অল্পস্বল্প দীর্ঘ জীবন: ০৯

অন্যআলো ডটকমে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে লেখক-অভিনেতা-চিত্রকর আফজাল হোসেনের স্মৃতি ধারাবাহিক ‘অল্পস্বল্প দীর্ঘ জীবন’। বিচিত্র এক জীবন পাড়ি দিয়েছেন আফজাল হোসেন। সাতক্ষীরার গণ্ডগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে চারুকলায় পড়েছেন, পত্রিকায় কাজ করেছেন, মঞ্চ কাঁপিয়েছেন একসময়। আর টেলিভিশনে তাঁর জনপ্রিয়তার কথা তো বলাই বাহুল্য। বিজ্ঞাপনের জগতেও আছে তাঁর নিবিড় পদচারণ। আবার লেখক ও চিত্রশিল্পী হওয়ার কারণে লেখক-চিত্রকরদের অনেকের সঙ্গেই রয়েছে তাঁর অন্তরঙ্গ সখ্য। জীবনের এসব নানা বর্ণের গল্প আফজালের কলমে উঠে আসবে এখানে। আজ প্রকাশিত হলো নবম কিস্তি।

আব্বা অসম্ভব এক আশার কথা জুড়ে দিলেন, আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার শর্তে। যে পুত্র কদিন আগের পরীক্ষায় অঙ্কে শূন্য পেয়েছে, মাত্র কয়েক মাস পরের পরীক্ষায় সেই বিষয়, অঙ্কে তাকে ষাট নম্বর পেয়ে দেখিয়ে দিতে হবে।


আম্মা মনে করেন আমি তা পারব। কথা শুনি না, সমস্যা সেটাই। দাদির কথা মনে পড়ে যায়। তিনি থাকলে রেগে যেতেন, কবে কার কোন কথা শোনেনি আফজাল?
আমি কথা শুনি না। ছোটবেলায় সবচেয়ে বেশি শোনা কথা। বলত বড়রা। বড়দের সব কথা ছোটদের বুঝতে পারার কথা নয়। এই এতকাল পর পেছন ফিরে তাকালে কত কিছু মনে পড়ে। যা যা মনে পড়ে, তার সবই ভুল ছিল, অন্যায় বা দোষের ছিল—তা এখনো মনে হয় না।


সেসব কৌতূহলের টানে মন বলেছে বলে করা। বড়দের অমান্য করতাম, তা নয়। দুপুরে বড়রা ঘুমায়। নিয়ম মানতে হলে ঘুম আসবে না, তবু শুয়ে থাকতে হবে। পুকুরে গোসল করতে যাওয়া মানে, কটা ডুব দিলেই হয়ে গেল। গামছা দিয়ে গা মাথা মুছে ঘরে ফিরলে সেটাই বড়দের কথা শোনা হয়। ডুবের পর ডুব দিয়ে যদি সাধ না মেটে, যদি বার দুয়েক পুকুরঘাট থেকে অন্য পাড় সাঁতরে মনে হয় আজ আরও দুবার আরামে সাঁতরাতে পারি কি না, চলো বন্ধুরা দেখা যাক, তা বড়দের অমান্য করা হয়ে যেত, বুঝতে পারতাম না। ডুব দিয়ে কত তাড়াতাড়ি পুকুরের তলার কাদা মুঠোভরে ওপরে তুলে আনতে পারি, সে খেলাটা বড়দের নয় বলে বলা হতো দুষ্টুমি।


পুকুর ছেড়ে দলেবলে যদি কোনো দিন নদীতে যেতাম, সে যাওয়া নতুন আনন্দের আশায়। যা খেয়ালখুশি, আনন্দের, জানাজানি হয়ে গেলে আনন্দের থাকত না আর।
দাদা বেঁচে থাকতে দুষ্টুমির জন্য শাস্তি ছিল নানা ধরনের। সবচেয়ে ঝটপট শাস্তিটা খুবই অপছন্দের ছিল। বেশি বিরক্ত হলে কষে একটা চড়ের পর দুই হাতে দুই কান ধরে শূন্যে উঁচু করে তুলে ফেলতেন। বাকি শাস্তিগুলো তেমন গায়ে মাখতাম না। উঠোনের রোদে কান ধরে ওঠবস করা। নিজের দুই কান ধরে উবু হয়ে বসে থাকা। এক পা উঁচু করে বকের মতো দাঁড়িয়ে থাকা। এই সব শাস্তি পালনের সময় কত ভেবেছি, কেন বলা হয় আমি বড়দের কথা শুনি না!
দুটো শাস্তি বাদে অন্য সব শাস্তি ভোগ করতে করতে হাসি পেয়ে যেত। মনের হাসির সামান্য যদি মুখে উদয় হতো, তার ফল ছিল আলাদা। বুঝতে পারতাম না সেটাও দোষের হয়ে যাচ্ছে। তার জন্য ছিল আরও বড় মাপের শাস্তি। সে শাস্তি ছিল দুই রকমের। একটা চেয়ার, অন্যটার জন্য দরকার হতো ইট। এক জোড়া অর্ধেক ইট, গ্রামে বলা হতো আধলা।

ঢাকায় প্রথম যখন ব্রিটিশ কাউন্সিলের আয়োজন করা থিয়েটার ওয়ার্কশপে অংশ নিই, সেখানে একটা অধ্যায় ছিল—যেকোনো বস্তু ব্যবহার করে অভিনয়। একটা চেয়ার, টুল বা বই—কাল্পনিক হতে পারে অথবা সত্যি সত্যি সেসব বস্তুর, প্রপসের সুনির্দিষ্ট ও সচেতন ব্যবহার সম্পর্কে অনুশীলন প্রক্রিয়া ছিল তা। যেদিন, যখন সে অনুশীলন পর্বে অংশ নিয়েছি, দাদার দেওয়া বিশেষ শাস্তির কথা মনে হয়ে যেত।


কোনো দ্বিতীয় ধাপের দোষের পর কী শাস্তি দেওয়া হবে, তা পালনে সহায়তার জন্য জোরে হাঁক দিতেন দাদা—জব্বার। জব্বার জানত, কেন তাকে ডাকা হচ্ছে। যেখানে যত জরুরি কাজ হাতে থাকুক, ডাক শোনামাত্রই ছেড়েছুড়ে একদৌড়ে উঠোনে হাজির হতেই হবে। আমাকে যদি দেখা যায় উঠোনে দাঁড়ানো, কিছু বলার আগেই বুঝে যেত সে কী তার করণীয়। তবে ইট না চেয়ার, সেটা জানতে তাকাতেই হতো দাদার দিকে। প্রথমে আমার দিকে তাকালে আমিই বলে ফেলতাম, ইট। অর্ধেক করা ইট থাকত ধারেকাছেই। আমার হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে জব্বারকেও মাঝেসাঝে বলতে শুনতাম,
: কথা শোনেন না কেন, বড়দের কথা শুনতে হয়।
সেটা কখনো শাসন বা খবরদারি মনে হয়নি। লেখাপড়া না জানা পাগলাটে ধরনের হলেও তার কণ্ঠস্বরে মায়া ছিল। অনুভব করতে পারতাম।


আমার শাস্তি শুরু হয়ে যাওয়ার পর সে যেত বারান্দায়। জব্বার জানত, এখন বাঘ–ডাক্তার গড়গড়া টানবেন। সেটা রাখা থাকত বারান্দার উত্তর কোনায়। সবাই সব সময় রব্বানী ডাক্তারের হুংকার–গর্জন বা বড় বড় চোখ করে তাকানোর ভয়ে ভীত হলেও মানুষটা বহু বিষয়ে খুবই শৌখিন ছিলেন। তামাক খেতেন বলে আট–দশ রকমের কলকি সংগ্রহ করেছিলেন। তামাকও ছিল নানা পদের। আসত কলকাতা থেকে।
জানালার পাশের একটা ছোট টেবিলের ওপর রকমারি কলকিগুলোকে শুইয়ে রাখা হতো। একেকদিন একেকটা কলকিতে তামাক ভরে গড়গড়াতে চড়ানো, আগুন জ্বালানো, ফুঁ দেওয়া—কাজগুলো ছিল জব্বারের। কলকিতে তামাক ভরে আগুন ধরিয়ে দিলে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ত ম–ম করা খুশবু। লম্বা নল চেয়ারের দিয়ে এগিয়ে দিয়ে জব্বারকে খানিকক্ষণ ফুঁ দিয়ে আগুন বাঁচিয়ে রাখতে হতো। দাদা বারান্দায় বসে চেয়ারে হেলান দিয়ে গড়গড়া টানতে টানতে শাস্তি পালনে ফাঁকি দিচ্ছি কি না, কড়া নজর রাখতেন।

আলতাফ কাকা দেখলেন, আমার মন ভালো নেই। পুরো দিনের অর্ধেকটাই এদিক–সেদিক উদাস হয়ে ঘুরে কাটাচ্ছি। একসময় ডাকেন,
: বসো। আমি তোমাকে দুটো কথা বলব। এক. তুমি বলেছ হেড স্যার তোমাকে অঙ্ক শেখাচ্ছেন। তাহলে তোমার কিসের ভয়? দুই. তোমার দাদি বেঁচে থাকলে কী করতেন ভেবে দেখো। তোমার আব্বাকে বকা দিতেন আর তোমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বলতেন, দে, সবাইকে দেখিয়ে দে সোনামানিক, তোর পক্ষে সবই সম্ভব।

দুই হাতে আধলা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া চেয়ার নিয়ে যে শাস্তিটা দেওয়া হতো, সেটা ছিল দীর্ঘ সময়ের জন্য। ধরন শুনলে মনে হবে, এটা কোনো শাস্তিই নয়। শুনে মনে হবে, এটা তো আরাম করা, শাস্তি হয় কেমন করে!
জব্বারকে দাদা হুকুম করতেন, একটা চেয়ার এনে দে। জব্বার একটা চেয়ার এনে উঠোনের মধ্যখানে রোদওয়ালা জায়গা বেছে রেখে দিত। উবু হয়ে দেখে নিতে ভুল হতো না চেয়ার পরিষ্কার রয়েছে কি না। নিজের কাঁধের গামছা দিয়ে ধুলো ঝেড়ে সরে দাঁড়ালে লক্ষ্মী ছেলের মতো সে চেয়ারে গিয়ে বসতাম। শাস্তি হচ্ছে বসে থাকা। না নড়েচড়ে শুধুই বসে থাকা। আমি যে দুদণ্ড বসে থাকার বান্দা নই, চোখের সামনে রেখে সেটা করতে বললে তা হয়ে উঠত আমার জন্য কঠোরতম শাস্তি।
শাস্তিভোগের সময় হাসির অপরাধে এ ভয়ানক শাস্তি বহুদিন, বহুবার ভোগ করতে হয়েছে। যেদিন, যখনই চেয়ারে বসে থাকার শাস্তি মিলেছে, মনে মনে ভেবেছি, দুষ্টুমি করব না আর। বড়দের কথা শুনব। কোনো দোষের কারণে শাস্তি মিললে একটুও হাসব না।


দাদা আর দাদি। অনেক দিন সংসার করা দুজন মানুষ। দুজনেই ছিলেন পরস্পরের একেবারে বিপরীত। দাদা মানে তর্জন–গর্জন, হুংকার আর শাসন। ঘরে–বাইরে সবার জন্য ছিলেন অস্বস্তি ও ভয়ের। বলাবলি হতো, তিনি বাড়িতে থাকলে মাছিও ডাক্তারের বাড়ির সীমানা ঘেঁষতে সাহস পেত না। সে মানুষটা বাইরে থাকলে এ দরকার–সে দরকারে দাদির কাছেই আসত পাড়ার কত রকমের মানুষ। বারান্দায় বসে সারা দিন তসবিহ গুনতেন দাদি, কিন্তু সবই জানতেন, কোন পাড়ার কোন ঘরে কার কী সমস্যা।
অনেক দিন যাবৎ কাকে দেখেননি, কেন আসে না, একে–তাকে ডেকে কারণ জানতে অস্থির থাকতেন। অজস্রজনের বিপদের ভরসা ছিলেন তিনি। দাদা সবার জন্য যেমনই হোন, দাদির কথা বিশেষ কানে তুলতেন না। দাদিও হাবেভাবে বুঝিয়ে দিতেন, যারা আপনাকে বাঘ–ভালুক ভাবে, ভাবুকগে, আমি ওসব ভাবি না। কেন ভাবব? সংসারটা আমারও।


অবাক সম্পর্ক। মনে হতো এক রাজ্য শাসন করছেন দুই দিকে দুজন। উভয়ের জন্য উভয়ের সমীহ ছিল, আবার অমিলও ছিল নানা বিষয়ে। সেসব কারণে ঝগড়া–বিবাদ, তর্ক–বিতর্ক কখনো হয়েছে, দেখেনি কেউ।


যখন পেছন ফিরে তাকাই, দেখতে পাই দাদার প্রবল দাপটের মুখে একজনই ছিলেন, যিনি মনে করতেন আমি কথা শুনি না, এ কথা ভুল। আমাকে দুষ্টু বলা হলে মানতেন না। তিনি ভাবতেন ও ওর মতো করে ভাবে, চলে ও বলে। যে কেউ, যেকোনো কিছুর জন্য আমাকে দোষী ভাবলে খুবই বিরক্ত হতেন দাদি।


অসুস্থতায় তেমন নড়াচড়া করতে পারতেন না দাদি। বারান্দায় বড় একটা চৌকির ওপর শুয়ে–বসে, নামাজ পড়ে দিন কাটাতেন। অসুখ, কষ্ট, উদ্বেগ নিজেকে নিয়ে ছিল না তাঁর, প্রতিমুহূর্তে অশান্তি, অস্থিরতায় ভুগতেন আমাকে নিয়ে। সব অমঙ্গল থেকে আমাকে আগলে রাখবার চেষ্টাই ছিল প্রধান কাজ তাঁর।

একটা কথা সিনেমা, নাটক, নভেলে পড়া বা শোনা হয়ে থাকে, অমুকের জন্য আমি জান দিতেও রাজি। দাদির তেমনই অন্ধ মায়া–ভালোবাসা ছিল আমার প্রতি।
শুনেছি, আমার জন্মের আগে থেকেই দাদির কাছে হয়ে উঠেছিলাম বিশেষ। তাঁর প্রথম সন্তানের পয়লা সন্তান আমি। অতএব, সে প্রথমের জন্য বিশেষ উত্তেজনা ও আলাদা আগ্রহ–আনন্দ হওয়ারই কথা।


অনেকের মুখে শুনেছি, আমার জন্মের পর দাদা যখন দেখেছেন নাতির গায়ের রং উজ্জ্বল হয়নি—খুশি হতে পারেননি। তাঁর আভিজাত্যে ধাক্কা লেগেছিল। সেই থেকে আমার প্রতি দাদির অধিক মায়ার শুরু। তাঁর চিরদিনের ধারণা ছিল, মনমতো রং হয়নি বলে দাদা অল্প দোষে বেশি শাস্তি দিয়ে থাকেন আমাকে। চৌকি থেকে নামতে পারলে হয়তো কখনোই কোনো শাস্তি ভোগ করতে দিতেন না তিনি। নামতে পারেন না বলে পুরো শাস্তি চলার সময়টা হাউমাউ করে কান্নাকাটি আর বিরতি দিয়ে জব্বারকে বকাঝকা করে কাটাতে হতো তাঁকে।


জব্বার নির্বিকার ভঙ্গিতে কলকিতে ফুঁ দিতে দিতে দাদির সে বকাঝকা শুনত। সে বোধ হয় বুঝতে পারত, হয়তো দাদাও বুঝতে পারতেন, হাউমাউ করে যে বকা ছুটে আসছে, তা যার উদ্দেশে, প্রাপ্য তার নয়।


আলতাফ কাকা দেখলেন, আমার মন ভালো নেই। পুরো দিনের অর্ধেকটাই এদিক–সেদিক উদাস হয়ে ঘুরে কাটাচ্ছি। একসময় ডাকেন,
: বসো। আমি তোমাকে দুটো কথা বলব। এক. তুমি বলেছ হেড স্যার তোমাকে অঙ্ক শেখাচ্ছেন। তাহলে তোমার কিসের ভয়? দুই. তোমার দাদি বেঁচে থাকলে কী করতেন ভেবে দেখো। তোমার আব্বাকে বকা দিতেন আর তোমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বলতেন, দে, সবাইকে দেখিয়ে দে সোনামানিক, তোর পক্ষে সবই সম্ভব। (চলবে)
অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]