পাঠক যেন বই কেনে, হাত ভর্তি করে কেনে

শুরু হয়েছে অমর একুশে বইমেলা। এই মেলা ঘিরে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে আবার জমবে লেখক–পাঠকের মিলনমেলা

অলংকরণ: আরাফাত করিম

ফেব্রুয়ারির বইমেলা শুরু হলেই আমাদের প্রতিদিনের আলোচনায় ‘বই’ শব্দটি একটা জায়গা করে নেয়। পাঠকদের কৌতূহল থাকে মেলায় নতুন কী বই আসছে তা নিয়ে, লেখকদের উৎসাহ থাকে বইয়ের প্রচারে, প্রকাশকদের চোখ থাকে বইয়ের হিসাব–নিকাশে। হিসাবের প্রশ্নে লেখক-প্রকাশক থাকেন ভিন্ন মেরুতে, কিন্তু এক জায়গায় তাঁদের কঠিন ঐকমত্য: পাঠক যেন বই কেনে, হাত ভর্তি করে কেনে।

যুগটা এখন পণ্যের, কেনাকাটার, ক্রেডিট কার্ডের। একটা সময় ছিল, সেই দর্শন যুগে, যখন রেনে দেকার্তের উপলব্ধি ছিল এই: আই থিঙ্ক, দেয়ারফোর আই এম—অর্থাৎ চিন্তা করতে পারি বলে অস্তিত্ব ধরে রেখেছি। এখন ক্রেডিট কার্ড উঁচিয়ে এ যুগের ক্রেতা বলেন, আই শপ, দেয়ারফোর আই এম। কেনাকাটায় আছি বলে টিকে আছি। কেনাকাটা সহজ করেছে অনলাইন ব্যবসা। কত পণ্যই না অনলাইনে বিক্রি হয়—ইলেকট্রিক ইয়োগা ম্যাট থেকে নিয়ে কলা কাটার যন্ত্র। বিক্রি হয় না শুধু বই, অথবা হলেও লেখক-প্রকাশকের সন্তুষ্টিমতো নয়। বইয়ের বিক্রি কম, যেহেতু বই এখনো পণ্য হতে পারেনি, ইয়োগা ম্যাটের মতো ব্যবহারযোগ্য পণ্য হওয়া তো দূরের কথা। কিন্তু বই বিক্রি তো হতে হবে। তা না হলে বইমেলা থাকবে না, বইয়ের জন্য পুরস্কার জেতাও হবে না, বাতিঘরের বাতি নিভবে, পাঠকদের সমাবেশ হবে না, প্রথমা শেষতমা হয়ে পাততাড়ি গোটাবে।

বই কেনা নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর আইকনিক সেই লেখাটার পর কত দীর্ঘ সময় চলে গেল, কিন্তু তাঁর আক্ষেপ জারি থাকল। ‘বই কিনে কেউ তো কখনো দেউলে হয় না,’ তিনি লিখেছিলেন। খাঁটি কথা, কিন্তু বাঙালি এখন বালিশ–কাণ্ডে হাত পাকিয়েছে, ব্যাংক লুট করতে শিখেছে, উপরি পাওনায় অভ্যস্ত হয়েছে। সে নিজেকে বাঁচিয়ে অন্যকে দেউলে করে। আর তাকে বই কিনতে বললে জানাবে, ‘অত কাঁচা পয়সা কোথায়, বাওয়া, যে বই কিনব?’ আক্ষেপটা যৌক্তিক। পয়সা এখন শুধু কাঁচা নেই, বেগমপাড়ায়, বিটকয়েনে, ছায়াচ্ছন্ন নানান ব্যবসায় সুপার কাঁচা অর্থাৎ পাকা আসন পেতে নিচ্ছে। আর আমার-আপনার মতো যারা মাসান্তে মাইনের টাকার দিকে তাকিয়ে থাকি, তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া গিন্নির বাজার-ফর্দ অর্ধেকটা কাটা পড়ার আগেই ওই টাকা কেটে পড়ে।

সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর লেখায় শুধু বই কেনার কথা বলেননি, পড়ার কথাও বলেছেন। বই পড়লে মনের চোখ ফোটে, অসংখ্য ভুবন সৃষ্টি হয়, এসব তিনি তাঁর বিশ্বাস আর চর্চা থেকেই বলেছেন। বই পড়াতে পারলে তিনি আনন্দ পেতেন। তাঁর বিশাল নাতি–নাতনি বাহিনীকে তিনি বইয়ের দিকে টানতেন, কিন্তু সমস্যা ছিল এই, তারা তাঁকে কদাচিৎ পেত, এবং পেলেও তাঁর বই নিয়েই উৎসাহ দেখাত। তিনি তাঁর বন্ধু শিবরাম চক্রবর্তীর কথা বলতেন, নাতি–নাতনিরা এমন ভাব করত, শিবরাম তো কবে পড়া হয়ে গেছে, এখন আপনার বই নিয়ে কিছু বলুন। নিজের বই নিয়ে কথা বলায় তাঁর উৎসাহ ছিল না, যা ছিল বিশ্বের বিখ্যাত-অখ্যাত সব লেখককে নিয়ে। মুজতবা আলীর আরেক বন্ধু ছিলেন আবু সয়ীদ আইয়ুব। কলকাতায় একই দালানে তাঁরা থাকতেন। আবু সয়ীদ আইয়ুব স্মরণে বাংলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানে গৌরী আইয়ুবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, আইয়ুবের বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ সহজ হয়েছিল যে কজনের জন্য, তাঁদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। আইয়ুবকে তিনি বেছে বেছে বেশ কিছু বই পড়তে দিয়েছিলেন।

‘বইগুলি কি আইয়ুব ফেরত দিয়েছিলেন,’ আমি জানতে চেয়েছিলাম?

গৌরী হেসে বলেছিলেন, ‘দিয়েছিলেন, শেলফসুদ্ধ!’

সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে দেখা করতে তাঁর ধানমন্ডির ১ নম্বর সড়কে আমি মাঝেমধ্যে গিয়েছি। তাঁর কথা শোনা ছিল এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। নাতি-নাতনিদের তিনি সময় দিতেন, প্রশ্ন করার সুযোগ দিতেন, আর গল্প শোনাতেন। এক বিকেলে তাঁর এক নাতি জানতে চেয়েছিল, ‘বই কেনা’ প্রবন্ধটা মাথায় রেখে, বই কেনা সম্ভব না হলে বই পড়ার সুযোগ তো কমে যায়। শহরগুলোতে দু–এক লাইব্রেরি থাকলেও গ্রামে তো তা-ও নেই। তাহলে বই সংগ্রহ করা যায় কী প্রকারে?

উত্তরে তিনি একটি গল্প বলেছিলেন। বইমেলার শুরুতে তাঁর এই গল্পটি আমলে নিলে বই কেনার একটা বিকল্প বাঙালি পেয়ে যেতে পারে। ‘গল্পটি দেশ পত্রিকার একজন আমাকে বলেছেন,’ মুজতবা আলী এভাবে শুরু করেছিলেন, ‘সত্য-মিথ্যা জানি না।’

এই ‘সত্য-মিথ্যা জানি না’ ছিল তাঁর এক নিরীহ রসাস্ত্র। এই অস্ত্র দিয়ে তিনি ঘোরতর সন্দেহবাদী অথবা সত্যসন্ধকেও নিরস্ত্র করতেন।

এক তরুণ গবেষককে তার গুরু একগাদা বই কিনতে বললেন। গবেষক বুঝলেন, এসব বইয়ের অর্ধেক তার নিজের কাজে লাগলেও অর্ধেক যাবে গুরুগৃহে। গবেষকের কাঁচা পয়সা নেই। যখন বুঝলেন, বই কেনা অসম্ভব, অথচ বই কেনা না হলে তার স্নাতক হওয়াও অসম্ভব, তিনি এক ফন্দি আঁটলেন। চুলে জটা লাগিয়ে, গায়ে ছাই মেখে, কপালে তিলক এঁটে সাধু বেশে তিনি এক পাহাড়ের ঢালে ধ্যানে বসলেন। তাকে দেখে দু–এক ভক্ত তৈরি হলো, দু–এক শাগরেদও। তাদের মাধ্যমে লোকজন জানল, এই সাধু মানুষের মনোবাসনা মেটাতে পারেন, আপদ-বালাই দূর করতে পারেন। সপ্তাহ না পেরোতে তাকে ঘিরে মানুষের একটা ভিড় দেখা গেল, তার এক শাগরেদ জানাল, তাকে টাকাপয়সা বা কোনো দক্ষিণা দিয়ে সন্তুষ্ট করা যাবে না, যাবে শুধু বই দিয়ে।

বই দিয়ে? মানুষ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। হ্যাঁ, বই দিয়ে। বই হচ্ছে জ্ঞান রাজ্যের চাবি। আলোকলোকের সিঁড়ি। তবে যেকোনো বই নয়, বিশেষ কিছু বই। অর্থাৎ গবেষকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া গুরুর তালিকাতে থাকা বই।

মানুষ নানা মুশকিল-সমস্যা নিয়ে গবেষকের কাছে এল, সঙ্গে একটা–দুইটা করে বই। মুশকিল আসান করার জন্য টোটকা-ফোটকাসহ যা দেওয়ার, গবেষক দিলেন। নানান ওজনের মন্ত্র-বর দিলেন। আরও এক সপ্তাহ যেতে না যেতে গবেষকের প্রায় সব বই পাওয়া হয়ে গেল। যখন তিনি ভাবছেন, এখন সটকে পড়ার শ্রেষ্ঠ সময়। এক নারী এলেন টুকরিবোঝাই বই নিয়ে। তাঁর সমস্যা প্রকট। সমস্যা স্বামী।

গবেষক টুকরিতে থাকা বই দেখে বুঝলেন, সেই স্বামী তার গুরুজি।

গুরুগিন্নি পরদিন আসবেন বলে বিদায় নিলেন। কিন্তু পরদিন তার জায়গায় দেখা দিলেন গুরু। দূর থেকে গুরুকে দেখে গবেষক তার সটকে পড়াটা বাস্তবায়ন করলেন। বস্তাভর্তি বই মাথায় নিয়ে পেছন পেছন গেল দুই শাগরেদ।

গল্প শেষ।

বই জোগাড় করার রাস্তাটা বাঁকা, কিন্তু বাঁকা রাস্তাতেও গাড়িঘোড়া চলে। জ্ঞানের গাড়ি আবার হাওয়া দিয়ে ওড়ে। ওড়ে না?

বই কেনা নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর আইকনিক সেই লেখাটার পর কত দীর্ঘ সময় চলে গেল, কিন্তু তাঁর আক্ষেপ জারি থাকল। ‘বই কিনে কেউ তো কখনো দেউলে হয় না,’ তিনি লিখেছিলেন। খাঁটি কথা, কিন্তু বাঙালি এখন নিজেকে বাঁচিয়ে অন্যকে দেউলে করে। আর তাকে বই কিনতে বললে জানাবে, ‘অত কাঁচা পয়সা কোথায়, বাওয়া, যে বই কিনব?’

২.

ছোটবেলায় বই কেনার পয়সা ছিল না। বই পেতাম জন্মদিনে, কিন্তু জন্মদিন তো আর ফি-রোজ আসে না।

তারপরও আমরা ছিলাম ভাগ্যবান। আমাদের শহরে তিনটি লাইব্রেরি ছিল। লাইব্রেরি মানে গ্রন্থাগার। সেগুলো আমাদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। আর ছিল নিউজ কর্নার। এর মালিক তাঁর লাইব্রেরি—লাইব্রেরি মানে বইয়ের দোকান—আমাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। দোকানের মেঝেতে পা ছড়িয়ে আমাদের বই পড়তে দিতেন। কিনতে হতো না, কিন্তু শর্ত ছিল একটাই, বইয়ের স্পাইন দুর্বল করা যাবে না। তিনি আমাদের স্পাইন কথাটা শিখিয়েছিলেন। ঠাট্টা করে বলতেন, খারাপ বই তোমাদের নসু গোয়ালার মতো, টিনভর্তি ভেজাল দুধ বয়ে বেড়ায়, সে জন্য স্পাইনে সমস্যা। আরও বলতেন, এক গবেষণা বই তার ডাক্তারকে বলল, ডাক্তার আমার এপেন্ডিক্সে সমস্যা। কী করা যায়? ডাক্তার বললেন, কেটে ফেলে দিলেই চলবে। এপেন্ডিক্স কথাটাও তিনি শিখিয়েছিলেন।

আমাদের স্কুলের ইংরেজির চেরাগ আলী স্যার শেকস্‌পিয়ারের ভক্ত ছিলেন। তিনি একদিন বললেন, শেক্‌সপিয়ারের মতে, ভিখিরির বই জমিদারের রক্তের থেকেও মূল্যবান। পরে এই উদ্ধৃতির সন্ধান পেয়েছিলাম। এটি আছে অষ্টম হেনরির প্রথম অঙ্ক প্রথম দৃশ্যে।

সব সময় পরিপাটি থাকা স্যার অবশ্য কথাটা বলতেন আমাদের বইয়ের ভিখিরি দশা দেখে। রোদ-বৃষ্টিতে কাঁধে বই ফেলে স্কুলে যেতাম। সিলেটের বৃষ্টি বলে কথা। পাথর গলিয়ে দিতে পারত।

পাথরেও বই লেখা হতো, তবে সিলেটে নয়। নিশ্চয় সেই প্রস্তরযুগে। পাথুরে–বইয়ের লাইব্রেরিও নাকি ছিল; এবং সেসব লাইব্রেরি থেকে যাতে পাথুরে-বই চুরি না হয়, তার জন্য পাহারাও থাকত।

সত্য-মিথ্যা জানি না।

তবে সত্য একটি গল্প হলো, এই ইরাকের বাগদাদে বইপাড়ায় যাঁরা কাঠের তক্তায় ফেলে বই বিক্রি করেন, রাতে তাঁরা সেভাবেই ফেলে রেখে চলে যান। যত্ন করে কোথাও তুলে রেখে, তালা মেরে যেতে হয় না। কারণ, ইরাকের পাঠক বই চুরি করে না। আর চোরেরা বই পড়ে না।

এই তরিকা আমাদের বইমেলায় চালু হতে পারে। তাহলে বাংলা একাডেমি দাবি করতে পারে, মেলায় এক রাতেই ৩০ কোটি টাকার বই হস্তান্তরিত হয়েছে।

সৈয়দ মুজতবা আলী মার্ক টোয়েনের ভক্ত ছিলেন। স্বাভাবিক। মার্কের ছিল মুজতবার মতো রসবোধ, উইট এবং বক্রোক্তিকে শিল্পে পরিণত করার অপার ক্ষমতা। মার্ক টোয়েনের মতে, আদর্শ জীবন হচ্ছে ‘ভালো বন্ধু, ভালো বই আর ঘুমন্ত বিবেক।’ ঘুমন্ত বিবেক? অবশ্যই। বিবেক ঘুমিয়ে না থাকলে ভালো বই না কিনেই কীভাবে হস্তগত হয়? টোয়েন নিশ্চয় ইরাকে কখনো পা রাখেননি। সেখানে ভালো বইরা রাতে নিদ্রা যায়, বিবেককে না ঘুমালেও চলে। বই না কেনার আরেক কারণ ই-বুক। এখন বাংলা বইও ‘ই’ হচ্ছে। সেটাই হওয়ার কথা, যেহেতু এখন পড়ার যুগকে পেছনে ফেলে দেখার যুগ-পরাক্রম দেখাচ্ছে। যত রাজ্যের ডিভাইসে আনন্দে মেতে ছেলেমেয়েরা পড়ার আগ্রহ হারাচ্ছে—এ রকম একটা অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। দেখার আকর্ষণ যত বাড়ছে, পড়ার চর্চা তত সীমিত হচ্ছে, এ সমস্যা পশ্চিমেরও। এর সমাধান কী? শিশুদের বইমুখী করা। এই লক্ষ্যে ইংল্যান্ডের রাজমহিষী কামিলা মাঝেমধ্যে স্কুলশিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করেন। এক বিশ্ব বই পড়া দিবসে, তিনি যখন শুধুই ডাচেস অব কর্নওয়াল ছিলেন, এক প্রাইমারি স্কুলে গিয়ে তিনি শিশুদের বলেছিলেন, ‘বইয়েরা কখনো তাদের সিগন্যাল হারায় না, বা তাদের ব্যাটারিও শেষ হয় না। তারা বরং প্রতিটি পৃষ্ঠায় তোমাদের সহস্র নতুন পৃথিবীতে নিয়ে যায়।’

সামান্য লেখিয়ের কথা কানে না হয় না-ই তুললেন, রাজন্যাবাণীকে অবহেলা করবেন কী প্রকারে? কাজেই বই পড়ুন, বই কিনুন, অথবা, যাহোক...সংগ্রহ করুন।