতির নাটক বেশি ‘ক্লাইমেক্স’ দিচ্ছে। কাজেই অভিনেতার কদর থাকছে না। সেই জায়গা দখলে নিয়েছেন নেতারা। স্তাবকতাই প্রধান গীত, কাজেই নতুন গান আর না হলেও চলবে বলে আপাতত মনে হচ্ছে। চিত্রকলা রাজা–বাদশাহর পোর্ট্রেট মেলাতে ব্যস্ত। সামাজিক মানুষও তার মানুষ হিসেবে থাকা দায়িত্বশীলতা ভুলে যেতে চাইছে। ভালোবাসা দূরে চলে যাচ্ছে। আমরা কি এগোচ্ছি, না, পেছাচ্ছি? আমরা কি ভবিষ্যৎ–মুখী? নাকি অতীতে বুঁদ বেশি? এই দেশ এভাবে টিকে থাকবে? এই প্রশ্ন আমার, নিজের কাছে, আপনার কাছেও, পাঠক! 

গ্রামের পর গ্রাম। আমরা যাচ্ছিলাম। আমরা যেন কোথায় যাচ্ছিলাম? হঠাৎ সামনে নদী। নদীতে বাঁশের সাঁকো। আমরা সাঁকো পার হলাম। আমরা কোথায় যাচ্ছিলাম? নদীর ওপারে মাঠ, মাঠে ছড়ানো শর্ষে ফুলের হলুদ, আমরা হলুদ রঙের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। দেখি, আস্তে আস্তে রোদ নিভে আসে। এবার কুয়াশা দেখার পালা। সন্ধ্যার আগেই নেমে আসে কুয়াশা। কুয়াশা কি আমাদের ঘিরে ধরছিল? তখন কি জানতাম, একদিন বাংলা কবিতার ভেতরে আবার সেই নদী-মাঠ-কুয়াশাকে খুঁজে দেখতে চাইব? সেই সময় ও সময়ের অনেক হারানো মুখ সন্ধান করতে চাইব? যারা ছিল, আজ নেই। আজ যারা আছি, একদিন থাকব না...।