অন্য এক বঙ্গবন্ধু

বাংলা ভাষায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক সবচেয়ে বেশি লেখালেখি হয়েছে বোধ করি রাধা-কৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে। শেষোক্ত দুজনের প্রথমজন বাংলাভাষী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষের মন, মনন ও রুচি গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন এক স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক রাজ্য। দ্বিতীয়জন, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার চিরবঞ্চিত, লাঞ্ছিত ও গরিব বাঙালি জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশ নামক একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি এই রাষ্ট্রের স্থপতি। ফলে এই দুজনকে নিয়ে বাংলা ভাষায় অসংখ্য গান, কবিতা, গবেষণাকর্ম হবে, তাতে আর সন্দেহ কী! কিন্তু সন্দেহ অন্য জায়গায়।

অধিকাংশ সময় ব্যক্তিকেন্দ্রিক; বিশেষত, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক; লেখালেখি পূজা বা স্তাবকতায় পর্যবসিত হয়। শেষ পর্যন্ত ভাবালুতা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। কারণ, এই ধরনের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মতাদর্শের একটা গভীর সম্পর্ক থাকে; তা সে সাহিত্যিক মতাদর্শই হোক আর রাজনৈতিক মতাদর্শই হোক। রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে এই ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে আরও বেশি ঘটার কথা। কারণ, তাঁকে নিয়ে লেখালেখির সঙ্গে শুধু মতাদর্শের সম্পর্ক নয়, লাভ আর লোভেরও সম্পর্ক থাকতে পারে। বিশেষত, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনৈতিক দল যখন রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকে, তখন এই সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়। ক্ষমতার কাছে প্রণত হওয়া বা বিনয় প্রদর্শন গড়পড়তা মানুষদের মনস্তত্ত্বের একটা প্রায় চিরকালীন স্বভাব। ফলে, বঙ্গবন্ধু নিয়ে লেখালেখি করা বা তাঁর সম্পর্কিত বস্তুনিষ্ঠ লেখা খুঁজে বের করাটা খুবই দুরূহ ব্যাপার সন্দেহ নেই। কিন্তু সবার মধ্যে তো আর লাভ-লোভ ও প্রণতি কাজ করে না। কেউ কেউ এসবের বাইরে গিয়ে দেখতে পারেন, দেখেন। নুরুল ইসলাম তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: কাছে থেকে দেখা’ বইটিতে অনেকটা বাইরে গিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন। এই চেষ্টাটাই এই বইয়ের একটা বড় শক্তির জায়গা।

বঙ্গবন্ধুকে যে নুরুল ইসলাম একটা দূরত্বে থেকে, লাভ ও লোভের বাইরে থেকে দেখার প্রয়াস পেয়েছেন, তার কারণ আছে। এর কিছু কারণ পেশাগত এবং কিছু কারণ সম্ভবত শিক্ষাগত। নুরুল ইসলাম ষাটের দশকের বাংলাদেশের একজন খাঁটি অর্থনীতিবিদ ছিলেন। বাঙালি অর্থনীতিবিদের সত্তা নিয়েই তিনি জাতীয়তাবাদের একজন নিষ্ঠ কর্মীও ছিলেন। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল মূলত দেশের জন্য কাজের। কাজ দিয়েই তিনি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তিনি শতভাগ পেশাদারিসহকারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতেন। পেশাদারি সম্পর্ককে না ছাপিয়ে যতটুকু ব্যক্তিগত সম্পর্ক বহন করা যায়, তা তিনি করতেন। শিক্ষাগত কারণের মধ্যে বলব, ইউরোপ-আমেরিকার একাডেমিক পরিসরে কাজ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছিল নুরুল ইসলামের। অসৎ, ক্যাজুয়াল ও সামন্ত মানসিকতার বাংলাদেশে ইউরোপ-আমেরিকার একাডেমিক পরিসরে কাজ করার অভিজ্ঞতা নুরুল ইসলামের মধ্যে একধরনের নৈর্ব্যক্তিক চৈতন্যের জন্ম দিয়েছে, সন্দেহ নেই। ইউরোপ-আমেরিকার একাডেমিক পরিসরে কাজ করা সবার মধ্যে এই নৈর্ব্যক্তিকতা থাকে বা থাকবে, এমন কথা নেই। কিন্তু নুরুল ইসলামের মধ্যে আছে বলেই মনে হয়। ফলে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: কাছে থেকে দেখা’ বইয়ে বঙ্গবন্ধুকে দেখার ক্ষেত্রে একটা নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব বজায় রাখার সামর্থ্য ও সংগতি নুরুল ইসলাম অনেকটাই দেখাতে পেরেছেন। পুরোপুরি পেরেছেন, তা হয়তো বলা যাবে না। কারণ, বঙ্গবন্ধুর মতো একজন বড় মাপের নেতা ও অপার সম্মোহনী গুণের অধিকারী মানুষের আশপাশে দীর্ঘদিন অবস্থান করে তাঁর সম্পর্কে নির্মোহ মূল্যায়ন করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। তবু নুরুল ইসলাম ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তাঁর দেখা বঙ্গবন্ধুকে দোষে-গুণে উন্মোচন করেছেন। তিনি প্রণত হয়েছেন। কিন্তু গড়িয়ে পড়েননি। এই কাণ্ডজ্ঞানই বইটিকে একটি বিশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্বে উত্তীর্ণ করেছে।

‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: কাছে থেকে দেখা’ বইটি ইতিহাস আর স্মৃতিকথার এক মিশেল। বাংলাদেশের একঘেয়ে ও একমুখী ইতিহাসচর্চার ধারায় এই গ্রন্থ ইতিহাসচর্চাকারীদের অনেক নতুন ও খাঁটি রসদ জোগাবে বলে মনে হয়। সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটা রাষ্ট্রের মানুষের আকাশচুম্বি স্বপ্ন, বিভিন্ন সংস্থা ব্যক্তি ও রাজনৈতিক সংগঠনের বিচিত্র চাওয়া এবং লাভ-ক্ষতি-ক্ষমতার হিসাব-নিকাশের মধ্যে দেশের স্থান যখন ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে যাচ্ছিল, তখন দেশ ও দশের ভাবনায় আকুল বিষণ্ন বঙ্গবন্ধুর ওপর আলো ফেলেছেন নুরুল ইসলাম তাঁর বইটিতে।

গ্রন্থটির প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘বাংলাদেশের জন্ম: রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পটভূমি’। এই অধ্যায়কে মূলত প্রথাগত ইতিহাসেরই পুনর্লিখন বলা যায়। কিন্তু এই অধ্যায়ে নুরুল ইসলাম চকিতে এমন কিছু দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন, যা প্রথাগত ইতিহাস খুব একটা বলে না। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিজয় উপলক্ষে ঢাকায় বিরাট এক গণসমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেই সমাবেশে অগণিত মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত মোতাবেক সংসদ সদস্যদের এক শপথবাক্য পাঠ করানো হয়। সেই শপথবাক্যে ছয় দফার প্রতি এবং জনগণের দেওয়া দায়িত্বের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা না করার কথা বলা হয়েছিল। নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাবজাত অনুভূতি ও প্রজ্ঞার বলে জনগণের মনের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সামরিক জান্তার হাতে অত্যাচারিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য জাতীয় নেতা ও কর্মী জেলে আটক ছিলেন। দলটি এ সময়ে দিকনির্দেশনাহীন হয়ে পড়ে। তাঁকে সেই দলীয় কাঠামো পুনরায় গড়ে তুলতে হয়। দলকে অল্প সময়ের মধ্যে পুনর্গঠনের দায়িত্ব নিতে হয় এবং দলীয় নিয়মানুবর্তিতা ফিরিয়ে আনতে হয়। ১৯৭০ সাল নাগাদ দলের সদস্যসংখ্যা প্রচুর বৃদ্ধি পায়। এই নতুন সদস্যরা পাকিস্তান আমলের নিষ্পেষণের শিকার হননি। সাংসদদের অধিকাংশই ছিলেন নতুন। ছয় দফা সম্পর্কে তাঁদের বিস্তারিত জ্ঞান ও এই দাবির প্রতি তাঁদের অঙ্গীকার সম্পর্কেও স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া সম্ভব ছিল না। সাংসদদের জন্য খুব একটা খুশির বিষয় না হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু গণশপথের মাধ্যমে দলের প্রতি তাঁদের অবিচল আনুগত্য রক্ষার প্রতিশ্রুতি আদায় এবং তাঁদের সম্ভাব্য দলত্যাগের ঝুঁকি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিলেন।’ (পৃষ্ঠা ২৭)। দলীয় রাজনৈতিকতার বাইরে গিয়ে নুরুল ইসলামের এই পর্যবেক্ষণ একাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গতিবিধিকে যেমন আভাসিত করেছে, তেমনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে একটা নতুন প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পরিচালনা কত দুরূহ ছিল, সেই সত্যও প্রকাশ করেছে। এ তো গেল রাজনৈতিক নেতৃত্বের কথা। অরাজনৈতিক আমলাদের কথাও বলেছেন নুরুল ইসলাম।
বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপ যার উপমান, সেই রকম একটা নতুন প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের কাজকর্মকে দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার জন্য দরকার ছিল দক্ষ, আন্তরিক ও দেশপ্রেমিক আমলাশ্রেণি। স্বাধীনতার পর অভিজ্ঞ ও চৌকস আমলাদের পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু উদ্গ্রীব হয়ে থাকতেন। তাঁর আশা ছিল, তাঁরা ফিরে এলে নতুন দেশ চালানোর সমস্যাগুলো তিনি ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারবেন। এ জন্য তিনি পাকিস্তানফেরত কোনো কোনো আমলাকে গুরুত্বপূর্ণ পদেও বসান। কিন্তু তাতে খুব ফল ফলেনি। তিনি দিন দিন অধিকাংশ আমলার মধ্যে দেখেছেন উদাসীনতা, অদক্ষতা, অনান্তরিকতা, অনভিজ্ঞতা আর দীর্ঘসূত্রতার প্রবণতা। ১৯৭৩ সালের এ রকম এক অভিজ্ঞতা আর পর্যবেক্ষণের কথা বলতে ‘রাষ্ট্র গঠনে বহুবিধ সমস্যা এবং তার সমাধান প্রচেষ্টা’ শিরোনামের দ্বিতীয় অধ্যায়ে নুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমি পরিকল্পনা কমিশনের কোনো এক কাজে তাঁর [বঙ্গবন্ধু] সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি, তিনি স্পষ্টতই বিরক্ত এবং হতাশ। তিনি সেদিন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ছিলেন; কারণ, কিছুদিন আগে তিনি যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা সময়মতো পালন করা হয়নি। এমনকি দক্ষ হিসেবে বিবেচিত আমলাদের দ্বারা গঠিত তাঁর ব্যক্তিগত সচিবেরাও সেই নির্দেশের খোঁজখবর রাখছেন না। আমি সেখানে বসে থাকা অবস্থায় তিনি তাঁদের একজনকে ডেকে পাঠান। তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সাবেক সদস্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে নির্দেশ পালনে বিলম্বের কারণ দ্রুত খুঁজে বের করতে বললেন। সেই কর্মকর্তা যখন ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধু আমার দিকে ফিরে বললেন, ছোট লাঠি (ব্যাটন) হাতে শর্টপ্যান্ট পরা আর ইংরেজি বলা (পাকিস্তানি) সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেনদের আদেশ এই আমলারা অবিলম্বে পালন করত। পাঞ্জাবি-পায়জামার মতো সাধারণ পোশাকের রাজনীতিবিদ, যারা বাংলায় কথা বলে আর মাঝে মাঝে পান চিবোয়, তাদের কথায় এরা মনোযোগ দিতে চায় না। সেনাবাহিনীর সেসব ক্যাপ্টেন আবার ক্ষমতা নিয়ে শাসন করলেই এরা খুশি হবে।’ (পৃষ্ঠা ৪৩)। পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে এই বক্তব্যকে নিয়তির পূর্বাভাস বলে মনে হয়। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চৈতন্যের খাঁটি বাঙালিয়ানার কথা না হয় না-ই বললাম। আরও না হয় না-ই বললাম, সদ্য মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা দেশপ্রেমিক (?) নাগরিকের ভূমিকার কথা। প্রসঙ্গত বলা দরকার, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন শ্রেণি, গোষ্ঠী, দল-উপদলের বিচিত্র আকাঙ্ক্ষা আর লাভ-লোভ বঙ্গবন্ধুকে প্রতিনিয়ত বিপন্ন আর বিষণ্ন করেছে, সেই সত্যও বঙ্গবন্ধুর এই মন্তব্যে আয়নার মতো উজালা হয়ে হয়ে উঠেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: কাছে থেকে দেখা: অন্য এক বঙ্গবন্ধুনুরুল ইসলামপ্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা। প্রকাশকাল: ২০২০।‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: কাছে থেকে দেখা’র দাম ২২০ টাকা। পাওয়া যাচ্ছে কারওয়ান বাজার ও শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে প্রথমার আউটলেটসহ দেশের সব মানসম্মত বইয়ের দোকানে। ঘরে বসে বই পেতে চাইলে অনলাইনে অর্ডার করুন prothoma.com-সহ অন্যান্য বই বিক্রির সাইটে। এ ছাড়া সরাসরি কল করতে পারেন ০১৯৮৮৩৩৭৭৩৩ নম্বরে।

‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: কাছে থেকে দেখা’ বইটির ‘রাষ্ট্র গঠনে বহুবিধ সমস্যা এবং তার সমাধান প্রচেষ্টা’, ‘বাংলাদেশের প্রথম সরকার পরিচালনা সম্পর্কে কিছু কথা’, ‘বঙ্গবন্ধু এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতির রাজনীতি’ শিরোনামের তিনটি অধ্যায়ে নুরুল ইসলাম ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রের নানা সংকটের বিশদ বর্ণনা যথাসম্ভব নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরেছেন। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংকট, দেশের দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, উপদলীয় নানা কোন্দল, আমলাদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের বিরোধ, মোশতাকের ষড়যন্ত্র, ‘রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের গভীর ও ব্যাপক আগ্রহ’, ‘সীমান্ত চোরাচালান’, বঙ্গবন্ধুর ‘মানবিক দুর্বলতা’, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনের তৎপরতা, দেশ পুনর্গঠনের নানা সংকট, ‘সরকারি কর্মচারী, মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য এবং তাঁর [বঙ্গবন্ধু] আত্মীয়স্বজনদের দুর্নীতি’ এবং এসব বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর মহাকাব্যিক তৎপরতা, অবিচল নিষ্ঠা, অন্তহীন দরদ, প্রশ্নহীন সততা ইত্যাদি সীমিত পরিসরে ব্যাপকতার ব্যঞ্জনায় উঠে এসেছে বইটিতে। এর অনেক বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর ব্যাখ্যা ও অবস্থানও দারুণ অন্তরঙ্গতায় উঠে এসেছে। অন্তরঙ্গতায় বলছি এ জন্য যে এই বইয়ে নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর একান্ত আলাপের মুহূর্তগুলোই বেশি তুলে ধরেছেন। এই একান্ত আলাপের ওপর গুরুত্ব দেওয়ায় গ্রন্থটিতে সব মিলিয়ে উঠে এসেছেন অন্তরঙ্গ আলোয় রাঙা ভিন্ন এক বঙ্গবন্ধু। এই অন্তরঙ্গ আলোয় উঠে আসা বঙ্গবন্ধু যতটা না ইতিহাসের, তার চেয়ে বেশি জনান্তিকের।

বইটিতে নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের বিচিত্র দিক তুলে ধরতে গিয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতি ঠুকে ঠুকে বের করে এনেছেন এক ভিন্ন বঙ্গবন্ধুকে। এই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের পুনর্গঠনে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ছুটছেন বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য প্রকাশ্য শত্রু আমেরিকার সঙ্গেও রাখছেন সদ্ভাব, আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন-চীনের সঙ্গেও রাখতে চাইছেন সুসম্পর্ক, মধ্যপ্রাচ্যকে করতে চাচ্ছেন না হাতছাড়া। কারণ, একটা নতুন রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের জন্য সবাইকেই পাশে প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেছিলেন। কিন্তু এত শত করেও যেন শেষ রক্ষা হচ্ছে না। ক্রমাগত দূরত্ব বাড়ছে চার নেতার সঙ্গে। ‘মন্ত্রিসভার খুব পরিশ্রমী সদস্য বলে পরিচিত কামারুজ্জামানের মতো মানুষও মন্ত্রিসভার দীর্ঘ বৈঠকে প্রায়ই অন্যমনস্ক’ হয়ে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু সহযোগিতা পাচ্ছেন না তাঁর আশপাশের কাঙ্ক্ষিত অন্য অনেকের কাছ থেকে। সবাই যেন দেশ নয়, ব্যক্তিগত লাভালাভের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। অধিকাংশই যেন বাংলাদেশের খেটে খাওয়া কোটি মানুষের আস্থার প্রতীক, তাঁদের প্রিয় শেখ মুজিবের ভেতরের ক্রন্দন ও উদ্বেলতা বুঝতে পারছেন না।

দোসর যেন কেউ নেই, এমন এক অবস্থা। নুরুল ইসলামের পুরো বইয়ে এই ক্রমাগত নিঃসঙ্গতা, ‘মানবিক দুর্বলতা’ আর দেশ ও দশের চিন্তায় আতুর অন্য এক বঙ্গবন্ধু উন্মোচিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর মহাকর্মযজ্ঞের বিচিত্র ঘটনা বর্ণনার মধ্যে একটা যেন বিষণ্নতার সুর লেগে আছে বইজুড়ে। সেই বিষণ্নতার সুরের উৎস যেন চারপাশের মানুষের বঙ্গবন্ধুকে না বোঝার ও সহযোগিতা না করা থেকে উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর শেষ দিকের সাক্ষাতের মধ্যে এমন একটি বিষণ্নতার সুরই যেন লেগে আছে—‘১৯৭৫ সালের ৮ জানুয়ারি আমার...ছুটিতে যাওয়ার আগে আমি তাঁর [বঙ্গবন্ধু] সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করেছিলাম। পার্লামেন্টে নতুন সংবিধান (বাকশাল) পাস হওয়ার সামান্য কয়েক দিন আগে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তখন তাঁকে বেশ বিষণ্ন দেখাচ্ছিল। আমি কিছু বিদায়ী কথাবার্তা বলতে শুরু করলাম। তিনি রুমের মধ্যে পায়চারি করছিলেন। এর মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গানটি গেয়ে উঠলেন, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে...।’ (পৃষ্ঠা ৪৮)।

সব মিলিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: কাছে থেকে দেখা’ বইটি ইতিহাস আর স্মৃতিকথার এক মিশেল। বাংলাদেশের একঘেয়ে ও একমুখী ইতিহাসচর্চার ধারায় এই গ্রন্থ ইতিহাসচর্চাকারীদের অনেক নতুন ও খাঁটি রসদ জোগাবে বলে মনে হয়। সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটা রাষ্ট্রের মানুষের আকাশচুম্বি স্বপ্ন, বিভিন্ন সংস্থা ব্যক্তি ও রাজনৈতিক সংগঠনের বিচিত্র চাওয়া এবং লাভ-ক্ষতি-ক্ষমতার হিসাব-নিকাশের মধ্যে দেশের স্থান যখন ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে যাচ্ছিল, তখন দেশ ও দশের ভাবনায় আকুল বিষণ্ন বঙ্গবন্ধুর ওপর আলো ফেলেছেন নুরুল ইসলাম তাঁর বইটিতে। এই বিষণ্নতা পুরো বইটিকে ও বঙ্গবন্ধুকে যেন মায়াময় করে তুলেছে।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]