আমার ঈদস্মৃতির জন্য ক্ষমা চাইছি, মা আমানি মনসুর

মাকে নিয়ে শিশুসন্তানের কবরে এসেছেন ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বোমায় সন্তান হারানো আমানি মনসুরছবি: রয়টার্সের ভিডিও থেকে নেওয়া

আমার ঈদস্মৃতির জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি, মা আমানি মনসুর।
আমার ঈদস্মৃতিতে আছে ১৯৭২, যেবার দেয়ালে বেঁধা বোমার টুকরা উদ্ধার করে
মাঠের মাঝখানে খড়ের গাদায় আগুনের মধ্যে ফেলে আমরা
পটকা ফাটানোর আনন্দ করেছিলাম।
আমার ঈদস্মৃতিতে আছে নতুন স্যান্ডেল না পাওয়ার দীর্ঘশ্বাস,
আছে আব্বার স্মৃতি, তাঁর অকালমৃত্যু,
এরপর প্রতি ঈদে কবর জিয়ারত করতে যাওয়া।
আমার ঈদস্মৃতিতে আছে ১৬ ঘণ্টা বাসে বসে থেকে শেষ রাতে রংপুর যাওয়া,
আম্মা আম্মা, দোরঘণ্টি বাজাতে বাজাতে ডাকি, আম্মা ঘুমভাঙা চোখে
সুইচ অন করেন, দরজা খুলে যায়, দেখতে পাই তাঁর প্রসন্ন হাসিমাখা মুখ,
জার্নির কষ্ট মুহূর্তে দূর হয়ে যায়।

আর মা আমানি মনসুর, আপনি নিজের মাকে সঙ্গে নিয়ে কাঁচা মাটির কবরের ধারে
দাঁড়িয়ে বিলাপ করছেন, কবরখানি ছোট,
৪ বছর বয়সী আমানির সন্তানের জন্য বড় কবরের দরকার পড়েনি,
মাত্র কদিন আগে ইসরায়েলিদের বোমায় আপনার এই ছোট্ট ছেলেটা মারা গেছে,
আপনার চোখের জল শুকোয় না—‘গত বছর ঈদের দিনটা কত আনন্দের ছিল,
এক বছর আগেও,
ঈদের সকালে বাচ্চাটা আমার হাতের আঙুল ধরেছিল, তাকে রেডি করে দিচ্ছিলাম,
সে বলছিল,
নামাজ পড়ে ফিরে আসার পরপরই সে যেন
ঈদের উপহারটা হাতে পেয়ে যায়।’
এবার ঈদের উপহার সে পেয়েছে
বোমার আঘাতে হাত উড়ে যাওয়ার নির্ভারতা,
ভয়াবহ যন্ত্রণার অবসানের জন্য দ্রুত নেমে আসা মৃত্যুর আলিঙ্গন
কাফনের কাপড়, মাটির বিছানা।
এখন ঈদের সকালে সে পাচ্ছে মায়ের অফুরান অশ্রু
আর ভাইয়ের নির্বাক চাউনি।

মাহমুদ হামিদ বসে আছেন হুইলচেয়ারে,
দুপুরের সূর্য মাথার ওপরে,
এই তীব্র রোদে শুকিয়ে যাচ্ছে রাফার জলাধারগুলো,
কিন্তু শুকোচ্ছে না মাহমুদ হামিদের চোখের জল।
উদাস হয়ে তিনি তাকান ধ্বংসস্তূপের দিকে,
গত বছর ঈদের দিনেও কত আনন্দ ছিল তাঁর পরিবারে,
সকালে নামাজ পড়ে যখন ঘরে ফিরেছিলেন,
সুস্বাদু রান্নার গন্ধে বাড়ি ম-ম করছিল,
আহা, কী সুখেরই না ছিল গত বছরের ঈদের দিনটা।

মাহমুদ হামিদের পা নেই, ইসরায়েলি আঘাতে উড়ে গেছে,
কিন্তু জানটা এখনো আছে দেহে,
হুইলচেয়ারে চলার আর রোদনের শক্তিও ফুরিয়ে যায়নি।
তার মতো ৭৫ হাজার মাহমুদ, মাহমুদা, হামিদ, হামিদা, মনসুর, মনসুরা—
নারী শিশু বৃদ্ধ যুবা,
এখন জখমি শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছে
আর অপেক্ষা করছে অন্নহীন,
তৃষ্ণার পানিবিহীন, চিকিৎসাবিহীন, আশ্রয়হীন মৃত্যুর।

৩২ হাজার মৃতকে আজ ঈর্ষা করছে ২২ লাখ গৃহহীন
গন্তব্যহীন
ভবিষ্যৎহীন
আশাহীন
মানবহৃদয়।

ধ্বংস হয়ে যাওয়া হাসপাতালের ভাঙা বেডের হাতল ধরে
হাসপাতাল হাসপাতাল খেলছে একদল শিশু
ধুলায় লুটে থাকা রাফার আল ফারুক মসজিদের পাশে
ধাওয়া আর ধরে ফেলার খেলা খেলছে একদল বালক

মরুভূমির বালিতে সার সার কবর,
পুরো গাজা পরিণত হয়েছে বিশাল গোরস্তানে,
তারই পাশে বৃদ্ধ আবু শায়ের বলছেন,
তবুও আমাদের ঈদ করতে হবে,
তবুও ঈদে আমাদের উৎসবে মাততে হবে,
আমরা পরাজয় মানব না।

ওই রোদ-তাতানো বালিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে
একটা ফণীমনসার নাছোড় সবুজ সতেজ তিনটা পাতা,
পাতার গায়ে কাঁটা,
আর তারই চূড়ায় একটা তীব্র হলুদ ফুল
ভ্যান ঘগের সব হলুদ শুষে নিয়ে ফুটে আছে, নাছোড়বান্দার মতো।

এই ঈদে আমার শৈশবের ঈদের স্মৃতিচারণা করবার জন্য
আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি,
প্যালেস্টাইন।

(রয়টার্সে ১০ এপ্রিল ২০২৪-এর Gazans live on memories of past Eid festivals as war ruins special day শিরোনামের প্রতিবেদন পড়ে)