আইয়ুব বাচ্চু: এই রুপালি গিটার ফেলে

আজ ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুদিন। তাঁকে স্মরণ করে প্রকাশিত হলো এই লেখা।

আজ আইয়ুব বাচ্চুর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৮ সালের এই দিনে ৫৬ বছর বয়সে তিনি শ্রোতাদের কাঁদিয়ে আকাশে উড়াল দিয়েছেন। গিটারধ্যানী আইয়ুব বাচ্চুর রুপালি গিটার থেমে যাওয়ার পর এই দেশের সংগীত-শ্রোতারা কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আসলে তাঁর গানগুলো হয়ে উঠেছিল আমাদের আত্ম-উদ্‌যাপনের গভীর অনুষঙ্গ।

আইয়ুব বাচ্চুর প্রসঙ্গ এলেই আমার মনে পড়ে যায় সেই ছোটবেলার স্মৃতি। মনের কোণে উঁকি দেয় ক্যাসেট প্লেয়ার, ফিতার A-পিঠ আর B-পিঠ উলটে-পালটে শোনার দিনগুলো। আমার হাইস্কুলের সহপাঠীদের বেশির ভাগই ছিল তাঁর মহাভক্ত। কখনো কখনো তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমিও গেয়ে উঠতাম ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’ কিংবা ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’।

সেসব গান কেন যে আমাদের এতটা ভালো লাগত, সেটা আসলে ঠিক এখন বলতে পারব না। খুব একটা ব্যক্তিগত কোনো বিরহের ঘটনা ছিল বলে মনে পড়ছে না, বরং এসব গান একধরনের বিরহের আবহ তৈরি করে ফেলতে সক্ষম ছিল। খুব সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করলে দেখবেন, পৃথিবীতে প্রেমের গান হিসেবে যে গানগুলো খুব সমাদৃত, সেগুলো কিন্তু প্রেমের ব্যর্থতা-কষ্ট-বিরহ নিয়ে লেখা।

আইয়ুব বাচ্চুর গানে এই ‘কষ্ট’ ও ‘মৃত্যু’ ব্যাপারটি ঘুরেফিরে ধারাবাহিকভাবে এসেছে। প্রায় চার দশকের দীর্ঘ পেশাদারি সংগীতজীবনে তিনি তাঁর গান দিয়ে দেশের পাড়া-মহল্লার আনাচকানাচে কষ্ট ফেরি করে বেড়িয়েছেন। আইয়ুব বাচ্চু আমাদের কষ্টের ফেরিওয়ালা।

আইয়ুব বাচ্চু।
ছবি: প্রথম আলো

১৯৬২ সালে চট্টগ্রামের মাটিতে জন্মেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু তথা সবার প্রিয় এবি। তাঁর প্রথম গিটার হাতে নেওয়া, স্টেজে ওঠা, প্রথম ব্যান্ড, গিটার বাজিয়ে প্রথম উপার্জন ৩০ টাকা—প্রথম সবকিছুই চট্টগ্রামে। তাঁর প্রথম গিটার ছিল বাবার দেওয়া। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়ে পরীক্ষায় ভালো ফল করার বাজিতে জিতে গিয়ে প্রথম একটা গিটারের মালিক হয়েছিলেন। তিনি একজন গিটারিস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন ১৯৭৪–৭৫ সালে বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে নয়ন মুন্সীকে বাজানো দেখে, সেটা ছিল আজম খানের শো। এটি দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁকেও নয়ন মুন্সীর মতো গিটার বাজানো শিখতে হবে। এরপর নিজে নিজে শেখা শুরু করলেন। অবশ্য একজন বার্মিজ গিটার শিক্ষক ছিল তাঁর। তাঁর কাছে অবশ্য তেমন কিছু শিখতে পারেননি, কিন্তু শিখেছিলেন গিটারকে কীভাবে ষোলো আনা ভালোবাসতে হয়।

বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে গানবাজনা শুরু করেন ১৯৭৭ সালের দিকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রুডি টমাস, কুমার বিশ্বজিৎ, গুলু, মঙ্গু ও আরও কয়েকজন। ব্যান্ডের নাম দিয়েছিলেন ‘রিদম ৭৭’। তার আগে অবশ্য জ্যাকব ডায়াসের সঙ্গে ‘স্পাইডার’ নামে একটি দলে গিটার বাজাতেন। মূলত, বিয়েবাড়িতে কিংবা হোটেলে ইংরেজি গান কাভার করতেন তাঁরা। তখন আইয়ুব বাচ্চুর নিজের কোনো গিটার ছিল না। অন্তরঙ্গ বন্ধু কুমার বিশ্বজিতের জাপানি টিএসকো গিটার নিয়ে বাজাতেন তিনি। সেটা ছিল ২২ ফ্রেটের লাল-সাদা মেশানো একটি গিটার। এরপর আরেক বন্ধুর থেকে নেন গিবসন সেমি-অ্যাকুয়েস্টিক গিটার। তার কিছুদিন পর নিলেন ইন্ডিয়ান গিটার রেনল্ডস। তারপর একাধিক জার্মান-আমেরিকান গিটার। এভাবেই চলে যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে ব্যান্ডের লাইনআপে পরিবর্তন হয় কিছুটা আর সেটার নাম নতুন করে হয়ে যায় ‘ফিলিংস’।

‘এলআরবি’ ব্যান্ডের অ্যালবাম

এরপর ফিলিংসে বাজিয়েছেন বছর দুয়েক। ১৯৮০ সালের দিকে যোগ দেন তখনকার সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যান্ড ‘সোলস’-এ। সেই সময়ে সোলসের দুর্দান্ত লাইনআপ ছিল রীতিমতো ঈর্ষা করার মতো। তপন চৌধুরী, নকীব খানদের আমন্ত্রণে ঢুকে পড়েন নতুন এক সাংগীতিক আবহে। প্রচণ্ড পরিশ্রমী ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। তাঁর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার নাম ছিল জিমি হেনড্রিক্স, তাঁর ছায়াশিক্ষক। তিনি সান্তানার গিটার বাজানোর স্টাইল শুরুর দিকে ফলো করতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন করে গিটারকে নিজের আয়ত্তে আনতে চাইতেন। যেহেতু একেবারে নিজের চেষ্টায় তাঁকে গিটার শিখতে হয়েছিল, তাই নিজের সবটুকু দিয়ে অনবরত গিটার বাজিয়ে গেছেন। হোটেলের ছোট একটা রুমে সারা দিন প্র্যাকটিস করতে করতে ঘেমে গিয়ে বাইরের নলকূপের পানি পান করে দিন কেটেছে তাঁর। বেশ কঠিন এক স্ট্রাগল ছিল নিজের মধ্যে।

সোলসর সঙ্গে কাজ শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যে সুরকার-কম্পোজার হিসেবে আইয়ুব বাচ্চু সামনে চলে আসেন মূলত নকীব খান ব্যান্ড ছাড়ার পর। সোলসের প্রথম অ্যালবাম ‘সুপার সোলস’–এর পুরোটাই কিন্তু তাঁর বাজানো। আইয়ুব বাচ্চুরা তখন ব্যান্ডসমেত ঢাকায়। ঢাকার বিভিন্ন স্টুডিওতে সেশন গিটারিস্ট হিসেবেও বাজাচ্ছেন তিনি। এরপর আশির দশকের মাঝামাঝিতে আলাউদ্দীন আলীর সহকারী হতে চেয়েছিলেন। ইতিমধ্যে আইয়ুব বাচ্চু কিন্তু তখন সুরকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় আছেন। তখন পর্যন্ত তিনি ব্যান্ডে শুধু গিটারই বাজাতেন, কম্পোজ করতেন। মাঝেমধ্যে দু-একটি ইংরেজি গানের কাভার করতেন, স্টেজে প্রথম গাওয়া বাংলা গান ‘হারানো বিকেলের গল্প’।

এলআরবি। বাঁ থেকে বাচ্চু, টুটুল, মিল্টন, স্বপন।
ছবি: সংগৃহীত

সুরকার হিসেবে নিজেকে আইয়ুব বাচ্চু পুরোপুরিভাবে মেলে ধরার সুযোগ পেলেন তপন চৌধুরীর একক অ্যালবামে। একেবারে খাঁটি মেলোডি, সেমি-ক্ল্যাসিক্যাল গান। অথচ আইয়ুব বাচ্চু পছন্দ করতেন রক, পুরোদস্তুর হার্ডরক। দীর্ঘ ১০ বছরের সোলস অধ্যায়ের ইতিও টেনেছিলেন মেলোডি থেকে রকের দিকে যাত্রা শুরু করার জন্য। সোলস মেলোডিনির্ভর গান করত তখন। কিন্তু বাচ্চু ভালোবাসতেন গিটারের ঝংকার। সোলস থেকে বের হয়ে আসাটাও নতুন কিছু দেওয়ার জন্যই, গিটার শোনাতে হবে বলেই তাঁর গান গাওয়া। সোলসে থাকাকালেই ‘ময়না’ নামে একটি একক অ্যালবাম বের করেছিলেন তিনি। হয়তো এই অ্যালবামের গানগুলো শ্রোতারা ভালোভাবে গ্রহণ করার ফলেই আইয়ুব বাচ্চু গায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশের সাহস পেয়েছিলেন। যাঁরা একই সঙ্গে গিটার বাজান এবং সুর করেন, তাঁদের গানে অন্য রকম একটা সুরের আদল পাওয়া যায়, গিটারের মেলোডি ধরা দেয় তাঁদের সৃষ্ট গানে।

এক দশক সোলসে পার করার পর ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল একটি দূতাবাসের ক্লাব কনসার্টে গান করার মাধ্যমে আইয়ুব বাচ্চু তাঁর নিজের ব্যান্ড ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’ (এলআরবি) প্রতিষ্ঠা করেন। অবশ্য এখানে একটি মজার ব্যাপার ঘটেছিল। তাঁদের ব্যান্ডের নাম ছিল ‘ইয়োলো রিভার ব্যান্ড’ (ওয়াইআরবি)। কনসার্ট করতে গিয়ে দেখেন, সেখানে লেখা ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। আয়োজকদের একজন অদ্ভুতভাবে জানান, এই নাম তাঁর কাছে বেশি ভালো লাগায় প্রচারের সময় এই নামই ব্যবহার করেছেন তিনি। এভাবে নামটি থেকে যায়। এর এক বছর পর এলআরবি তাদের প্রথম অ্যালবাম বের করে, যেটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ডাবল অ্যালবাম। এরপরের গল্প সবার কমবেশি জানা। ক্রমাগত নতুন গান, এবির সাফল্য। বছর পাঁচেক পর ব্যান্ডের নাম হয়ে যায় ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’। এর কারণটা ছিল তাদের আগের নামে একটি ব্যান্ড ছিল অস্ট্রেলিয়াতে। আইয়ুব বাচ্চু বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখতে হবে।

তাঁদের ব্যান্ডের নাম ছিল ‘ইয়োলো রিভার ব্যান্ড’ (ওয়াইআরবি)। কনসার্ট করতে গিয়ে দেখেন সেখানে লেখা ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। আয়োজকদের একজন অদ্ভুতভাবে জানান, এই নামটি তাঁর কাছে বেশি ভালো লাগায় প্রচারের সময় এই নামটিই ব্যবহার করেছেন তিনি। এভাবে নামটি থেকে যায়।

আরেকটা ব্যাপার বেশ খেয়াল করার মতো, আইয়ুব বাচ্চু যখন নিজের ব্যান্ড বানালেন, তারপর থেকেই মূলত লিড গিটারিস্টদের কদর বাড়তে শুরু করেছিল। এর আগে গান হতো অনেকটা কি-বোর্ডনির্ভর। আইয়ুব বাচ্চু এবং তখনকার কিছু ব্যান্ডের কারণে সেটার খানিকটা পরিবর্তন হয়েছিল। রক মিউজিকের মতো একটা আগন্তুক সংগীত ঘরানাকে বুকে ধারণ করে সাংগীতিক কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন এবি এবং তাঁর প্রজন্মের সতীর্থ রক মিউজিশিয়ানরা। আবার মূলধারার মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই ব্যান্ড মিউজিশিয়ানদের খানিকটা তুচ্ছতাচ্ছিল্যের চোখে দেখতেন, তাঁদের শক্ত জবাব দিয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। নব্বইয়ের ব্যান্ড মিউজিশিয়ানদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম ব্যস্ত কম্পোজার।

গিটার হাতে প্রচুর এক্সপেরিমেন্ট করেছেন আইয়ুব বাচ্চু। এলআরবির প্রথম লাইভ আনপ্লাগড অ্যালবাম ‘ফেরারী মন’। এখানের গানে ভায়োলিনের যে দুর্দান্ত মিশ্রণ ঘটেছে, এককথায় তা অনবদ্য। হার্ডরক দিয়ে শুরু করলেও ব্লুজে চমৎকার পারদর্শিতা ছিল এবির। তিনি বলতেন ‘ব্লুজ হচ্ছে কান্নাকাটির জনরা। ব্লুজে গিয়ে আপনি শুধু কান্না করবেন। আপনার যত দুঃখ, যত কষ্ট, সব এই ব্লুজে।’ কনসার্ট শেষে চাইতেন একসঙ্গে গিটার জ্যামিং করতে। তার মৌলিকত্ব স্বীকার করবেন না, এমন কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। এবির সাক্ষাৎকারে বারবার উঠে এসেছে তাঁর সমসাময়িক অনেক মিউজিশিয়ানের নাম। অবলীলায় সবার অবদানের কথা স্বীকার করতেন তিনি। গ্রেট গিটারিস্ট নয়ন মুন্সী, নিলয় দাশের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল মুগ্ধতা।

আইয়ুব বাচ্চুর গিটার কালেকশন দেখে পৃথিবীর যেকোনো গিটারিস্ট ঈর্ষান্বিত হবেন। কাছের মানুষদের উপহার, চ্যারিটিতে দেওয়া বাদে অর্ধশতাধিক গিটারের কালেকশন তাঁর। এর মধ্যে কোনোটি আবার দুষ্প্রাপ্য। এসব গিটারের অধিকাংশই সংগ্রহ করা আমেরিকা থেকে। গিটারের এই জাদুকরের স্বপ্ন ছিল ইন্সট্রুমেন্টাল অ্যালবাম আর কনসার্টের। ঢাকা ও চট্টগ্রামে তাঁর গিটার কনসার্ট হয়েছে, মানুষ শুধু তাঁর গিটার শুনতে ছুটে গেছেন সেখানে। তবে আইয়ুব বাচ্চুর সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল একটি গিটার স্কুল প্রতিষ্ঠা করার, যেখানে গিটার ছাড়াও অন্য সব বাদ্যযন্ত্র শেখানো হবে। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও এ ব্যাপারে যাঁরা আর্থিক সাহায্য করতে পারেন, তাঁদের সাহায্য তিনি পাননি। এই আক্ষেপ, এই অভিমান এবি বয়ে বেড়িয়েছেন আমৃত্যু।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]