অন নাথিং ডে

আজ ১৬ জানুয়ারি, নাথিং ডে মানে ‘কিছু না’ দিবস। এই দিনে কী করা যায়, সেই ভাবনা থেকেই এই লেখা।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

সকাল সকাল অফিসের জন্য বের হচ্ছিলাম, বউ বলল, ‘আজকে একটু তাড়াতাড়ি এসো। তোমার বন্ধুদেরও ডেকেছি।’
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন?’
বউ বলল, ‘এসো না। ছোট্ট একটা পার্টির ব্যবস্থা করেছি। সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যেই চলে এসো।’
আমি পড়লাম বিপদে।
আজ কোনো বিশেষ দিন কি?
বউয়ের জন্মদিন সামনে মাসে, তার পরের মাসে কন্যার। আমার জন্মদিন তো দুই মাস আগেই গেছে।
বিবাহবার্ষিকী?

স্বামীরা নাকি বিবাহবার্ষিকী ভুলে যায়। কেউ কেউ বলেন যে এমন ভয়ংকর একটা দিনের কথা স্বামীরা নাকি ইচ্ছা করেই মনে রাখে না। আমি ভুলি না। আর ভুলে যেন না যায়, তাই বিভিন্ন জায়গায় তারিখটাকে সংরক্ষণ করে রেখেছি। মানে আমাকে গুগল সাহেবও জানিয়ে দেন, এই যে শুনছেন ভাই, কাল কিন্তু আপনার বিবাহবার্ষিকী!
তা বিবাহবার্ষিকীও আমার জন্মমাসের আগের মাসে। তাহলে বাকি থাকল কী যে বউ একটা আয়োজন করে বসল? মানে এমন কোনো দিন যে দিনটায় আমি আমার বউ তো বটেই...আমার বন্ধুরাও জড়িত!

আমার আর আমার বউয়ের পাঁচ বছরের প্রেম, আট বছরের সংসার!

তাতে কিছু কিছু স্পেশাল দিন তো নিজে নিজে তৈরি হয়েছেই। কিন্তু সেগুলো তো আমরা পালন করি না। কিন্তু বউ যদি হঠাৎ নতুন করে আবার পালন করা শুরু করে? সে মনে রেখেছে, আমি মনে রাখিনি, এমন একটা ব্যাপার যদি হয়েই যায়, তাহলে তো বড় লজ্জায় পড়তে হবে!

আমাদের প্রথম দেখা কি আজকে?

মানে সেদিন ছিল বৃষ্টিভেজা বিকেল। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম বাসস্ট্যান্ডে আর আমার বউ বাস থেকে নেমে আমাকে রিকশাওয়ালা ভেবে হাতের ব্যাগটা ধরিয়ে বলেছিল, মামা, মালিবাগ!

কিন্তু সেটা জুনের দিকে না?

আবার প্রেমের প্রথম প্রস্তাব দেওয়ার দিনটা যেন কী ছিল?

ওই যে আমরা তখন ধানমন্ডি ৩২-এর দিকে ঘুরিফিরি, টিএসসি যাই, লাল চা খাই, সন্ধ্যায় প্যাটিস খাই...একসঙ্গে ঘুরতে আমাদের খুব ভালো...কিন্তু লাগলে কী হবে, কেউই কিছু বলতে পারি না; একদিন ভরা পূর্ণিমায় দুম করে বলে বসলাম, তুমি না থাকলে আমি গৃহত্যাগী হইতাম...
ভাগ্যিস, চাঁদ উঠেছিল গগনে!
কিন্তু সেও তো আগস্টের দিকেই। এখন তো জানুয়ারি, তাই না?
কলিগকে বললাম, ‘ভাই রে, আজ কী দিন?’
কলিগ আমার ঝাড়া মুখস্থ পার্টি। বলল, ‘আজ ১৬ জানুয়ারি ২০২১ ইং...২ মাঘ ১৪২৭ বাং...’
ভাবলাম, মাঘের ১ হলেও না হয় কিছু একটা হতে পারত...কিন্তু মাঘের দুইয়ে আবার কী!
কাজে ঠিক করে মন বসাতে পারলাম না। দিবস ভুলে যাওয়ার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নেই!
একটু পরেই হিমেলের ফোন এল, ‘ঘটনা কী বল তো?’
‘কী ঘটনা?’
‘ভাবি তো দাওয়াত দিছে। আজ কিসের কী?’
‘তোরে বলে নাই কিছু?’
‘না না বলে নাই। কিন্তু এমন কইরা বলল যে আমাদের কিছু একটা!’
‘হুম্‌।’
‘হুম্‌ মানে কী? কারও বার্থডে হইলে এক রকম প্রিপারেশন আবার অন্য কিছু হইলে অন্য রকম প্রিপারেশন না...আইজ কী আসলে?’
‘কী যে আমি বুইঝা উঠতে পারতেছি না।’
‘মঞ্জুকেও ডাকছে শুনলাম। বুলেটও ফোন দিছিল...’
‘ডাকছে যখন তখন চইলা আয়!’
বুঝলাম বউ খুবই আটঘাট বেঁধে নেমেছে। নিশ্চয় বড় কোনো দিন...আমিই ভুলে বসে আছে! এর পরিপ্রেক্ষিতে কী ঘটতে পারে, সেটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল!
বউ বলবে, এমন একটা দিন...বছরে মাত্র একটা দিনই তো আসে...সেইটাও তুমি মনে রাখতে পারো না?
আমি বলব, একটা দিন বলেই তো মুশকিল! স্লিপে দাঁড়িয়ে ক্যাচ ধরার মতো স্লিপারি বিষয়!
‘থাক, তোমাকে আর সাফাই গাইতে হবে না। যা–ই বলি না কেন সবকিছুর এক্সপ্লেইন তোমার কাছে হাজির থাকে! এ বিষয়ে আমি আর কোনো কথা বলতে চাই না!’

বউ যখন বলে, ‘এই বিষয়ে আমি আর কোনো কথা বলতে চাই না’—এর চেয়ে ভয়ানক কথা আর কিছু হতে পারে না। বউ তখন এ বিষয়ে কোনো কথা বলবে না ঠিকই...কিন্তু এই কথা সাবটেক্সট হয়ে বিভিন্ন কথার মধ্যে চলতে থাকবে। বিষয় দাঁড়াবে এ রকম—মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে!
দু–একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরও খোলাসা হবে:
হয়তো খেতে বসেছি। বলছি, মাছের রান্নাটা তো ভালোই হয়েছে!
বউ বলবে, থাক। রান্নার কথা বলে অযথা পটানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। আমি তো বলেইছি ওই বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলব না!
অথবা টিভি দেখতে বসেছি। বউয়ের পছন্দের শিল্পীর গান চলছে। আমি হয়তো বলে, উঠলাম এই শিল্পীটা তোমার ফেবারিট, না?
বউ বলবে, ওহ, আমার কোনো শিল্পী পছন্দ সেইটা তোমার মনে থাকে...কিন্তু...থাক, ওই বিষয়ে কথা নাইবা বলি!
সারাটা দিন অফিসে খুব অস্থির কাটল। আজকে কী যে এক দিন তাই বের করতে পারলাম না। ব্যর্থ মনে একটা কেক কিনলাম। যে অনুষ্ঠানই হোক...বউ ও কন্যা কেক খেতে পছন্দ করে।
কেকওয়ালা জিজ্ঞেস করল, ‘কী লিখবেন?’
আমি বললাম, ‘কিছু না!’
ওরা কেক প্যাক করে দিল। আমি বাসায় ফিরে দেখলাম বন্ধুরা চলে এসেছে। বউ আর কন্যার মুখে হাসি। আমি বললাম, ‘পরাজয় বরণ করে নিলাম। আজকে যে কী আমাদের বিশেষ দিবস তা মনে রাখতে পারি নাই...স্যরি! কিন্তু কী এমন সেই দিন যে আমার সব বন্ধু যুক্ত?’

ওরা কেক প্যাক করে দিল। আমি বাসায় ফিরে দেখলাম বন্ধুরা চলে এসেছে। বউ আর কন্যার মুখে হাসি। আমি বললাম, ‘পরাজয় বরণ করে নিলাম। আজকে যে কী আমাদের বিশেষ দিবস, তা মনে রাখতে পারি নাই…স্যরি! কিন্তু কী এমন সেই দিন যে আমার সব বন্ধু যুক্ত?’ বউ বলল, ‘আজকে হলো কিছু না দিবস। তো আমি আমার পরিচিত সব গুড ফর নাথিংদের ডেকেছি। ইনক্লুডিং ইউ!’ আমি ও আমার বন্ধুরা পরস্পরের দিকে তাকালাম। আমরা যে গুড ফর নাথিং—এ নিয়ে আমাদের কারও কোনো সন্দেহ নেই। ফলে লজ্জা লজ্জা হাসি হাসা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় থাকল না।

বউ বলল, ‘আজকে হলো “কিছু না” দিবস। তো, আমি আমার পরিচিত গুড ফর নাথিংদের ডেকেছি। ইনক্লুডিং ইউ!’
আমি ও আমার বন্ধুরা পরস্পরের দিকে তাকালাম। আমরা যে গুড ফর নাথিং—এ নিয়ে আমাদের কারও কোনো সন্দেহ নেই। ফলে লজ্জা লজ্জা হাসি হাসা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় থাকল না।
কন্যা বলল, ‘বাবা, নাথিং ডে ভালো। কারণ, তুমি কেক এনেছ!’
কেক খোলা হলো। আর খুলতেই দেখা গেল কেকের ওপর লেখা, ‘কিছু না’!
বউ বিস্ময় নিয়ে আমাকে বলল, ‘তুমি জানতা?’
আমি পুরো ব্যাপারটা চেপে গিয়ে বললাম, ‘যতটা গুড ফর নাথিং আমারে ভাবো, আমি তাইলে তা না...কী বলো?’

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]