মায়ের হাতের সেমাই–ই কি সবচেয়ে সুস্বাদু

ছবি: প্রথম আলো

ঈদুল ফিতরকে আমরা ছোটবেলায় বলতাম সেমাইয়ের ঈদ। ঈদুল আজহাকে যেমন বলা হয় কোরবানির ঈদ। বকরি ঈদও বলা হতো ঈদুল আজহাকে। বাকার মানে গাভি। আর ছাগিকে আমরা বলতাম বকরি। হয়তো আগে ভারতে কোরবানির ঈদে শুধু ছাগলই কোরবানি দেওয়া হতো বলে এর নাম বকরি ঈদ হয়েছে।

সেমাই কথাটা কোত্থেকে এসেছে, ব্যাপক গবেষণা করেছেন ফরহাদ খান। প্রথম আলোতে তিনি লিখেছিলেন, ‘বাংলা অভিধানে সেমাই শব্দটাকে কোথাও বলা হয়েছে হিন্দি, কোথাও বলা হয়েছে দেশি। ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, গ্রিক শব্দ সেমিদালিস থেকে সেমাই শব্দের উৎপত্তি। তবে ব্যাপারটা সরাসরি ঘটেনি। সেমিদালিস শব্দের মূল অর্থ হলো ময়দা। ময়দা অবশ্য ফারসি শব্দ। যাহোক, এই সেমিদালিস শব্দ সংস্কৃত ভাষায় প্রবেশ করে সমিদা রূপ ধারণ করে। সমিদা থেকেই তৈরি হয় সেমাই, সেমিয়া ইত্যাদি শব্দ এবং এই সব নামের মিষ্টান্ন দ্রব্য।

‘আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের মধ্য দিয়ে গ্রিসের সঙ্গে ভারতের পরিচয় ঘটে। সেই সময় খাদ্যদ্রব্য হিসেবে সেমিদালিস বা ময়দার সঙ্গে ভারতের পরিচয় ঘটা বিচিত্র নয়। সেমিদালিসের সমিদা হওয়া এবং সমিদা থেকে সেমাই হওয়া ভাষাতত্ত্বে নতুন কোনো ঘটনা নয়।

‘শব্দের পথ ধরে ইতিহাসের দিকে এগোনো যায়। শব্দের চাবি দিয়ে খোলা যায় ইতিহাসের অনেক দরজা। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সেমাই শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্দেশ করে দেখিয়ে দিয়েছেন—সেমাই শব্দের গায়ে গ্রিসের গন্ধ থাকলেও সেমাই দ্রব্যটা আসলে ভারতীয়। ভারতের অনেক রাজ্যেই সেমাই নানাভাবে খাওয়া হয়। বিভিন্ন পালাপার্বণেও সেমাই রান্নার রেওয়াজ রয়েছে। তা ছাড়া উপমহাদেশের মুসলমানমাত্রই ঈদের দিনে সেমাই খায়। পাকিস্তানেও সেমাই ছাড়া ঈদ হয় না।’

আজকের পত্রিকায় একটা আজব খবর পড়লাম। ৩৪ বছর আগের কথা। ১৯৯০ সাল। সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা ইউনিয়নের নৈশ্বেরকাটি গ্রামের মতলেব সরদারের বড় ছেলে মো. রফিকুল ইসলামের বয়স তখন ২৭ বছর। ঈদের দিন। ছেলে রফিকুল ইসলাম ঈদে সেমাই খেতে চান। বাবা সেমাই আনেননি। রাগ করে রফিকুল ইসলাম বাড়ি ছেড়ে চলে যান। চলে গেলেন কুমিল্লায়। মুরাদপুর উপজেলার চুলুরিয়া গ্রামে। সেখানে বিয়েথা করলেন। এক ছেলে, দুই মেয়ের বাবা হলেন। এখন বয়স তাঁর ৬১ বছর। এই এত বছর তিনি জেদ ধরেই থাকলেন। বাড়ি ফিরলেন না।

এবার ঈদে তিনি ফিরে এসেছেন। এর মধ্যে তাঁর বাবা মতলেব সরকার মারাও গেছেন। কিন্তু আছেন মা। শুকজান বিবি। মা ছেলেকে ফিরে পেয়ে খুবই খুশি। এবারের ঈদ তাঁর কাছে নতুন আনন্দের।

আমাদের ছোটবেলায় আমরা নিজেদের বাসায় মেশিনে সেমাই বানাতাম। ছোটখাটো একটা টিউবওয়েলের মতো ছিল জিনিসটা। হাতল ঘোরাতে হতো। এক পাশ দিয়ে আটা ছেনে ঢোকানো হতো। হাতল ঘোরালে নিচের ফুটোগুলো দিয়ে সেমাইয়ের একেকটা শলা পিরপির করে বের হতো। সেসব আবার রোদে শুকাতে দিতে হতো। ছোটবেলায় আমার ডিউটি ছিল ছাদে এই সেমাই পাহারা দেওয়া। হাতে থাকত পাটকাঠি। আমি পাখি তাড়াতাম।

পাখি তাড়াতাম। আর একটা কাগজ দিয়ে চোঙ বানিয়ে লাঠির ওপরে বেঁধে বানাতাম মাইক। দেশলাইয়ের বাক্সের সঙ্গে তার বেঁধে মাইকের সঙ্গে যোগ করে দিতাম। তারপর সেই দেশলাইয়ের বাক্সটাকে মাউথপিস বানিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা আবৃত্তি করতাম আমার নিজস্ব বেতারকেন্দ্র থেকে: শাতিল আরব শাতিল আরব, পুত যুগে যুগে তোমার তীর।

আর আছে হাতে বানানো সেমাই। পিঁড়ির ওপরে আটা মাখা রেখে হাত দিয়ে ডলে ডলে বানানো। ঘন দুধ দিয়ে সেই সেমাই রাঁধলে বড়ই উপাদেয় হয়।

এখন তো দুধ সেমাই, জর্দা সেমাইয়ের পাশাপাশি এসে গেছে লাচ্ছা সেমাই। সেমাই দিয়ে এখন আরও নানা রকমের পদ বানানো হয়।

সেমাই শব্দটিকে সে মা-ই বা সেই মা হিসেবে ব্যবহার করে আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম। ২০১৬ সালে শোলাকিয়ার ঈদের জামাতে জঙ্গি হামলা হয়। তখন ঝর্ণা রানী নামের একজন মা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তিনি বাড়িতে সেমাই রাঁধছিলেন ঈদের দিন।

এই সুযোগে কবিতাটা পুরোটা তুলে ধরি:

ঝর্ণা রানী, ও বাংলাদেশের মা

(শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার সময় নিজ শয়নকক্ষে গুলিবিদ্ধ ও নিহত ঝর্ণা রানী ভৌমিকের উদ্দেশে)

রান্নাঘরের টিনের চালের ওপরে বৃষ্টিভেজা কলাপাতা দোল খায়।

ঝুলবারান্দার কাঠ বর্গায় দুটো পায়রা বাকবাকম বলে ডাকে।

ঈদের সকালে আপনি, ঝর্ণা রানী, ব্যস্ত রান্নাঘরে। সেমাই রাঁধতে বসে গেলেন।

একই ঝর্ণার ধারা, এ ঘরে জল তো ও ঘরে পানি,

তেমনি মিষ্টান্নরও নাকি আছে ভেদ।

আপনাদের নাকি সেমাই রাঁধতে নেই।

ও বাসুদেবের মা ঝর্ণা রানী, ও শুভদেবের মা ঝর্ণা রানী, আপনি কি তা জানেন না? আপনি কি তা মানেন না?

কল্লোলিনী ঝর্ণা হিন্দুকেও যা দেয়, মুসলমানকেও তা–ই দেয়,

গাছগাছালি পাখি পতঙ্গ প্রাণীকেও তা–ই দেয়—

জল কিংবা পানি, বারি কিংবা নীর।

আপনিও

পুজোয় বাঁধেন নাড়ু,

পার্বণে পায়েসান্ন,

ঈদের সকালে সেমাই।

আপনার সংসারের এটাই নিয়ম।

আপনার ঘরে আসে সন্তানেরা, কে যে তারা হিন্দু কেবা মুসলমান, কেবা খ্রিষ্টান, কেবা বৌদ্ধ, তা বাছবিচারের দরকার আপনার পড়ে না।

খিদে পেলে সবার পেটেই সমান আগুন জ্বলে। পেটে পড়লে সব খাবারই এক।

ঢাকার তেজগাঁর কলেজে পড়ান আপনার ছেলে বাসুদেব। ঈদ, পূজা দুটোই তার কাছে সমান পাবন।

মা মানেই তো উৎসব। উৎসব মানেই তো মায়ের কাছে ফেরা।

মায়ের আঁচলে মুছে ফেলা কপালের ঘাম।

তাই তো পূজায় কিংবা ঈদে আপনার বাসু ছুটে আসে আপনার কাছে, শোলাকিয়ায়।

আর বারো বছরের শুভর তো পার্বণ লাগে না, মিষ্টির পোকা যেন সে!

সেমাই পছন্দ করে আপনার ছেলেরা। আপনি তো তা জানেনই।

ঈদের সকালটায় আপনি তাই ব্যস্ত ছিলেন সেমাই নিয়েই। আঁচলটা কোমরে গুঁজে ঘিয়ে ভাজছিলেন সেমাই, খুন্তি নাড়ছিলেন মন দিয়ে।

খোকন খোকন ডাক পাড়ি

খোকন গেছে কার বাড়ি

আয় রে খোকন ঘরে আয়...

আপনি রুটি ভাজবেন। আটা ছানছিলেন। পাশে বসবার পিঁড়িতে নিজেই একটা ছোট রুটি বেলছিল শুভ।

সকাল সকাল স্নানটা সেরে নিতে চান আপনার বাসুদেব। নামাজ শেষে আসবে বন্ধুরা, আসলাম, পারভেজ, রন্টি, লিটন। ঘাড়ে গামছাটা ফেলে বাসু চিৎকার করে উঠল, মা, আমার লুঙ্গি কই।

চুলা থেকে কড়াইটা নামিয়ে আপনি ছুটলেন আপনার ঘরে।

উঠানে কক কক করে উঠল ছানাসমেত মা মুরগিটা।

ইটের ঘর।

জানালায় ড্রামের কবাট।

সেই কবাট ফুটো করে ভেতরে ঢুকল বুলেট।

একবারই আপনি আর্তনাদ করে উঠলেন, খোকা!

আপনার আটা মাখা দুহাত ধীরে ধীরে লাল হয়ে গেল।

দেহ লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে।

আপনার বাসু ছুটে এলেন সেই ঘরে।

দেখলেন, মায়ের ঘর ভেসে যাচ্ছে মায়ের রক্তে। আহা, আমি যদি লুঙ্গিটা না চাইতাম! রক্তধারার দিকে তাকিয়ে, আটামাখা চিবুকটা ধরে একবার ভাবলেন বাসু।

রান্নাঘরে খেলনা রুটি বেলতে বেলতে শুভ ভাবল, কাকগুলো ডেকে উঠছে কি গুলির শব্দে! পুলিশেরা বুকে আগলে রোধ করল ওই অস্ত্রধারীদের ক্রূর পথ।

আপনার বাসুদেবের বন্ধুরা নিরাপদে সেরে নিল নামাজ।

এবার ওরা আসবে। দলে দলে। বাসুরে, তোর মার হাতের রুটি–সেমাইয়ের স্বাদই আলাদা। কাকিমা, কাকিমা, গরম–গরম দুটো রুটি সেঁকে দিন না!

রক্তের বিছানায় শুয়ে আপনি হাত নাড়ছেন। ঠোঁট বিড়বিড় করছে। আপনার ছেলেরা এসেছে, ওরা যে আপনার হাতের সেমাই ভালোবাসে ঈদের দিন। ঝর্ণা রানী, ও বাংলাদেশের মা, আপনার ছেলেরা ঈদের নামাজ সেরে নিরাপদে ফিরে এসেছে, আপনি উঠুন, ওদের রুটি-সেমাই খেতে দিন।

খোকন খোকন ডাক পাড়ি

খোকন গেছে কার বাড়ি

বাসুর মায়ের ঘরে যাই

শুভর মায়ের ঘরে যাই

সে-মাই রাঁধেন শেষ সেমাই।

কবিতার শেষ লাইনে সেই-মা বা সে-মাই আর সেমাইয়ের অনুপ্রাস ব্যবহার করেছিলাম।

এই লেখাটাও মা আর সেমাই মিলিয়েই শেষ করি। সবার মা–ই সেমাই বানাতে পারেন কিন্তু আমার মায়ের মতো কেউ পারেন না। আপনার মায়ের সেমাইয়ের স্বাদ আপনার কাছে পৃথিবীর সেরা। অমৃত।

এই নিয়েও কথা আছে। মম’স কুকিং ইজ দ্য বেস্ট। আপনার জিবে স্বাদ তৈরি হয়েছে আপনার মায়ের রান্না খেয়ে। কাজেই সেটাকেই আপনি মাপকাঠি ভাবেন। অন্যের রান্না আপনার পছন্দ হয় না। এই নিয়ে বউয়ের সঙ্গে ঝগড়াও লাগতে পারে। সেটা অন্য প্রসঙ্গ। সেটা না হয় আজকে তোলাই থাকল। আজকে না হয় মেনেই নিন, আপনার বউই সেরা রাঁধুনি।

আজকের দিনে তা–ও বলা যাবে না। পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট কথা হবে। এখন বলতে হবে, আমার বাবা ও মা–ও ভালো রাঁধেন, আমি ও আমার বউও ভালো রাঁধি। তবে বউয়েরটাই বেস্ট।

ঈদ মোবারক।