আপনার কয়টি স্মৃতি নিহত হয়েছে এই সময়ে?

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

শৈশবে প্রতিবেশী বা অপ্রতিবেশী স্থানীয়দের মৃত্যুসংবাদ মিলত মাইকে। একটি রিকশায় বসে থাকতেন একজন বা দুজন ব্যক্তি। মৃত্যুর খবর জানিয়ে তাঁরা মাইক্রোফোনের সামনে বলে যেতেন মৃত ব্যক্তিদের পরিচয়। রংবেরঙের মাইকে পাখনা মেলত সাদা-কালো মৃত্যু। মন খারাপ হতো। মহামারির কাল সেই মন খারাপের তীব্রতাকে কি গা–সওয়া করে ফেলল?

কথায় আছে, অধিক শোকে পাথর। শোক বেশি হলে হয়তো তা পাথরের মতোই পাষাণভার হয়। করোনা মহামারি আমাদের দিয়েছে সামর্থ্য অনুযায়ী সামলে চলার শিক্ষা। হয়তো করোনাই আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। স্বার্থের তীক্ষ্ণ ফণায় কি মনের পরতে অমোচনীয় দাগ পড়ছে? হয়তোবা। এই মহামারি একদিকে যেমন দেখিয়েছে মানুষ মানুষের জন্য, ঠিক অন্যদিকে এ-ও দেখিয়ে দিয়েছে যে এ দেশে ধনী-গরিবে পার্থক্য কত ব্যাপক, বিশাল। আমরা হয়তো এখনো গুনে চলেছি নিজেদের অবস্থান। উঁচুতে নাকি নিচুতে—তা কি ঠাওর হচ্ছে?

সত্যিটা ঠাওর হলে বিপদ। যখন বুঝবেন, এত দিন যা ভাবতেন তার অনেকটাই ছিল মেকি, তখন আর মেনে নিতে চাইবেন না। করোনার শুরুর দিকে অনেক সাহায্যপ্রার্থী আমরা চারপাশে দেখেছি। আমরাও ছিলাম সাহায্য চাওয়ার কাতারেই। পেতে থাকা হাত তখন চাইত বেঁচে থাকার অবলম্বন। যাদের নিজেদের কিছু ছিল, তাঁদের কেউ কেউ শুরুতে তা ভাগাভাগি করতে চেয়েছেন বটে; তবে যাঁদের অনেক অনেক ছিল বা এখনো আছে, তাঁরা আসলে কতটুকু দিয়েছেন? কতটুকু দিলে আসলে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বেঁচে থাকতে পারে?

আচ্ছা, আমরা কি জানি কোনো দিন কেউ না খেয়ে মরেছে কি না? হয়তো মরেছে, হয়তো নয়। বা চালের সঙ্গে ডাল না পেয়ে কোনো শিশু কি তার সদ্য কর্মহীন মা–বাবার সঙ্গে রাগ করে প্রবল অভিমানে কেঁদেছে? অশ্রু ও অভিমানের দাম এই পৃথিবীতে সর্বদাই নিম্নমুখী। ক্ষতি হয়েছে, তা কে না জানে! বড় বড় অঙ্কের হিসাব হচ্ছে। বড় বড় লোক প্রণোদনা পাচ্ছে। কিন্তু তা পিরামিডের মাথা থেকে চুঁইয়ে পড়তে পড়তে কি নিচে দাঁড়ানো ঘর্মাক্ত শ্রমিকের হাতে গিয়ে পৌঁছায়? নাকি পিঠ চাপড়ে দিলেই সাত খুন মাফ! ক্ষতির উল্টো পিঠের অশ্রুর হিসাব কি কষে কেউ? না, কেউ সেই হিসাবে যায় না। অন্তত একটি দীর্ঘ মহামারি কাটাতে কাটাতে এই অনুসিদ্ধান্ত সিদ্ধান্তে রূপ নিয়েছে। এর মেয়াদ কত দিন, তা-ও হিসাবসাপেক্ষ। আদতে দিন শেষে হয় শুধু ডেবিট-ক্রেডিটের জটিল অঙ্কের একতরফা কাব্য।

এই একতরফা কাব্যে ছন্দের ধার ধারে না কেউ। মাত্রাবৃত্ত নাকি অক্ষরবৃত্ত—তাতে কারও যায়–আসে না। করোনাভাইরাস ঠিক তেমনই এক নিস্পৃহ ভঙ্গিমায় মৃত মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে চলে। তা শুধু নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলে নয়, সর্বত্র। একবার ভেবে বলুন তো, এত মৃত্যুর খবর কি অন্য কোনো বছরে পেয়েছেন? কাছের পরিজন, প্রিয়জন বা পর্দায়-পত্রিকায় দেখতে দেখতে কাছের মানুষ হয়ে ওঠা বিখ্যাতজন—কত পরিচয়!

আচ্ছা, আমরা কি জানি কোনো দিন কেউ না খেয়ে মরেছে কি না? হয়তো মরেছে, হয়তো নয়। বা চালের সঙ্গে ডাল না পেয়ে কোনো শিশু কি তার সদ্য কর্মহীন মা–বাবার সঙ্গে রাগ করে প্রবল অভিমানে কেঁদেছে? অশ্রু ও অভিমানের দাম এই পৃথিবীতে সর্বদাই নিম্নমুখী। ক্ষতি হয়েছে, তা কে না জানে! বড় বড় অঙ্কের হিসাব হচ্ছে। বড় বড় লোক প্রণোদনা পাচ্ছে। কিন্তু তা পিরামিডের মাথা থেকে চুঁইয়ে পড়তে পড়তে কি নিচে দাঁড়ানো ঘর্মাক্ত শ্রমিকের হাতে গিয়ে পৌঁছায়?

ভেবে দেখুন, এই প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে আপনার কোনো না কোনো স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কারও লেখা বা আঁকা হয়তো আপনার শৈশব রাঙিয়েছে, কারও অভিনয় হয়তো কৈশোরে পরমানন্দ দিয়েছে। কোনো প্রিয়জনের একটি স্মৃতি হয়তো এখনো জমা আছে মনের কুঠুরিতে। কখনো কখনো মনে পড়লে হয়তো ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি দেখা দেয়। হয়তো গেল বছর এমন কারও মৃত্যুসংবাদ ঝাপসা চোখের অস্পষ্ট দৃষ্টিতে কাঁপা কাঁপা হাতে আপনাকেই লিখতে হয়েছে। তা কি মাইকে জানানো হয়েছে সবাইকে? প্রশ্নটি প্রবলভাবেই আছে। কারণ, মহামারি যে আমাদের শোক প্রকাশকেও মিথ্যা সামাজিক বাধার অদৃশ্য বাঁধনের বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।

মহামারি আমাদের স্মৃতি হত্যা করছে—এই কথা তাই অত্যুক্তি হবে না মোটেও। আপনার কয়টি স্মৃতি নিহত হয়েছে এই সময়ে? গুনতে পারবেন? নিহত স্মৃতিকে সংখ্যায় বাঁধতে পারলে এবার শুধু তা কয়েক গুণে বাড়াতে থাকুন। একসময় তা পুরো পৃথিবীর আকার নিতে পারে।

তা-ও ভালো, স্মৃতি হত্যার কালে নিহত স্মৃতিদের যদি সংখ্যায় রূপ দেওয়া যায়, তবে মন্দ কী? অন্তত একটা আকার তো পেল! অনির্দিষ্ট সীমাহীন চরাচরের সীমা দেখতে পাওয়াতেও যে আশার আলো মেলে। সংশয় জাগা মনে আশা তখন একটাই—পথের শেষ কি হলো?

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]