অভিবাদন, প্রিয় মানুষ রশীদ হায়দার

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম
আজ সকালে প্রয়াত হয়েছেন কথাসাহিত্যিক ও ‘স্মৃতি: ১৯৭১’ গ্রন্থমালার সম্পাদক রশীদ হায়দার। তাঁকে শ্রদ্ধা।

কথাসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক রশীদ হায়দার আজ চলে গেলেন। আমার কাছে রশীদ হায়দার মানে বাংলা একাডেমি। গত শতকের আশির দশকের শেষ দিক থেকে আমাদের শৈশবের কত যে মধুর স্মৃতি ওঁনার ভালোবাসায় ভরা! বাংলা একাডেমিতে বছর বছর একুশের আয়োজনে শিশু–কিশোরদের জন্য গান–কবিতার প্রতিযোগিতা আর পরিবেশনা থাকত। পরম যত্নে আর সম্মানে রশীদ হায়দার কাকা সেই আয়োজন করতেন শিশু–কিশোরদের জন্য! বাকি সবার কাছে যখন বাংলা একাডেমি মানে এর প্রাঙ্গণ আর তাতে আয়োজিত বইমেলা, আমরা তখন একদল শিশু–কিশোর বর্ধমান হাউস বা বাংলা একাডেমির মূল ভবনে ঢোকার সুযোগ পেতাম ওই আয়োজনের সুযোগে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের স্বদেশ ও প্রকৃতি পর্যায়ের গান আর তাঁদের কবিতা পাঠের আসর বসত সারা দিনের জন্য। রশীদ কাকা সারা দিন থাকতেন, নিজে সঞ্চালনা করতেন, ইতিহাস, সংস্কৃতি, গান, কবি, কবিতার কথা বলতেন আমাদের মতো ঘরভর্তি শিশু–কিশোরদের জন্য! বলতেন, কেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের গানে–কবিতায় দেশ আর প্রকৃতি এত মিলেমিশে থাকে। শিশুদের অনুষ্ঠান বড় বেশি শিশুতোষ করে তোলার বা একে হালকা আনন্দে মনোগ্রাহী করার কোনো চেষ্টা থাকত না সে আয়োজনে। মনে পড়ে, সেমিনার রুমের মতো মাঝারি আকারের ঘরে মঞ্চে উঠে একজনের পর একজন গাইতাম আমরা। কাকা মঞ্চে বসেই নানা আলোচনা করতেন। এখন বুঝি, তা ছিল কত বড় পাওয়া! এরপর পুরস্কার বিতরণীর দিন আমাদের মধ্যে অনেকেই বাংলা একাডেমির বইমেলার মূল মঞ্চে গান গাওয়ার সুযোগ পেতাম। সেদিনও পুরো অনুষ্ঠান রশীদ হায়দারই পরিচালনা করতেন; আর আমাদের এমনভাবে ভালোবাসতেন, সম্মান দেখাতেন, মনে হতো, আমাদের মধ্যে বুঝি শিশু নয়, বরং শিল্পীকেই দেখছেন তিনি বেশি।

রশীদ হায়দার সম্পাদিত ‘স্মৃতি: ১৯৭১’
ছবি: সংগৃহীত

বছর বছর ওই প্রতিযোগিতার পুরস্কার হিসেবে দারুণ দারুণ সব বই পেতাম। সে–ও বাংলা একাডেমির তখনকার পরিচালক রশীদ হায়দারেরই পছন্দ করা। বলা ভালো, সেসব বইয়ের পছন্দেও শিশুতোষ মনোরঞ্জনের বই খোঁজার কোনো চেষ্টা ছিল না। বরং ছিল শিশুর মন আর মননের খোরাক জোগানোর তাগিদ। সেখানেই আমরা দুই বোন রশীদ হায়দার সম্পাদিত অমর গ্রন্থ ‘স্মৃতি: ১৯৭১’–এর একেক খণ্ড পুরস্কার হিসেবে পেতে শুরু করি। তখন বোধ হয় চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি! ওই ‘স্মৃতি: ১৯৭১’–এর সূত্রেই ১৯৭১ নিয়ে আমার বিভিন্ন মানুষ/পরিবারের ব্যক্তিগত স্মৃতি পড়তে শুরু করা। ৮০-৯০–এর দশকে মুক্তিযুদ্ধকে বাঙালির কাছে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলার প্রাতিষ্ঠানিক চেষ্টার মধ্যে ওই বইগুলোতে একেকজনের স্মৃতি পড়ে কত রাত যে ঘুমাতে পারিনি; আর প্রতিজ্ঞা করেছি, ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’!

‘স্মৃতি: ১৯৭১’ বইয়েই আমি প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকজন শিক্ষককে হত্যার স্মৃতিকথা তাঁদের স্বজনদের বয়ানে বিস্তারিত পড়ি। জানতে পারি, শুধু ঢাকা বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, সারা দেশের ছোট ছোট শহরে খুঁজে খুঁজে কীভাবে একাত্তরের নয় মাসজুড়েই হত্যা করা হয়েছে শিক্ষক, লেখক, সংস্কৃতিকর্মী, চিকিৎসক এবং প্রগতিশীল ও প্রাগ্রসর মানুষদের। আমি সেখানেই পড়ি, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে ২৫ মার্চের রাতে কয়েকটি গুলি করে ফেলে রেখে যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা। এরপর তাঁর স্ত্রী আর স্কুলপড়ুয়া কন্যা নিরুপায় হয়ে দেখতে থাকেন কয়েক দিন ধরে বাড়ির বিছানায় রক্তক্ষরণ ঘটতে ঘটতে মারা যাচ্ছেন তাঁদের প্রাণপ্রিয় স্বজন। বইয়ে একাত্তরের এই নির্মম বাস্তবতার কাহিনি পড়ে আমি কেবল ভেবেছি, ইশ, এর চেয়ে কেন তখনই, গুলি খেয়েই মরে গেলেন না অধ্যাপক গুহঠাকুরতা? কেন কয়েক দিন ধরে বাবার মৃত্যুকষ্ট দেখতে হবে নিরুপায় কন্যাকে? আর সেই বইয়েই আবার পড়লাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের দিয়ে গণকবর খুঁড়িয়ে, তাঁদেরই আবার এর পাশে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে ওই গণকবরেই ফেলে দেওয়া হলো! এসব পরিকল্পিত নিষ্ঠুরতার ইতিহাস প্রত্যক্ষদর্শী আর ভুক্তভোগীর বয়ানে পড়ে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলার স্বাধীনতার মূল্য মূর্ত হয়ে উঠল যেন ওই শিশু মনে। গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা যে একটি জাতিকে ধ্বংসের পাঁয়তারা—সেটা তখন আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠল।

বড় হয়ে বহুবার, বহু বছর ধরে ভেবেছি, আমার শৈশবের প্রিয় রশীদ হায়দার কাকুকে গিয়ে বলব এসব কথা। একাত্তরের সত্য ইতিহাস আমাদের সামনে সহজভাবে তুলে ধরার জন্য জানাব তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা। কিন্তু তা বলা হয়নি। কখনো আর হবেও না। প্রশংসা, প্রচারণা, প্রচারের কেন্দ্রে থেকে নয়, বরং নীরবে নিজের কাজগুলো খুব যত্নে আর পরিশ্রমে করে যাওয়ার মানুষ এই জগৎ–সংসারে কম। রশীদ হায়দার তেমনই একজন মানুষ ছিলেন।
রশীদ হায়দার
ছবি: সংগৃহীত

ওই বয়সে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বললেই আমার চোখে ভেসে উঠত তরুণ পুরুষের চেহারা। ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী’ বললেই কাঁচা–পাকা চুলের মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা প্রাজ্ঞ কোনো পুরুষের চেহারা মনে মনে ভাসত; আর ‘কবি’ বললেই মনে মনে আঁকতাম ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষকে। তো তখন, সেই একেবারে কাদামাটি মনের শৈশবে ‘স্মৃতি: ১৯৭১’–এর বদৌলতে জানলাম এক কবি মেহেরুন্নেসার কথা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যাঁকে মেরে তাঁরই চুল দিয়ে ফ্যানে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেছিল। স্কুলের মাঠে দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গেলে ছিলে যাওয়া হাঁটুর জ্বলুনির কথা ভেবেই যে বয়সে চোখে পানি এসে যায়, সেই বয়সেই জানলাম, মাগুরার এক শিক্ষিকার দুই পা হানাদার বাহিনী জিপের পেছনে বেঁধে সারা শহর ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে তাঁকে মেরে ফেলেছিল। ‘স্মৃতি: ১৯৭১’ পাঠের অভিজ্ঞতা নিয়ে ব্যক্তিগত আলোচনায় আজকেই এক বন্ধু মনে করালেন, সেই শিক্ষকের নাম লুৎফুন্নাহার হেলেন। ওই বই পড়েই জেনেছিলাম, মাতা–পিতা, বান্ধব বা সন্তানের হত্যাকারীর পরিচয় জানেন অনেক স্বজন। ৭১–এ ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় ঘাতকের মুখের মুখোশ সরে গিয়েছিল; এমনকি পত্রিকার পাতায় ছবি দেখে পরেও অনেকে চিনে রেখেছিলেন ঘাতককে! স্বাধীনতার কয়েক দশক পেরিয়ে গেছে, সেই স্বজনেরা বিচার চান, কিন্তু তখনো এখানে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় ঘাতক, আর মুখ লুকিয়ে কাঁদেন স্বজন। বইয়ে এসব পড়ে সেই ছোট্ট আমিও বুঝে যাই, দামাল ছেলেরা নয় মাস যুদ্ধ করে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে দেশটাকে মুক্ত করে এনেছেন। আমাদের তখনকার পাঠ্যবইয়ে রূপকথার গল্পের মতো বর্ণিত সেই মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে বটে, তবে আমাদের প্রজন্মেও বাকি রয়ে গেছে অনেক অনেক বোঝাপড়া।

বড় হয়ে বহুবার, বহু বছর ধরে ভেবেছি, আমার শৈশবের প্রিয় রশীদ হায়দার কাকুকে গিয়ে বলব এসব কথা। ব্যক্তির অভিজ্ঞতায় একাত্তরের সত্য ইতিহাস আমাদের সামনে নিরাভরণ নির্মোহে তুলে ধরার জন্য জানাব তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা। কিন্তু তা আর বলা হয়নি। কখনো আর হবেও না। প্রশংসা, প্রচারণা, প্রচারের কেন্দ্রে থেকে নয়, বরং নীরবে নিজের কাজগুলো খুব যত্নে আর পরিশ্রমে করে যাওয়ার মানুষ এই জগৎ–সংসারে কম। রশীদ হায়দার তেমন একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর সম্পাদিত ‘স্মৃতি: ১৯৭১’ প্রজন্মান্তরে বাঙালিকে দেওয়া তাঁর সেরা উপহার হয়ে থাকবে। সবাই নীরব কাজে এমন প্রবল স্বাক্ষর রেখে যেতে পারেন না, রশীদ হায়দার পেরেছেন। অভিবাদন, প্রিয় মানুষ, রশীদ হায়দার!

অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]