আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের আজ জন্মদিন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
ছবি: সুমন ইউসুফ

বইয়ের পাঠক থাকবে, নাকি হারিয়ে যাবে—থেকে থেকেই এ বিতর্ক ওঠে। সেখানে উমবার্তো একোর মতো মানুষও বলেন, বই থাকবে। কারণ, বই ছাড়া গত হাজার বছরে এত ডিভাইস এসেছে, যা অল্প কিছুকাল পরেই বদলে গেছে। কিন্তু বই রয়ে গেছে অটুট। এ নিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কথা ছিল, একমাত্র বই হলো মানুষের মনের গতির সঙ্গে যায়। মানুষ বইয়ের সঙ্গে বা বই মানুষের সঙ্গে এভাবে সমান্তরাল লীলায় তাল মেলাতে পারে। কথাটি প্রথম হয়তো টিভিতে বা কোনো অনুষ্ঠানে বইয়ের গুরুত্ব নিয়ে বলতে গিয়ে এর টিকে থাকা না-থাকার প্রশ্নে বলেছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। বিষয়টি নিজে অনেক ভেতর থেকে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই বই পড়ার ও পাঠক তৈরির মতো জরুরি বিষয়কে সামনে রেখে তিনি গড়ে তুলেছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।

প্রথম নিজের ছাত্রদের নিয়ে, পরে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে চাইলেন বই পড়ার এই আন্দোলন। বোধ করি, রবীন্দ্রনাথের মতো তাঁরও আস্থা মানুষের অবিরত বেড়ে ওঠায় কি অবিরত হয়ে ওঠায়। রাতারাতি কিছু হয় না, অমূল পরিবর্তন এক-দুই দিনে বা বছরে ঘটে না। তাই তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন, প্রতিটি দিনে আছে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিযুগ। মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন সে কলিযুগে, যখন সে চোখ মেলে উঠে বসে তখন দ্বাপরে, যখন সে উঠে দাঁড়ায় তখন সে ত্রেতায়, আর যখন সে চলতে শুরু করে শুরু হয়ে তার সত্যযুগ।

পাউল ডি মানের চিন্তাধারায় আমরা জানতে পারি যে একমাত্র প্রকৃত পাঠক তৈরি কাজটি যদি বিশ্বব্যাপীয় এগিয়ে নেওয়া যায়, তাহলেই পৃথিবীর এত লোভ, হিংসা, হিংস্র বেনিয়াবৃত্তি ও অশুভ রাজনীতির হাত থেকে মানুষের মুক্তি মিলতেও পারে। এ ছাড়া পৃথিবীতে মুক্তি সুদূর পরাহত। পাঠকেরাই জগৎকে সুন্দর জগৎ হিসেবে তৈরি করতে পারে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তৈরি করার মাধ্যমে একদিকে যেমন পাঠক তৈরি কাজে নেমেছিলেন, অন্যদিকে নেমেছিলেন ভালো লেখক ও বইয়ের প্রচারে। প্রথম প্রথম যা হয়, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো করেই তাঁকে এগোতে হয়েছে। সেই সময়ের কষ্টদায়ক অনেক অভিজ্ঞতা তিনি এ সময়ে বিভিন্ন আসরে সুযোগ পেলেই রসিয়ে রসিয়ে বলেন। সে সময়ের বিভিন্ন সংকটের ভেতর একটি রসসিক্ত মন তিনি অক্ষুণ্ন রেখেছেন, সেই জীবনরসিক মানুষটি হয়ে ওঠা বা আজও তা-ই হয়ে থাকাটি তাঁর নিজের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ে তোলার সমান্তরাল এক কীর্তি বৈকি।

কখনো লাগাম ছেড়ে না দেওয়া বা হাল ছেড়ে না দেওয়ার কাজটি বরাবরই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ করেছেন। তাতে কোথাও দৃঢ়, কোথাও কঠোর, কোথাও নমনীয় হতে হয়েছে এক বিরাট উদ্দেশ্য সাধনের কথা ভেবে—‘মানুষ তাঁর স্বপ্নের সমান বড়’। যখন বলেন, ‘একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় হলো তাঁর স্বপ্ন—কোথায় সে যেতে চায়, তার অভিযাত্রা ও গন্তব্য কী?’ এটাই তাকে অনন্য করে তোলে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ নিজেই এর উদাহরণ। পদে পদে হতাশা, নিরাশা, অন্ধকার তাঁকে ঘিরে ধরেনি, তাও তো নয়। তিনি স্পষ্ট করেই জানতেন, হতাশ হয়ে আমরা কিছু পাব না। হতাশার ভেতর দিয়ে কিছু গড়ে ওঠে না। বেড়ে ওঠে না। বরং হতাশা ও আশার দ্বৈরথেই জীবন এগিয়ে যায়। তেমন করেই এগিয়ে গেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
ফাইল ছবি

এ কথা খুব কম লোকেই এখনো বোধ করতে পারে যে সাহিত্য মানেই আসলে বিশ্বসাহিত্য। কারণ, ভাষা যার যার, সাহিত্য সবার। তাতে একজন হোমার হয়ে ওঠেন আমার নিজের লেখক। ‘মনসামঙ্গল’-এর পাঠ অনেক দেরিতেও হলেও ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তবে তাতেই তার মহত্ত্ব তৈরি হয় না, সেটি বিদ্যমানই ছিল। লালনের টেক্সট পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের কেন্দ্রে। উন্নত বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশের সাহিত্য তো এখনো প্রায় প্রান্তীয়। কিন্তু এই প্রান্ত ও কেন্দ্রে ভেঙে যায় প্রকৃত সাহিত্যের প্রশ্নে। আমাস তুতুওয়ালা কি তায়েব সালেহের মতো লেখকের লেখা বিশ্বসাহিত্যে প্রবলভাবে গণ্য হতে শুরু করে। অনূদিত হচ্ছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক। কেবল তা-ই নয়, ভাষা ও সংস্কৃতির নামে চলা আধিপত্যের বিচিত্র জালচক্র ছিঁড়ে প্রকৃত সাহিত্য তার পথ করে নেয়। ঠিক এমনটাই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ করেছেন বাংলাদেশে সাহিত্য পাঠকদের জন্য। তিনি সব রকমের সীমাবদ্ধতাকে ভেঙে দিয়ে বিশ্বসাহিত্যের দরকারি বইগুলো এনে দিতে চেয়েছেন বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে।

আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখি, সেই ১৯৯৫-৯৬ সালে যখন সবে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের সঙ্গে লগ্ন হয়েছি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র হলেও টের পেতে দেরি হয়নি যে বাংলা সাহিত্য বলি কি সাহিত্য বলি, কোনো পাঠই সম্পন্ন হতে পারে না জগতের বিভিন্ন ভাষায় লেখা সেরা বইগুলোর সঙ্গে যদি যুক্ত না হওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যের প্রকৃত পাঠকের তাই বিশ্বসাহিত্যের পাঠক না হয়ে উপায় নেই। কিন্তু কোথায় মিলবে? হাতে কাছেই পাওয়া যাবে বিশ্বের বাঘা বাঘা লেখকের বই? ঠিক তখন খোঁজ মেলে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গ্রন্থাগারে জীবন্ত হয়ে দেখা দেন¯স্তাঁদাল, বালজাক, তুর্গেনেভ, দস্তয়েভস্কি, তলস্তয় থেকে ইভান বুনিন কি মেলভিল, হেমিংওয়ে, ফকনারের বই। বিস্ময় নিয়ে চোখের সামনে চলে আসে ভি এস নাইপলের একের পর একটি কীর্তি। হাতের কাছে পাওয়া কাফকার অনুবাদ। পেয়ে গোগ্রাসের গেলা। এই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রই। আজকের এই বিরাট দালান নয়, ছিমছাম একতলার পেছনে দোতলার সেই বাড়ি, সামনে চোখজুড়ানো ঘাসের লনের সেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আমাদের স্মৃতিবিলাসী করে। নস্টালজিয়ায় ভোগায়।

কখনো লাগাম ছেড়ে না দেওয়া বা হাল ছেড়ে না দেওয়ার কাজটি বরাবরই তিনি করেছেন। তাতে কোথাও দৃঢ়, কোথাও কঠোর, কোথাও নমনীয় হতে হয়েছে এক বিরাট উদ্দেশ্য সাধনের কথা ভেবে—‘মানুষ তাঁর স্বপ্নের সমান বড়’। যখন বলেন, ‘একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় হলো তাঁর স্বপ্ন—কোথায় সে যেতে চায়, তার অভিযাত্রা ও গন্তব্য কী?’ এটাই তাকে অনন্য করে তোলে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ নিজেই এর উদাহরণ। পদে পদে হতাশা নিরাশা অন্ধকার তাঁকে ঘিরে ধরেনি, তাও তো নয়। তিনি স্পষ্ট করেই জানতেন, হতাশ হয়ে আমরা কিছু পাব না। হতাশার ভেতর দিয়ে কিছু গড়ে ওঠে না। বেড়ে ওঠে না। বরং হতাশা ও আশার দ্বৈরথেই জীবন এগিয়ে যায়। তেমন করেই এগিয়ে গেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
ফাইল ছবি

তখন এমন ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার ছিল না। পাড়া-মহল্লায় বই পৌঁছে দিতে ছুটে যেত না কোনো গাড়ি। বইয়ে কাছেই যেতে হতো পাঠককে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তখন সাহিত্য পাঠকের পাঠমন্দির। বইয়ের হাতে বন্দী পাঠক তখন বইয়ের সারি ধরে ধরে পৌঁছে যায় বিভিন্ন সংস্কার সংকীর্ণতামুক্ত হয়ে আনন্দলোকে। এই আনন্দলোকই তৈরি করতে চেয়েছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষা—মারিয়া মন্তেসেরির কথা তখন আমরা কজনই-বা জানতাম! আর এই আনন্দ মানে আমোদের কারখানা নয়; বরং প্রতি ক্ষেত্রে জীবনের স্বাদকে আস্বাদ করার আনন্দ।

একটি গ্রিক প্রবাদ ছিল, ‘লাইব্রেরি হলো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অস্ত্রাগার।’ তাতে একটু ভয়ের বিষয়ও থাকে বৈকি! কারণ, অস্ত্রাগার তখনই হয়, যখন প্রকৃত সাহিত্যের পাঠ সেখান থেকে পাওয়া যায়। নইলে আমোদ বিলানোর কারবারি হয়ে ওঠা কোনো লাইব্রেরি ঢোঁড়া ছাড়া আর কিছু নয়। তবে হ্যাঁ, লাইব্রেরিতে যেসব রাজগোখ থাকে, তার ফণায় বিষ নয়, অমৃত ভরা। সেই অমৃতের ক্রিয়াও শরীরে বিষের চেয়ে কম নয়। সেই অমৃতের সঞ্চার যারা পাওয়ার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে জীবনের একটা সময় পেয়েছেন। অনেকের জীবনের সেই সময়টা, এই সময়ে এসেও স্মরণীয়।

এই বিমর্ষ সময়ে, নিত্যদিন প্রিয়জনে মৃত্যুসংবাদের ভেতরে ম্রিয়মাণ হয়ে যেতে যেতে কোনো জায়গা থেকে যদি প্রাণের উৎস থাকে, তা সাহিত্যেই, যে সাহিত্য কোনো দেশ-কাল-পাত্রে আঁটানো নয়। সেই সাহিত্য সবার। সেদিক থেকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আসলে সবার। আর এই বৃহৎ প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।