আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন
নিজেকে নিয়ে কখনোই আমার তেমন ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা স্বপ্ন ছিল না। ছিল কেবল এক স্বতঃস্ফূর্ত ঘোর। নিজের ভেতরে ডুবে থাকার মতো গোপন এক জলাধার। খুব ছোটবেলায় মনের গহিনে ভেসে ওঠা সেই জলাধারের খানিক খোঁজ পেয়েছিলেন একজন—আমার মা।
আমার তখন বিষণ্নতায় বসবাস। এভাবেই তারুণ্যের প্রথম প্রহরে লেখা হতে থাকে প্রেম-বিরহের ছদ্মবেশী আখ্যান, কিছু বিপন্ন বিষণ্নতা, যার ডাকনাম হতে পারে ‘কবিতা’।
এসব কবিতা লেখার মাঝামাঝি একদিন মায়ের কাছেই শুনলাম জীবনানন্দ দাশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কারের কথা। আমাকে নিয়ে কখনোই স্বপ্ন দেখা না থামানো এই মহীয়সীর ইচ্ছা, পুরস্কার পাওয়া হোক বা না হোক, এখানে-সেখানে এলোমেলোভাবে থাকা আমার অবাধ্য কবিতারা যেন এ সুযোগে একটা পাণ্ডুলিপি হয়ে ওঠে!
তত দিনে আমি ঘর বেঁধেছি। স্বামী-সন্তান নিয়ে নিভৃত এক গ্রামে বসবাস আমার। যে গ্রামে একটু বাতাস বইল কি বইল না, অমনি বিদ্যুৎহীন হয়ে যায় দিন–রাতগুলো; একটু মেঘ ঝরলেই যেখানে কাদায় মাখামাখি হয়ে যায় পথঘাট, সেই গ্রামের এক গেঁয়ো বধূর লেখা কবিতা অন্য কারও কি ভালো লাগতে পারে? সে সময় আমার কবিতাগুলো রচিত হয়েছে রান্নাঘরের মাটির চুলায় আগুন উসকে দিতে দিতে, সবজিখেত থেকে সদ্য তুলে আনা কচি লাউয়ের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে, শিশুসন্তান কোলে নিয়ে তাকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে অথবা ফুলবাগানের বুনো আগাছা উপড়ে দিতে দিতে। এসব বুনো ঘ্রাণের কবিতা কি বিজ্ঞজনদের নজরে পড়বে? প্রথম দিকে এমন দোনোমনা ছিল মনে।
তবে আমি স্বপ্ন শিকেয় তুলে রাখতে চাইলেও মা হাল ছাড়লেন না। রীতিমতো জোর করেই আমাকে দিয়ে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করালেন তিনি। তখন আমার হিমশিম অবস্থা দেখে এগিয়ে এলেন আমার কন্যার বাবা। সময় দিলেন, সুযোগ করে দিলেন তৈরি হওয়ার জন্য। এভাবেই আমার ব্যক্তিগত গোপন অনুভূতিগুলো শেষ অবধি পাণ্ডুলিপির রূপ পেল।
পুরস্কারের স্বপ্ন দেখিনি সত্যি, শুধু চেয়েছিলাম, আমার হাতে জন্ম নেওয়া এই কাব্যশিশুদের কেউ একটু ছুঁয়ে দেখুক, পড়ে ফেলুক।
পাণ্ডুলিপিটি পাঠিয়ে প্রায় ভুলতে বসেছি, এমন সময় একদিন প্রথম আলো থেকে ফোন এল, আমার একটা ছবি লাগবে। তখনো ওইভাবে কিছু জানতে পারিনি।
ভেবেছিলাম, আমার মতো যেসব কবিযশোপ্রার্থী পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছেন, সবার ছবিই হয়তো প্রয়োজন। তারপর এক রোদমাখা শীতের সকালে আমার মুঠোফোনে দেখলাম অনেকগুলো মিসড কল। সাংসারিক ব্যস্ততায় কলগুলো কখন এসেছে, টের পাইনি। এত মিসড কল দেখে প্রথমে ভয় পেলাম, কারও কোনো খারাপ কিছু নয় তো?
মিসড কলের লিস্ট থেকে প্রথমে মাকে ফোন দিলাম। তাঁর কাঁপা কাঁপা গলা শুনে ভয় জন্মাল আরও। তবে খানিক বাদেই কেটে গেল সেই সন্ত্রস্ত মেঘ, যখন মা বললেন, আজ তাঁর স্বপ্ন সত্যি হয়েছে, আমার কবিতার পাণ্ডুলিপি ‘বিষণ্ণতার দ্বাদশ অধ্যায়’ জিতেছে জীবনানন্দ দাশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার!
প্রাথমিক ঘোর কাটতেই মনে হলো, এ সকালের রোদ যেমন সত্য, তেমনি সত্য এ প্রাপ্তি! সত্য আমার আপনজনের উচ্ছ্বাসও!
প্রথমা প্রকাশন থেকে আমার সেই পাণ্ডুলিপি দ্রুতই বই হিসেবে প্রকাশিত হলো—বিষণ্নতার দ্বাদশ অধ্যায়, আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এই বই আমার মতো গ্রামনিবাসী এক কবিকে অনেক পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।
প্রথম আলো ও প্রথমা প্রকাশন বাংলাদেশের তরুণ কবিদের নিয়ে ভেবেছে, ৩০ বছরের কম বয়সী কবিদের কাজের স্বীকৃতি দিয়ে তাঁদের বইও প্রকাশ করেছে। তরুণ কাব্যমোদীদের জন্য এটা অনেক বড় ব্যাপার। আর আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন, পুরস্কারটির সুবাদে কবিতার নতুন আকাশে যে ইকারুস হয়ে উড়তে পেরেছে।