অদৃশ্যমান

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মনোবিজ্ঞানীর সামনে বোধ হয় মানুষ একটু তটস্থ থাকে। সে জন্যই সাইকিয়াট্রিস্ট জিব্রান আহমেদের মনে হতে লাগল, তার সামনে যে দুজন মানুষ বসে আছে, তারা নিজেরা নিজেরা বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। তাই খুব একটা অবাক হচ্ছে না জিব্রান। তবে ওকে বিস্মিত করছে অন্য একটা বিষয়। 

একজন পুরুষ, যার নাম আবীর এবং এক নারী, নাম যার সিনথিয়া। দুজনের বয়সের তফাত দুই-তিন বছর হবে, এই মুহূর্তে বসে আছে তার সামনে। সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। পাশাপাশি বসে থাকা সত্ত্বেও যখনই একে অপরের দিকে তারা তাকাচ্ছে, মনে হচ্ছে নিজেদের যেন দেখছে না, একজন অন্যজনের শরীর ভেদ করে পেছনের দেয়াল, দেয়ালের সাদা রং আর গায়ে ঝোলানো বিদেশি পেইন্টিংগুলো দেখছে। ভুলেও যেন চোখাচোখি না হয়, এ বিষয়ে তারা ভীষণ সতর্ক। কেন? এ বিষয়টাই জিব্রান আহমেদকে ভাবাচ্ছে। 

জিব্রান দম নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনাদের সমস্যাটা কী বলুন তো? আন্ডারস্ট্যান্ডিং হচ্ছে না? সংসারে মানিয়ে চলতে কষ্ট হচ্ছে?’

ওর প্রশ্নে দুজনের কারও কোনো ভাবান্তর হলো না। তবে আবীর নামের তরুণটি কেশে গলা পরিষ্কার করল, ‘ব্যাপারটার শুরু দুবছর আগে।’

‘কী শুরু হয়? কলহ? অশান্তি?’

আবীরের স্ত্রী, সিনথিয়া মুখ খুলল এবার, ‘আমাদের সমস্যাটা শুরু হওয়া নিয়ে জানতে চাইছেন?’

একটু বিভ্রান্ত হলো জিব্রান। এমনভাবে মেয়েটা ওকে প্রশ্নটি করেছে, যেন স্বামীর উচ্চারিত শব্দ তার কানেই যায়নি। 

‘জি। একটু খুলে বলুন।’

আবীর আবারও ছোট কাশি দিয়ে বলতে লাগল, ‘দুই বছর আগে আমরা খুলনা গিয়েছিলাম, লঞ্চে করে, ঘুরতে। তখন আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে। হানিমুন ফেজে ছিলাম। দুজনের সবকিছু দুজনের ভালো লাগত। মাত্র ছয় মাসের প্রেম, এরপর বিয়ে, বুঝতেই পারছেন!’

‘তারপর?’

‘রাতের লঞ্চ ছিল। আমরা কেবিন নিয়েছিলাম। সঙ্গে লাগোয়া বারান্দা। মাঝরাতে দুজন বারান্দায় চেয়ার পেতে গল্প জুড়ে দিলাম। আকাশে মস্ত চাঁদ। হু হু করে বয়ে যাচ্ছে শীতল বাতাস। কী দুর্দান্ত একটা সময়! কিন্তু কিছুক্ষণ পর লক্ষ করলাম, একজন বুড়ো লোক আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে গভীর দৃষ্টিতে। আমাদের দুটো কেবিন পরে যে টেবিল পাতা, সেখানে বসে আছে সে। তার দৃষ্টিতে একধরনের প্রশংসা আর পরিতৃপ্তি। এমন চাহনি আগে দেখিনি। প্রথমে ভেবেছিলাম ইগনোর করে যাব, কিন্তু লোকটার অপলক দৃষ্টিতে একসময় অস্বস্তি হতে লাগল। সিনথিয়াও নড়েচড়ে বসল। ঠিক করলাম লোকটার সঙ্গে কথা বলব। ধমক-ধামক দেব এভাবে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকার জন্য।’

‘তারপর? গেলেন?’

‘না। লোকটা নিজে থেকেই উঠে এল। পরিচয় দিল নিজের। জানাল তার নাম আমজাদ, ব্যবসায়ী। খুলনায় থাকে। ঢাকায় এসেছিল কাজে। কথাবার্তায় এত অমায়িক যে ধমক দিয়ে কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না; বরং নিজেই সে ব্যাখ্যা করল, কেন এতক্ষণ ওভাবে দেখছিল আমাদের।’

‘ইন্টারেস্টিং, কেন দেখছিল?’

‘আমজাদ সাহেব বললেন, আমাদের দেখে তার নিজের তরুণ বয়সের কথা মনে পড়ে গেছে। সিনথিয়ার সঙ্গে নাকি তার স্ত্রীর চেহারার বেশ মিল। কথাটা বিশ্বাস করিনি যদিও, বুড়ো হাবড়ারা নিজেদের নিঃসঙ্গতা কাটাতে এমন অনেক ছুতো নিয়ে এসে খেজুরে আলাপ জুড়ে দেয়। তবে অবাক হলাম খানিক, যখন সিনথিয়া কানে কানে বলল, আমজাদ সাহেবের সঙ্গে আমার চেহারারও বেশ মিল আছে।’

‘আধো-অন্ধকার, জাহাজের বারান্দায় এত ভালো তো বোঝার কথা নয় আপনাদের। বোধ হয় ওনার কথায় প্রভাবিত হয়েই এমন মনে হয়েছিল। সে যাক, তারপর?’

‘তারপর লোকটা নিজেই নিজের প্রেমের গল্প শুরু করে দিলেন। কীভাবে দেখা হয়, প্রেম হয়, বিয়ে হয়—সব বলল। যতই শুনছিলাম, সিনথিয়া আর আমি বিস্মিত হচ্ছিলাম একটু একটু করে।’

‘কেন?’

‘কারণ, লোকটার গল্প আমাদের গল্পের সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে যায়। যেমন সে তার প্রেমিকার কলেজের সিনিয়র ছিল, আমিও সিনথিয়ার ভার্সিটির সিনিয়র। একটা সেমিনারে যোগ দিতে গিয়ে তাদের পরিচয় হয়, আমার আর সিনথিয়ারও তা–ই। এভাবে যতই গল্প শুনছিলাম, আবিষ্কার করছিলাম যে লোকটার গল্প আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠানে কতজন অতিথি ছিল, কতজন বন্ধুবান্ধব ছিল, কী কী হয়েছিল, সেসব বর্ণনাও প্রায় অভিন্ন। মনে হচ্ছিল, আমাদের গল্পই বোধ হয় কারও মুখে শুনছি, শুধু সময়টা আলাদা। লোকটা কথা শেষ করার পর থ হয়ে বসেছিলাম আমরা।’

‘লোকটার স্ত্রীর কথা জানতে চেয়েছিলেন? কোথায় আছেন তিনি এখন? খুলনায়?’

‘চেয়েছিলাম, সেখানেই আসে আসল ধাক্কাটা। লোকটা বলল, বলা নেই কওয়া নেই, একদিন হুট করে তার স্ত্রী অদৃশ্য হয়ে যায়। রাতের বেলা তার সঙ্গেই ঘুমাচ্ছিল, সকালে উঠে দেখে বিছানায় তার পাশে স্ত্রী নেই। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। পালিয়ে গেছে বা অন্যত্র চলে গেছে, এমন কিছু নয়। স্রেফ উধাও হয়ে গেছে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী অনেক খোঁজাখুঁজি করল, পুলিশ কেসও হলো একসময়, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।’

‘হুম, তো এ গল্পটা আপনাদের বিরক্ত করছে?’

‘জি, ভীষণ!’

‘বুঝলাম। লোকটার স্ত্রীর কী হয়েছিল আমি জানি না, কিন্তু দুই দম্পতির গল্প অভিন্ন কেন, সেটা অনেকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে আমার একটা প্রশ্ন, এটা তো দুই বছর আগের ঘটনা, এত দিন পরে গল্পটা আপনাদের বিরক্ত করছে কেন? আর করলেও সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে আসতে হলো কেন আপনাদের? এত সিরিয়াস কিছু তো নয়!’

ফোঁস করে দম নিয়ে মাথা নিচু করল আবীর। মিনমিন করে বলল, ‘সেদিনের পর থেকে আমার আর সিনথিয়ার মধ্যে অল্পবিস্তর ঝামেলা শুরু হয়, শুরু হয় মনোমালিন্য, ভুল–বোঝাবুঝি। মাসখানেক পর এক সকালে…’

‘কী হলো এক সকালে?’

‘এক সকালে উঠে দেখি, সিনথিয়া নেই আমার পাশে। প্রথমে পিলে চমকে উঠল বুড়োর গল্প মনে করে। কিন্তু আস্তে আস্তে আবিষ্কার করলাম, সিনথিয়া গায়েব হয়নি। গায়েব হয়েছি আমরা!’

‘আপনারা গায়েব হয়েছেন মানে?’

‘মানে, আমরা একে অপরকে দেখতে পাই না এখন আর, শুনতে পাই না। সবাই আমাদের দেখতে পায়, শুনতে পায়, কিন্তু নিজেরা নিজেদের কিছুতেই দেখতে-শুনতে-ছুঁতে-অনুভব করতে পাই না। কিছুতেই না…!’