
দেশে দেশে কত রকমের আদরণীয় বস্তু, কাপড়ের পুতুল, দিদিমার হাতের মিঠাই, জোকার দিয়ে ওঠার মতো বুলি বা বচন—ঘুমপাড়ানিয়া রূপকথা। এরা চিরপুরাতন, অনেক কালের আনন্দ-বেদনা-প্রাপ্তি-বঞ্চনার আলেখ্য লুকোনো এদের বুকে। যে রূপকথাগুলো আমাদের শৈশবসঙ্গী তাদের কেউ কেউ জন্মেছে হাজার বছর আগে, এমনকি কেউ কেউ ছয় হাজার বছর আগের ব্রোঞ্জ যুগের। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এদের কাজ মাতৃজঠরের অ্যামনিওটিক ফ্লুইডের মতো শিশুর পৃথিবীকে লালন করা, জীবন যে সুন্দর আর আশাজাগানিয়া, জগৎ যে ন্যায় ও সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে—এই সব মানবিক ভরসাতে পরিপুষ্টি দেওয়া এদের কাজ। বাঙালি শিশুর গঠনে তেমন পালিকা কোষমাতৃকা হচ্ছে ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদার থলে, দাদামশায়ের থলে, ঠানদিদির থলে। গ্রামবাংলার ভুলে যাওয়া কাহিনিগুলো উদ্ধার করে সাড়ে বারো বছরে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের সংগ্রহ ও নির্মাণ, যা একই সঙ্গে মৌলিক ও যৌগিক।
ঠাকুরমার ঝুলি নিয়ে কথা বলতে গেলে দক্ষিণারঞ্জন মজুমদারের জীবনকে বাদ দেওয়া অসম্ভব। শৈশবে মাতৃহীন, স্কুল পালানো দুরন্ত এই কিশোরকে শেষ অবধি মাতৃত্বের বাঁধনে বেঁধেছিল দেশের মাটি, জমিদারির দেখাশোনা করতে গিয়ে আরেক স্কুল পালানো মনীষার মতোই তিনিও কান পেতে শুনেছিলেন বিশাল বাংলার মেঠো আত্মার সুর, সংস্পর্শে এসেছিলেন লোককবি ও লোককাহিনির, ফোকলা দাঁতের গল্পকুশলা দিদিমাদের গল্প যত্ন করে সংগ্রহ করেছেন ফনোগ্রাফের কৃপায়। কলকাতায় দক্ষিণারঞ্জন যখন তাঁর সংগ্রহ নিয়ে আবির্ভূত হলেন, তখন স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ারে ভাসছে কলকাতা শহর। সঠিক সময়েই তিনি এলেন স্বদেশি সম্পদের সম্ভার হাতে করে, কাগজে করে ধরে এনেছেন ‘পরণকথা’র জাদুকরদের, গল্পকে জীবন্ত করে তুলেছেন একটি অভিনব ভাষারীতিতে। প্রত্যন্ত পল্লির পালাপার্বণ-যাত্রা-কথকতার সরস প্রবাহ ধরে এনেছেন বয়স্কলোকের নির্দয় নির্লিপ্ত স্বার্থবিকৃত হৃদয়ের কাছে। অতএব, দক্ষিণারঞ্জন দোরে দোরে ঘুরলেন পাণ্ডুলিপি হাতে করে। লোকে বলল, এমন বই ছাপলে পাগল উপাধি পেতে হবে। একসময় দীনেশচন্দ্র সেনের জহুরি হাতে পড়ে গেল ঠাকুরমার ঝুলির পাণ্ডুলিপি। দীনেশচন্দ্র এই অপূর্ব রচনাবলি নিয়ে গেলেন সে কালের নামকরা প্রকাশক ভট্টাচার্য অ্যান্ড সন্স-এ। শুধু তা-ই নয়, দীনেশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জানালেন দক্ষিণারঞ্জনের কথা—যে রবীন্দ্রনাথ আশা করে গেছেন, ‘ব্যক্ত হোক জীবনের জয়/ব্যক্ত হোক তোমা মাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।’ রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ঠাকুরমার ঝুলির ভূমিকা, অকুণ্ঠ চিত্তে দক্ষিণারঞ্জনকে ধন্যবাদ জানিয়ে সে ভূমিকায় তিনি লিখলেন, ‘আমি হইলে এ কাজে সাহসই করিতাম না। শিশুর মনভুলানিয়া রূপকথা আর “ম্যানচেস্টারের কল হইতে তৈরী” হয়ে আসবে না, দেউলিয়া স্বদেশের কোলে লুকানো ছিল মণিমানিক্যের থলে—আজ হতে তার সন্ধান পাওয়া গেল।’ ঠাকুরমার ঝুলির সঙ্গে শুধু রবীন্দ্রনাথ আর দীনেশচন্দ্র সেনই নন, জড়িত আছেন ঋষি অরবিন্দ, বারিদবরণ ঘোষ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, চিত্তরঞ্জন দাশ, রমেশচন্দ্র দত্ত—এমন সব বিশাল নাম।

এই রূপকথাগুলো তো কেবল নিটোল বৃত্তে ঘুরে আসা গল্পই নয়, নয় শুধু ফ্যান্টাসি আর কল্পনাশক্তির যূথক্রিয়া, সিসার অক্ষরে আর ছাপাখানার কালিতে ধরা আছে গ্রামবাংলার গল্প বলিয়েদের কণ্ঠের জাদু, সেই সঙ্গে ধরা আছে একরকমের প্রাচীন সারল্য। ঠাকুরমার ঝুলিতে এমন কিছু ধন্যাত্মক অব্যয় শব্দ আছে, এমন কিছু উপমা এবং বলার ভঙ্গি আছে, যা আর কোথাও নেই। রাজপুত্রের ‘পরান কেন ছবছব’ করে, ‘হেঁটে কাঁটা ওপরে কাঁটা’ই বা কী শাস্তি, পালোয়ানে কী করে একগালে পুরে নেয় একটি পুকুর, মায়াবিনীকে ধরে ‘স্বরূপকথা ক’ বলার মানে কি তাকে আপনার মূর্তি ধারণ করতে বলা? ‘দর্পণে মুখ হেলে’ মানে আয়নায় মুখ দেখে? পাশাবতীর বোনদের গানটি মনে পড়ে আপনাদের? ‘যে জিনে সে মালা পায়, হারলে মোদের পেটে যায়।’ এ যেন শহরের যান্ত্রিকতায় উন্মাতাল জীবনযুদ্ধের গান। যে জিতবে, সে যশ লাভ করবে, হারলে একেবারে হজম হয়ে যাবে। এই যে রাক্ষস-রাক্ষুসী, এই যে পিশাচ—এরা আসলে কারা? বনভূমিতে যে প্রবলপরাক্রান্ত ক্যানিবলরা থাকত, তারা নয়তো? জীবজগতে কোন প্রাণীটি ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি, উষ্ণ রক্তে যাদের বাছাদের চোখ ফোটে? শুধু আবৃত্তি করে দেখুন ‘কেন রে নটে মুড়োলি’, কিংবা ‘কেন লো বৌ ভাত দিস না?’—আপনার গলায় আপনা থেকে সুর এসে পড়বে।
গজেন্দ্রকুমার মিত্র লিখেছিলেন, দক্ষিণারঞ্জনকে লোকে গ্রিম ব্রাদার্সের সঙ্গে তুলনা করে। এহেন তুলনা অনুচিত। এক প্রতিভার সঙ্গে আরেক প্রতিভার তুলনা চলে না। আমি অধম এই অনুরোধের সঙ্গে একমত। ঠাকুরমার ঝুলি কীর্তি হিসেবে এবং দক্ষিণারঞ্জন কীর্তিমান হিসেবে তুলনারহিত, তাঁর রচনাবলি যে শূন্যস্থান পূরণ করেছে, সেটুকুকে বাদ দিলে বাংলাভাষায় শিশুসাহিত্য এবং রূপকথা দেউলিয়া হয়ে পড়ে। রূপকথায় সাধারণত বলার কথাটিই প্রধান। অর্থাৎ গল্পটিই রূপকথায় মূল বিষয়, কিন্তু ঠাকুরমার ঝুলির প্রাণ এর বলার ভঙ্গিতে, সেই ভঙ্গিতে ক্ষণে ক্ষণে নির্মীয়মাণ একটি অধরা জগতে—যতিচিহ্নগুলোর, অব্যয়ধ্বনিগুলোর ও উপমাগুলোর নাটকীয়তায়। বাঙালির ঐতিহ্যের একটি স্মারকচিহ্ন ঠাকুরমার ঝুলি।
বাংলা ভাষা, পল্লিগ্রামের ভাষাভঙ্গি ও বচনরীতি—এই সব যখন থেকে অযত্নের শিকার হয়েছে, তখন থেকে হয়েছে নির্বাসিত, তাকে প্রতিস্থাপন করেছে পুনরায় ম্যানচেস্টারের কলে তৈরি হয়ে আসা রূপকথারা। মোটের ওপর বাঙালি পড়ুয়া জাত নয়, পড়তে ভালোবাসে না যতটা শুনতে ভালোবাসে, যে পড়ে না সে পড়ার জিনিসের কদরও জানে না। অতএব ঠাকুরমার ঝুলি এবং ঝুলিস্থিত তাবৎ মণিমানিক্য একদিন গ্রন্থাগারের তাকের বস্তু হয়ে গেছে, কবে তা বোধ হয় আমরা টেরও পাইনি। সাড়ে চার শ বছরের পুরোনো শেক্সপিয়ারকে সজীব করে রেখেছে ইংরেজরা, ২০৫ বছরের পুরোনো গ্রিম ভ্রাতৃদয় বেঁচে আছেন নতুন সব শৈল্পিক ক্রিয়াকাণ্ডে। অথচ ১১০ বছরের পুরোনো ঠাকুরমার ঝুলিকে কেউ আগলে বসে নেই, কিছু অপটু হাতের অ্যানিমেশনে বিকটদর্শন মামদো ভূত আর শাঁকচুন্নি ছাড়া আর কোথাও চিহ্ন নেই তার। আমাদের শৈশবেও চোষ-কাগজে ছাপাই এই বইটি লোকে ছেলেমেয়েদের জন্মদিনে হাতে তুলে দিত। শিঙা ফুঁকতে থাকা উত্তরমুখী আর দক্ষিণমুখী পরির ছবির মাঝখানে লিখে দিত শিশুর নাম আর জন্মদিনের শুভাশিস। রূপকথা পড়ে শিশুর অবোধ চোখ ঘুরে যেত জগতের রাজপুত্র-রাজকন্যার প্রেম-ভালোবাসার হাতছানিময় জগতে কিংবা ভয়ে শিঁটিয়ে যাওয়ার মতো অন্ধকারের রাক্ষস-রাক্ষসীর দিকে। এই পূর্বপ্রস্তুতির পর্ব এখন অচল। শিশুরা পাতা উল্টিয়ে বই পড়ে না, আঙুল দিয়ে সার্ফ করে। আপন ঠাকুরমার কোঁচড়ের রত্নাবলির হদিস মেলার আগেই সে প্রস্তুতিহীনভাবে চলে যায় বিশ্বসভায়, বা বলা ভালো বিশ্বের তথ্যসভায়।
শিশু আর শিশুর মাতা-পিতাকে দোষারোপ করার আগে কিছু বিষয়ে আমাদের ভাবতেই হবে। আমরা কি যা কিছু আমাদের, ভালোবেসে সেগুলোকে যুগোপযোগী করার, পরিবর্তিত কালের দাবির কাছে গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করেছি? দক্ষিণারঞ্জন নিজের হাতে যেসব ছবি এঁকে ঠাকুরমার ঝুলির অলংকরণ করেছিলেন, তা আজকের একটি শিশুর কাছে কতটা নয়নলোভন? পাশ্চাত্যে বেশির ভাগ শিশুকে ঘুমোতে যাওয়ার আগে নিয়ম করে গল্পের বই পড়ে শোনানো হয় বা পড়তে দেওয়া হয়, সেটা আমরা কতটা করি? এক শ বছরের অধিক পুরোনো এই ভাষারীতির সঙ্গে শিশুর অভিভাবকেরাই-বা কতটা পরিচিত, কতটা দীক্ষিত? চর্চার কমতি থাকতে পারে, নিজের জিনিস বলে আদরের কমতি আপনি পুষিয়ে দেবেন কী দিয়ে? হৃদয়ে অনাদর থাকলে কুযুক্তির অভাব হয় না। হয়নি আমাদের। নইলে ঠাকুরমার ঝুলিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যেত অসাধারণ অলংকরণ করে। ঠাকুরমার ঝুলির লেখনরীতিকে নিয়ে পুনর্নির্মাণ করা যেত স্যাটায়ার। প্রতিটি গল্পে রয়েছে পুনর্নির্মাণের ইন্ধন, সমাজতত্ত্ববিদ যেমন করে দেখতে চান, নারীবাদী যেমন করে দেখতে চান, তেমন-তেমন করে দিব্যি দেখা যায় এই গল্পগুলোকে। এক দেশের রূপকথার সঙ্গে আরেক দেশের রূপকথা মিলিয়ে দিলে কেমন হতে পারে তার সাজ? সামাজিক পঙ্ক্তি-বিভাজন এবং শোষণের যে চিত্র বারবার রূপকথায় চালচিত্রের মতো ধরা দেয়, সেই চিত্রটি নতুন কালে নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছে কিন্তু মূল সুর বজায় আছে—তাকে রূপকথার ভঙ্গিতে আরেকবার আকার দেওয়া যেতে পারে না? যে মালঞ্চমালা বা রূপবান আমাদের রূপকথা ও যাত্রাপালায় বয়সে প্রেমিক পুরুষের জ্যেষ্ঠ নারী বলেই এমন অবহেলিত, তাকে নিয়ে নারী জাগরণের কর্মীদের অনেক নতুন কিছু বলার আছে। যে শ্বশুরবাড়ি কিশোরী পুত্রবধূর হাত কাটে, পা কাটে, চোখ পোড়ায়, মাথা মুড়িয়ে দিয়ে পিশাচের ঘাটে ভেলায় ভাসিয়ে দেয়, সেই শ্বশুরবাড়ি তো এখনো তেমনি আছে। ঘুঁটেকুড়ুনির সঙ্গে ছুঁচকুমারের বিয়ে হলেও শেষ অবধি রাজকুমারীই হতে পারে ছুঁচকুমারের স্ত্রী, এই বিভক্তি আছে এখনো, কত রূপে। রূপতরাসী রাক্ষসী দিনে রানি সেজে থাকত আর রাতে হাতিশালের হাতি, ঘোড়াশালের ঘোড়া আর হংসশালের হাঁস খেয়ে ফেলত, সেই রূপতরাসীই কি আমাদের রাজনীতির প্রধান প্রবণতা নয়? দাদামশায়ের থলেতে যে সন্ন্যাসী তাঁর শিষ্যকে বলছেন, ‘শিগগির এ দেশ ছেড়ে পালাও, যে দেশে মুড়ি মিছরির সমান দর, সে নিশ্চয় কোনো মূর্খের দেশ!’, সেই উপদেশ কি আমাদের নিত্যদিনের প্রযোজ্য নয় এখনো?
এত প্রশ্নের উত্তর মেলে না। ব্যক্তিগত বা জাতীয়ভাবে আমাদের নিজেদের দিকে, নিজেদের সংস্কৃতির দিকে তাকানোর সময় আমাদের আজও হলো না। এমন অপূর্ব সব কীর্তি পাশাবতীর সাত বোনের মতোই ‘কেঁচোর মরণ মরিল’। শৈশব থেকে শুভর জয় আর অশুভর পরাজয়ে বিশ্বাস করার মতো ভরসাভরা প্রাণ আর তৈরি হবে না আমাদের, সেই ভরসা যে দেবে সেই রূপকথারা মরে হেজে গেছে।