এই সময়ে বই পড়া, বই কেনা 

১ ফেব্রুয়ারি শুরু হচ্ছে মাসব্যাপী বইমেলা। এ উপলক্ষে ২১ জানুয়ারি শনিবার প্রথম আলো কার্যালয়ে লেখক–পাঠক এবং বই পড়ানো কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন—সবাইকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হলো এক মুক্ত সংলাপ। এই সময়ে বই পড়া ও বই কেনার সংস্কৃতি, তার সঙ্গে আগের দিনের তুলনা এবং আমাদের করণীয়—সব মিলিয়ে বই নিয়ে জমে উঠল অন্তরঙ্গ আলাপ।

মুক্ত সংলাপে (বাঁ থেকে) আরিফ খান, মোরশেদ শফিউল হাসান, আলভী আহমেদ, ফারুক মঈনউদ্দীন, আফসানা বেগম, সাজ্জাদ শরিফ ও আনিসুল হকছবি: খালেদ সরকার

অংশগ্রহণকারী 

আলোচক

মোরশেদ শফিউল হাসান: লেখক ও শিক্ষক

ফারুক মঈনউদ্দীন: কথাসাহিত্যিক

সাজ্জাদ শরিফ: কবি; প্রথম আলোর 

নির্বাহী সম্পাদক

আফসানা বেগম: কথাসাহিত্যিক 

আরিফ খান: রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের সভাপতি 

আলভী আহমেদ: কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক

সঞ্চালক

আনিসুল হক: কবি ও কথাসাহিত্যিক;
প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক

আনিসুল হক

আনিসুল হক

প্রথম আলো শুক্রবারের ক্রোড়পত্র ‘অন্য আলো’ আয়োজিত ‘এই সময়ে বই পড়া, বই কেনা’ শিরোনামের মুক্ত সংলাপে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। ফেব্রুয়ারি মাস আসছে। এটাকে আমরা বলি ‘ভাষার মাস’। ফেব্রুয়ারিজুড়ে বাংলা একাডেমিতে যে অমর একুশে গ্রন্থমেলা হয়, সেটা বাংলাদেশের প্রধান সাংস্কৃতিক ঘটনা। এই বইমেলায় অনেক অনেক ভালো বই আমরা পাই, জনপ্রিয় বই পাই। 

আমরা খুব আনন্দের সঙ্গে লক্ষ করেছি যে বাংলাদেশে বইয়ের পাঠক ও ক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে। এই হিসাব অবশ্য প্রথমা প্রকাশনের। অনেকে যে বলেন বইয়ের বিক্রি কমছে—ধারণাটি ঠিক না–ও হতে পারে। এখন তো আবার অনলাইনেও বইয়ের বিক্রি ভালো।

আরেকটি প্রবণতাও খেয়াল করার মতো, আগে দেখা যেত কেবল উপন্যাসই বেশি বিক্রি হচ্ছে। প্রকাশকেরা বলতেন, ছোটগল্প ও কবিতা কম বিক্রি হয়। প্রবন্ধ বা নন–ফিকশনের কথাটা সেভাবে আলোচনায় আসত না। তবে এখন পরিস্থিতি বদলেছে। সম্প্রতি দেশ–বিদেশে অনুষ্ঠিত বইমেলার অভিজ্ঞতা থেকে লক্ষ করা যাচ্ছে, উপন্যাস, ছোটগল্প ও কবিতার চেয়ে মননশীল বই—নন–ফিকশন বইয়ের বিক্রি খুব ভালো। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, কবিতা ও কথাসাহিত্য পড়ার দরকার আছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বই, রাজনীতির বই, ইতিহাসের বই, এমনকি অর্থনীতির বই এখন খুব ভালো বিক্রি হয়। এটা একটা নতুন লক্ষণ।

বিশ্বখ্যাত ঔপন্যাসিক উমবের্তো একো বলেছেন, চামচ, কাঁচি, চাকা—আবিষ্কার হওয়ার পর এগুলো আমাদের জীবনে থেকে গেছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। তেমনি বইয়ের অনিবার্যতা প্রমাণিত, আমাদের জীবনে বইও থাকবে। তবে সামনের দিনগুলো বই পড়ার ধরনটা কেমন হবে, ছাপা বইয়ের পাশাপাশি আমরা কি ই–বুক বেশি পড়ব, নাকি বই শুনব? 

পাঠকদের মধ্যেও এখন চরিত্রগত বদল লক্ষ করা যাচ্ছে। আমি নিয়মিত বইমেলায় যাই। সেই সূত্রে দেখেছি, আগে একজন নির্দিষ্ট লেখকের বই কিনতে পাঠকেরা বইমেলায় যেতেন। এখন তাঁরা বিভ্রান্ত চোখে ঘুরে বেড়ান। মা–বাবা জানেন ও মানেন যে সন্তানকে বই পড়াতে হবে। কিন্তু ঠিক কী ধরনের বই পড়াতে হবে, তা তাঁরা ঠিক জানেন না। এ ক্ষেত্রে আমাদের একটা বড় ধরনের ঘাটতি আছে বলে মনে হয়। এসব বিষয় নিয়েই আমরা আজ আলোচনা করব। বই মানুষকে কীভাবে পরিবর্তন করে—এ প্রসঙ্গ ধরে কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে বইসংশ্লিষ্ট অন্য প্রসঙ্গগুলোও আসবে আলোচনায়। কবি সাজ্জাদ শরিফকে আলোচনার সূত্রপাত করতে অনুরোধ করছি। 

সাজ্জাদ শরিফ

সাজ্জাদ শরিফ

বই মানুষের জীবন কীভাবে পাল্টে দিতে পারে, সেটা আমি আমার নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছি। পুরান ঢাকার জিন্দাবাহারের একটি অতি দরিদ্র পরিবারে আমার জন্ম। উচ্চতর পড়াশোনা করা মানুষ আমাদের পরিবারের চৌহদ্দিতে কেউ ছিল না। সেখান থেকে আমার কিছুমাত্র উত্তরণ যদি ঘটে থাকে, তার পেছনে আছে বই। যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি, তখন এক আত্মীয় আমাদের কিছু বই উপহার দিয়েছিলেন। কে দিয়েছিলেন জানি না। তাঁর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এখনো মনে আছে, ঠাকুরমার ঝুলি, জসীমউদ্​দীনের বাঙ্গালির হাসির গল্প, দেশ–বিদেশের রূপকথা—এই বইগুলো পেয়েছিলাম। বইগুলো আমাকে চুম্বকের মতো গেঁথে ফেলল। আমার বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করল। 

সেই অভ্যাসের টানে বাড়ির পাশের আরমানিটোলা মাঠের লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়তে শুরু করি। বইয়ের কোনো বাছবিচার ছিল না। সামান্য দূরে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে ছিল ভারতীয় তথ্যকেন্দ্রের লাইব্রেরি। সেখানে এসে সোনার খনি পেয়ে গেলাম। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তলস্তয়, এমিল জোলার উপন্যাসগুলো পড়তে শুরু করি। তখন আমি স্কুলে পড়ি। অল্প বয়সের চৌহদ্দিতেই উপহার হিসেবে আর লাইব্রেরিতে যেসব বই পেলাম, মূলত তা–ই আমার মন গড়ে তুলেছে। বুঝে না বুঝে আমি বই পড়েছি। যতটুকু আসতে পেরেছি, সেখানে বইয়ের ভূমিকাই ৯০ শতাংশ। 

নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তাই বলতে পরি, জন্মদিনে বা যেকোনো উপলক্ষে বাচ্চাদের বই উপহার দেওয়াটা খুব জরুরি। কাউকে যদি বই ধরাতে হয়, ছোটবেলা থেকেই পড়াতে হবে। নইলে বড় হয়ে আর কখনো বই ধরবে না কেউ। আমরা তো এখন প্রায় ভুলেই গেছি যে বই খুবই মূল্যবান উপহার। 

একটা আন্তর্জাতিক জরিপে দেখছিলাম, ২০২১ সালে সারা পৃথিবীতে বইয়ের বিক্রি অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। চমকপ্রদ তথ্য হলো, যাঁদের বয়স তিরিশের নিচে, তাঁরাই বই পড়ছেন সবার চেয়ে বেশি। পৃথিবীর সবাই বই পড়লে আমাদের এখানে পড়বে না কেন? আমাদেরও সেই সুযোগ আছে। আসলে শৈশব থেকেই বই দেওয়া গেলে, একবার বই পড়ার নেশা পেয়ে গেলে বই পড়াটা মানুষ অব্যাহত রাখবেই।

আমাদের এখানে বই প্রকাশে আমরা যত উৎসাহী, বইয়ের সরবরাহব্যবস্থা নিয়ে এখন পর্যন্ত সেভাবে ভাবিনি, বিনিয়োগ করিনি। এটা হওয়াটা খুব জরুরি। এটা হলে ব্যবসায়িকভাবে যেমন তা লাভজনক হবে, দেশের সামগ্রিক চিত্তের বিকাশের পক্ষে খুব উপকারী হবে।

নানা বয়সের উপযোগী সৃজনশীল বা মননশীল বই যেন প্রচুর বের হয় এবং সেসব বই যেন পাঠযোগ্য হয়, লোকের ভালো লাগে—এ বিষয়ে খেয়াল রাখা দরকার। আর পাড়া–মহল্লার চৌহদ্দির মধ্যে লাইব্রেরি থাকা যেমন দরকার, তেমনি একইভাবে শিশুদের বই উপহার দেওয়ার সংস্কৃতিটাও আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। 

কেউ যখন বই পড়ে, প্রথম প্রথম কিছুদিন বইয়ের খুঁটিনাটি মনে থাকে। যখন আরও বই পড়তে থাকে, তখন আগের বইয়ের তথ্য মুছে যেতে থাকে। কিন্তু তাঁর মনে বইটি পলি রেখে যায়। একের পর এক বইয়ের পলি পড়তে পড়তে তাঁর মন বদলে যায়। ওই বদলে যাওয়া মনটাই আপনার জীবনকে অর্থবহ করে। এখন ভাবুন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ যদি এমন অর্থবহ জীবন যাপন করেন, তাহলে সামষ্টিক সামাজিক জীবনের কী অসাধারণ একটা উত্তরণ ঘটবে, তার মধ্য দিয়ে পুরো দেশটা কীভাবে পাল্টে যাবে! 

মোরশেদ শফিউল হাসান

মোরশেদ শফিউল হাসান

সাজ্জাদ শরিফের কথার সূত্র ধরে বলি, বই জীবন বদলে দেয়। বই না পড়লে আমি এ জগতে আসতাম না। আনিসুল হক মাঝেমধ্যে একটা কথা বলেন, ‘বই পড়ার দরকার নেই, বই কিনুন। আপনি না পড়লেও কেউ না কেউ বই পড়বে।’ কিন্তু আমি এ ক্ষেত্রে আশাবাদী হতে পারছি না। এটা বয়সের কারণেও হতে পারে। কিছুদিনের মধ্যে আমি ৭০ বছরে পা দেব। এখন আমার প্রধান চিন্তা আমার সংগ্রহে যেসব বই আছে, এগুলো আমি কাকে দিয়ে যাব। বাংলা একাডেমিতে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি বই দিয়ে গেছেন। খোঁজ নিয়ে দেখবেন, সেই বইগুলো এখন বস্তাবন্দী হয়ে পড়ে আছে। 

বই পড়ার ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটা ভূমিকা রয়েছে। আমি যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়েছি—চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল—সেই প্রতিষ্ঠানের একটা সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ছিল। সপ্তাহে একটা নির্দিষ্ট দিন ছিল, যে দিন আমাদের লাইব্রেরিতে যেত হতো। সবাই লাইব্রেরিতে যেত না, কেউ কেউ যেত। আমি নিয়মিত যেতাম। লাইব্রেরিতে এই যাওয়া–আসাটাই বইয়ের প্রতি আমার নেশা ধরিয়ে দেয়। আর খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাই এখন বই পড়ার বিপক্ষে।

আমাদের সময় বার্ষিক পরীক্ষাটা হতো শীত ও বসন্তকালীন বন্ধের আগে। ফলে পরীক্ষার পর আমরা কী কী বই পড়ব, তার একটা পরিকল্পনা করতে পারতাম। আর এখন কী হয়, অধিকাংশ সময় বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধের পরে হয়। যে কারণে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে শিক্ষার্থীদের বই পড়ার আর কোনো সুযোগ থাকে না। তারপরের ব্যাপারটা হলো, বার্ষিক পরীক্ষা দেওয়ার পর ছেলেমেয়েরা আবার দৌড়ঝাঁপ শুরু করে পরের ক্লাসের কোচিং বা নতুন শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার জন্য। ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যে ছেলেমেয়েদের এখন আর বই পড়তে উৎসাহিত করছে না, এটা বলাই যায়। 

আগে সবাই কি জ্ঞানের জন্য বই পড়ত? উপন্যাসের বড় পাঠক ছিলেন আমাদের মায়েরা। স্বামী অফিসে, ছেলেমেয়েরা স্কুলে, মায়েরা বাসায় বসে বই পড়ছেন। কিন্তু এখন তো সেই সুযোগ নেই। মায়েদের ছেলেমেয়েকে স্কুলে আনা–নেওয়া করতে হয়, আবার গৃহস্থালি সামলাতে হয়। কাজেই পুরো ব্যবস্থাটা আসলে বই পড়ার বিপক্ষে। 

আবার প্রকাশনা ক্ষেত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে, দেশের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অংশই অসম্পাদিতভাবে বই করে। একটি পাণ্ডুলিপি পাওয়ার পর সেটি আদৌ প্রকাশযোগ্য কি না, বিষয়টি আমলেই নেওয়া হয় না। এসব কারণে ফি বছর গুণমানহীন বই বেশি বের হয়। আর এ বছর তো কাগজের দাম দ্বিগুণ বা আড়াই গুণ বেড়ে গেছে। এটা নিয়ে কথা বলবে কারা? ছাত্র, শিক্ষক, প্রকাশক এবং লেখকেরাও। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, এ ব্যাপারে তাঁদের বেশির ভাগেরই কোনো বক্তব্য নেই। আমাদের পুরো প্রকাশনাটা এখন একধরনের দুর্নীতির মধ্যে ঢুকে গেছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ জেলা–উপজেলায় সরকারিভাবে বই কেনার জন্য একটা বরাদ্দ থাকে। এই বইগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেখানে কমিশন বেশি পাওয়া যায়, সেখান থেকেই কেনা হয়। ফলে মানহীন বইপত্র ঢুকে পড়ে। তো এসব জায়গায় যদি আমরা নজর দিতে পারি, তাহলেই আসলে পরিবর্তন সম্ভব হবে।

ফারুক মঈনউদ্দীন

ফারুক মঈনউদ্দীন

আমি মোরশেদ শফিউল হাসানের কথার প্রসঙ্গ ধরে শুরু করি, যখন আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, তখন আমার মায়ের জন্য স্কুলের লাইব্রেরি থেকে নিয়মিত বই নিয়ে আসতাম। সে সময় আমি বুঝে না বুঝে মা পড়ার আগে বা পরে তাঁর জন্য যে বই আনতাম, তা পড়ে ফেলতাম। আমার মা আবার সন্তানদের ‘আউট বই’ পড়া নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। আউট বই কথাটা তো এখন আর শোনাই যায় না। আমাদের সময় অভিভাবকেরা আউট বই পড়াকে গর্হিত কাজ মনে করতেন। কিন্তু এই আউট বই আসলে আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। 

মোরশেদ ভাই আরেকটা কথা বললেন, এখন মায়েদের পড়ার সময় কোথায়? বিভিন্ন স্কুলের সামনে দিয়ে গেলে দেখা যায়, মায়েরা পুরো দিনের জন্য চলে আসেন। শুধু গল্প করে দিন না কাটিয়ে তাঁরা তো ওখানে বসে বই পড়তে পারেন, অবশ্য যদি তাঁরা চান। 

বই কেনা আর পড়া—এর মধ্যে কিন্তু ফরাক আছে। বই কেনা আমাদের একটা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে, না কিনে থাকতে পারি না। দশটা কিনলে দুটো পড়ি। জীবনসায়াহ্নে এসে এখন মনে হয়, ঘরে প্রচুর বই, এগুলো সংরক্ষণ করব কীভাবে? 

আমাদের দেশে বইমেলাটা আমরা মৌসুমভিত্তিক করে ফেলেছি। যেমন ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় বইমেলা হয়। তবে কেবল রাজধানীতে বইমেলা করলেই কি হবে? আমার প্রস্তাব হলো, সারা বছর বইমেলা হতে হবে। এ ক্ষেত্রে সারা দেশে সব প্রকাশককে একটি জেলার বইমেলায় যাওয়ার দরকার নেই। ধরুন, রংপুরে একজন প্রকাশক বইমেলা করছেন। তিনি সেখানে শুধু নিজের বই রাখবেন না, সব প্রকাশনীর বই রাখবেন। আবার অন্য জেলায় আরেকজন প্রকাশক বইমেলা করবেন। তিনিও সেখানে অন্য প্রকাশকদের বইপত্র রাখবেন। আমাদের প্রকাশক সমিতির নেতৃত্বেই এটা হতে পারে। তাঁরাই ঠিক করে দেবেন কারা কোন জেলায় বইমেলা করবেন। এভাবে বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকাশক বইমেলা করে বইকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে পারেন। 

এ ছাড়া অমর একুশে গ্রন্থমেলাসহ অন্যান্য বইমেলায় টিকিট চালু করলে মেলার পরিবেশ আরও সুন্দর হবে বলে মনে হয়। একুশে বইমেলায় যত মানুষ যায়, এর মধ্যে কতজন সত্যিকার অর্থে বইপ্রেমী, আর কতজনই–বা ক্রেতা? অনেকে তো শুধু সেলফি তোলার জন্য বইমেলায় যান। ফলে টিকিটের দাম ১০–২০ টাকা করলে বইপ্রেমী মানুষজন আপত্তি করবেন বলে মনে হয় না। এতে বাংলা একাডেমিরও কিছু আয় বাড়বে। 

আফসানা বেগম

আফসানা বেগম

ছোটবেলায় আমরা যখন স্কুলের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম—গান, নাচ, আবৃত্তি—এসব প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে ক্রেস্ট নয়, বই–ই পেতাম। সেখান থেকেই মূলত আমার বই সংগ্রহ শুরু। একদম শৈশবে বই ছিল আমার একমাত্র খেলনা। বইয়ের ছবির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতাম। কার্টুন পড়ার নেশা হয়েছিল। বড় ভাই নিয়মিত বাসায় বই নিয়ে আসতেন। উদয়নসহ অন্যান্য পত্রপত্রিকাও নিয়মিত বাসায় আসত। তো ওই উদয়নসূত্রেই আমার রাশিয়ান সাহিত্য পড়া শুরু। মনে আছে, পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা শেষে একটা লম্বা ছুটি পেলাম, সেই সময় বাবা রবীন্দ্র–শরৎ রচনাবলি হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সব মিলিয় বই–ই আমাকে প্রথম কল্পনা করতে শিখিয়েছে। আমাদের সময় আজকের মতো বিনোদনের এত ব্যবস্থা ছিল না, বইয়ের মধ্যে নিভৃতে সব সময় লুকিয়ে থাকতাম। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। এখন অনেক কিছু রয়েছে, যেখানে মানুষ সহজেই মনোযোগী হতে পারে। 

আমাদের চোখের সামনেই তো ভিজ্যুয়াল মিডিয়া বইকে ছপিয়ে গেল। এখন এমন পর্যায় এসেছে, একটা দ্রুত চলে যাওয়া ভিডিওতে মানুষ যেভাবে মনোযোগী হতে পারে, বইয়ে সেভাবে পারে না। কিন্তু এগুলো আমাদের মননশীলতায় কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। তাই আমার মনে হয়, বইয়ের প্রভাব খুব দীর্ঘস্থায়ী। 

বইয়ের ক্ষেত্রে যদি গল্প–উপন্যাসের কথা বলি, যখন বইটি পড়ছি, কল্পনায় সেই চরিত্রগুলোকে সামনে আঁকতে পারছি। কিন্তু প্রযুক্তির প্রাবল্যে আমাদের তো এখন কল্পনা করার কোনো কিছু আর থাকছে না। সবাই–ই সব সময় ব্যস্ত, একটা থেকে আরেকটায়। এ পরিস্থিতিতে মননশীলতা তৈরির জন্য বই খুবই দরকারি। 

তবে কোন বই আমার জন্য দরকারি, অধিকাংশ পাঠকই এখন তা জানেন না। বইমেলায় তাঁরা উদ্​ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ান। আমি তো বইয়ের খবর মোটামুটি রাখি। কিন্তু মেলায় গিয়ে আমিও বিভ্রান্ত হই, এই রাশি রাশি বইয়ের মধ্য থেকে কোনগুলো কিনব? তাই বইমেলার ভালো বইগুলো সম্পর্কে পাঠক যেন আগেভাগে জানতে পারেন, সে ব্যাপারে আমাদের গণমাধ্যমগুলো আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে।

আরেকটা বিষয়, আমরা যে নিশ্চিন্ত সময় পার করেছি, আমাদের ছেলেমেয়েদের সেই নিশ্চিন্ত সময় কি এখন আছে? এখন বোধ হয় আমরা পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়তে ছেলেমেয়েদের অনেক কম উৎসাহিত করি। আর করলেও তাদের জীবন এত দ্রুতগামী হয়ে গেছে যে তার ভেতরে বই পড়ার মতো নিরিবিলি একটা ব্যাপার, জোর করে চাপিয়ে দেওয়াও কঠিন। তাই আমি মনে করি, ছেলেমেয়েদের উৎসাহিত করার পাশাপাশি তাঁদের অভিভাবকদেরও অনুপ্রাণিত করতে হবে, যেন তাঁরা ছেলেমেয়ের হাতে আনন্দময় বই তুলে দেন, যেটা তাঁদের বাবা–মা ও শিক্ষকেরা তাঁদের হাতে একসময় তুলে দিয়েছিলেন।

আরিফ খান

আরিফ খান

বই পাঠের যে একটা ন্যারেটিভ বা বয়ান আছে, তার পুনর্জাগরণ দরকার। আসলে বই পাঠের সেই বয়ানের সবচেয়ে ধারালো অংশটাই আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এখানে আমি বই পড়ার যে বয়ান প্রসঙ্গে বললাম, এখন তার ব্যাখ্যা দেওয়া যাক: এই আলোচনায়ও এসেছে যে বই পড়লে কল্পনাশক্তি বাড়ে, বড় বড় মানুষ বই পড়েন বা পাঠের গুরুত্ব আছে। শুরুতে এই বয়ান আমাদের ছিল না। ছাপানো বই যখন মানুষের জীবনের অত্যাবশ্যকীয় অংশ হয়ে উঠল, এই বয়ান তখন প্রধান ছিল না। সে সময় প্রধান বয়ান ছিল, শ্রেষ্ঠ হতে হলে বই পড়তে হবে। পড়া শ্রেষ্ঠ হওয়ার পূর্বশর্ত। পাঠ না করলে শ্রেষ্ঠ হওয়া যায় না। বই পড়লে কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি পায়—আমাদের এখানে এ ধরনের বয়ান চালু হয়েছে গত ৫০–৬০ বছর। 

ঢাকায় প্রথম ছাপা বই প্রকাশিত হয় ১৮৪৯ সালে। সেই হিসাবে মাত্র ২০০ বছরের পাঠের ইতিহাস আমাদের। এত অল্প সময়েই বই পাঠের বয়ানটা কীভাবে বদলে গেল, তা নিয়ে অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

দেশভাগের পরে এখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে। এ শ্রেণি বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে পাঠক শ্রেণিরও বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের কারণে সেই পাঠক শ্রেণির বিকাশের পথ নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ব্যক্তিগত স্তর থেকে শুরু করে সামষ্টিক বা গণমাধ্যম—সব জায়গায় যে কথাটি সবচেয়ে জোর দিয়ে বলা দরকার তা হলো: বই পড়লেই মানুষ শ্রেষ্ঠ হয়। কিন্তু আমরা এখন এটা খুব মিনমিন স্বরে বলি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা রিডিং ক্লাব ট্রাস্ট শুরু করেছি। আমাদের সংগঠনটি শিক্ষার্থীদের শুধু বই–ই পড়ায় না, বই পড়ার উপায়ও বাতলে দেয়। আমরা কেন এই কার্যক্রম শুরু করেছিলাম? কারণ, সবাই শুধু পড়ার কথা বলে, কিন্তু কীভাবে পড়তে হয়, তা বলে না। পড়ারও একটা কৌশল আছে, এর জন্য প্রশিক্ষণ দরকার। আসলে পাঠ কৌশলটা আমাদের আয়ত্ত করতে হবে। পাঠ দক্ষতার অভাবহেতু অনেকেই বই পড়তে পারে না। বইভীতি একটা রোগ। আমাদের মূলধারার আলোচনায় এই বিষয়টি আসে না। আমরা রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের মধ্য দিয়ে বই পড়ার ব্যাকরণ তৈরির চেষ্টা করছি। এখানে আমি সুনির্দিষ্টভাবে বলতে চাই, পাঠের মতো একটা নিঃসঙ্গ কাজ কী কৌশলে করা সম্ভব হবে, তা আমাদের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হোক।

সবশেষে বলব, বই পড়া সারা জীবনের কাজ এবং মানুষ আসলে পড়লেই বেঁচে থাকে—আমাদের সাংস্কৃতিক আলোচনাগুলোতে বিষয়টি এখন জোরেশোরে উত্থাপন করা উচিত। 

আলভী আহমেদ

আলভী আহমেদ

আমি বড় হয়েছি মফস্​সলে, গোপালগঞ্জ শহরে। সেখানে নজরুল পাবলিক লাইব্রেরি নামে একটা গ্রন্থাগার ছিল। ওখান থেকে আমরা বই নিয়ে আসতাম। তো আমার বড় ভাই দেখলেন, আমি প্রতিদিন বই নিয়ে আসি। আমি বই পড়ি বলে তিনি খুব খুশি হলেন। কিন্তু তিন গোয়েন্দা, সাগর সৈকত, রত্নদানো—এসব বই আনতাম বলে বড় ভাই আমাকে একটু ‘মানুষ’ করার চেষ্টা করলেন। মনীষীদের জীবনী কিনে নিয়ে এলেন আমার জন্য। তবে সেগুলো পড়তে আমি উৎসাহী হলাম না। এরপর তিনি কিন্তু অন্য দশজন মানুষের মতো আমাকে ওগুলো পড়তে বাধ্য করেননি, আমাকে তিনি সেবা প্রকাশনীর গ্রাহক করে দিলেন। ঘটনাটা বলার মাধ্যমে আসলে যা বলতে চাইছি তা হলো: বই পড়াটা একটা ভালোবাসার ব্যাপার। এই ভালোবাসাকে কাছের মানুষজন, পরিবার যদি উৎসাহ না দেয়, তবে এটা কখনোই বিকশিত হবে না। 

এখনকার ছেলেমেয়ে, এ যুগের মানুষের হাতে অনেক রকমের বিকল্প আছে। বই তো কোনো চটকদার জিনিস না যে একটা শিশু বা কিশোর নিজের ইচ্ছায় এটা বেছে নেবে। ছোটবেলা থেকে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলাটা খুব জরুরি। আমার মনে হয়, এখনকার ছেলেমেয়েরা যে বই কম পড়ছে, এর কারণ হলো আমরা তাকে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বই পড়ায় উৎসাহিত করছি না। আরও কিছু ব্যাপারও আছে। যেমন বইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী এখন আর শুধু বই নয়, অনেক কিছু—বইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী একটা ইউটিউব প্ল্যাটফর্ম এবং একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসও। অসংখ্য জিনিস এখন বইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে, যেগুলো আমরা একটা মুঠোফোনের মধ্যেই পেয়ে যাচ্ছি। 

এই সময়ে সবকিছুই তো অনলাইনে সহজলভ্য। এই অনলাইন সহজলভ্যতা কমাতে হবে। আর সামনের দিনগুলো ই-বুক বেশ ভালোভাবেই রাজত্ব করবে বলে আমার অনুমান। ডিভাইসের মাধ্যমে বই পড়লেও তো মানুষ আসলে বই–ই পড়ছে। তো এই ই–বুক দিন দিন আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। তাই ই-বুক প্ল্যাটফর্মগুলো নিয়েও আমাদের কাজ করার অবকাশ আছে। 

আনিসুল হক

সবার কথা থেকেই আমরা উপলব্ধি করলাম, বই মানুষের জীবনকে কীভাবে ইতিবাচকভাবে বদলে দেয়। বই পড়ারও একটা যোগ্যতা লাগে, কাজেই সবাই পাঠক হবেন না। তবে বই না পড়ে কেউ বড় মানুষ হবে, শ্রেষ্ঠ হবে—এটা অকল্পনীয়। বেশ অনেক দিন ধরেই আমি একটা কথা বলে আসছি, ‘ক্রেস্ট নয়, বই দিন।’ যেকোনো আয়োজন বা অনুষ্ঠানে অতিথি বা পুরস্কৃতকে ক্রেস্টের বদলে বই দিন। জন্মদিন, বিয়ে, পয়লা বৈশাখসহ বিভিন্ন উপলক্ষে ক্রেস্টের বদলে বই দেওয়ার আন্দোলন সফল হলে তা আমাদের পাঠাভ্যাসের ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন আনবে বলে আমার বিশ্বাস।

সবাইকে ধন্যবাদ।