আমাদের একজন নিলয় দাশ ছিলেন

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম
নিলয় দাশ। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা গিটারিস্ট। নতুন প্রজন্মের কাছে এখন তিনি প্রায় বিস্মৃত। কদিন আগে ছিল এই গিটারসাধকের জন্মদিন। এ লেখায় থাকল নিলয় দাশকে নিয়ে এক টুকরো।

তিন দিন আগে চলে গেল সেপ্টেম্বর। ১৯৬১ সালের এই সেপ্টেম্বরের শেষ দিনে জন্মেছিলেন নিলয় দাশ। কে এই নিলয় দাশ? তিনি অবশ্য খুব চর্চিত কেউ নন। অনেকের কাছেই হয়তো নামটি পরিচিত লাগছে না। তাঁদের জন্য প্রথমেই এখানে প্রয়াত লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চুর একটি মন্তব্য তুলে ধরছি, ‘ওর (নিলয় দাশ) মতো করে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আর কেউ গিটার বাজাতে পারে না। হি ইজ দ্য ওয়ান অ্যান্ড অনলি নিউ ক্ল্যাসিক্যাল গিটারিস্ট, গিটার প্লেয়ার। আনফরচুনেটলি বাংলাদেশ ওকে হারিয়েছে বা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ওর অভিমান থেকে ও চলে গেছে।’

নিলয় দাশ প্রয়াত হয়েছেন ২০০৬ সালে। এরপর কেটে গেছে বেশ কিছু বছর। কিন্তু আফসোসের বিষয় এই যে মানুষের মধ্যে এই গিটারসাধককে নিয়ে জানার আগ্রহ কম। নিলয় যে কেবল একজন বড় মাপের গিটারিস্ট ছিলেন, তা কিন্তু নয়; তিনি ছিলেন একাধারে গায়ক, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও একজন জনপ্রিয় গিটার–শিক্ষক। গত শতকের আশির দশকে যাঁরা গিটার শিখেছেন এবং পরবর্তীকালে অনেক বিখ্যাত হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই নিলয় দাশের সরাসরি ছাত্র কিংবা তাঁর সঙ্গে বাজিয়ে শিখেছেন এমন। এর মধ্যে ‘অর্থহীন’-এর সুমন, ‘ওয়ারফেজ’-এর কমল, ‘দলছুট’-এর বাপ্পা মজুমদার, ‘সোলস’-এর পার্থ বড়ুয়া অন্যতম। তাই বলা যায়, এখনকার সময়ের প্রথম সারির ব্যান্ড হিসেবে যাঁদের ধরা হয়, সেসব ব্যান্ডের অনেক গিটারিস্টই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিলয় দাশের হাত ধরে উঠে এসেছেন।

সে সময়ের ঢাকার মিউজিশিয়ানরা প্রতিনিয়ত তাঁদের প্রিয় ‘নিলয়দা’র কাছে আসতেন নতুন কিছু শেখার জন্য। তিনি নাকি কাউকে ফিরিয়ে দিতেন না। শুনেছি, অনেক মিউজিশিয়ানের বিকেলের প্রধান কাজ ছিল নিলয় দাশের বাসায় এসে আড্ডা দেওয়া, গিটার বাজিয়ে গান গাওয়া। নিলয় দাশ তাঁদের হাতে ধরে শেখাতেন কোনটা রক, কোনটা কান্ট্রি, কোনটা জ্যাজ কিংবা ব্লুজ। মূলত বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকের শ্রোতাদের তিনিই প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যাল, নিও ক্ল্যাসিক্যাল, স্প্যানিশ ফ্ল্যামেনকো মিউজিকের সঙ্গে। বিশ্বসংগীতের সব খবরাখবর রাখতেন তিনি। দুর্দান্ত সব অ্যালবামের কালেকশন ছিল তাঁর। হার্ড রক, হেভি মেটাল নিয়েও ছিল তাঁর অনেক ঝোঁক।

গিটার ছিল নিলয় দাশের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন গিটারসাধক। তিনি যতটা না গায়ক হিসেবে আমাদের কাছে সমাদৃত, তার চেয়েও বড় পরিচয় তিনি বাংলাদেশের অন্যতম একজন সেরা গিটারিস্ট। আমাদের গিটারমাস্টার নিলয় দাশ, হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় থেকেও যিনি ডাক্তারকে বলতে পারেন, ‘আমার বাম হাতে স্যালাইন দেবেন না, তাহলে ব্যথা নিয়ে গিটার বাজাতে পারব না।’

নিলয় দাশ ছিলেন প্রধানত নিও ক্ল্যাসিক্যাল গিটারমাস্টার। অনুসরণ করতেন বিখ্যাত গিটারিস্ট রিচি ব্ল্যাকমোর, র‍্যান্ডি রোডসকে। তাঁর শেখানোর বিশেষত্ব ছিল ক্ল্যাসিক ইনফ্লুয়েন্স লিড। তিনি অনায়াসে পিঙ্ক ফ্লয়েড, ডিপ পার্পল, ইগলস, অল স্টুয়ার্ট, ব্রেড, নিল ইয়াং, ক্রসবি স্টিলস অ্যান্ড ন্যাশ, লোবো, ড্যান ফকলারবার্গ, এয়ার সাপ্লাই, জিম করবি, সান্টানা, ডায়ার স্ট্রেইটসের বিখ্যাত সব গান হুবহু নিখুঁতভাবে গিটারে বাজাতে পারতেন। যাঁরা তাঁকে সামনাসামনি গিটার বাজাতে দেখেছেন, তাঁদের কাছে নিলয় দাশ ছিলেন এক বিস্ময়ের নাম। দুর্বোধ্য ফ্ল্যামেনকো পিসও তাঁর কাছে ছিল অত্যন্ত সরল। নিলয় দাশের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এই সময়ের অন্যতম সেরা গিটারিস্ট-গিটার–শিক্ষক ওয়ারফেজের কমল লিখেছিলেন, ‘অসাধারণ রিদম গিটারিস্ট তিনি (নিলয় দাশ)। আমি তাঁর বাজানো অনেক রিদমের তালই ধরতে পারতাম না।’
আশির দশকেও ঢাকার অভিজাত হোটেলগুলোতে গানবাজনার বেশ চল ছিল। নিলয় দাশ হোটেলেও বাজিয়েছেন তখনকার সময়ের অন্য আর সব মিউজিশিয়ানের মতোই। তাঁর হাত ধরে ওয়ারফেজ, রকস্টার্টা, ইন ঢাকা, এসেসসহ অনেক ব্যান্ডই হোটেলে বাজিয়ে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। তিনি জ্যাজ বাজাতেন তাঁর প্রিয় বন্ধু, তখনকার সময়ের অন্যতম প্রতিভাবান মিউজিশিয়ান হ্যাপী আখান্দের সঙ্গে। হ্যাপীর সঙ্গে নিলয় দাশের ছিল অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, বন্ধুর পরামর্শেই হাতে তুলে নিয়েছিলেন গিটার। অল্প বয়সে হ্যাপীর চলে যাওয়া তাঁর ওপর অনেক প্রভাব ফেলেছিল, বন্ধুর বিদায়ে খুব ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। আর তাই বন্ধুকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত তাঁর সেই গিটারস্কুলের নাম দিয়েছিলেন ‘হ্যাপী স্কুল অব মিউজিক’।

নিলয় দাশ গিটার বাজানো শুরু করেন ১৯৮১ সালে। অবশ্য একদম ছোটবেলা থেকেই তিনি গানবাজনার আবহে বড় হয়েছিলেন। কারণ, তাঁর বাবা উপমহাদেশের বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ, নজরুল গবেষক-স্বরলিপিকার সুধীন দাশ এবং মা সংগীতশিল্পী নীলিমা দাশ। প্রথমে তিনি নজরুলসংগীতই গাইতেন। কিন্তু আরেক গিটার জাদুকর নয়ন মুন্সীকে দেখে হাতে তুলে নিয়েছিলেন গিটার। তবে গিটার কেনার পর তিনি অনুভব করছিলেন, যত্নের সঙ্গে তাঁকে কেউ শেখাতে চাইছেন না কিংবা শেখাচ্ছেন না। এমন সময় তাঁর পরিচয় হয় এক কোরিয়ান গিটারবাদকের সঙ্গে, যিনি ক্ল্যাসিক্যাল বাজাতেন। তাঁর কাছ থেকে প্রাথমিক কয়েকটি কর্ড শিখে নিয়েছিলেন তিনি। এভাবেই তাঁর শুরু। যা শিখেছেন সব নিজের চেষ্টায়। তিনি কখনো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কারও কাছে গিটার শেখেননি। প্রথম দিকে তিনি বাখ, মোজার্ট, বেটোফেনের সিম্ফোনি শুনে সেই সব গিটারে তোলার চেষ্টা করতেন, এটাই ছিল তাঁর শিখনপদ্ধতি।

গিটারসহ নিলয় দাশ
ছবি: সংগৃহীত

শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে তাঁর ইন্সট্রুমেন্টাল কনসার্ট ঢাকায় বেশ সুনাম অর্জন করেছিল। শুধু গিটার শুনতে মানুষ সেখানে ভিড় করতেন। শিল্পকলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক ও প্রখ্যাত সুরকার আজাদ রহমান তাঁর কদর বুঝতে পেরে তাঁকে শিল্পকলা একাডেমির গিটার–শিক্ষক হিসেবে কাজের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বাজিয়েছেন গোলাম আলী, মেহেদী হাসানের মতো উপমহাদেশের বিখ্যাত সব শিল্পীর সঙ্গে। এভাবে ধীরে ধীরে তাঁর জনপ্রিয়তা আরও বাড়তে থাকে।

তাঁর গায়কিও ছিল অসাধারণ। ১৯৮৮ সালে নিলয় দাশের প্রথম একক অ্যালবাম ‘কত যে খুঁজেছি তোমায়’ প্রকাশ হয় ‘সারগাম’-এর ব্যানারে। গীতিকার কাউসার আহমেদ চৌধুরী, আহমেদ ইউসুফ সাবের, আসিফ ইকবালের লেখা এবং সুরকার-সংগীত পরিচালক ‘ফিডব্যাক’-এর ফুয়াদ নাসের বাবুর সংগীত আয়োজনে এ অ্যালবামের শিরোনামের গানটি সে সময় তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। প্রেম-ভালোবাসা থেকে শুরু করে, হ্যাপীর বিরহ, হতাশা; সব মিলিয়ে গভীর এক জীবনবোধের প্রকাশ ঘটেছিল গানগুলোতে।

নিলয় দাশ ‘দ্য জেনমস’ ও ‘ট্রিলজি’ নামে দুটি ব্যান্ডে বাজিয়েছেন। এর মধ্যে ট্রিলজি ছিল সে সময়ের ঢাকার গানপাড়ায় জনপ্রিয় নাম। এরপর ১৯৯২ সালে আরেক গুণী সংগীতকার, আর্ক ব্যান্ডের আশিকুজ্জামান টুলুর সংগীত পরিচালনায় বের হয় তাঁর দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘বিবাগী রাত’। নিলয়ের গান মানেই নান্দনিক সব গিটারওয়ার্ক। তাঁর বৈচিত্র্যময় গিটার শুনলে যে কারও কানে সেটা ভালো লাগতে বাধ্য। এ অ্যালবামের পর তিনি বা তাঁর ব্যান্ড এককভাবে আর কোনো অ্যালবাম বের করেনি। তবে বিভিন্ন মিক্সড অ্যালবামে গান করেছেন নিলয়। বাংলাদেশের প্রথম ও জনপ্রিয় ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম ‘স্টারস ১’-এ আশিকুজ্জামান টুলুর সুরে ‘অবহেলা’ শিরোনামে একটি গান করেন। এ ছাড়া তাঁর গাওয়া মিক্সড অ্যালবামের মধ্যে ‘স্টারস-২’, ‘দেখা হবে বন্ধু’, ‘টুগেদার’, ‘তুমিহীনা সারাবেলা’, ‘কেউ সুখী নয়’ অন্যতম।

নিলয় দাশের অ্যালবাম
ছবি: সংগৃহীত

এমনিতে নিলয় দাশ খুব বেছে বেছে গান করতে পছন্দ করতেন। গায়ক হিসেবে তিনি খুব বেশি গান রেখে যাননি। শুধু সংখ্যার দিক দিয়ে বিচার না করে তাঁর গানগুলো শুনলেই বোঝা যায়, সেগুলো কত যত্ন নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে পরবর্তী এক যুগ তিনি তেমনভাবে গুছিয়ে গান প্রকাশের কাজ শুরু করতে পারেননি। শুরু করলেও সেগুলো শেষমেশ আলোর মুখ দেখেনি বিভিন্ন কারণে। অনেক অভিমান নিয়ে চলে গেছেন তিনি। নিলয় ব্যক্তিজীবনে ছিলেন প্রচারবিমুখ মানুষ, পছন্দ করতেন অত্যন্ত নিভৃতচারী জীবনযাপন। তাই মিডিয়াতে তাঁকে ঘিরে কোনো হইচই দেখা যায়নি কখনো। ফলে একভাবে আমরা হারাতে বসেছি নিলয় দাশকে।

গিটার ছিল নিলয় দাশের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন গিটারসাধক। তিনি যতটা না গায়ক হিসেবে আমাদের কাছে সমাদৃত, তার চেয়েও বড় পরিচয় তিনি বাংলাদেশের অন্যতম একজন সেরা গিটারিস্ট। আমাদের গিটারমাস্টার নিলয় দাশ, হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় থেকেও যিনি ডাক্তারকে বলতে পারেন, ‘আমার বাম হাতে স্যালাইন দেবেন না, তাহলে ব্যথা নিয়ে গিটার বাজাতে পারব না।’

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]