আমাদের সময়ের জাহাঙ্গীরনগর

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী আজ। গেল নব্বই দশক থেকে আমাদের শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনে এই বিদ্যায়তনের শিক্ষার্থীদের রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। জাহাঙ্গীরনগরের বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈসর্গিক জগৎটি কেমন ছিল, প্রতিষ্ঠার ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে জানা যাক সেই কাহিনি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার অবলম্বনেকোলাজ: মনিরুল ইসলাম

একটা সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ঢাকা থেকে দূরে প্রায় দুর্গম অঞ্চলে বনজঙ্গলঘেরা শ্বাপদসংকুল এক বিদ্যাপীঠ। ছাত্রদের জন্য এক প্রান্তে আল বেরুনি, আরেক প্রান্তে মীর মশাররফ হোসেন হল। ছাত্রীদের জন্য ফজিলাতুন্নেছা আর ফয়জুন্নেসা হল। মাঝখানে অনেক দূরে দূরে অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবন। ঘন জঙ্গলের মধ্যে লেক আর উঁচু-নিচু চালা-বাইদের ভূমিরূপ। দিনের বেলাতেও গোধিকা, শিয়ালের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। রাতে পথ চলতে হঠাৎ হঠাৎ সরীসৃপের দেখা না মেলা একটু অস্বাভাবিক ছিল।

স্বাধীনতার পর এই দুর্গম বিশ্ববিদ্যালয় আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল বলে প্রচার আছে। হুলিয়া মাথায় নিয়ে অনেকে আত্মগোপনের জন্য জাহাঙ্গীরনগরকে বেছে নিতেন। জাহাঙ্গীরনগরের সে সময়ের ভূগোলের সঙ্গে পরিচয় থাকলে এসব খবরকে অবিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। সে সময় নির্জনতায় শিক্ষার্থীরা ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। অনেকেই নেশাগ্রস্ত হতেন এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যেত। কালক্রমে অসহনীয় নির্জন দূর হয়ে একটা উপভোগ্য নির্জনতা তৈরি হয়েছে, শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ সুলভ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে জনপদগুলোতে লোকসংখ্যা বেড়েছে।

নব্বইয়ের দশকজুড়ে জাহাঙ্গীরনগর উপভোগ্য নির্জনতার আদলে সেজে উঠেছিল। এখনকার বিশ্ববিদ্যালয় দেখলে অসহনীয় নির্জনতা বা উপভোগ্য নির্জনতার সময়টাকে বোঝা যাবে না। এখন বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিণত হয়েছে বিল্ডিংয়ের বস্তিতে। স্থানে স্থানে অপরিকল্পিত ভবন। প্রকৃতি বলতে তেমন কিছু আর অবশিষ্ট নেই, জঙ্গল তো দূরের কথা। লেকের জলের প্রকৃতিও হারিয়ে গেছে। জাহাঙ্গীরনগর এখন পিকনিক পার্টিতে ভরপুর এক ট্যুরিস্ট জোন, কখনো কখনো জমজমাট শুটিং জোন। মানুষের কাকলিতে মুখর।

আমাদের মতো ক্লাসে অমনোযোগী শিক্ষার্থীরা মাল্টিডিসিপ্লিনারি শিক্ষা পেয়েছি এই উদার শিক্ষকদের কারণে। কখনো কখনো এই শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মারফত ভায়া হয়ে আমাদের কাছে পৌঁছাত। কবি মোহাম্মদ রফিকের রুমে বসে আমরা যেমন পূর্ব ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার কবিতার বিস্তর তথ্য ও বিশ্লেষণ পেতাম। তেমনি সেলিম আল দীনের কাছে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটা পাঠ মুফতে পেয়ে যেতাম। এভাবে কখনো চেনা হয়ে যেত নৃবিজ্ঞানের পাঠ্যসূচি। কখনো অর্থনীতির পাঠ। শিক্ষকদের মধ্যে বিভাগের বাইরে অনুরক্ত আড্ডার সহযোগী জোগাড় করার একটা প্রতিযোগিতাও চলত।

আমাদের সময়ও জাহাঙ্গীরনগর ছিল শান্ত ও নির্জন। দিনের খুব ব্যস্ত সময়েও একেবারে জনমানবহীন এলাকা পাওয়া যেত। যেকোনো দিকে তাকালে দিগন্তরেখায় দৃষ্টি হারিয়ে যেত। বসন্তের দুপুরে ধুলা ওড়া পাতাঝরার দিনে ট্রান্সপোর্টের মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে মনে হতো কোথাও যেন কেউ নেই। গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় চৌরঙ্গীতে দাঁড়িয়ে মনে হতো এই উষ্ণতার ভাগ নেওয়ার কেউ নেই। একটানা বিরামহীন বর্ষণের মধ্যে যে নির্জন একাকিত্বের দেখা পাওয়া যেত, তা পাড়াগাঁয়েও মেলা ভার। শীতে সহস্র পাখির কাকলিতে মুখর লেকগুলোকে মনে হতো অভয়ারণ্য। এমন শান্ত, নিরিবিলি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা আমাদের হৃদয়ের গভীরে যে মগ্নতার বীজ বুনে দিয়েছে, তা কি আমরা অন্য কোথাও আর কোনোভাবে পেতে পারতাম?

রাজধানী শহর থেকে খুব দূরে নয়, হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। আবার ঘরে ফিরলেই এ রকম এক গহনতার ডাক এমন এক মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে কেটেছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়জীবন। যার যার ব্যক্তিত্ব অনুসারে বেড়ে ওঠার সুযোগ যেন অবারিত। আর বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনের আশপাশে তৎপরতা চালাবার সুযোগ নেই। তাই নিজেদের মধ্যে নিজেদের চেনাশোনার এক অপূর্ব সুযোগ আমরা পেয়েছি। সীমিতসংখ্যক শিক্ষার্থীরা যেন সবাই সবাইকে চেনে। একেবারে সবার পরিচয় সবার জানা না থাকলেও প্রায় সবাই সবার মুখচেনা। সর্বত্র একটা আত্মীয়তার আভাস পাওয়া যেত। এর প্রধান কারণ বোধ হয় ওই প্রকৃতিই। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর যখন কোনো প্রাক্তন শিক্ষার্থীর সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাদের মধ্যে ওই আত্মীয়তার রেশটা খেয়াল করেছি। প্রত্যেকেই যেন প্রত্যেককে রিলেট করতে পারছে। কোথায় সেই সংযোগসূত্রটা?

আমার মনে হয়, জাহাঙ্গীরনগরের বিশেষায়িত স্পেসে বা স্থানে, এর প্রকৃতিতে। এই স্পেসটাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটা সম্প্রদায়ে পরিণত করে দেয়। শিক্ষকদের বেলাতেও একই কথা। অনেক শিক্ষক এ বিশ্ববিদ্যালয়েও হয়তো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মেশেন না। কিন্তু অনেকেই মেশেন। যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক, তাঁরা কোনো না কোনোভাবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সময় কাটান। আর এই মেলামেশাটা অনেকের বেলায় শুধু বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। আমরা বলি, আমাদের মতো ক্লাসে অমনোযোগী শিক্ষার্থীরা মাল্টিডিসিপ্লিনারি শিক্ষা পেয়েছি এই উদার শিক্ষকদের কারণে। কখনো কখনো এই শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মারফত ভায়া হয়ে আমাদের কাছে পৌঁছাত। কবি মোহাম্মদ রফিকের রুমে বসে আমরা যেমন পূর্ব ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার কবিতার বিস্তর তথ্য ও বিশ্লেষণ পেতাম, তেমনি সেলিম আল দীনের কাছে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটা পাঠ মুফতে পেয়ে যেতাম। এভাবে কখনো চেনা হয়ে যেত নৃবিজ্ঞানের পাঠ্যসূচি। কখনো অর্থনীতির পাঠ। শিক্ষকদের মধ্যে বিভাগের বাইরে অনুরক্ত আড্ডার সহযোগী জোগাড় করার একটা প্রতিযোগিতাও চলত।

একসময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো দিকে তাকালে দিগন্তরেখায় দৃষ্টি হারিয়ে যেত
ছবি: সংগৃহীত

এসবের বাইরে ছিল আন্দোলন ও প্রতিবাদের আরেক স্কুলিং। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে বাইরে আসার পর সবচেয়ে বিস্ময় জেগেছিল যখন দেখেছিলাম, আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের বিরোধিতাকারী ক্ষমতাসীন দলের কর্মীটিও আন্দোলনকে গর্বের সঙ্গে ধারণ করছে। আমরা বলি, নব্বই দশক ছিল জাহাঙ্গীরনগরের এক রেনেসাঁ। এ সময় শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলনগুলো করেছেন, তা বাংলাদেশের ইতিহাসেই পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে। নব্বইয়ের শুরুতে ছাত্রীদের হলে প্রবেশে সান্ধ্য আইনবিরোধী আন্দোলন থেকে নব্বইয়ের শেষে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন—সবই এ দেশে নতুন অভিজ্ঞতা ছিল। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সব সময় একটা তৎপরতা জাহাঙ্গীরনগরে ছিল। শিক্ষার্থীদের অধিকারের প্রশ্নে একটা সোচ্চার তৎপরতা পুরো বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে আমাদের একটা অদ্ভুত শক্তি জোগাত। আমাদের পুরো শিক্ষাজীবনে আমরা কখনো ক্ষমতাসীন কোনো ছাত্র সংগঠনের দাপটের সামনে মাথা নিচু করে চলিনি, কোনো অন্যায়কে প্রতিবাদহীনভাবে যেতে দিইনি। এটা আমাদের জীবনের বড় অর্জন হয়ে আছে।

আমরা বলি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শান্ত নির্জনতা, প্রকৃতি, আত্মীয়তা আর প্রতিবাদের ককটেল হয়ে আছে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে সাহিত্যচর্চা বিশেষ আরেক অভিজ্ঞতা হয়ে আছে। গত শতকের নব্বই দশকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যত সাহিত্যিক আত্মপ্রকাশ করেছেন তা আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ঘটেনি। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ও দ্বিতীয় দশকের অনেক কবি-সাহিত্যিকের আত্মপ্রকাশও এই বিদ্যাপীঠ থেকে। নতুন কোনো আবর্তনের ক্লাস শুরু হলে আগের ব্যাচের সাহিত্যিকেরা প্রথমেই নবীনবরণের মতো করে তাদের খুঁজে বের করে রীতিমতো আড্ডায় ভেড়াতেন। সাহিত্যিকদের যোগাযোগটা একেবারে প্রথম ব্যাচ থেকে শেষ ব্যাচ পর্যন্ত ছিল। যোগাযোগের সূত্রটা গেঁথে দিয়েছিলেন মোহাম্মদ রফিক ও সেলিম আল দীন। সে রেওয়াজটা এখনো আছে। জাহাঙ্গীরনগরে নতুন কোনো শিক্ষার্থী কবিতা বা গল্প লেখা শুরু করলে তার সঙ্গে আগের ব্যাচের কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়ে যায়। যোগাযোগটা শিক্ষকেরা যেমন তৈরি করে দেন, তেমনি শিক্ষার্থীরাও এগিয়ে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সাহিত্যিক আড্ডাগুলোর সবচেয়ে বড় প্রাণ পারস্পরিক ভাগাভাগি বা শেয়ারিং। কী পড়তে হবে, কী জানতে হবে, সেটা যখন আড্ডার মাধ্যমে এক ব্যাচ থেকে আরেক ব্যাচে সঞ্চারিত হয়, তখন সেটা হয়ে ওঠে একটা ‘ক্রিয়েটিভ রাইটিং কোর্স’।

কখনো কখনো আমরা দিনের পর দিন নাওয়া-খাওয়া ভুলে আড্ডা দিয়েছি। যৌথভাবে পাঠ করেছি বইয়ের পর বই। সাহিত্যিক শিক্ষকদের বাসায়, রুমে বন্ধুর মতো গিয়েছি। আবার নিয়মিত আড্ডায় রাজনীতিতে নিমগ্ন শিক্ষার্থীর সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীর কথার মধ্যে ঔপন্যাসিকের কথা মিশে যেতে দেখেছি। নাটকের মহড়া শেষে ক্লান্ত মেয়েটি নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলেছে যেমন, তেমনি নৃবিজ্ঞানের সেমিনার শেষে কয়েকজন মিলে কবিদের বর্ণনা করেছে আলোচনার আদ্যোপান্ত। এ রকম এক যৌথচর্চার ভেতর দিয়ে কেটেছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়জীবন। আমরা বলি, আমরা জীবনে যা শিখেছি, ক্লাসরুমের বাইরেই শিখেছি। তাই বলে, ক্লাসরুমের ভেতরে যারা শিখেছে, তাদের ছোট করছি না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তো সেই বিদ্যাপীঠ, যেখানে বারান্দায় ঘুরে ঘুরেও মূল্যবান পাঠ নেওয়া যায়। আর ক্লাসরুমে যেতে পারলে তো কেল্লাফতে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছর হলো। এর মধ্যে মাত্র ছয়টি বছর আমাদের। তারপর অঙ্গনটা অন্যদের হয়ে গেছে। কিন্তু এই অন্যরাও যেন আমরা। পুরোটা সময় যেন আমাদের সময়ে থমকে আছে। এর পেছনে হয়তো ওই বিশেষ স্পেসটা। হয়তো এমনটা সবার ক্ষেত্রে হয়। সব বিদ্যাপীঠে সব শিক্ষার্থীর বেলায়। আলমা মাতার (গ্রিক শব্দ ‘আলমা মাতার’ অর্থ পরিচর্যাকারী মা) বলে যে কথাটা বলা হয় সেটা হয়তো এটাই। এই অনুভূতিটাই।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]