আন্দোলনের পূর্বাপর বৃত্তান্ত

ভাষা আন্দোলনের ঘটনা নানাভাবে উদ্দীপ্ত করেছে মানুষকে। এর গভীর প্রভাব পড়েছে পরবর্তী ইতিহাসে। এই আন্দোলনের আবেগ স্ফুরিত হয়েছে সাহিত্যে, গানে, চিত্রকলায়, চলচ্চিত্রে। কবিতা ও কথাসাহিত্য থেকে গবেষণা পর্যন্ত পৌঁছেছে এর প্রেরণা। এখানে রইল ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত একটি বইয়ের আলোচনা।

কথাসাহিত্যিক বশীর আল্​হেলাল কাজ করতেন বাংলা একাডেমিতে। হঠাৎই বাংলা একাডেমির ইতিহাস রচনার দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পিত হয়। সেই সূত্রেই রচিত হয়েছে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে। ১৯৯৯ সালে আগামী প্রকাশনী থেকে এর নতুন সংস্করণ বের হয়। প্রচ্ছদটি এঁকেছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৮১১। ভাষা আন্দোলন নিয়ে এটি ছিল দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।

বদরুদ্দীন উমরের পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (খণ্ড ৩) বইটির পর এটিই বহুলপঠিত ও ব্যবহৃত। বদরুদ্দীন উমরের উক্ত গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে বর্ণিত হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারির পূর্বাপর ঘটনা। বশীর আল্​হেলাল তাঁর বই রচনার সময় উমরের তৃতীয় খণ্ডটি দেখেননি। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, বশীর আল্​হেলাল একেবারে নতুনভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের ইতিহাস রচনা করেছেন।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস

বশীর আল্​হেলাল

বাংলা একাডেমি, ঢাকা; ১৯৮৫

তিন খণ্ডে বিভক্ত গ্রন্থটির প্রথম খণ্ডে ‘ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট’, দ্বিতীয় খণ্ডে ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ এবং তৃতীয় খণ্ডে রয়েছে ‘বাংলাভাষার সংস্কার-প্রয়াস’। সূচিপত্র থেকে বোঝা যাচ্ছে, গ্রন্থকার ভাষাসংগ্রামের ইতিহাস লিখতে গিয়ে এর পটভূমিকার যেমন বিস্তৃত বিবরণ তুলে ধরেছেন, তেমনি ভাষাসংগ্রামের পরবর্তী সময়ে তার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়াও অনুসন্ধান করেছেন সযত্নে।

লেখক গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লিখেছেন, ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির ইতিহাস লিখতে গিয়ে পটভূমি প্রসঙ্গে যে ব্যাপক তথ্যের সন্ধান পান এবং সংগ্রহ করেন, তারই ফসল আলোচ্য গ্রন্থ। বিনয় করে গবেষক লিখেছেন, ‘এই গ্রন্থে পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কেবল তথ্য ও ঘটনাবলীকে তুলে ধরেছি। মূল্যায়ন, সাধারণভাবে, করা হয়নি। এবং লেখ্যগত প্রমাণ ও সমর্থন ছাড়া কোনো তথ্যের উল্লেখ বা ঘটনার উপস্থাপন করি নি। ভাষা আন্দোলনের পূর্ণ ইতিহাস এখনো প্রকাশিত হয়নি। বরং বহুতর প্রবন্ধে, নিবন্ধে, আলোচনায়, স্মৃতিচারণে, সাক্ষাৎকারে তথ্যের অজস্র বিভ্রম ঘটে গেছে। আমি চেষ্টা করেছি যথাসাধ্য সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে।’ কাজটি করতে গিয়ে লেখক সাপ্তাহিক সৈনিক, সাপ্তাহিক নওবেলাল এবং দৈনিক আজাদ ব্যবহার করেছেন; বহু দলিলপত্রের সহায়তা নিয়েছেন।

প্রথম খণ্ডের প্রথম অধ্যায়ে লেখক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান করেছেন। সে ক্ষেত্রে আলোচনার যাত্রারম্ভ বঙ্গভঙ্গ থেকে যুক্তফ্রন্ট পর্যন্ত। দ্বিতীয় অধ্যায় ‘সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট’-এ রয়েছে বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়, উনিশ শতকের শেষাংশ ও বিশ শতকের প্রথমার্ধের সাংস্কৃতিক চিন্তা, চল্লিশ ও পঞ্চাশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, শিক্ষা পরিস্থিতি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, নাট্যপ্রয়াস প্রভৃতি অনুষঙ্গ। পূর্ববাংলার সাংস্কৃতিক অবদমন থেকেই মূলত দেখা দিয়েছিল ভাষা আন্দোলন। এর মূল দুরভিসন্ধি ছিল অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক আধিপত্যবাদ। এ কারণে লেখক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটটি বিস্তৃত করেছেন পরিকল্পিতভাবেই। তবু তাকে কিঞ্চিৎকর বিবেচনা করে ‘খোলস’ বলে মনে করেছেন।

গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে ৫টি অধ্যায়। এখানে ক্রমান্বয়ে ১৯৪৭-১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমির ঘটনাধারা এবং ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২৭ এপ্রিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সম্মেলন পর্যন্ত ঘটনাধারা বর্ণিত হয়েছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে রয়েছে ১৯৫৩-১৯৫৬ পর্যন্ত একুশের গান রচনা, ১১ মার্চ উদ্​যাপন প্রভৃতি ঘটনাপ্রবাহ। পরবর্তী অধ্যায়ে রয়েছে ভাষাসংগ্রামে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ও বাঙালি জাতীয়তার প্রশ্ন।

তৃতীয় খণ্ড ‘বাংলাভাষার সংস্কার-প্রয়াস’ অংশে রয়েছে বাংলা ভাষার সংস্কার-প্রয়াসের ইতিহাস। অষ্টম ও নবম অধ্যায়ে রোমান হরফ প্রবর্তনের প্রয়াস, আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি এবং দশম অধ্যায়ের উপজীব্য বাংলালিপি, বানান, ব্যাকরণ ও ভাষাসংগ্রামের প্রয়াস। অনেক দিন ধরে এই সংস্কার-প্রয়াস চলছিল, বহু পণ্ডিত তাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তবু তা নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়। লেখকের পর্যবেক্ষণ, ‘এই রূপ আনুষ্ঠানিক ও কৃত্রিমভাবে বর্ণমালা, বানান ইত্যাদির পরিবর্তন আসলে করা যায় না।’ মূলত এর মধ্য দিয়ে বাংলাভাষাবিরোধী নানা চক্রান্ত ও প্রয়াসের ইতিবৃত্ত উঠে এসেছে।

বশীর আল্​হেলাল গ্রন্থের ভূমিকাংশে লিখেছিলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের মফস্বলের ইতিহাসের আমার বইয়ে কমতি হয়েছে...।’ কিন্তু মফস্বলের ইতিহাস একেবারে কম নেই এ বইয়ে। অঞ্চলভিত্তিক স্বতন্ত্র বইগুলি অবশ্য সময়মতো যোগ্য ব্যক্তিদের লেখা উচিত ছিল বা এখনো আছে।’ গবেষকের কথা সত্য প্রতীয়মান হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের স্থানীয় অনেক ইতিহাস বের হয়েছে। দ্বিতীয় সংস্করণে গবেষক দ্বিধাহীন চিত্তে বলেছেন, সালাহুদ্দীন নামের কেউ শহীদ হননি। কারণ, এ বিতর্ক বহুদিনের।

বশীর আল্​হেলাল গবেষণাপদ্ধতি অনুসরণ করেও অনেকটা সহজ ও সরলভাবে তথ্যবিন্যাস করে ঘটনাধারা বিশ্লেষণ করেছেন। কিছুটা কাহিনি বর্ণনার মতো ইতিহাসের পর্ব থেকে পর্বান্তরে প্রবেশ করেছেন। হয়তো সৃজনশীল সাহিত্যচর্চার কারণেই ইতিহাসটি শুষ্ক ও খরখরে গ্রন্থে পর্যবসিত হয়নি। পরিণত হয়েছে সুখপাঠ্য গ্রন্থে। সব ছাপিয়ে বইটি হয়ে উঠেছে ভাষা আন্দোলনের ওপর গুরুত্ববহ একটি কাজ।

লেখক: গবেষক।