ডায়েরি

অলংকরণ: মানব গোলদার

‘ডায়েরিটাতে কী লেখা ছিল?’ থেরাপিস্টের এই প্রশ্নের জবাব দিতে খানিকটা ইতস্তত করি আমি। আরেকজনের ব্যক্তিগত ডায়েরি পড়ে ফেলেছি, এটা স্বীকার করাই বেশ লজ্জার ব্যাপার। কিন্তু ডায়েরিটা আমাকে এত বেশি পীড়া দিচ্ছে যে আমাকে সাইকিয়াট্রিস্ট পর্যন্ত আসতে হলো।

‘তেমন কিছু না, চিঠির মতো করে লেখা রোজনামচা।’

‘আচ্ছা, চিঠিগুলো আপনার প্রেমিককে লেখা?’

আমি হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বলি না, আসলে তো মেয়েটা চিঠি লিখেছে তার নিজের প্রেমিককেই। যখন লিখেছে তখন আমি ছিলাম না। সে সময় মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ আসেনি, স্মার্টফোনের জন্ম হলেও বাংলাদেশে অত প্রচলিত হয়নি। প্রেমিক–প্রেমিকারা ল্যান্ডলাইনে কথা বলত। সে সুবিধাও সবার ছিল না বলে চিঠি লিখত অনেকেই।

‘হ্যাঁ, মানে মাহফুজকে লেখা, যদিও কোথাওই ওর নাম নেই।’

‘আচ্ছা?’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ভদ্রমহিলা। আমার মনে হচ্ছে, এখানে এসে বড় একটা বোকামি করেছি। মাহফুজের ঘরের বুকশেলফের নিচের তাকে ধুলাপড়া অনেক বইপত্র ঝাড় দিতে গিয়ে আমি ডায়েরিটা পেয়েছিলাম। ওর প্রাক্তনের ডায়েরি ও কেন রেখে দিয়েছে, তা জিজ্ঞেস না করে আগাপাশতলা সেটা পড়েছি। পড়ার পর থেকে প্রায় প্রতি রাতে ভয়াবহ সব দুঃস্বপ্ন দেখছি। ওর প্রেমিকার লেখা চিঠি পড়ে ফেলার কথা ওকে জানাতে আমার ইচ্ছা করেনি, মনে হয়েছে ওর সামনে আমি ছোট হয়ে যাব।

এমনিতে দশ মাসের যুগল জীবনে আমরা কেউই একে অন্যের প্রাইভেসি লঙ্ঘন করার মতো কিছু করিনি। একটা অলিখিত চুক্তি আর উচ্চারণ না করা শপথের মতো করে পালন করেছি—নিজ থেকে না বললে কিছু জিজ্ঞেস সেও আমাকে করে না, আমিও করি না তাকে। কেউ কারও ফোন রিসিভ করি না, চেক করা তো দূরের কথা। ওর প্রাক্তনের সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য আমি জানতাম, প্রেম হবে হবে করছে, তখনো হয়নি—এমন সময় মাহফুজ বলেছিল, কেন ও সিরিয়াস সম্পর্কে যেতে ভয় পায়।

‘ওয়ান্স বিটেন, টোয়াইস শাই, বুঝলি?’

বলে হা হা করে হেসে ফেলেছিল ও, আমিও মজা করে বলেছিলাম, ‘ওনলি ওয়ান্স? দ্যাটস ইম্প্রেসিভ! নাউ ডোন্ট টেল মি ইউ আর আ ভার্জিন।’

একটা ফচকে হাসি দিয়ে চোখ টিপে ও বলেছিল, ‘অফ কোর্স আইম নট।’

সেটা এক বছর আগের কথা। এই এক বছরে অনেক কিছু পাল্টে গেছে, আমরা লিভ ইনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। হলের রুম ছেড়ে না দিলেও আমার জিনিসপত্র প্রায় সব এখন মাহফুজের বাসায়। ওর বুকশেলফে আমার কিছু বইয়ের জায়গা করতে গিয়েই ডায়েরিটা পাই আমি, মাস ছয়েক আগে। ছয় মাসের মধ্যে কয়েক দফা ভেবেছি, ওর সঙ্গে এটা নিয়ে খোলাখুলি আলাপ করব। সেই ব্রেকাপের পর তো বহু বছর কেটে গেছে। তাহলে ডায়েরিটা কেন রেখে দিতে হলো? আমি ওর সঙ্গে কথা বলার আগে মুনিয়ার সঙ্গে জিনিসটা শেয়ার করলাম, মুনিয়া হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা নিয়ে এত আপসেট হওয়ার কিছুই নেই। এভরিবডি হ্যাজ আ পাস্ট। হাসতে হাসতেই বলল, ‘ডোন্ট ইউ হ্যাভ অ্যান এক্স অ্যান্ড হিজ মেমরিজ?’

‘ওয়েল, আই অ্যাম নট ক্যারিং দোজ এনিমোর।’

‘হি ইজ নট ইদার,’ ডায়েরি রেখে দেওয়ার বিষয়টাকে মুনিয়া পাত্তাই দেয়নি। ওর মতে, সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলে পরে আয়োজন করে স্মৃতিচিহ্ন নষ্ট করার কিছু নেই। মুভ অন করতে পারলে কেউ তা করেও না।

ডায়েরিটা ফেলে দিলে কেমন হয়, সেটাও আমি ভেবেছি। কিন্তু জিনিসটা আমার নয়। মাহফুজের এক্স গার্লফ্রেন্ডের, যেটা সে মাহফুজকেই দিয়েছিল, আমি সেটা ফেলি কী করে?

‘নামের বদলে কিছু আদরের সম্বোধন আছে, যা দিয়ে তারা পরস্পরকে ডাকত।’

ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকিয়েই থাকেন। আমার একটু একটু ভয় লাগে। ইদানীং ‘আফটার লাইফ’ নামে একটা নেটফ্লিক্স সিরিজ দেখেছি আমি, সেখানে প্রটাগনিস্টের সাইকিয়াট্রিস্ট এক রোগীর সমস্যা আরেক রোগীকে বলে দেয়। আমার কেসটার কথা কি উদ্ভট বা হাস্যকর সমস্যার উদাহরণ হিসেবে ইনি অন্য কোনো রোগীকে বলে দেবেন?

‘একই নামে আপনার প্রেমিক কখনো আপনাকে ডেকেছেন?’

আমি প্রশ্নটা এড়িয়ে যাব কি না ভাবি। আমার উচ্চতা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি আর মাহফুজের পাঁচ ছয়। মাহফুজের প্রেমিকা প্রতিটি চিঠির সম্বোধনে ‘আমার পুচকু’ লিখেছে, নিচে নিজের নামের জায়গায় ‘তোর পুচকু’। ইউনিসেক্স সম্বোধন, টিনেজ প্রেমের জন্য উপযুক্ত ডাক। আমি ক্লাস এইটে পড়ার সময়ই পাঁচ ফুট তিন হয়ে গিয়েছিলাম, দাদির মতো চওড়া কাঁধ আর বিরাট পেলভিসের জন্য আমাকে সব সময়ই বিশালবপু লাগত। কেউ মহা আহ্লাদ করেও আমাকে এ রকম নামে ডাকতে পারবে না। মাহফুজ একদিন আমাকে আদর করার সময় অনেক ননসেন্স আহ্লাদি শব্দ বলতে গিয়ে পুচকু বলে ডেকেছিল। তখন আমি খেয়াল করিনি। ডায়েরি পড়ার পর থেকে জিনিসটা কাঁটার মতো বিঁধে রয়েছে।

‘আমার আসল সমস্যা হলো, আমি রাতে ঘুমাতে পারছি না, দুঃস্বপ্ন দেখছি।’

‘কী দেখছেন?’

এনাকে কি বলা উচিত যে আমি ফেসবুকে মেয়েটাকে স্টক করেছি, তার বর্তমান প্রেমিকের সঙ্গে সে বিন্দাস ভালো আছে, তাদের সব পাবলিক পোস্ট দেখে মাহফুজ যে তার জীবনের কোথাওই নেই, এটা মোটামুটি নিশ্চিত, এই সব জেনেও আমার শান্তি হয়নি? প্রায় প্রতি রাতে আমি তাদের দুজনকে আমার স্বপ্নে দেখি উদ্দাম ভালোবাসাবাসি করতে, পরস্পরকে ‘পুচকু’ নামে ডেকে আদর করতে আর আমি ভোয়্যারের মতো একটা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে থাকি। একপর্যায়ে ওরা আমাকে দেখে ফেলে এবং মাহফুজের এক্স আমার দিকে তার কিশোরী বয়সে লেখা ডায়েরিটা ছুড়ে মারে, তখন আমার ঘুম ভেঙে যায়! আর আমার প্রেমিক অন্য কাউকে আদর করছে, এমন দৃশ্য দেখার ভয়ে বাকি রাত আর আমি ঘুমাতে পারি না!

আমি সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারের আরামদায়ক সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। ব্যাগ থেকে ডায়েরি বের করে সামনের টি–টেবিলে রাখি। তারপর বলি, নেক্সট সিটিংয়ের দিন এটা নিয়ে যাব।

দেখা যাক, এই দশ দিন ঘুমাতে পারি কি না।