আবদুল খালেক টু

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শেষ হয়েছে ঈদ। তবে আনন্দের রেশ রয়ে গেছে এখনো। এ সংখ্যায় থাকছে তিনটি রসগল্প

দুজন ভিন্ন রুচির মানুষ—একজন পুরুষ ও একজন নারী—নিজেদের অজান্তে ভাঙনের ঝুঁকি নিয়ে কাবিননামা সই করে প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক আত্মীয়স্বজনের নাকের ডগায় ভেতর থেকে দরজায় তালা মেরে (দরজার খিল-আঁটা যুগ আর নেই, দুই পাল্লার দরজাও দুর্লভ, দরজার ছিটকিনি-লাগা যুগও প্রায় শেষ; দরজায় তালা মারতে একসেরি বাটখারার সমান তালাও লাগে না, দরজায় ইন-বিল্ট পুশ বাটন টিপলেই যথেষ্ট) খিলখিল করে হাসতে হাসতে যখন বিছানায় গড়িয়ে পড়ে, তখন তাদের বলা হয় বিবাহিত। তারা জানে না সামনে কী ভয়ংকর দিন।

আনুষ্কা বলল, ‘তোমার সঙ্গে আমার রুচির একদম মিল নেই, তবুও কেন যে...’ (অব্যক্ত: তোমার মতো একটা আহাম্মককে বিয়ে করতে হলো!)

আমি যথেষ্ট পরিমাণ আউটবই পড়া মানুষ, কাজেই এই বই থেকে চার লাইন ওই বই থেকে ছয় লাইন মেরে দিয়ে ইমপ্রেসড করার মতো জবাব দিতে পারি। বললাম, ‘বেশ তাহলে চলো একটা রুচির পরীক্ষা দিই, দেখি মেলে কি না।’

‘কিসের পরীক্ষা?’

‘রুচির। ধরো, ভয়ংকর এক ঝড়ের রাতে তুমি এমন একটি বাড়িতে আশ্রয় পেলে, যার দুটিমাত্র রুম, দুই রুমে দুটো ডাবল বেড। প্রথমটিতে উঁকি দিয়ে দেখলে বিছানায় ভয়ংকর চেহারার একজন পুরুষ—ড্রাকুলার মতো, তোমাকে তার বিছানায় শুতে ডাকছে। পাশের দ্বিতীয় রুমে উঁকি দিয়ে দেখলে লাবণ্য ঝরানো এক সুন্দরী শুয়ে আছে। তোমাকে শুতে ডাকছে। তুমি কোন বিছানায় যাবে বীভৎস পুরুষের না, সুন্দরী নারীর?’

আনুষ্কা বলল, ‘অবভিয়াসলি, দ্বিতীয় রুমে।’

আমি তখন বললাম, ‘তুমি যে বললে আমাদের রুচির মিল নেই? বাইরে ঝড়বৃষ্টি থাক বা না থাক, আমিও তো দুই নম্বর রুমেই থাকতাম।’

আনুষ্কা বলল, ‘তুমি অন্য মেয়েমানুষের...ওহ্ মাই গড!’ (অব্যক্ত অংশে ছিল: সঙ্গে শুতে! মানে লক্ষ্মী বাবুটির মতো শুয়ে অমনি ঘুমিয়ে পড়তে? আর কী করতে সত্যি করে বলো?)Ñ এ প্রশ্নের জবাবে হয়তো বলতে পারতাম, আমাকে কাছে পেয়ে ওই সুন্দরী মেয়েটি যদি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি মোদের বাড়ি এসোÑ—এটা গুনগুন করে গাইত, তাহলে না হয় ঘুমিয়েই পড়তাম। কিন্তু যদি...

আনুষ্কা চিৎকার করল না, খুব বঙ্কিম স্বরে বলল, ‘খায়েশ কত, আঠারো-উনিশ বছরের ঘাড়ে তিল, গালে টোল পড়া সি-থ্রু পোশাকে বিছানায় শুয়ে থাকা একটা সুন্দরী মেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে লালাবি গেয়ে তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে, আর তুমি...’ (এবারও আনুষ্কা বাক্যটি অসমাপ্ত রেখে দিল।)

দুই নম্বর রুমের সুন্দরীর বয়স কত উনিশ না উনপঞ্চাশ জানি না, আনুষ্কা জানে। তার ঘাড়ে তিল, গালে টোল পড়ে, সে ভ্রু কুঁচকে কথা বলে কি না আমার জানা নেই; আনুষ্কার জানা। যে পোশাকে সে বিছানায় শুয়ে আছে তা লাল কাতান, না বুক ফাড়া হালকা গোলাপি সি-থ্রু ম্যাক্সি,Ñ আমার কোনো ধারণা নেই, কিন্তু আনুষ্কা জানে।

‘তুমি ওই বদমাশ মেয়েটার সঙ্গে এক বিছানায় শোবে?’

আমি বলি, ‘তুমি কি আমাকে ওই ভয়ংকর ড্রাকুলার পাশে শুতে বলো? তা ছাড়া একজন ভদ্রমহিলা সম্পর্কে তুমি যা-তা বলছ?’

‘ভদ্রমহিলার জন্য দরদ কত! আমি বদমাশ বললাম আর অমনি তোমার গায়ে লেগে গেল? কেন, আগে থেকেই জানাশোনা আছে নাকি? ভালো হলে ও–রকম সি-থ্রু বুক ফাড়া ম্যাক্সি পরে?’

‘কিন্তু ম্যাক্সি যে পরেছে এটা জানলে কেমন করে?’

‘বেডরুমে কেউ ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভার মতো নভোচারী ড্রেস পরে শুয়ে থাকে না, হালকা-পাতলা কাপড়ই পরে।’

‘তা অবশ্য ঠিক।’

‘এই তো এখন নিজের মুখেই স্বীকার করলে। আগে থেকেই এ রকম কথা ছিল, তাই না?’

‘কী রকম?’

‘ঝড়ের বাহানায় তুমি শেগুফতার বেডরুমে ঢুকে পড়বে আর আমাকে বলবে পাশের রুমে ড্রাকুলা!’

আমি জিজ্ঞেস করি, ‘শেগুফতা আবার এল কোত্থেকে? তুমি এসব কী বলছ?’

আনুষ্কা বলল, ‘ঠিকই বলছি। ঘাড়ের ঠিক মাঝখানে আঁচিলের মতো একটা তিল কার? শেগুফতার। গালে কার টোল পড়ে? শেগুফতার। আমাদের ফ্যামিলিতে মানে কাজিনদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর কে? শেগুফতা। ব্যাংকক থেকে পিঙ্ক কালারের একটা বুক ফাড়া সি-থ্রু ম্যাক্সি কে কিনে এনেছে? এটাও তো শেগুফতা। তাহলে আর বাকি থাকল কী?’

আলোচনার খাত পরিবর্তন করার জন্য বললাম, ‘তুমি বললেই আমি মেনে নেব, আমাকে কী পেয়েছ? তোমাদের ফ্যামিলিতে ইন ট্রু-সেন্স অব বিউটি হলে তুমি, শেগুফতার তো শুধু গায়ের রংটা ফরসা। তা ছাড়া গায়ে কেমন বাদামি রঙের ছিট পড়েছে, মার্গারিটা ড্র্যাবলের মতো।’

আনুষ্কা বলল, ‘এটা অবশ্য তুমি ঠিকই বলেছ। তোমার জাজমেন্ট কারেক্ট। গতবার মিস ইউনিভার্স কনটেস্টে তুমি বলেছিলে পুয়ের্তো রিকোর জুলেইকা রিভেরা চ্যাম্পিয়ন হবে আর আমি বলেছিলাম অস্ট্রেলিয়ার জেনিফার হকিন্স। শেষ পর্যন্ত ওই কালো মেয়ে জুলেইকা রিভেরাই ক্রাউন পরল। জেনিফার সেকেন্ড রানারআপও হতে পারল না।’

আমি বললাম, ‘সুন্দরের একটি বড় অনুষঙ্গ হচ্ছে ইনটেলেক্ট, বাংলায় বুদ্ধিমত্তা, এটা তোমার আছে।’

আমি বললাম, ‘ঝড়ের রাতে অজানা-অচেনা জায়গায় তুমি কার কাছে আশ্রয় নেবে Ñঅন্য কোনো অপশন নেই, কেবল দুটি আশ্রয়: ড্রাকুলার বিছানা অথবা এক সুন্দরীর বিছানা। তুমি তোমার বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে বের করে ফেললে এই সুন্দরী আর কেউ নয়, তোমার বোন শেগুফতা। কিন্তু ঠিক এ প্রশ্নই ওকে জিজ্ঞেস করা হলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। তোমার নাম মুখেও নিত না।’

আনুষ্কা বলল, ‘এগজ্যাক্টলি। ও তো ভীষণ জেলাস। আমার কথা মনে হলেও বলত না। বললে যে আমাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে যায়!’

‘তবু সত্যটা তো সত্যই।’

আনুষ্কা বলল, ‘তুমি এক মাস ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে একটা বই পড়ছ: ওয়ান হানড্রেড অ্যান্ড ওয়ান ওয়েজ টু স্যাটিসফাই ইয়োর ওয়াইফ—স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার এক শ একটা উপায়। এই বইয়ের ১০১ নম্বর টিপসটা হচ্ছে, তোমার স্ত্রী যে সবচেয়ে সুন্দর,Ñএটা নির্ধারিত সময় পরপর তাকে স্মরণ করিয়ে দেবে। তুমিও তা-ই করলে।’

আমি বললাম, ‘আমি তো অর্ধেকটা বই পড়েছি, এমন কোনো কথা চোখে পড়েনি।’

‘ছি, বইটার প্রথম দিকেই কী সব নোংরা কথা লিখেছে, তোমাদের ওই বাৎসায়নের মতো।’

‘কিন্তু এই বইটা তো একজন আমেরিকান নারী লেখকের।’

আনুষ্কা বলল, ‘আমি সব জানি। গোটা বইটা এক ফাঁকে আমি নীলক্ষেতে গিয়ে একটা বাচ্চা ছেলেকে দিয়ে ফটোকপি করিয়েছি। আমি তোমার প্রত্যেকটা মুভমেন্ট এবং ডায়ালগ ফলো করে বইয়ের সঙ্গে মেলাচ্ছি। তুমি বাৎসায়নের সাফাই গাইতে গিয়ে বললে নারী লেখক। শোনো, পৃথিবীর সব দেশেই শেগুফতা আছে, তারা জানে কেমন করে কাকে বিছানায় টানতে হয়।’

আনুষ্কা ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে সরাসরি কয়েক ঢোঁক গেলে, আমি তার গলনালি দিয়ে পানির নিচের দিকে চলে যাওয়া লক্ষ করি।

আমি আনুষ্কার সৌন্দর্যের যে প্রশংসা করেছি তা কনস্ট্যান্স চ্যাটার্লি যেমন বলেছেন তেমন কাজে লাগেনি। এই কনস্ট্যান্স চ্যাটার্লি স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার ১০১ উপায় গ্রন্থের লেখক। তাঁর জন্মš আমেরিকার জ্যাকসন হাইটসে, বাবা অজ্ঞাত, মায়ের বয়ফ্রেন্ড তাঁকে অ্যাবিউজ করেছে, নিজের বয়ফ্রেন্ড তাঁকে ডেজার্ট করেছে। ডিএইচ লরেন্স নামে এক ব্রিটিশ লেখকের এক নায়িকার নাম নিয়ে লেখালেখি শুরু করে এখন বেশ বিখ্যাত তিনি। তাঁর যে বইটি বাজারে আসছে তার নাম: হানড্রেড অ্যান্ড ওয়ান ওয়েজ টু ডিল উইথ ওয়াইফ’স সিস্টার—শ্যালিকা সামলানোর ১০১ উপায়। আমি এই বইটি না কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আনুষ্কার হাতে পড়লে ভুল-বোঝাবুঝি বাড়বে। ফ্রিজের ঠান্ডা পানি আনুষ্কার কণ্ঠ আরও শীতল করল। বলল, ‘বেশ মেনে নিলাম শেগুফতা তেমন সুন্দর নয়, বিদেশি মেয়েদের মতো তার শরীরে বাদামি রঙের ছিট পড়েছে। বলো তো দেখি শরীরের কোন কোন জায়গায় এসব দাগ তোমার চোখে পড়েছে?’

প্রশ্নটি বিব্রতকর। ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনে উচ্চশিক্ষার সময় আমাদের পাবলিক পলিসি, আরও সরাসরি বলতে গেলে অ্যারন উইল্ডাভস্কির স্পিকিং ট্রুথ টু দ্য পাওয়ার বইটি পড়াতেন মার্গারিটা ড্র্যাবল। বাদামি রঙের বিন্দু বিন্দু দাগ হাতে-মুখে-গলায় তো ছিলই, যেদিন স্কার্ট পরে আসতেন, পায়ের ওপর পা তুলে বসলে হাঁটুর ওপরেও বেশ খানিকটা জায়গায় এই দাগ আমার চোখে পড়ত। কিন্তু শেগুফতার তেমন বেশি নয়, হাতে দু-চারটে, গলার কাছেও থাকতে পারে। উইন্ডাভস্কি বলেছেন, ক্ষমতাবানেরা সারাক্ষণ ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কায় দিন কাটায়, ফুড়ুৎ করে ছুটে যাওয়া ইঁদুরকে ভাবে বিস্ফোরণোন্মুখ ল্যান্ড মাইন। আমার এই প্রিয় শিক্ষকের শরীরে আরও এক লাখ বাদামি স্পট যোগ হলেও তিনি আমার একই রকম প্রিয় থাকবেন।

আনুষ্কা উত্তরের অপেক্ষায় আছে, আমি বললাম, ‘মার্গারিটা ড্র্যাবলের তো হাতে-মুখে-পায়ে এবং সম্ভবত বুকে-পিঠেও ছিল।’

‘আমি মার্গারিটার কথা জিজ্ঞেস করিনি।’

‘শেগুফতারও হাতে কয়েকটা আছে। এর বেশি তো আর জানা সম্ভব নয়।’

আনুষ্কা বলল, ‘সে কথা সত্যি, তোমাকে না দেখালে তুমি জানবে কেমন করে। সে জন্যই সেই ঝড়ের রাতে যখন বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, বঙ্গোপসাগরে ভীষণ নিম্নচাপ, আকাশে হঠাৎ বিদ্যুচ্চমক এবং দুনিয়া-কাঁপানো বজ্রপাত, কোথাও যাওয়ার কোনো উপায় নেই, তুমি একজন পুরুষ মানুষের রুমে না ঢুকে তাকে ড্রাকুলা আর কী সব বলে ঢুকে পড়লে শেগুফতার রুমে। সে তোমাকে দেখাবে শরীরের আর কোথায় কোথায় ব্রাউন স্পট লুকিয়ে আছে। তোমার যাতে কষ্ট না হয় সে জন্য তার পরনে সি-থ্রু ম্যাক্সি, তার আবার বুক ফাড়া। বলো শুনি, কোথায় কোথায় দেখলে?’

আমি এবার একটু উত্তেজিত হয়ে বললাম, ‘তোমার বোন শেগুফতা ছাড়া পৃথিবীতে কি আর কোনো সুন্দরী নেই?’

আনুষ্কা বলল, ‘অবশ্যই আছে, আমি তার নামও জানতে চাচ্ছি। সত্যটা প্রকাশিত হওয়া দরকার।’

আমি বললাম, ‘সত্যটাই বলব। তার পুরো নাম কিম্বারলি নোয়েল কার্দাসিয়ান। সবাই তাকে কিম কার্দাসিয়ান নামে চেনে। তোমারও চেনার কথা।’ (কনস্ট্যান্স চ্যাটার্লির বইয়ের ৪৭ নম্বর টিপস ব্যবহার করলাম: যখন স্ত্রী স্বামীকে তার প্রিয় কোনো নারীর নাম বলতে পীড়াপীড়ি করে, তখন স্ত্রীর কাছে অবিশ্বাস্য কারও নাম বলে দেবে।)

আনুষ্কা বলল, ‘ইমপসিবল।’

আমি বললাম, ‘ঠিকানাটা মনে রেখো: ৩১৪৫ অ্যাবিংটন ড্রাইভ, বেভারলি হিলস। ক্যালিফোর্নিয়া ৯০২১০। ফোন নম্বরও আছে, দেব?’

‘অ্যাবসলিউটলি ইমপসিবল।’

আমি বললাম, ‘মেট্রোপলিটন ঢাকায় যখন তোমাকে বিয়ে করলাম, সবাই বলল ইমপসিবল।’

আনুষ্কা এবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘আর একটা কথাও নয়। জাস্ট স্টপ। কিম কার্দাসিয়ান ইজ আ হৌর।’

এবার নিস্পৃহ কণ্ঠে একটি জ্ঞানগর্ভ উক্তি আওড়ালাম, ‘সফল নারীকে অন্যরা বেশ্যা বলে গাল দিয়ে নিজের ব্যর্থতা ঢাকে।’

মাছশূন্য কিন্তু পানিপূর্ণ একটি ছোট্ট অ্যাকোয়ারিয়াম ছিল আনুষ্কার হাতের নাগালের মধ্যে, ওটাই তুলে ছুড়ে মারল। জুতা ছুড়ে মারার পর জর্জ বুশ যেভাবে মাথা সরিয়ে নিয়েছিলেন, আমিও ধাবমান অ্যাকোয়ারিয়ামের গতিপথ থেকে মাথা সরিয়ে নিলাম।

আমি বললাম, ‘আনু, প্লিজ, থামো।’

‘সাবধান আবদুল খালেক টু, তুমি আমাকে আনু বলবে না, এটা মেট্রোপলিটন ঢাকা, আমার নাম আনুষ্কা।’

২.

আমার স্ত্রীর নাম অবশ্যই আনুষ্কা।

আমার নাম আবদুল খালেক।

আমি নিজের যোগ্যতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে এক বছর শিক্ষকতার আশায় বসে থেকে দুই বছর আইসিডিডিআরবিতে কাজ করে দেশের অন্যতম বৃহৎ ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পেম্বারটন ফার্মাসিউটিক্যালসে প্রডাকশন বিভাগে চাকরি নিলাম। যেখানে সম পদে কিন্তু জ্যেষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে পেলাম আমেরিকার ভার্জিনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ফার্মেসিতে পাস করা সুদর্শন ও চটপটে আর একজন আবদুল খালেককে। এ ধরনের মানুষের নাম হওয়ার কথা হ্যারল্ড কাদরী কিংবা ধীমান ইরতিজা। কিন্তু তিনি যে কেন আবদুল খালেক, আমার জানা নেই। স্কুলে আমি বাবুল নামের দুজন সহপাঠীকে পেয়েছি, একজন ট্যাঁরা বাবুইল্যা, অন্যজন বাইট্টা বাবুইল্যা। আমি বরিশালের উজিরপুর থেকে সরষের তেল দিয়ে ভালো করে মাথা আঁচড়ে লঞ্চে সদরঘাট নেমে ভীরু পায়ে ঢাকা শহরে ঢুকেছি; আর তিনি দূরপাল্লার বোয়িং ৭৭৭-এ ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে ট্যাক্সি কাবে চড়েই শহরে আসতেন, কিন্তু পেম্বারটন ফার্মাসিউটিক্যালসের মালিক নওশের আলী তাঁকে আনার জন্য শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ি পাঠান। তাঁর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা—তিন কন্যাকে যোগ্য পাত্রে সমর্পণ করে তাদের হাতে ব্যবসা তুলে দেবেন। তত দিন আমিও জেনে গেছি আমেরিকান আবদুল খালেক যোগ্যদের একজন। আমি পরিচিত হতে পারতাম বরিশাইল্যা আবদুল খালেক হিসেবে। কিন্তু কোম্পানির প্রশাসন-প্রধান ও হিসাব-প্রধান ঠিক করে দিলেন তিনি আবদুল খালেক ওয়ান, আমি আবদুল খালেক টু।

ফার্মেসি ডিপার্টমেন্টের ঢাকাবাসী শিক্ষার্থীরা গ্রাম থেকে আসা সবাইকে আবদুল খালেক ডাকত, আমাকেও।

মালিকের তিন কন্যা সুস্মিতা, আনুষ্কা ও শেগুফতা বাবার উৎসাহে কারখানা পরিদর্শনে আসত, এটা-ওটা জিজ্ঞেস করত, আমরা তাদের সমীহ করতাম।

সুস্মিতা তার বাবা নওশের আলীর এক মাতাল বন্ধুর সঙ্গে পালিয়ে গেলে পরের মাসেই আনুষ্কা ও আবদুল খালেক ওয়ানের বিয়ের কার্ড পেয়ে যাইÑ হোটেল শেরাটনের উইন্টার গার্ডেনে। অঘটন তারপরই। বিশালদেহী এক কৃষ্ণ রমণী শীর্ণকায় একটি কন্যাসন্তান এবং মার্কিন দূতাবাসের একজন কর্মকর্তাকে নিয়ে হাজির। তাঁর নাম উইনফ্রেড মাতানজিমা খালেক, শিশুটির নাম সুরাইয়া খালেক, এখানকার আবদুল খালেক ওয়ান তার স্বামী, নিউইয়র্কে ইয়েলো ক্যাব চালাত। তার গাড়িতেই এক প্রস্টিটিউট হত্যাকাণ্ডে তার নাম জড়িয়ে পড়েছিল বলে পালিয়ে চলে এসেছে, উইনফ্রেড একা তার জন্য লড়ে তাকে মুক্ত করেছে। চার্জশিট হয়েছে অন্য দুজনের বিরুদ্ধে। এক মাস ধরে স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করায় উইনফ্রেড নিজেই চলে এসেছে।

চক্ষের নিমেষে আবদুল খালেক ওয়ান নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।

বিয়ের দুদিন আগে নওশের আলী সংশোধিত আমন্ত্রণ পাঠালেন। স্থান, সময় পাত্রী, আবদুল খালেক—সবই ঠিক আছে, কেবল ওয়ানের বদলে টু বসেছে।

খবরের কাগজে আমার আর আনুষ্কার বর-বধূ বেশে ছবি ছাপা হয়েছে। বিশিষ্ট শিল্পপতি নওশের আলীর কন্যা আনুষ্কা আবদুল খালেক টুকে বিয়ে করলেন।

শেগুফতা এসে বলল, সব ঠিক আছে, আমার শুধু তোমার নামটা পছন্দ হয়নি। আমার বান্ধবীরা যেসব ছেলের প্রেম রিফিউজ করে, তাদের ডাকে আবদুল খালেক। তুমি আবার টু!

আবদুল খালেক ওয়ান অফিস ছেড়ে গেলেও আমার নাম থেকে টু ঝরে পড়ল না।

আনুষ্কার বিয়ের কার্ডে যেদিন বরের নাম আবদুল খালেক টু মুদ্রিত হলো, ফার্মাসিস্ট জন পেম্বারটনের নামে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির বাইরে আমার কোনো কিছু চিন্তা করার শক্তি লোপ পেল। আনুষ্কা, শেগুফতাকে অরক্ষিত রেখে আমি যাব কোথায়?

উইনফ্রেড মাতানজিমা খালেক মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাকে পাশে রেখে আবদুল খালেক ওয়ানের ছবি টাঙিয়ে প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করলেন। তিনি বার্তা দিলেন: আবদুল খালেক ওয়ান এখন আমেরিকায় নিরাপদ। আমাদের সন্তান সুরাইয়া খালেকের স্বার্থে তাকে আমেরিকায় নিয়ে যাব। যেখানে পাবেন তাকে ধরে নিয়ে আসুন। পুরস্কৃত করা হবে।

পেম্বারটন ফার্মাসিউটিক্যালসের গণসংযোগ কর্মকর্তা আবদুল খালেক ওয়ানের বরখাস্ত হওয়ার প্রেস রিলিজ পাঠিয়েছেন। আবদুল খালেক টু পদোন্নতি পেয়ে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন, সে খবরও ইংরেজি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।

পরদিন উইনফ্রেড মাতানজিমা খালেক ফ্যাক্টরিতে ঢুকে আমার কলার চেপে ধরলেন। বললেন, এটা তোমার কন্সপিরেসি, আমার আবদুল খালেককে সরিয়ে প্রমোশন নেওয়ার জন্য তুমি তাকে গায়েব করে ফেলেছ। নো প্রবলেম, আমি তাহলে তোমাকেই সঙ্গে নিয়ে যাব। আমার আবদুল খালেক চাই। আমার যেকোনো একজন আবদুল খালেক হলেই হলো।

এ খবর আনুষ্কার কানেও পৌঁছাল। আবদুল খালেক ওয়ানকে হারিয়ে এমনিতে তার ভেঙে পড়ার কথা, আবদুল খালেক টু-ও যদি কিডন্যাপড হয়, তাহলে?

আনুষ্কা ফোন করল, এই প্রথম তার সঙ্গে ফোন-কথন। বলল, আমি সব শুনেছি আবদুল খালেক টু। একটুও ঘাবড়াবেন না। আমি সব ম্যানেজ করব।

সে রাতেই আমি হিজাব পরা আনুষ্কার সঙ্গে পালালাম।

আনুষ্কা প্রমিজ করেছে, উইনফ্রেডের হাত থেকে আমাকে বাঁচাবেই। আমাদের পালিয়ে যাওয়ার কাহিনি জানত কেবল শেগুফতা।

শেগুফতা ফোনে আশ্বস্ত করল, উইনফ্রেড শেষ রাতের ফ্লাইটে দোহা হয়ে নিউইয়র্ক রওনা হয়েছে। দিনের বেলা চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেছে: কোনো আবদুল খালেক থ্রি কি নেই? চলে এসো, তোমাকেই নিয়ে যাব।

আনুষ্কার সঙ্গে আমার বিয়ের অনুষ্ঠানটি অনিবার্য কারণে স্থগিত রাখা হয়েছে।

তত দিনে আমরা জেনে গেছি, আমাদের সংসার টেকার নয়। আমরা যখন সেই না টেকা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি, এরই মধ্যে হঠাৎ আনুষ্কা আমাকে জাপটে ধরে চুমুটুমু খেতে খেতে বলল, ‘গুড নিউজ, প্রেগন্যান্সি টেস্ট রিপোর্ট পজিটিভ, আমরা একজন আবদুল খালেক থ্রি পেতে যাচ্ছি।’

আনুষ্কার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে বললাম, ‘যথেষ্ট হয়েছে, আর কোনো আবদুল খালেক নয়, আমি চাই আনুষ্কা টু।’

সেই প্রথম আনুষ্কার চাওয়া নাকচ করে দিল তার হাজব্যান্ড আবদুল খালেক টু।

এই নাকচ করায় কিছুই এসে-যায় না। আবদুল খালেক থ্রি কিংবা আনুষ্কা টু-এর আগমন সম্ভাবনা আসন্ন ভাঙনটাকে অনিশ্চিত করে তুলল।