অথচ কারও ঘুম ভাঙে না আর

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম
এক অদ্ভুত সময়। যেন নিজের ছায়াকেই বিশ্বাস করতে পারছে না কেউ! এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে বর্তমান সময়কে কাব্যিক আবহে ছুঁয়ে দেখা হয়েছে এ লেখায়।

যেন এখানেই থামার কথা ছিল সবার। যেন এখানেই থমকে গিয়ে নেওয়ার কথা ছিল নিজেদের ছায়ার মাপজোখ। দুপুরের আকাশ থেকে নেমে আসা সটান রোদের নিচে অথচ কোনো ছায়া নেই। মাপবে কী লোকেরা তবে? অতএব তারা আর প্রত্যাদেশ মানে না। দাবিনামা উল্টে হনহন হেঁটে চলে যায় যার যার কাজে। তবুও কিছু বোকার দল তখনো ছায়া খোঁজে। খোঁজে নিদানের ঠিকুজি। খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে একনাগাড়ে ‘আ...আ...আ...’ করে চিৎকার করে চলে। একটানা বেরহমভাবে। কোনো মায়া নেই যেন আর। নেই অন্য কোনো অনুকল্প। কিন্তু শহরে তো এখনো চলে বেশুমার বাস-গাড়ি। আর বড় রাস্তার ধার ছাড়া আর্তচিৎকারেরও কোনো অর্থ থাকে না। তাই তারা পথ ছাড়ে না। তারা দাঁড়িয়ে থাকে। নিচে আর ওপরে তাকিয়ে ছায়া খোঁজে নিজেদেরই। অথচ ছায়াদের থাকার কথা পায়ের তলায় নিরীহ-নিপাট। আর ওপরে থাকার কথা ছায়ার শুলুক। কিন্তু তার সন্ধানের বদলে তারা সেই উৎস বরাবর ছুড়ে দিতে থাকে তীব্র কানবিদারী চিৎকার।

অথচ কারও ঘুম ভাঙে না আর। এমনকি এই ভীষণ নিদাঘকালেও। অথচ ঘুম ভাঙে না আর। ব্যথার সঙ্গে ব্যথার আর দেখা হয় না। এ তল্লাটের জমিনে নেমে আসা রোদেরাও যেন আলাদা আলাদা। পৃথক তাদের আপতন রেখা। তারা যেন ভীষণ নির্বাচিত পন্থায় আলো বিলায় আজকাল। সূর্যেরও তবে আছে নিজস্ব পক্ষপাত সমীকরণ! সেই সমীকরণের অংশ হতে একে একে প্রত্যেকে আলাদা হয়। আলাদা হয়ে তারা ছোটে। ছুটতেই থাকে, যেন একটা রেস। তাদের স্মৃতিতে কি জেগে ওঠে কোনো ঘোড়দৌড়ের মাঠ? ঘোড়ার খুরের শব্দ তবু পাওয়া যায়, পাওয়া যায় তার প্রবল নিশ্বাসের ভাপ। কই, তেমন শব্দ কই?

অথচ ছুটছে সবাই। সমীকরণে গরহাজিরেরাও অন্যের হয়ে মাঠে নেমে বসে আছে। তাদেরই ব্যস্ততা বেশি। তাদেরই তাগাদা বেশি। অথচ ছুটছে সবাই। থামার প্রত্যাদেশ উপেক্ষা করে ছুটছে। কড়াইয়ে চড়াৎ শব্দ তুলে অনায়াসে ভেজে উঠছে মাছ। কেউ দেখছে না যে তখনো তার কানকোয় লেগে আছে লাল রং। সাদা ভাত আর কোনোভাবেই সম্মিলিত রোদের কথা বলছে না। সবাই যেন জেনে গেছে পৃথক রোদের কৌশলনামা।

ওই দূরে যারা কিছু আগুন জ্বালিয়ে এ দিনের বেলাতেই ভাবছে, এখনো বের হতে পারা মেয়েদের নিয়ে একটু চিৎকার করবে, তাদের দিকে ছুটে আসছে একের পর এক ইঞ্জিন। চিৎকারের আগেই তারা খেয়ে ফেলবে সবটুকু শক্তির আরক। আর বাকি যারা জবুথবু হয়ে আছে এখনো নিজস্ব উঠানে, আছে ব্যক্তিগত চিৎকার সাধনায় মশগুল, তাদের হঠাৎ করেই মনে পড়ে যাচ্ছে বৈষয়িক নানা হিসাব। তারা সেসব হিসাবের চোয়ালে বসে রাত হলে দেখে খবরবুড়োর মুখ। আর এভাবে তারা প্রস্তুত হতে থাকে কালকের দৌড়টির জন্য। তারপর কালকের। আবার কালকের।

অথচ কারও ঘুম ভাঙে না আর। এমনকি এই ভীষণ নিদাঘকালেও। অথচ ঘুম ভাঙে না আর। ব্যথার সঙ্গে ব্যথার আর দেখা হয় না। এ তল্লাটের জমিনে নেমে আসা রোদেরাও যেন আলাদা আলাদা। পৃথক তাদের আপতন রেখা। তারা যেন ভীষণ নির্বাচিত পন্থায় আলো বিলায় আজকাল। সূর্যেরও তবে আছে নিজস্ব পক্ষপাত সমীকরণ! সেই সমীকরণের অংশ হতে একে একে প্রত্যেকে আলাদা হয়। আলাদা হয়ে তারা ছোটে। ছুটতেই থাকে, যেন একটা রেস। তাদের স্মৃতিতে কি জেগে ওঠে কোনো ঘোড়দৌড়ের মাঠ? ঘোড়ার খুরের শব্দ তবু পাওয়া যায়, পাওয়া যায় তার প্রবল নিশ্বাসের ভাপ। কই, তেমন শব্দ কই?

অথচ এখানে কেউ নেই আর। ঘাসের ডগাগুলো কবেই তো চলে গেছে কংক্রিটের নিচে। অথচ শিশুগুলো এখনো স্বপ্ন দেখে। ফড়িংয়ের ওড়া দেখে। দেখে রংধনু। অথচ শিশুগুলো এখনো হয়নি উধাও। অথচ শিশুগুলো জানে না, তাদের মায়েদের গান মরল কিসে। বাল্যশিক্ষার বইয়ে তো এসবের উল্লেখ নেই। নেই সামাজিক রাইমে। তারা তাই জানে না, কী করে তারা অর্ধেক হয়। কী করে কে গিলে খায় সম–শৈশব। জোলাভাতি খেলতে খেলতে তারা আর দেয় না কল্পডানার উড়াল। ফলে তার ডানা–সম্পর্কিত কোনো স্মৃতি থাকে না। থাকে না নিজস্ব ধারাপাত। আর তাই তারা বড় হয়। বড় হতে হতে শান দেয়। শান দেয় ছুরি ও আদলের মগজে। শান দেয় রোদের পৃথক তত্ত্বে।

আর এভাবেই ‘নাই’ হয় সব। এভাবেই আসে নেমে ছায়াহীন দুপুরেরা। আসে নেমে টেনে টেনে হাঁটা মানুষ-আদল। জ্যান্ত থাকার অভিনয় নিয়ে তারা প্রতিযোগিতা করে। আর তখনো ছায়াহীন দুপুরে দাঁড়িয়ে যায় কেউ কেউ। সুদূর কোনো শৈশবের, সুদূর কোনো সমভাবের, সদ্য কোনো লুণ্ঠনের, সদ্য কোনো বিকারের কথা মনে করে, তারা একটানা চিৎকার করে চলে—‘আ...আ...আ...’। আর তাদের দিকেই ছুটে আসতে থাকে সশব্দ ইঞ্জিন ও বাস-গাড়ির মিলিত হর্ন ও সাইরেন। তবু তারা করে চলে সেই চিৎকার। যতক্ষণ কণ্ঠ মানে, যতক্ষণ হয় না অবশ। তবু তারা হয় না উধাও, পথের পৃষ্ঠাগুলো এক তালে দুলে ওঠার সুদূর আশ্বাসে।
অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]