কেন পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠলেন শহীদুল জহির
তিনি লিখেছেন ‘আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই’-এর মতো বেশ কিছু গল্প, লিখেছেন ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ ও ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’র মতো উপন্যাস। তাঁর লেখা সংখ্যায় খুব বেশি নয়। তবে এই লেখাগুলোই আচ্ছন্ন করে তুলেছে পাঠককে। কিন্তু কেন? কেন দিনে দিনে পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠলেন শহীদুল জহির? আজ এই কথাসাহিত্যিকের মৃত্যুদিনে প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা যাক...
কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরকে নিয়ে বাজারে কিছু কথা চালু আছে। সবচেয়ে বড় যে কথাটি তা হলো: জীবদ্দশায় তিনি কোথাও যেতেন না—না সাহিত্যিক আড্ডায়, না কোনো সাহিত্যানুষ্ঠানে। কিন্তু এই ‘অদেখা’ সাহিত্যিকের সাহিত্য হঠাৎই পাঠকপ্রিয়তা পেতে শুরু করল। আর আমরা অনুভব করতে শুরু করলাম যে শহীদুল জহিরের লেখা পড়ার আগের আমরা আর পরের আমরা এক নই! কেন এমন ঘটল? তাঁর লেখার মধ্যে কী এমন আছে, যা আমাদের তীব্রভাবে আচ্ছন্ন করল এবং এখনো করেই যাচ্ছে?নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই বরং লেখাটি শুরু করা যাক।
দক্ষিণ মৈসুন্দি, ভূতের গলি, সুহাসিনী, লক্ষ্মীবাজার কিংবা আগারগাঁও কলোনির মানুষদের গল্পগুলো প্রথম পড়ি আজ থেকে ১৩-১৪ বছর আগে। প্রথমবার এই গল্পগুলো পড়ে একটা ধাক্কার মতো লেগেছিল। তার আগপর্যন্ত গল্প পড়ার যে ধরন-ধারণের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল, তা ছিল একেবারেই আলাদা। সব বাদ দিয়ে প্রথম অনুভূতিটা ছিল, ওহ, এভাবেও তাহলে গল্প বলা সম্ভব! সম্ভব যে বটে, সেটি বুঝতে শহীদুল জহিরের সবটাই পড়ে ফেলি।
শহীদুল জহির তাঁর চরিত্রগুলো নির্মাণ করেন প্রগাঢ় মায়া দিয়ে। আবদুল করিম, শেপালি বেগম, চাঁন মিয়া, আবদুল হালিম, আবদুল মজিদের জন্য আপনি একধরনের মায়া অনুভব করবেন। এমনকি আকাশের দিকে মানুষের মাংস ছুড়ে দেওয়া বদু মওলানার মতো নেতিবাচক চরিত্রগুলোও বহুমাত্রিকতা বা ‘ডায়নামিক’ আকার নিয়ে হাজির হয়। এই চরিত্রগুলো তাই যখন আপনার সামনে আসবে, যখন তাদের সঙ্গে আপনার পরিচয় ঘটবে, আপনি তাদের আর ভুলতে পারবেন না। যে কারণে ময়মনসিংহে যেতে চাওয়া আবদুল করিম কিংবা কখনো উন্মোচিত না হওয়া শেপালি অথবা বান্দরের দুধ খাওয়া পোলারা তাদের উদ্ভট কার্যকলাপের ভেতর দিয়ে বইয়ের পাতা থেকে আমাদের সামনে চলে আসে।
নাহ, অনুভূতি একটুও বদলায়নি। শহীদুল জহির পড়ে তাঁর মতো করে একটা গল্পও লেখা চেষ্টা করেছিলাম মনে আছে। আমার ধারণা, শহীদুল জহির পড়ার পর তাঁর মতো করে লেখার চেষ্টা নিশ্চয় অনেকেই করেছেন। যদিও আমার যখন শহীদুল জহিরের সঙ্গে পরিচয়, তখন পর্যন্ত তাঁর জনপ্রিয়তা আজকের মতো ছিল না। মূলত ২০১২-১৩ সালের পর থেকে কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বেড়েছে এবং তা একপর্যায়ে ‘কাল্ট’ আর এখন রীতিমতো ক্ল্যাসিকে পরিণত হয়েছে।
শহীদুল জহিরের জনপ্রিয়তা নিয়ে ভাবছিলাম। মার্কেজীয় জাদুবাস্তবতাকে অবলম্বন করে শহীদুল জহির অনেক গল্প লিখেছেন, লিখেছেন উপন্যাসও। তাঁর ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসে ১৪টি চিরকুটে ‘তুমি কিছু কও না কেন’ কিংবা টানা ৫৫ বারের মতো যৌন সম্পর্ক জড়ানোর ঘটনার সঙ্গে মার্কেজের ‘নিঃসঙ্গতার এক শ বছর’-এর গরুর গায়ে গরু লিখে রাখার ব্যাপারগুলোর যথেষ্ট মিল পাওয়া যায়। এ ছাড়া গল্পগুলোতে পুনরাবৃত্তিও কম নয়। মোটামুটি নির্দিষ্ট কিছু বৃত্তের ভেতরই গল্পগুলো ঘুরপাক খেতে থাকে। এরপরও প্রতিনিয়ত এর পাঠকপ্রিয়তা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ সম্ভবত তাঁর টেক্সট বা লেখার ভেতরে লুকিয়ে থাকা ঘোর।
শহীদুল জহির বিচিত্র ও স্বতন্ত্র এক গদ্যভাষায় গল্পগুলো লিখেছেন। এ ভাষা আমাদের সাহিত্যে অভিনব। তার আগে এবং পরেও এই ভাষাভঙ্গিতে কেউ তেমনভাবে গল্প-উপন্যাস লেখেননি। এ ক্ষেত্রে যদিও তাঁর পূর্বসূরি হিসেবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বা সৈয়দ শামসুল হকের নাম নেওয়া যায়। তবু এটা বলতে হবে যে তাঁদের কাছ থেকে কিছু বিষয়গতভাবে কিছু উপাদান গ্রহণ করলেও লিখনভঙ্গির জায়গায় শহীদুল জহির ছিলেন একদমই স্বতন্ত্র, অনেকটা নিঃসঙ্গ শেরপার মতো।
ফলে তাঁর গল্প-উপন্যাসের ভাষা এতই ‘ইউনিক’ হয়ে উঠেছে, যা অনুকরণ ও অনুসরণ অসম্ভব। বরং নবীন লিখিয়েদের জন্য তা এক মস্ত ফাঁদেও পরিণত হয়েছে; যে ফাঁদে পড়ে অনেককেই লেখালেখির পথ হারিয়ে ফেলতে দেখা গেছে। তবে এসবের মধ্য দিয়েই নিজেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন শহীদুল জহির।
কেউ যখন প্রথমবার শহীদুল জহির পড়ে, তখন সে এমন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়, যা পুরোপুরি অনভিপ্রেত। তাঁর ভাষাবিশ্ব আপনাকে লম্বা সময়ের জন্য চমকিত ও বিমূঢ় করে রাখবে। এই মুগ্ধতা থেকে হয়তো আপনি বের হয়ে আসবেন, হয়তো আসতে পারবেন না। কিন্তু শহীদুল জহির পাঠের রেশ থেকে আপনি আর কখনোই বের হতে পারবেন না।
শহীদুল জহির তাঁর চরিত্রগুলো নির্মাণ করেন প্রগাঢ় মায়া দিয়ে। আবদুল করিম, শেপালি বেগম, চাঁন মিয়া, আবদুল হালিম, আবদুল মজিদের জন্য আপনি একধরনের মায়া অনুভব করবেন। এমনকি আকাশের দিকে মানুষের মাংস ছুড়ে দেওয়া বদু মওলানার মতো নেতিবাচক চরিত্রগুলোও বহুমাত্রিকতা বা ‘ডায়নামিক’ আকার নিয়ে হাজির হয়। এই চরিত্রগুলো তাই যখন আপনার সামনে আসবে, যখন তাদের সঙ্গে আপনার পরিচয় ঘটবে, আপনি তাদের আর ভুলতে পারবেন না। যে কারণে ময়মনসিংহে যেতে চাওয়া আবদুল করিম কিংবা কখনো উন্মোচিত না হওয়া শেপালি অথবা বান্দরের দুধ খাওয়া পোলারা তাদের উদ্ভট কার্যকলাপের ভেতর দিয়ে বইয়ের পাতা থেকে আমাদের সামনে চলে আসে।
বইয়ের কোনো চরিত্র যদি পাতা থেকে সাধারণ পাঠকের মুখের কথায় জায়গা করে নেয়, তখন সেই চরিত্র ও টেক্সটের জনপ্রিয়তা ভিন্ন মাত্রা লাভ করে। শহীদুল জহিরের ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছে।
অবশ্য শুধু চরিত্রই নয়, স্থান-কালও নিজেদের ‘ইউনিকনেস’ নিয়ে আমাদের পপ-কালচার ও ভাইরাল দুনিয়ার অংশ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে জাদুকে বাস্তবতায় রূপান্তরের কাজটা শহীদুল জহির করেছেন বেশ নিখুঁতভাবে। পাশাপাশি এসব জাদুকর কার্যকলাপের বিশ্বাসযোগ্যতাও তাঁর জনপ্রিয়তাকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।
শহীদুল জহিরের সমসামিয়কতাও তাঁর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। তিনি যখন মুক্তিযুদ্ধের গল্প লিখেছেন, তা তিনি বর্তমানের ভেতর বসেই লিখেছেন। আর সেগুলো এত জীবন্ত হয়ে পাঠকের সামনে হাজির হয়েছে যে এগুলোকে কখনো ধার করা বা আরোপিত মনে হয়নি। জাদুবাস্তবতাকে আশ্রয় করে যে গল্পটা তিনি বলতে চেয়েছেন, তা আমাদের চারপাশের জীবনেরই গল্প।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই কথাশিল্পীর বয়ান বা ভাষাজাদুর ভেতর চরিত্র কিংবা গল্প হারিয়ে যায়নি, বরং সবকিছু এগিয়েছে একই সমান্তরালে—প্যারালালি। তাই পড়তে বসে গল্প খুঁজতে চাওয়া পাঠককে আলাদা করে কসরত করতে হয় না। শহীদুল জহিরের যেসব গল্পকে আপাত গল্পহীন মনে হয়, সেগুলোও শেষ পর্যন্ত পরিপূর্ণ গল্প আকারে আমাদের সামনে হাজির থাকে।
এই লেখক সম্পর্কে আরেকটা কথা বলে শেষ করা যাক। পাঠক না থাকা কিংবা গড়ে না ওঠা নিয়ে আমাদের যে আক্ষেপ, জহির সম্ভবত তার জবাবও। পাঠক যে নতুন সাহিত্য পড়তে চায়, নতুন কিছুর অপেক্ষায় থাকে, তার সার্থক উদাহরণও সম্ভবত শহীদুল জহিরের জনপ্রিয়তা।
আর জনপ্রিয়তাকে যাঁরা ভালো-খারাপ সাহিত্যের মানদণ্ড হিসেবে ধরে বসে থাকেন, তাঁদের জন্যও বড় দৃষ্টান্ত তিনি নিজে এবং তাঁর সাহিত্য। সামনের দিনে হয়তো বিষয়গুলো আরও বেশি মূর্ত হয়ে উঠবে।