আমার জানালা থেকে নতুন বিশ্ব

কোলাজ: আমিনুল ইসলাম
পোল্যান্ডের বাসিন্দা, লেখক ও বুদ্ধিজীবী ওলগা তোকারচুক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ২০১৮ সালে। মহামারিকালে কোয়ারেন্টিনে থেকে তিনি লিখেছিলেন এ লেখাটি। ছোট্ট এ লেখায় উঠে এসেছে এ সময় ও মহামারি–পরবর্তী নতুন বিশ্বের অবস্থা নিয়ে তাঁর ভাবনাচিন্তা। এ লেখা পাঠককে বৈশ্বিক অবস্থা নিয়ে চিন্তার খোরাক জোগাবে। ‘দ্য নিউইয়ার্কার’ থেকে অনুবাদ করেছেন সালেহ ফুয়াদ

আমার জানালা থেকে একটি সাদা মালবেরি দেখা যায়। মালবেরির প্রতি রয়েছে আমার অসীম মুগ্ধতা। বর্তমানে যে জায়গাটায় থাকছি বলতে গেলে তা এ গাছটির জন্যই। মালবেরি একটি উদার বৃক্ষ। পুরো বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে কয়েক ডজন পক্ষী–পরিবারকে সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর ফল বিলিয়ে যায়। এ গাছটি এখনো তার নতুন পাতা ফিরে পায়নি। ফলে সহজেই ডালের ফাঁক দিয়ে পার্কে যাওয়ার সুনসান পথটি দেখতে পাই। পার্কের দিকে হাঁটা এক-আধজন মানুষকে কখনো কখনো পথটি ব্যবহার করতে দেখা যায়। রোসলোতে আবহাওয়া এখন প্রায় গ্রীষ্মের মতো। চোখধাঁধানো সূর্য, নীল আকাশ, পরিষ্কার বাতাস। আমার কুকুরের সঙ্গে আজ হাঁটতে গিয়ে দেখলাম দুটি ম্যাগপাই একটি প্যাঁচাকে তাড়া করছে। মাত্র ২ ফুট দূর থেকে প্যাঁচাটির সঙ্গে আমার চোখাচোখি হলো। মনে হলো, প্রাণীরাও ভীষণভাবে অপেক্ষা করছে। ভাবছে—কী হয় সামনে!

দীর্ঘদিন ধরে আমি ভেবে এসেছি, বিশ্বটা অনেক বড়। বিশ্বটা বিরাট, তীব্র গতিময়, অনেক উচ্চকিত। তাই কোনোরকম ‘আইসোলেশন ট্রমা’র সঙ্গে আমি পরিচিত নই। মানুষকে না দেখে থাকাটা আমার জন্য মোটেও কঠিন কিছু না। সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমি দুঃখিত নই। শপিং সেন্টারগুলো যে বন্ধ হয়ে গেছে, এতে আমার কিচ্ছু যায়-আসে না। হ্যাঁ, চাকরি হারানো মানুষের কথা চিন্তা করে আমি অবশ্যই উদ্বিগ্ন। তবে ‘কোয়ারেন্টিনের’ কথা ভেবে স্বস্তির মতো কিছু একটা অনুভব করলাম যেন। আমি জানি, বহু লোকের এই অনুভূতি হয়েছে। অবশ্য এই অনুভূতির কারণে তারা কিছুটা লজ্জিতও। বহির্মুখী কাজে অতিরিক্ত সক্রিয়তা ও অপব্যবহারে আমার যে অন্তর্মুখী স্বভাবটা দীর্ঘদিনের রুদ্ধকর অবস্থায় আটকা পড়ে ছিল, তা এখন গা–ঝাড়া দিয়ে বেরিয়ে এসেছে।

জানালায় বসে প্রতিবেশীদের দেখি। আমার কাজপাগল প্রতিবেশী আইনজীবী ভদ্রলোককে কদিন আগেও দেখতাম আদালতের পোশাক কাঁধে চাপিয়ে সকালবেলা কাজে বের হয়ে যাচ্ছেন। এখন দেখি থলের মতো ঢিলা ট্র্যাকস্যুট পরে উঠোন–বাগানে নানা কাজ করছেন। যেন প্রতিটা বস্তুকে যথাস্থানে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

কয়েকজন যুবককে দেখি বিগত শীত থেকে আর সেভাবে হাঁটতে না–পারা একটি কুকুরকে নিয়ে বের হয়েছে। অত্যন্ত ধীরগতিতে হাঁটে ওরা। কুকুরটি তবু তাল সামলাতে না পেরে বারবার পড়ে যায়। বেশ শব্দ করে ময়লার গাড়িটা আবর্জনা তুলছে।

জীবন চলতে থাকে। সম্পূর্ণ এক ভিন্ন ছন্দে। আমার ব্যক্তিগত ছোট ঘরটা গোছাই। পড়া হয়ে গেছে এমন খবরের কাগজগুলো বাছাই করে ঝুঁড়িতে ফেলি। ফুলদানি বদলে নতুন টবে ফুল গুঁজে দিই। মেরামতের জন্য দেওয়া বাইসাইকেলটা দোকান থেকে নিয়ে আসি। রান্নাবান্নাটা উপভোগ করছি।

শৈশবের টুকরো টুকরো ছবি ফিরে ফিরে আসতে থাকে। তখন সময় ছিল অফুরন্ত। তা ‘নষ্ট’ বা ‘হত্যা’ করা সম্ভব ছিল। শুধু জানালায় বসে বাইরে তাকিয়ে, পিঁপড়ের চলাচল পর্যবেক্ষণ করে করে, টেবিলের নিচে শুয়ে শুয়ে সেটিকে নুহের জাহাজ কল্পনা করতে করতে অথবা এনসাইক্লোপিডিয়া পড়তে পড়তে কত সময় কাটিয়ে দেওয়া যেত!
এমন নয়তো যে, আমরা জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এসেছি? জীবাণু স্বাভাবিক অবস্থার বিঘ্নকারী নয়, বরং উল্টো—জীবাণুটি আসার আগের অস্থির পৃথিবীটাই ছিল অস্বাভাবিক?

আমরা কিছু বিষয় ভয়ানকভাবে অগ্রাহ্য করছিলাম এত দিন। এ জীবাণুটি আমাদের অন্তত তেমন কয়েকটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। আমরা এক দুর্বল সৃষ্টি। সবচেয়ে ভঙ্গুর উপাদানে গঠিত। ভুলে গিয়েছিলাম—আমরা মারা যাই, আমরা মরণশীল। মানতে চাইছিলাম না—আমাদের ‘মনুষ্যধর্মের’ কারণে আমরা বাকি সৃষ্টিজগৎ থেকে ভিন্ন কিছু নই। কোনো বিশেষত্বের কারণেই আমরা আলাদা কিছু না। বিশ্বটা একধরনের বৃহৎ অন্তর্জালের মতো। যে জালে আমরা সবাই পরস্পরে সংযুক্ত। জগতের অন্যান্য সত্তার সঙ্গে নির্ভরতা ও প্রভাবের এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। কতটা দূর দেশ থেকে আমাদের আগমন বা কোন ভাষায় আমরা কথা বলি, আমাদের গায়ের রং কী—এই সবকিছু বিবেচ্য হওয়া ছাড়াই আমরা একই রোগে কাতর হয়ে পড়ি, একই ধরনের ভয় ভাগাভাগি করি; হই একই মৃত্যুর শিকার।

অন্যরা যখন নিজেদের সব হারিয়ে নিঃস্ব হবে তখন কেউ কেউ মহামারি থেকে করবে বিপুল অর্থ উৎপাদন। আমাদের যে নীতি–আদর্শকে খুব দৃঢ় মনে হতো এ সংকট সেগুলোকে ধ্বংস করে দেবে। বহু দেশ এ ধাক্কা সামলে উঠতে পারবে না। নতুন ক্ষমতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। প্রতিটি সংকটের পর যেমনটি ঘটে।

মহামারি আমাদের এ উপলব্ধি দিয়েছে, দুঃসময়ে আমরা কতটা দুর্বল বা অরক্ষিত তা বিবেচ্য নয়; বরং আমরা আরও বেশি দুর্বল ও অসহায়দের দ্বারা ঘেরা, আমাদের সাহায্য তাদের জন্য খুব প্রয়োজন। এ মারি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, আমাদের বয়স্ক মা–বাবা ও দাদা–দাদিরা কতটা দুর্বল, আমাদের শুশ্রূষা তাঁদের জন্য কতটা প্রয়োজনীয়। এ মহামারি দেখিয়েছে, আমাদের অযাচিত আন্দোলন বিশ্বকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে। সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। এ আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়া আমাদের জন্য বিরল। প্রশ্নটি হলো, আমরা আসলে কিসের সন্ধানে ছুটি?

অসুখের ভয় স্মরণ করিয়ে দিয়েছে আমাদের সেই ছোট্ট নীড়ের কথা। যেখানে আমরা বেড়ে উঠি। নিজেদের নিরাপদ ভাবি। বর্তমান অবস্থায় অবিশ্রান্ত পরিব্রাজকও এমন আশ্রয়ের সন্ধানে ছোটে। এ সময় আমাদের সামনে একটি দুঃখজনক সত্য উন্মোচিত হয়েছে—এমন ঘনঘোর দুর্দিনেও আমাদের চিন্তা জাতি ও সীমান্তের সীমাবদ্ধতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এই কঠিন সময়ে আমরা দেখেছি, ইউরোপীয় সংহতির ধারণা কতটা দুর্বল। জাতি–রাষ্ট্রগুলোতে সংকটকালীন সিদ্ধান্ত পাঠিয়ে ইউরোপ ম্যাচ হেরেছে। অন্ধ স্বাদেশিকতা আবার ফিরে এসেছে। ফিরে এসেছে ‘আমরা’ এবং বহিরাগত ‘বিদেশি’–এর মাঝের বিভাজন। অন্য অর্থে বললে, বিগত দশকগুলোয় আদতে আমরা এই বিভাজনের বিরুদ্ধেই লড়ে এসেছি। এ আশায় লড়েছি যে কোনো দিন এসব চিন্তা আর আমাদের মনের মধ্যে ফিরে আসবে না। জীবাণুর ভয় আমাদের অপরাধী সাব্যস্ত করার সেই পুরোনো ধারণায় নিয়ে গেছে। এই মহামারির পেছনে অপবাদ পাওয়ার জন্য অবধারিতভাবে থাকবে বিদেশিরা। বিদেশিরা হুমকিস্বরূপ। ইউরোপে ভাইরাসটি এসেছে ‘অন্য কোথাও’ থেকে। পোল্যান্ডে বিদেশফেরত সবাইকে ‘সন্দেহজনক’ মনে করা হচ্ছে। জীবাণু আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, সীমানার অস্তিত্ব আছে এবং তা দারুণভাবে কাজ করছে।

ওলগা তোকারচুক

আমার আশঙ্কা, জীবাণু আমাদের আরও একটি পুরোনো সত্য সম্পর্কে সতর্ক করে তুলবে—আমরা ঠিক কতটা সমান নই। নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখতে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ যখন ব্যক্তিগত বিমান নিয়ে দ্বীপে বা বনভূমিতে উড়াল দেবে, তখন অন্যরা অবস্থান করবে শহরে; তারা বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা ও পানি সরবরাহের কাজ করে যাবে। দোকানপাট ও হাসপাতালগুলোতে কাজ করে নিজেদের ঝুঁকিতে ফেলবে। অন্যরা যখন নিজেদের সব হারিয়ে নিঃস্ব হবে, তখন কেউ কেউ মহামারি থেকে করবে বিপুল অর্থ উৎপাদন। আমাদের যে নীতি–আদর্শকে খুব দৃঢ় মনে হতো এ সংকট সেগুলোকে ধ্বংস করে দেবে। বহু দেশ এ ধাক্কা সামলে উঠতে পারবে না। নতুন ক্ষমতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। প্রতিটি সংকটের পর যেমনটি ঘটে।

আমরা মনে করছি, আমরা ঘরে অবস্থান করছি, বই পড়ছি, টেলিভিশন দেখছি। কিন্তু আসলে আমরা এক নতুন বাস্তবতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছি প্রতিনিয়ত। এ নতুন বাস্তবতা এমন যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। ধীরে ধীরে বুঝে আসছে কিছুই আর আগের মতো হবে না।

বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন ও পরিবারবেষ্টিত হয়ে থাকার শর্ত আমাদের এমন সব ব্যাপারে বেকায়দায় ফেলতে পারে, আমরা যা মানতে প্রস্তুত নই। পরিবারে গুরুত্বহীন হতে চাইনি আমরা। আমাদের দাম্পত্য সম্পর্ক দুর্বল হয় পড়ছে। কোয়ারেন্টিনের কারণে আমাদের সন্তানেরা অন্তর্জালে আসক্ত হয় পড়ছে। অবস্থান ও আলস্যের ক্রিয়ায় যান্ত্রিকভাবে লোকদেখানো মেতে থাকার অর্থহীনতা অনেকে উপলব্ধি করতে পারছেন। এসবের সঙ্গে খুন, আত্মহত্যা এবং মানসিক ব্যাধির সংখ্যা যদি বেড়ে যায়, কী হবে তখন?

দুই শ বছর ধরে আমরা যে সভ্যতা থেকে আকার পেয়েছি আমাদের চোখের সামনে সেই আদর্শ পুড়ে গিয়ে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা সৃষ্টির কর্তা, আমরা যা ইচ্ছা করতে পারি, জগৎটা আমাদের হাতের মুঠোয়—এ বিশ্বাস ভেঙে পড়বে। একটি নতুন সময় ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে।

অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]